#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১৮
ঘন্টা দেড়েক পর হোটেলে চেক ইন করলো সবাই, আরিশ আগেই হোটেলে রুম বুক করে রেখেছিলো। রাতটা এখানে কাটিয়ে কাল সকালে সুহানা জয় বিয়ে করবে। তিনটা রুম বুক করা হয়েছে, প্রথমটায় জয় – অয়ন থাকবে। দ্বিতীয় রুমে আরিশ মেঘ ও তৃতীয়টায় সুহানা ও তিশা। সবাই বেশ ক্লাস, তাই হোটেলে ঢুকেই যে যার মতো রুমে চলে গেলো রেস্ট নিতে। আরিশ ফ্রেশ হওয়ার জন্যে ব্যাগ থেকে টি শার্ট বের করতে গিয়ে এক নজর দেখে নিলো যে মেঘ ওর কি কি ড্রেস প্যাক করেছে। মেঘ মোটামুটি ওর পছন্দমত ব্যাগ গোছাতে সক্ষম হয়েছে দেখে আরিশের বেশ গর্ব হলো!
‘ ভালোই তো প্যাকিং করেছো দেখছি, ভেবেছিলাম আমার পছন্দমতো ড্রেস প্যাক করতে পারবে না ‘
‘ এতদিন ধরে দেখছি তুমি বাড়ি ও বাইরে কেমন ড্রেসআপ করো, এইটুকু ধারণা থেকেও যদি প্যাকিং না করতে পারি তাহলে আর একসঙ্গে থাকার মানে কি হলো?’
‘ দ্যাটস ট্রু! তোমার ডেডিকেশন আছে বলতে হবে। ওয়াইফ হিসেবে নিজের কর্তব্য পালনে আমার তরফ থেকে ৯০% মার্কস দিলাম তোমায় ‘
‘ আচ্ছা? তাহলে আমিও তোমাকে হাসবেন্ড হিসেবে মার্কস দেই?’
‘ ইটস ওকে, তোমাকে আর কষ্ট করে মার্কস দিতে হবে না। কারণ আমি জানি আমি ফুল মার্কস পাবো ‘
তাজ্জব বনে গেলো মেঘ, নিজের ব্যাপারে ছেলেটা কখনো কাউকে ছাড় দেয় না। জোর করে হলেও নিজেকে সেরা প্রমাণ করেই ছাড়বে। মেঘ বুক বাঁকিয়ে বললো…
‘ ইশ! তোমার মতো সেলফ অবসেসিভ ছেলে আমি দুটো দেখিনি, কে বললো যে আমি তোমায় ফুল মার্কস দেবো?’
‘ তাহলে কতো দেওয়ার প্ল্যান করছিলে?’
‘ উম্ম! এতদিনের পুরো হিসেব করলে তুমি ৫০% ও পাবেনা ‘
‘ কি? মাত্র ৫০%?’
‘ এতো অবাক কেনো হচ্ছো? ভালোভাবে মনে করে দেখো, হাসবেন্ড হিসেবে তুমি একটা দায়িত্বও ঠিকঠাক পালন করোনি। আর যেটুকুও বা করেছো সেটা তোমার আব্বুর চাপে পড়ে ‘
মেঘ মুখ গোমড়া করে নিলো, আরিশের মনে পড়লো সত্যিই তো। বিয়ের পর থেকে মেঘের সঙ্গে ভালোভাবে কথাও বলতো না ও, মেয়েটার মনে নিশ্চয়ই এখনও অনেক অভিমান জমে আছে। যদিও মেঘ কিছু প্রকাশ করেনা তবে আরিশ এখন একটু একটু করে ওকে বোঝার চেষ্টা করছে। পুরোনো কথা টানতে গিয়ে মেয়েটার মুড অফ হয়ে গেছে আরিশ ওকে কাছে টেনে নিয়ে বললো…
‘ ইয়াহ! ঠিকই বলেছো তুমি। আমারই দোষ ছিলো। হাসবেন্ড হিসেবে অনেক দায়িত্বই পালন করিনি আমি ‘
মেঘ অবাক হলো, ছেলেটা এতো সহজে দোষ স্বীকার করছে? মেঘের অবাক চাহনি দেখে মজাই লাগলো আরিশের…
‘ অবশ্য, একটা ব্যাপারে আমরা দুজনেই দোষী ‘
‘ কোন ব্যাপার?’
