#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ২৫
ননদের কথা শুনে জামা কাপড় সরিয়ে রেখে ওকে টেনে বিছানায় বসালো মেঘ, উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করলো…
‘ কিভাবে কি হলো বলোতো! হুট করেই প্রোপোজ?’
‘ কি জানি ভাবী, আমিও কিছু বুঝতে পারছি না। অবশ্য ছেলে হিসেবে তাকে আমার ভালোই লাগে কিন্তু তাকে কখনো আমি অন্য কোনো নজরে দেখিনি, আর দেখো না আজ সেই আমাকে হুট করে প্রোপোজ করে বসলো’
‘ আমার কি মনে হয় জানো? সে তোমাকে আগে থেকেই পছন্দ করতো, শুধু বলার সুযোগ পায়নি’
‘ হবে হয়তো, হুট করেই তো আর কারো কাউকে ভালো লেগে যেতে পারেনা। কিন্তু আমি এখন কি করবো! আমার তাকে ভালো লাগে মানে ছেলে হিসেবে অনেক ভালো, আবার সে আমাকে নিজেই প্রোপোজ করলো। এখন কি করা উচিৎ আমার? দারুন দোটানায় পড়ে গেলাম ‘
‘ আমি একটা কথা বলি? আমার মনে হয় চেনাজানায় সম্পর্ক হলে মন্দ হবেনা, আর তোমরা একে অপরের যখন পছন্দই করো তাহলে বিষয়টা তো সামনে এগিয়ে নেওয়া যায় তাইনা?’
‘ বলছো? আমার না কেমন অদ্ভুত লাগছে, মানে সে আমার কাজিন! প্রেম করবো কিভাবে!’
‘ শুরুতে অমন একটু লাগবেই, কতো কাজিনরা বিয়ে করছে বলোতো? তাছাড়া এখনি তো আর বিয়ে করবে না। সম্পর্ক থাকুক, একে অপরকে তোমরা জানার চেষ্টা করো। তোমাদের মতের মিল হয় কিনা সেটা দেখো ‘
‘ হুমম, তাও ঠিক বলেছো। তাছাড়া আমার মামাতো ভাই আমার তুলনায় অনেক বেটার! আই মিন হি ইজ দ্যা বেস্ট গাই। তাহলে কি ট্রাই করবো? একবার তো না বলতে পেরে ছ্যাঁকা খেলাম, এবার সুযোগ হেঁটে হেঁটে আমার কাছে এসেছে। সুযোগটা নিয়ে ফেলাই উচিত তাইনা ভাবী?’
‘ একদম! আর বললেই তো সম্পর্ক হয় না। আগে দেখো তোমাদের মতের মিল কেমন হয়, ছেলেটা কতোটা ম্যাচিওর! আরো জানার জন্যে অনেককিছু আছে, একটা সম্পর্ক শুরু করার আগে অনেককিছুই জানতে হয় ‘
মেঘের সঙ্গে আলোচনা শেষে আনিশা সিদ্ধান্ত নিলো মামাতো ভাইয়ের প্রোপোজাল অ্যাকসেপ্ট করবে তবে এখনি নয়, কিছুদিন কথাবার্তা বলে দেখার পর। যদি ভালো লাগে তাহলে হ্যা বলবে নাহলে রিজেক্ট করবে! মেঘও আনিশার এই সিদ্ধান্তে সমর্থন করলো… সন্ধ্যায়, আরিশ ভিডিও কলে সুহানার সঙ্গে কথা বলছিলো। কথা শেষ হতেই মেঘ রুমে এলো..
‘ কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’
‘ সুহানা ‘
‘ আঙ্কেল এখনও মেনে নেয়নি?’
‘ সুহানা বললো চেষ্টা চলছে, এতদিন চেষ্টায় পর ওর বাবা আপাতত ওকে বাড়িতে অ্যালাও করছে কিন্তু জয়কে এখনও জামাই হিসেবে মানছে না ‘
‘ আঙ্কেল বেশ স্ট্রিক্ট বলতে হবে, নাহলে এতদিনেও মানছে না? বিয়ের তো কয়েকমাস হয়ে গেলো ‘
‘ আঙ্কেল ভীষণ জেদি, এতো সহজ হবেনা তাকে মানানো ‘
‘ আই হোপ সব ঠিক হয়ে যাবে, আচ্ছা চলো। খাবার সময় হয়ে গেছে ‘
‘ আজকে তুমি রান্না করেছো?’
