এলো প্রেমের মৌসুম পর্ব-২৬ এবং শেষ পর্ব

0
187

#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#শেষ_পর্ব

মেঘের প্রেগনেন্সির বিষয়টার নিশ্চিত করার জন্যে ওরা হাসপাতালে এসে টেস্ট করে নিয়েছে, রিপোর্ট পজিটিভ! রিপোর্ট কালেক্ট করার পর আর্লি প্রেগনেন্সিতে কিভাবে কি করতে হবে, পরবর্তীতে কিভাবে চলতে হবে এসব নিয়েও টুকটাক আলোচনা করে নিয়েছে মেঘ সঙ্গে চেকাপও করেছে। মেঘ একাই ডাক্তারের কেবিনে গেছিলো, আরিশ বাইরে ছিলো। ডাক্তার দেখানো শেষে বেরিয়ে মেঘ এসে আরিশের পাশে বসলো, আরিশ তখন কোনো এক ব্যাপার নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন! মেঘ কাঁধে হাত রাখতেই ধ্যান ভাঙলো আরিশের…

‘ ওহ! হয়ে গেছে তোমার? ডাক্তার কি বললো, সব ঠিক আছে? আর নেক্সট চেকআপের জন্যে কবে আসতে হবে?’

‘ সব জেনে নিয়েছি আমি কিন্তু তুমি এতো মনোযোগ দিয়ে কি ভাবছিলে?’

‘ কিছুনা! অফিসিয়াল রিপোর্ট তো পেয়ে গেছি, এখন তাহলে বাড়িতে জানানো যাক? চলো ‘

মেঘের হাত থেকে রিপোর্টের খামটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো আরিশ, হঠাৎ মেঘ বললো…

‘ আরিশ, আমি জানি তুমি এখনও বাবা হওয়ার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত নও। ইটস টু আর্লি, কিন্তু আমরা দুজন মিলে সব ম্যানেজ করে নেবো। ওকে?’

মেঘের কথা শুনে আরিশ কিছুটা অবাক হলো, হাঁটু মুড়ে মেঘের সামনে বসে ওর গালে হাত রেখে প্রশ্ন করলো…

‘ তোমার এটা কেনো মনে হলো যে আমি বাবা হওয়ার জন্যে তৈরী নই?’

‘ গতকাল থেকে তোমাকে কেমন চিন্তিত দেখাচ্ছে, তাছাড়া তুমি তো..’

‘ বোকা মেয়ে! এরকম ভাবনা তোমার মাথায় আসে কিভাবে বলোতো? আমি বাবা হবো এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় একটা সুখবর, কেনো খুশি হবো না? আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি ‘

‘ তাহলে তোমাকে এতো চিন্তিত লাগছে কেনো?’

আরিশ উঠে মেঘের পাশে বসে একটু ভেবে বললো…

‘ উম্ম! অ্যাকচুয়ালি আই অ্যাম ফিলিং নার্ভাস! জানোই তো আমি কতোটা কেয়ারলেস, এখনও আমাকে আমার আব্বু না বকলে কোনো কাজ করিনা। সেখানে আমি নিজেই এখন বাবা হতে যাচ্ছি, বেবিকে বড় করা অনেক বড় দায়িত্বের ব্যাপার। সেসব নিয়েই একটু ভাবছি আর কি, কিন্তু তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। তোমার কাজ এখন শুধু রিল্যাক্স করা ‘

গতকাল থেকে আরিশের হাবভাব দেখে বেজায় চিন্তায় পড়ে গেছিলো মেঘ কিন্তু আজ ওর প্রতিক্রিয়া দেখে নিশ্চিন্ত হলো। আরিশের কাঁধে মাথা মেঘ বললো…

‘ বাব্বাহ! এতো কেয়ারফ্রী একটা মানুষ হুট করে এতকিছু ভাবতে শুরু করেছে?’

‘ ইয়াহ! গতকাল তুমি যখন বললে যে পজিটিভ এসেছে তখন থেকেই নিজের মধ্যে কেমন একটা আব্বু আব্বু ব্যাপার কাজ করছে ‘

‘ এতো প্যারা নেওয়ার কিছু নেই, দেখবে তুমি অনেক ভালো বাবা হবে ‘

মেঘ অবশ্য নিজেই নার্ভাস। নতুন একটা প্রাণ পৃথিবীতে আসছে, নতুন মা হিসেবে নার্ভাস হোয়াট স্বাভাবিক, তবুও আরিশকেও সাহস দিচ্ছে। বেচারা যে এখনই টেনশনে চুপসে গেছে!
_______________________________

আজ অয়ন ও তিশার বিয়ে, তিশার বাবা শর্ত দিয়েছিলেন ছেলে আগে ছয়মাস চাকরি করার পর তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন। সেই শর্ত অনুযায়ীই অয়নের চাকরির ছয়মাস পর বিয়ে হচ্ছে। বিয়েটা সিম্পলভাবেই হচ্ছে, ঘরোয়াভাবে। অয়ন বেচারা টেনশনে চুপসে গেছে, হাত পা কাঁপাকাপি অবস্থা। আরিশ মজার চলে বললো…

‘ কেনো রে! এখন কেনো হাঁটু কাঁপছে? আমার বিয়ের দিন কি করেছিলি মনে আছে? ওখানে বসে আমাকে নিয়ে কতো মজা করেছিলি!’

‘ ভাই! তুই কি প্রতিশোধ নিতে চাইছিস নাকি এখন? এগুলো পরে করিস, আমার এমনিতেই এতো টেনশন হচ্ছে ‘

‘ আরে চিল কর, এখন এতো প্যারা নিলে বিয়ের পর কি করবি?’

‘ আরিশ, পারলে আমাকে একটু সাহস দে! ভয় দেখাচ্ছিস কেনো?’