‘হাসবেন্ড ওয়াইফ হিসেবে আমরা আসল দায়িত্বটাই পালন করিনি। এটা তো ভীষণ অন্যায় হয়ে গেছে ‘
ভ্রু কুঁচকে নিলো মেঘ…
‘ আমি? আমি আবার কোন দায়িত্ব পালন করলাম না?’
ভাবনায় পড়ে গেলো মেঘ, কোন দায়িত্বের কথা বলছে আরিশ? অনেক ভেবেও যখন ওর মাথায় কিছু আসছেনা, সেই মুহূর্তে মেঘের কানের পাশ থেকে চুল সরিয়ে ফিসফিসিয়ে আরিশ বলে উঠলো…
‘ শুধু তুমি না, আমরা দুজন! আমাদের দুজনকে মিলেই পালন করতে হবে ‘
এবার মেঘ বেশ বুঝলো আরিশ কোন দায়িত্বের কথা বলছে, সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার ছোটো ছোটো চোখ দুটো বিশালাকৃতি ধারণ করলো! মেঘ দ্রুত নিজেকে আরিশের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো…
‘ আ..আমি সুহানার সঙ্গে গিয়ে দেখা করে আসি, দেখি মেয়েটা কি করছে। তুমি যাও তো, ফ্রেশ হয়ে এসো ‘
দ্রুত পায়ে এক প্রকার পালিয়েই গেলো মেয়েটা, আরিশ মেঘের কান্ড দেখে হাসলো। মেয়েটা ইদানিং একটু বেশিই লজ্জা পেতে শুরু করেছে। আরিশ একগাল হেসে মনে মনে বললো…
‘ কতোদিন পালিয়ে বেড়াবেন ম্যাডাম, শেষে আমার কাছে এসেই ধরা দিতে হবে আপনাকে ‘
______________________________________
মেঘ সুহানার রুমে গিয়ে দেখলো মেয়েটা মন খারাপ করে বসে আছে, মেঘ ওর পাশে এসে বসলো…
‘ কি ব্যাপার, সুহানা কি হয়েছে?’
‘ আই অ্যাম ফিলিং স্কেয়ার্ড ‘
একজন মেয়ে হিসেবে এই মুহূর্তে সুহানার মন খারাপের কারণ অনুভব করতে পারছে মেঘ, একটা মেয়ে ভালোবাসার মানুষের জন্যে সব ছেড়ে এসেছে। তাদের অনুপস্থিতিতে বিয়ে করবে, এসব ভেবে মেঘেরই খারাপ লাগছে সেখানে সুহানার আরো বেশি মন খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক!
‘ আমি জানিনা কাজটা ঠিক করছি না ভুল, আই রিয়েলি ডোন্ট নো। এমন একটা স্টেপ নিতে চাইনি কিন্তু আব্বু মানলো না। জয়কে ছাড়া থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব ‘
‘ ডোন্ট বি স্যাড, বিয়ের আগের দিন কণের এভাবে মন খারাপ করে থাকাটা ভালো দেখায় না। তাছাড়া তোমাদের এতো বছরের ভালোবাসা আগামীকাল পূর্ণতা পেতে যাচ্ছে। সব ছেড়ে যখন এসেছো, আপাতত না হয় সেই পূর্ণতার কথাই ভাবো। তোমরা ভালো থাকলে দেখবে তোমাদের পরিবারও একসময় হাসিমুখে তোমাদের আপন করে নেবে ‘
‘ সেটাই ভাবছি, কিছুদিন পর আমরা দুজনেই পরিবারের কাছে যাবো। কিন্তু আমাদের পরিবার মানবে কিনা জানা নেই, জয়ের পরিবারও ভীষণ রেগে আছে ‘
দীর্ঘশ্বাস ফেললো সুহানা, মেঘ ওকে কি বলে শান্তনা দেবে বুঝতে পারছে না। একটু পরে সুহানা নিজেই বলে উঠলো..
‘ যা হবার হবে, পরে দেখা যাবে। এখন এগুলো নিয়ে ভেবে লাভ নেই, কি বলো মেঘনা?’
‘ হুমম! আচ্ছা সুহানা, বিয়ের জন্যে কি পড়বে কালকে? ঠিক করেছো কিছু?’
‘ হ্যা, শাড়ি গয়না সব নিয়ে এসেছি। সবই জয়ের পছন্দ করা জিনিস, ভাবছি সিম্পলভাবেই সাজবো। ওহ হ্যা, মেঘনা তোমাদের বিয়েটাও তো ঘরোয়াভাবে ছিলো। তুমিও নিশ্চয় সিম্পল সেজেছিলে?’