‘ না!’
‘ কেনো?’
‘ আম্মু করতে দেয়নি! কেনো? আমার রান্না না তোমার মজা লাগেনা?’
‘ না, অতো খারাপও হয় না। মাঝে মাঝে একটু আম্মুর রান্নার বাইরে কারো রান্না খেতে ইচ্ছে হয় তো তাই বললাম ‘
‘ ঠিক আছে, তাহলে কালকে পুরোদিনের রান্না আমি করবো। খাওয়ার সময় অভিযোগ করলে কিন্তু খবর আছে ‘
‘ হুমকি দিচ্ছ নাকি?’
‘ হ্যা দিচ্ছি!’
মেঘকে একটানে নিজের কোলের ওপর বসালো আরিশ, মেঘের গলায় আঙ্গুল ছুঁইয়ে বললো..
‘ অভিযোগ করলে কি করবে শুনি?’
গলায় সুড়সুড়ি আছে মেঘের, আর ও জানে আরিশ ইচ্ছে করে এমন করছে। আরিশকে থামানোর চেষ্টা করলো মেঘ, কিন্তু সে শুনলে তো। উল্টে আরো বেশি সুরসুড়ি দিচ্ছে। এর মাঝে দরজায় নক পড়লো, আনিশা ডিনারের জন্যে ডাকতে এসেছে। মেঘ দরজা খুলে দ্রুত বেরিয়ে গেলো, আনিশা ভ্রু কুঁচকে ওর ভাইকে প্রশ্ন করলো..
‘ মনে হয় খুব মজার জোকস বলছিলি ভাবীকে? সে তো হেসে কুটিকুটি হচ্ছিলো শুনলাম। আমাকেও একটু বল ‘
আরিশ এক গাল হেসে বললো…
‘ বোন আমার, তুই এখনও বাচ্চা আছিস। বিয়ে শাদী করলে নিজেই বুঝবি ‘
ভাইকে জিজ্ঞাসা করে কোনো লাভ নেই, তাই আনিশাও আর কথা বাড়ালো না। সবাই একসঙ্গে ডিনার করছিলো, এক পর্যায়ে আফজাল সাহেব বললেন…
‘ তুই কালকে আমার সঙ্গে বাজারে যাবি আরিশ। তোর আম্মু লিস্ট করে দেবে, সেগুলো আনতে যাবো ‘
‘ হোয়াট! আমি গিয়ে কি করবো?’
‘ সারাজীবন শুধু আমিই বাজার করে খাওয়াবো নাকি? তোর কিছু শিখতে হবে না? কোন জিনিসের কোন দাম, কিভাবে দরদাম করতে হয় সেটা নিজে বাজারে না গেলে কিভাবে বুঝবি?’
‘ এতো প্যারা নেওয়ার কি আছে আব্বু? সুপার শপ থেকে সবকিছু অর্ডার করে নিলেই তো হয়’
‘ এতো আরামে তো জীবন চলেনা বাবা, একটু গা গতর খাটিয়ে না খেলে কিভাবে হবে? কথা না বলে কালকে সকাল সকাল উঠে আমার সঙ্গে যাবি। সকালে সবকিছু পাওয়া যায় সবকিছু ‘
বাবার কথা শুনে আর কিছু বলতে পারলো না আরিশ, যদিও বিয়ের পর আফজাল সাহেব ছেলেকে কিছু বলেননি কিন্তু ছেলে তার নিজে থেকে কোনো কাজ করতেই আগ্রহী না তাই নিজেই ঠিক করলেন ছেলেকে দিয়ে টুকটাক কাজ করাবেন! ছুটির দিনটা আরিশ বাড়িতেই কাটিয়েছে, বাবা তাকে দিয়ে অনেক কাজও করিয়েছে। আরিশকে এতো কাজকর্ম করতে দেখে বেচারার প্রতি মেঘের ভীষণ মায়া হচ্ছিলো। একদিন ভার্সিটিতে এসে অয়ন জানালো ওর একটা প্রাইভেট সেক্টরে চাকরি হয়েছে, খবরটা শোনার পর সবাই বেশ খুশি! মিষ্টি এনেছে বন্ধুদের খাওয়ানোর জন্যে, কিন্তু সেখানে আরিশের প্রিয় রসগোল্লা ছিলো না ‘
‘ আমার রসগোল্লা কই!’