নিজের বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ে গেলো মেঘের…
‘ উম্ম! হ্যা, আমিও শাড়ি পড়েছিলাম, আর হাঁটতে গিয়ে অনেকবার হোচটও খেয়েছি। সেই নিয়ে বিয়ের প্রথম রাতেই তোমার বন্ধু আমাকে টি’জ করতে ছাড়েনি ‘
‘ রিয়েলি! আমাদের আরিশ কাউকেই রোস্ট করতে ছাড়ে না, এত্ত শ’য়’তা’ন তবে ছেলে হিসেবে অনেক ভালো। ভেবো না আমার বন্ধু বলে সুনাম করছি, হি ইজ রিয়েলি অ্যা কেয়ারিং পার্সন ‘
মুচকি হাসলো মেঘ…
‘ আই নো! তবে তোমার থেকে হয়তো বেশি কেয়ারিং এই মুহূর্তে কেউই নয়। এতো বছর ধরে একজনকে ভালোবেসেছে তার জন্যে সব ছেড়ে এসেছো তুমি। আমি তো সাহসই পেতাম না। জয় ভীষণ লাকি, যে তোমার মত একজনকে পাচ্ছে ‘
‘ থ্যাংকস অ্যা লট মেঘনা ‘
‘ আচ্ছা, কালকে তো বিয়ে আর কণের হাত খালি থাকবে নাকি? আমি মেহেদী নিয়ে এসেছি, দিয়ে দেই?’
‘ তাহলে তো খুবই ভালো হয়, আমার আসলে তাড়াহুড়োয় এসব কিছু খেয়াল ছিলো না ‘
‘ সমস্যা নেই, তুমি বসো আমি নিয়ে আসছি ‘
মেঘ মেহেদী আনতে গেলো, ওদিকে অয়ন কোনো একটা দরকারে নিচে এসেছিলো, তিশাকে দেখলো একা একা হোটেলের নিচ তলায় ঘুরছে। অয়ন এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলো…
‘ এখানে দাঁড়িয়ে কি করছো?’
‘ এমনি, ঘুরে দেখছি। কেনো কোনো সমস্যা আছে?’
‘ অবশ্যই আছে। অচেনা জায়গা এটা, তুমি হারিয়ে গেলে তার দায় কে নেবে? শেষে দোষ এসে আমার ঘাড়ে পড়বে ‘
‘ তুমি দেখছি আমার আব্বুর মতো মতো কথা বলছো, ছোটবেলায় কোনো ভিড় জায়গায় গেলে আব্বুও আমাকে এভাবেই বলতো। যে সঙ্গে সঙ্গে থাকো নইলে হারিয়ে যাবে ‘
‘ অচেনা জায়গায় একা ঘোরাঘুরি করতে মানা করাটা দোষের কিছু নয়, রুমে যাও ‘
‘ তুমি আমাকে শাসন করছো?’
‘ হ্যা করছি!’
‘ তোমার শাসনের তোয়াক্কা আমি করিনা, হুহ!’
তিশা বাইরের দিকে যাওয়া শুরু করলে অয়নও ওর সঙ্গে হাঁটা শুরু করলো..
‘ বাইরে কোথায় যাচ্ছো?’
‘ রিসিপশনিস্টের কাছে শুনলাম হোটেলের এক পাশে সুন্দর বাগান আছে, সেটাই দেখতে যাচ্চি। ইচ্ছে হলে তুমিও আসতে পারো। ওহ সরি, তুমি তো দেখছি আমার সঙ্গেই আসছো ‘
‘ তুমি কি সবসময়ই এমন, জেদী?’
‘ মোটেই না, আমি মা বাবার বাধ্য সন্তান। তবে এখন একটু ডানা ঝাপটানোর সুযোগ পেয়েছি!’
তিশার কথার কি উত্তর দেবে বুঝলো না অয়ন, আবার মেয়েটাকে এখানে একাও ছাড়তে চাইছেনা। অগত্যা তিশার সঙ্গে গেলো। জয় আরিশের রুমে এসেছ একটু আগে, কথার এক ফাঁকে আরিশ প্রশ্ন করে…
‘ হাউ আর ইউ ফিলিং ব্রো ‘
‘ স্ট্রেসড, টেন্সড!’
‘ এখনো তো বিয়েই করলে না, আগে এতো চাপ নিলে বিয়ের পরের চাপ কিভাবে সহ্য করবে? বিয়ের পর সংসার করা অনেক কষ্টের কাজ’
‘ হেই! আরিশ, ভয় দেখানোর চেষ্টা করছো নাকি?’