‘ এতো অভিযোগ না করে চুপচাপ খেয়ে নে! প্রথম মাসের বেতন পেলে তোকে এক কেজি রসগোল্লা পাঠিয়ে দেবো ‘
আরিশ প্যাকেট থেকে একটা চমচম তুলে খেলো, মেঘ আগেই খেয়েছে। একটু পরে কোত্থেকে ক্লান্ত হয়ে এসে তিশা বসলো!
‘ কি হয়েছে তোর?’
‘ আর বলিস না মেঘনা, এত্ত রোদ বাইরে। আসতে গিয়ে অবস্থা টাইট হয়ে গেছে আমার। কিন্তু এখানে মিষ্টি বিতরণ চলছে কেনো? কারো বিয়ে নাকি?’
হুট করেই অয়ন বলে বসলো….
‘ তুমি রাজি থাকলে পরবর্তীতে আমাদের বিয়ের মিষ্টিই বিতরণ করতে পারি ‘
‘ কিহ!’
‘ জ্বি, আচ্ছা তোমার আব্বু ছুটির দিনে কখন বাসায় থাকে আমাকে একটু জানিও তো। দেখা করতে যাবো ‘
তিশাসহ উপস্থিত সকলেই রীতিমত অবাক হয়ে গেলো, অয়ন চাকরি পাওয়ামাত্রই সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে? আরিশ তো বন্ধুর এহেন সাহসের সাধুবাদ জানাচ্ছে, মেঘও তিশাকে উৎসাহ দিচ্ছে। তিশাও যেহেতু অয়নকে পছন্দ করে তাই আর অয়নের প্রস্তাবে আপত্তি করলো না। ভালোবাসার মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে যতো দ্রুত পাওয়া যায় ততোই উত্তম!
__________________________________
বর্তমানে ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট আরিশ মেঘ দুজনেই, সপ্তাহ দুয়েক আগে ওদের বিবাহিত জীবনের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। সংসার ও ভার্সিটি জীবন উভয়ই বেশ চলছে! ক্লাসমেট টপ হাসবেন্ড থাকায় বিশাল একটা সুবিধা পেয়েছে মেঘ, প্রয়োজন হলে একটা বিষয় একবারের জায়গায় দশবার জিজ্ঞাসা করে বুঝে নিতে পারে। মাঝে মাঝে আরিশ অবশ্য রেগে যায়, কিন্তু একটু পরে নিজেই হেল্প করতে এগিয়ে আসে। কিছুদিন ধরে মেঘ বেশ অসুস্থ বোধ করছে, যদিও আরিশকে জানায়নি। মায়ের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করায় ওর মা বলেছিলো একবার প্রেগনেন্সি টেস্ট করে দেখতে, মায়ের কথামতো আজ প্রেগনেন্সি টেস্ট করছে মেঘ। প্যাকেটের ওপর লিখা নির্দেশনা অনুযায়ী সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে তিন মিনিট অপেক্ষা করছিলো, প্রতিটা সেকেন্ড পার হচ্ছিলো আর মেঘের মনে নানান ভাবনা ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে। যদি পজিটিভ আসে তাহলে? আরিশ এখনও স্টুডেন্ট, এ অবস্থায় বেবির ব্যাপারটা কিভাবে অ্যাকসেপ্ট করবে? যদি রাগ করে? নানান ভাবনায় বুদ ছিলো মেঘ, হুট করে খেয়াল করলো কিটে দুটো গাঢ় লাইন উঠেছে। এটা দেখামাত্রই হাত কেপে উঠলো মেঘের, আর দুর্ঘটনাবশত কিটটা হাত স্লিপ করে পড়লো বাথরুমের প্যানের ভেতর! সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে দেখলো আরিশ সবে জগিং করে ফিরেছে! তোয়ালে দিয়ে ঘাড় মুছতে মুছতে মেঘের দিকে তাকালো আরিশ, সাত সকালে মেয়েটাকে এভাবে ফোঁপাতে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে ও প্রশ্ন করলো…
‘ কি হয়েছে?’