‘ নো! নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি। তাছাড়া আমার বান্ধবীর ক্ষণে ক্ষণে মুড সুইং হয়। ওকে সামলানো একটু টাফ ব্যাপার ‘
‘ জানি! সুহানার রাগ, জেদ মা’রা’ত্ম’ক! তবে চিন্তা করো না, তোমার বান্ধবীকে আমি যত্নে আগলে রাখবো’
‘ রাখতেই হবে, নাহলে আমি কিন্তু তোমায় ছেড়ে কথা বলবো না। কোনোদিন যদি শুনেছি আমাদের সুহানাকে কষ্ট দিয়েছো তাহলে কিন্তু…’
‘ ওকে ওকে! আর ভয় দেখাতে হবে না, এমনিতেই অনেক চিন্তায় আছি আমি ‘
তখনই রুমে এলো মেঘ, ব্যাগ থেকে মেহেদী বের করে নিয়ে যাচ্ছিলো। তখনই আরিশ জিজ্ঞাসা করলো…
‘ আবার কোথায় যাচ্ছো?’
‘ হবু বউকে মেহেদী দিয়ে দেবো, কালকে বিয়ে তো!’
মেঘের ছোট্ট এই জেস্টার জয়ের বেশ ভালো লাগলো..
‘ থ্যাংক ইউ মেঘনা ‘
‘ ধন্যবাদের কিছুই নেই, বন্ধু হিসেবে এইটুকু আমরা না করলে কে করবে?’
__________________________________
দুপুরে হোটেল থেকে বেরিয়েই পার্লারে গিয়ে বিয়ের সাজে তৈরি হয়ে নিয়েছে সুহানা, বাকিরা সবাইও তৈরি। লাঞ্চের পর জয় সুহানা কোর্ট ম্যারেজ করে, সাক্ষী হিসেবে ছিলো ওরা চারজন। বিয়ের পর নতুন বর কণেকে নিয়ে ওদের নতুন বাসায় যায় সবাই। সুহানা জয়ের অনুরোধে আজকে ওরা চারজন রাতটা ওদের ভাড়া করা নতুন বাসাতেই কাটাবে বলে ঠিক করেছে। ভাড়া বাসাটা আগে থেকেই মোটামুটি নিয়েছিলো জয় সুহানা। তাই এসে তেমন একটা অসুবিধা হয়নি, আসার সময় বাজার করে আনা হয়েছে। রান্নার দায়িত্ব মেঘ আর তিশা নিলো, দুজনে মিলে মোটামুটি একটা বিয়ের খাবারের আয়োজন করবে বলে ঠিক হলো! মেঘ আর তিশা মিলে রান্নাঘরে কাজ করছিলো, অয়ন এসে তিশাকে অপটু হাতে সবজি কাটতে দেখে বললো…
‘ তুমি সত্যিই রান্না টান্না পারো নাকি শো অফ করছো?’
‘ তোমার সমস্যা কি বলোতো? তুমি আমার পেছনে পড়েছো কেনো?’
‘ না, এমনি জানতে চাইছি আর কি। ঠিকঠাক রান্না না জানলে এতগুলো টাকার জিনিস নষ্ট হয়ে যাবে আর আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে ‘
অয়নের কথায় কান দিতে গিয়ে বেখেয়ালি হয়ে তিশার হাত কে’টে যায়। মেঘ বলে উঠলো..
‘ সাবধানে! বললাম তোর করতে হবে না। আমি একাই করে নেবো ‘
আরিশ আবার বাইরে থেকে ওদের কথাবার্তা শুনেছে, ও রান্নাঘরে এসে মেঘকে উদ্দেশ্য করে বললো…
‘ তুমি আবার কাকে কি বলছো? তুমি নিজেই তো রান্নার ব্যাপারে অদক্ষ, কতোটা হাত কেটে ফেলেছিলে এর আগে মনে আছে?’
‘ তো? রান্না করতে গেলে একটু আধটু এমন হয়ই ‘
‘ তা ঠিক আছে, কিন্তু তোমার রান্না তেমন মজা হয় না। অবশ্য তোমার বিরিয়ানি রান্না খাওয়া হয়নি এখনও, কেমন না কেমন হবে!’
‘ তুমি আমার খাবারের বদনাম করছো?’