মেঘ ফোঁপাতে ফোঁপাতে এগিয়ে এসে খপ করে আরিশের হাত ধরলো!
‘ ওঠো!’
আরিশ উঠে দাঁড়ালো…
‘ কি হলো তোমার?’
এতক্ষণ ফোপাচ্ছিলো, কিন্তু এবার আর কান্না আটকে রাখতে পারলো না মেয়েটা। সে কি কান্না তার, আরিশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। দু হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করলো…
‘ হেই, মেঘনা! সকালবেলা এভাবে কাঁদছো কেনো?’
আরিশের বুকে মুখ গুঁজে কান্না জড়ানো কণ্ঠে মেঘ বললো…
‘ দুটো লাইন উঠেছিলো আরিশ, আমি ভালোভাবে দেখতে পারলাম না। তার আগেই পরে গেছে ‘
‘ কিসের লাইন? কি পড়ে গেছে?’
‘ আমাকে কোনোভাবে ওটা উঠিয়ে দাও ‘
‘ কি হয়েছে পরিষ্কার করে না বললে কিভাবে বুঝবো? কিসের লাইনের কথা বলছো? আর কি উঠিয়ে দেবো?’
মেঘ এবার মাথা তুলে তাকালো, টলমল চোখে বললো…
‘ প্রেগনেন্সি কিট! ওখানে দুটো গাঢ় লাইন উঠেছে, আমি প্যানের সামনে দাড়িয়ে দেখছিলাম। দুটো লাইন দেখে এক্সসাইটমেন্টে আমার হাত থেকে ওটা ভেতরে পড়ে গেছে!’
“প্রেগনেন্সি কিট” – “দুটো লাইন” এই বাক্য দুটো শোনার পর আরিশ যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো! নিজের কানকেই যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না, যা শুনলো সেটা কি সত্যি? এদিকে মেঘ আফসোসের সহিত বলছে…
‘ কি করবো আমি এখন! আমার প্রথম টেস্ট ছিলো ওটা, আমি যত্ন করে রেখে দিতাম ‘
আরিশ এবারও নিশ্চুপ, মেঘের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করছে! আরিশের কোনো রেসপন্স না পেয়ে মেঘ ওকে ঝাঁকিয়ে বললো…
‘ তুমি কোনোভাবে ওটা আমাকে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে? প্লিজ ডু সামথিং!’
মেঘ ছটফট করতে শুরু করেছে, আরিশ এবার দু হাত ওর কাঁধে রাখলো। ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞাসা করলো…
‘ দুই লাইন এসেছে? তুমি শিওর দেখেছো?’
‘ হ্যা! ওটা দেখেই তো আমি…’
মেঘ পুরো কথা শেষ করার আগেই কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আরিশ বললো…
‘ সো, উই আর গোইং টু বি প্যারেন্টস সুন?’
এবার স্থির হলো মেঘ, তাকালো আরিশের দিকে। ছেলেটার চোখমুখ আনন্দের ছাপ! মেঘ অসহায় নজরে তাকালো, কিটের চিন্তা করতে গিয়ে এতো বড় একটা কথা এতো সহজেই বলে দিলো! ও তো ভেবেছিলো এই খবরটা জানানোর জন্যে সুন্দর একটা প্রিপারেশন নিয়ে তারপর সারপ্রাইজ দেবে আরিশকে, কিন্তু সবকিছু উল্টো হয়ে গেলো!
চলবে…
[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]