‘ বদনাম নয়, যা সত্যি তাই বলছি ‘
আরিশের কথায় মেঘের কেনো যেনো খুব রাগ হলো, এভাবে সবার সামনে রান্নার বদনাম করছে? মেঘ মুখ ফুলিয়ে বললো…
‘ বেশ! আমরা তো অপটু, তাহলে আজকের রান্নাটা তোমরা দুজনেই করো। আমরা চললাম, তিশা চল তো। এখানে আমাদের কাজ নেই ‘
তিশাকে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো মেঘ, রান্না হবেনা আজকে। দেখা যাক, এবার কিভাবে আরিশ খাওয়ার ব্যবস্থা করে!
চলবে…
#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ১৯
তিশা ও মেঘ মিলে ঠিক করলো খাবার অর্ডার করবে, দুপুরে তো আর না খেয়ে রাখা যাবেনা সবাইকে! ওরা ফোনে চেক করছিলো যে আশেপাশে ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট আছে কিনা। সুহানা এসে দেখলো তিশা মেঘ দুজনেই ফোনে মুখ গুঁজে আছে! ও প্রশ্ন করলো…
‘ এতো মনোযোগ দিয়ে কি করছো তোমরা দুজন?’
তিশা উত্তর দিলো…
‘ আমরা খাবার অর্ডার করার জন্যে আশেপাশের রেস্টুরেন্টের খোঁজ করছি ‘
‘ কেনো?’
মেঘ আমতা আমতা করে বললো…
‘ সরি সুহানা, আমি বলেছিলাম সবার জন্যে রান্না করবো কিন্তু তোমার বন্ধু গিয়ে আমার রান্নার কাজে বাঁধা দিয়েছে। আমি রাগ করে সব রেখে চলে এসেছি, তবে চিন্তা করো না, খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে ‘
‘ এক মিনিট, অয়ন আর আরিশ রান্নাঘরে ঢুকেছে?’
‘ হ্যাঁ!
‘ তাহলে আর বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করার প্রয়োজন নেই, ওরাই বানিয়ে নেবে ‘
‘ বানিয়ে নেবে মানে?’
‘ ওরা দুজনেই রান্না পারে ‘
এ কথা শুনে তিশা মেঘ দুজনেই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো, অয়নের ব্যাপার না হয় বাদ কিন্তু এতদিনে মেঘও জানতে পারেনি যে আরিশ রান্না করতে পারে! সুহানা মেঘকে প্রশ্ন করলো…
‘মেঘনা, তুমি জানতে না আরিশ রান্না জানে?’
‘ ন..না! আমায় কখনো বলেনি আর ওকে আমি কখনো রান্নাঘরে ঢুকে কিছু করতেও দেখিনি ‘
‘ ওহ আচ্ছা! আসলে, ইন্টারমিডিয়েট এক্সামের পর আমরা তিনজন একসঙ্গে কুকিং ক্লাস জয়েন করেছিলাম, আমার এক মামা আছে শেফ! ওনার থেকেই কিছু কমন রেসিপি রান্না শিখেছিলাম। আমরা তিনজনই মোটামুটি ভালো রান্না জানি। ওরা যখন গেছে খাবার বানিয়ে নেবে, তোমরা এতো চিন্তা করো না ‘
সুহানার কথা শুনে তিশা ফিসফিসিয়ে মেঘকে বললো…
‘ কি বুঝলি মেঘনা? ছেলে দুটোর ভালোই গুন আছে দেখছি, হতে পারে এমন আরো অনেক হিডেন ট্যালেন্ট আছে যা আমরা জানিনা ‘
‘ তাই তো দেখছি, এতোদিনে আরিশ আমাকে কখনো বুঝতেই দেয়নি যে ও রান্না জানে! সুহানার সামনে আমার বেইজ্জতি হয়ে গেলো একেবারে। ও কি ভাবছে বলতো? আমার হাসবেন্ড রান্না জানে আর আমিই সেটা জানিনা?’
‘ সেটাই তো! আমরা যখন চলে এলাম তখনও কিছু বললো না, বুঝতেই দিলো না ‘
ওদের দুজনকে ফিসফিস করতে দেখে সুহানা ভ্রু কুঁচকে তাকালো, মেঘ তিশার সঙ্গে কথা থামিয়ে এক গাল হেসে সুহানাকে বললো…
‘ তোমাকে শুধু শুধু এখানে বসতে হবেনা সুহানা, তুমি গিয়ে রেস্ট করো। এদিকে সবকিছু আমরা সামলে নেবো ‘
‘ ঠিক আছে, আমি তাহলে তোমাদের ঘরটা গুছিয়ে দেই। তোমাদের থাকার রুমটা গোছানো হয়নি ‘
সুহানা উঠে যেতেই তিশা মেঘ দুজনে গুটি গুটি পায়ে রান্নাঘরের সামনে এসে উঁকি দিয়ে দেখলো সুহানার কথাই মিলে গেছে। আরিশ অয়ন মিলেমিশে রান্নাবান্না করছে, আরিশের এই নতুন রূপ দেখে মেঘ আশ্চর্য্য হয়ে গেছে। রান্না জানা ছেলের প্রতি তিশার একটু বেশীই দুর্বলতা কাজ করে, অয়নকে এভাবে গুছিয়ে রান্নার কাজ করতে দেখে তিশার মনে লাড্ডু ফুটতে শুরু করেছে! তিশা তো দ্রুত ফোনে অয়নের রান্না করার দৃশ্য ছোটো একটা ভিডিও করে নিলো। মেঘ আরিশকে দেখছে, ছেলেটার ওপর রাগও হচ্ছে আবার ভালোও লাগছে! বিরিয়ানি রান্না করেছে ওরা, রান্না শেষে টেবিলে খাবার সাজাতে গিয়ে মেঘ মুখ গোমড়া করে ছিলো দেখে আরিশ প্রশ্ন করলো…
‘ তোমার কতোটা কাজ কমিয়ে দিলাম আমি, তারপরও মুখটা ওরকম করে রেখেছো কেনো?’
‘ কাজটা আজকে ঠিক করলে না তুমি ‘
‘ কি করেছি?’
‘ তুমি রান্না জানো সেটা আগে কখনো বলোনি কেনো আমায়? জানো তোমার বান্ধবীর সামনে আজ আমাকে কতো ইম্ব্যারেসড হতে হলো?’
‘ সারপ্রাইজ দিলাম!’
‘ এটা কেমন সারপ্রাইজ?’
‘ আমাকে কুকিং করতে দেখে তুমি ইমপ্রেস হয়েছো রাইট? আজকাল সব মেয়েরাই চায় তার হাসবেন্ড কুকিং এক্সপার্ট হোক’
‘ আমার তেমন কোনো চাওয়া ছিলো না, নিজের অন্তত এইটুকু যোগ্যতা আছে যে রান্না করে হাসবেন্ডকে খাওয়াতে পারবো ‘
‘ অদ্ভুত মেয়ে তো তুমি! না চাইতেও এতো হাসবেন্ড পেয়েছো, কোথায় খুশিতে পা’গ’ল হয়ে যাবে তা না করে মুখ গোমড়া করছো?’
‘ বিষয় সেটা নয় আরিশ, এতদিন একসঙ্গে থাকার পরও আমি এইটুকু জানিনা তোমার সম্পর্কে। ইন ফ্যাক্ট, আমি তোমার ব্যাপারে তেমন কিছুই জানিনা, তোমার সঙ্গে থাকার পরও তুমি কি পারো না পারো সেটা অন্যের মুখ থেকে জানতে হচ্ছে। এটা আমার জন্যে লজ্জাজনক!’
মেঘ হঠাৎই যেনো রেগে গেলো, আরিশ ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললো…
‘ হেই রিল্যাক্স, এতো সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই ‘
উত্তর দিলো না মেঘ, চুপচাপ খাবার সাজানোর কাজ করতে থাকে। আরিশ আবারো আহ্লাদী স্বরে বলে উঠলো…
‘ ওকে ফাইন! আমি তোমাকে নিজের সম্পর্কে সবকিছু বলবো, কিছু বাদ দেবো না। দরকার পড়লে ডায়রীতে লিখে দেবো, তুমি পড়ে নিও ‘
আরিশের কথা শুনে না হেসে পারলো না মেঘ, হাফ ছেড়ে বাঁচলো আরিশ। যাক, মেয়েটার রাগ কমেছে! একটু পরে সবাই মিলে খেতে বসলো, জয় ভেবেছিলো মেয়েরা রান্না করেছে তাই মেঘ ও তিশাকে উদ্দেশ্য করে ধন্যবাদ জানাতেই আরিশ বলে উঠলো…
‘ ব্রো! আজকের রান্না ওরা নয়, আমরা করেছি ‘
‘ তোমরা?’
‘ ইয়াহ! বান্ধবীর বিয়ের ভোজন আজ আমরা তৈরি করেছি, খেয়ে দেখুন কেমন হয়েছে ‘
সবাই খাওয়া শুরু করলো, খাওয়ার এক ফাঁকে জয় বললো..
‘ তোমরা সত্যিই অনেক ট্যালেন্টেড! বিরিয়ানিটা অনেক মজা হয়েছে ‘
সঙ্গে সঙ্গে সুহানা মুখ ফুলিয়ে জয়কে বললো…
‘ দেখেছো? এজন্যেই তোমাকে বলেছিলাম, একটা কুকিং কোর্স তুমিও করো কিন্তু আমার একটা কথায় পাত্তা দিলে না। তাহলে তুমিও আমাকে এভাবে রান্না করে খাওয়াতে পারতে ‘
‘ এতো হতাশ হওয়ার কি আছে! সময় পেলে তুমি আমাকে রান্না শিখিয়ে দিও, তোমার কাছে শিখেই তোমাকে রান্না করে খাওয়াবো’
‘ নাহ থাক! তোমাকে কষ্ট করে আর রাধতে হবেনা, এমনিতেই অফিস করে এসে ক্লান্ত থাকো। আমিই তোমাকে রেঁধে বেড়ে খাওয়াবো ‘
সুহানার কথা শুনে অয়ন আরিশকে কুণুই দিয়ে ধাক্কা বললো…
‘দেখেছিস আরিশ? বান্ধবী আমার এখনই কেমন সংসারী হয়ে গেছে?’
‘ ট্রু! অ্যাই সুহানা শুধু বরকেই নয়, মাঝে মাঝে আমাদেরও দাওয়াত করিস। এসে খেয়ে যাবো ‘
তিন বন্ধুর কথোপকথন শুনে উপস্থিত বাকিরাও আনন্দিত। হিংসা বিবাদ বাদ দিয়ে অটুট থাকতে পারলেই বন্ধুত্ব পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর একটি ব্যাপার!
__________________________________________
ড্রইংরুমে বসেছিলো অয়ন, সারাদিন মায়ের সঙ্গে কথা হয়নি তাই কথা বলে নিলো। তিশা রান্নাঘরে পানি খেতে এসেছিলো, অয়নকে বসার ঘরে একা বসে থাকতে দেখে তিশা এগিয়ে এলো…
‘ বসতে পারি?’
‘ শিওর! জিজ্ঞাসা করার কি আছে?’
অয়নের পাশে বসলো তিশা…
‘ তুমি তো বেশ গুণী মানুষ, রান্নাটা আজ সত্যিই মজা হয়েছিলো ‘
‘ থ্যাংক ইউ! তবে আমি একা করিনি, আরিশের ক্রেডিটই এখানে বেশি’
‘ তবুও, তুমি হেল্প তো করেছো। আচ্ছা, তোমার বন্ধুরা সব বিয়ে করে নিলো। এবার তুমি একাই আছো, তোমার বিয়ে শাদী করার প্ল্যান কতদূর?’
হাসলো অয়ন…
‘ এই দুঃখের কথা আর জিজ্ঞাসা করো না, বিয়েটা করার জন্যে মেয়ে তো দরকার। বিয়ের উপযুক্ত মেয়ে পাই, তাহলে আমিও আর দেরি করবো না ‘
‘ কেনো? তোমার প্রেমিকা নেই?’
‘ তোমার কি মনে হয় আমার প্রেমিকা থাকলে এখানে বসে তোমার সঙ্গে গল্প করতে পারতাম? আর তাকে না নিয়ে আমি একা এখানে আসতাম?’
অয়নের প্রেমিকা নেই শুনে তিশা মনে মনে একটু খুশিই হলো বটে..
‘ ওহ! আমি ভাবলাম তোমার বুঝি প্রেমিকা আছে’
‘ তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?’
‘আমার আব্বু কতো কড়া এ ব্যাপারে তোমার ধারণা নেই বুঝলে! তাই প্রেম করার মতো সুযোগই কখনো পাইনি, যদিও ভার্সিটিতে ওঠার পর আগের থেকে কিছুটা ছাড় দিয়েছে আমাকে আব্বু ‘
‘ তাহলে যেটুকু সুযোগ পেয়েছো তা দিয়েই ট্রাই করতে চাও নাকি?’
‘ কি?’
‘ প্রেম করবে?’
অয়নের কথা শুনে রীতিমত চমকে তিশা, এভাবে ছেলেটা প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসবে ভাবতেই পারেনি! তিশা নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলো…
‘ মজা করছো?’
‘ কি মনে হয়?’
‘ আমার তো মজাই মনে হচ্ছে ‘
‘ দেখো তিশা, তোমার কাছে দুটো অপশন আছে। তুমি চাইলে মজা ভেবে উড়িয়ে দিতে পারো, আবার সিরিয়াসলিও নিতে পারো। মজা ভেবে উড়িয়ে দিলে আমার আর কিছু বলার নেই ‘
তিশা কৌতুহল বশত জানতে চাইলো…
‘ আর যদি সিরিয়ালি নেই তাহলে?’
প্রতিউত্তরে এক গাল হাসলো অয়ন, হুট করে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো…
‘ সারাদিন অনেক খাতখাটনি করেছো, এবার রুমে গিয়ে রেস্ট করো। গুড নাইট!’
বেচারি তিশা কতো আশা নিয়ে অয়নের উত্তর শোনার অপেক্ষায় ছিলো, কিন্তু অয়ন ওর আশায় পানি ঢেলে দিলো!
‘ অয়ন! আমাদের কথা শেষ হয়নি, তুমি এভাবে উঠে কোথায় যাচ্ছো?’
অয়ন কিছু না বলেই চলে গেলো, তিশার মেজাজ গরম হয়ে গেলো। এভাবে অর্ধেক কথা বলে চলে যাওয়ার মানে কি!
সুহানাদের ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে তিনটা রুম, দুইটা বেড রুম আর ডাইনিং। রাতে তিশা আর মেঘ এক রুমে থাকবে আর অয়ন আরিশ ড্রইংরুমে ঘুমাবে বলে ঠিক করেছে কারণ ড্রইংরুম এখনও ফাঁকাই আছে! সুহানা আরিশদের ঘুমানোর জন্যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে গেছে, যদিও ও নিজেই গুছিয়ে দিতে চেয়েছিলো কিন্তু আরিশ ওকে পাঠিয়ে দিয়েছে। সদ্য বিবাহিত বর বউকে ওরা কেউই বিরক্ত করতে চায়না। একটু পরে মেঘ আরিশদের বিছানা ঠিক করতে চাইলে আরিশ বললো…
‘ আমি করে নেবো ‘
‘ আমি করে দিচ্ছি, আজ তুমি অনেক পরিশ্রম করেছো’
‘ তাও ঠিক, আজ অনেক খাটনি গেছে আমার। তোমার কাজও কমিয়ে দিয়েছি আমি, আমাকে পারিশ্রমিক দেবে না?’
মেঘ মুচকি হেসে আরিশের গালে চু’মু দিয়ে বললো..
‘ হয়েছে?’
‘ হুমম, হয়েছে! এবার তুমি যাও, ঘুমিয়ে পড়ো ‘
মেঘ বিছানা গুছিয়ে রেখে ঘরে চলে গেলো, হঠাৎ আরিশ লক্ষ্য করলো অয়ন একপাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!
‘ তুই ওখানে কি করছিস?’
‘ তোদের প্রেমে ডিস্টার্ব করতে চাইনি, তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম
‘ ওহ! তো কি দেখলি?’
অয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে এসে বালিশ ঠিক করে শুয়ে বললো…
‘ সিরিয়াসলি বলছি ভাই! তোকে আর মেঘনাকে একসঙ্গে দেখলে আমার নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে। কি শান্তির জীবন কাটাচ্ছিস তোরা ‘
‘ এতো হতাশ হওয়ার কিছু নেই ব্রো, এমন দিন তোমারও শীঘ্রই আসবে ‘
‘ শান্তনা দিচ্ছিস নাকি?’
‘ তুই যে স্পিডে এগোচ্ছিস তাতে আমার আর তোকে শান্তনা দিতে হবে না ‘
‘ মানে?’
আরিশ টানটান হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বললো..
‘ প্রেমের প্রস্তাব যখন দিয়েছিস, ভালো করে দে। মেয়ে কিন্তু নিজে থেকে এসে তোকে প্রপোজ করবে না ‘
অয়ন চমকে উঠলো, তিশার সঙ্গে কথা বলার সময় আরিশ শুনে নিয়েছিলো?
‘ তুই শুনেছিস?’
‘ ইয়াহ! বন্ধু হিসেবে তোকে একটা উপদেশ দিচ্ছি, যদি তোর তিশাকে পছন্দ হয়েই থাকে তাহলে বলে সে। অযথা মনের কথা মনে চেপে রেখে সময় নষ্ট করিস না ‘
অয়নের তিশাকে এমনিতেও পছন্দ, আরিশের কথা শুনে যেনো ওর আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে গেলো! ঠিক করলো, এরপর যা বলার তিশাকে সরাসরিই বলবে…
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]