পাশ থেকে সুহানা বলে উঠলো…

‘ এটাই তো বিয়ের দিনের মজা, বিয়ের আগ মুহূর্তে অমন একটু আধটু চিন্তা হবেই ‘

সুহানা আর আরিশ মজা করছে, এদিকে বেচারা অয়ন চিন্তায় শেষ! একটু পরে তিশাকে নিয়ে আশা হলো, মেঘ সঙ্গে ছিলো। সবার নজর যদিও বধূর ওপরই ছিলো কিন্তু আরিশ ব্যস্ত ছিলো তার প্রিয়তমাকে দেখতে, মেঘের প্রেগনেন্সির ছয় মাস চলছে এখন! আগের থেকে স্বাস্থ্য অনেকটা ভালো হয়েছে, মুখে মাতৃত্বের ছাপ এসেছে। ল্যাভেন্ডার রঙের শাড়িতে কি দারুন লাগছে! আরিশ চোখই সরাতে পারলো না। তিশার পাশে বসেছিলো মেঘ। বিয়ে পড়ানোর মাঝে আরিশের দিকে তাকাতেই চোখ টিপলো আরিশ, মুচকি হাসলো মেঘ! বিয়ে পড়ানো শেষ হতে মেঘ গিয়ে একটা ফাঁকা ঘরে বসলো, এতো মানুষের ভিড়ে ভেতরে কেমন অস্থিরতা কাজ করছিলো ওর। এখন একটু ভালো লাগছে, ওই ঘরে আবার তিশার দুজন বান্ধবী বসেছিলো। আনিশা ওদের সঙ্গে কথা বলছিলো, হ্যাঁ আনিশাও এসেছে নিজের প্রথম ক্রাশের বিয়ে খেতে! মেঘ ওদের বললো…

‘ তোমরা গিয়ে খেয়ে নাও, অনেক দেরি হয়ে গেছে’

‘ ভাবী! জীবন কি অদ্ভুত তাইনা? দেখো আমি আমার ক্রাশের বিয়ে খাচ্ছি ‘

‘ এখনও আফসোস করো? তোমার মামাতো ভাই জানলে কষ্ট পাবে তো!’

‘ আরে না না, ওকে কেনো বলবো! তাছাড়া আমার ক্রাশ এখন অন্যের হাসবেন্ড, অন্যের স্বামীর দিকে আমার নজর দিতে বয়েই গেছে ‘

‘ গুড গার্ল, আচ্ছা যাও! এবার গিয়ে খেয়ে নাও, তোমার ভাইয়া বলেছে খাওয়া দাওয়া শেষ হলেই আমরা বাড়ি ফিরবো ‘

আনিশা ওখানে উপস্থিত বাকিদের নিয়ে খেতে চলে গেলো, মেঘ ফ্যানটা ফুল স্পিডে দিয়ে বসলো। ছয় মাসেই পেটটা অনেক উচুঁ হয়ে গেছে ওর, একটু হাঁটাচলা করলেই ক্লান্ত লাগে। তখনই আরিশ এলো, খাবার প্লেট হাতে নিয়ে…

‘ খাবার এখানে আনলে কেনো? টেবিলে বসেই খেতাম। এভাবে আলাদা খেলে সবাই কি ভাববে!’

‘ কে কি ভাবলো আই ডোন্ট কেয়ার! তুমি এখানে আরামমতো খাও ‘

‘ কিন্তু…’

‘ আর একটা কথা না, অনেকক্ষণ হলো না খেয়ে আছো! ওয়েট, আমি খাইয়ে দিচ্ছি’

‘ তুমি খেয়েছো?’

‘ হ্যা, আমি খেয়েই তোমার জন্যে নিয়ে এসেছি ‘

আরিশ মেঘকে খাইয়ে দিতে শুরু করলো, খাবার অর্ধেকটা শেষ হবার পরই পেটে হাত রেখে কুকিয়ে উঠলো মেঘ। ভয় পেয়ে গেলো আরিশ…

‘ আর ইউ ওকে?’

মেঘ কিছু না বলে আরিশের হাত থেকে প্লেট সরিয়ে রেখে ওর হাতটা নিজের পেটের ওপর ধরলো, একটু পরেই আরিশ বেবির কি’ক ফিল করলো। এতোদিন বেবি করলে আরিশ পেটে হাত রাখতেই আর কিক করতো না। মন খারাপ হয়ে গেছিলো আরিশের কিন্তু আজ প্রথমবার নিজের সন্তানের উপস্থিতি অনুভব করে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লো আরিশ! মেঘের উচুঁ পেটটায় ছোট্ট একটা চু’মু খেলো ও। মেঘ মুচকি হেসে বললো…

‘ মনে হচ্ছে খুব চঞ্চল হবে, তোমার মতো ‘

‘হলে মন্দ কি! আমি নিজের একটা মিনি ভার্সন পেয়ে যাবো’

মেঘের প্রেগন্যান্সির শুরুর দিকে আরিশ ভীষণ টেনশনে ছিলো যে ও কি পারবে ভালো বাবা হতে? আস্তে আস্তে বেবির প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে ওর। সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে শুরু করেছে মেঘ আরিশ দুজনেই!
______________________________________

তিন বছর পর….মেয়ের পিছু খাবার নিয়ে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে গেছে মেঘ। অবশেষে কোনরকম খাইয়ে শেষ করেছে, শাশুড়ির কাছে মেয়েকে দিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লো মেঘ। আরিশ মেঘের মেয়ে আনায়া, দু বছর বয়স এখন তার। একরত্তি মেয়েটা পুরোটা দিন সারাবাড়ি মাথায় তুলে রাখে, আরিশের চাওয়া ছিলো ওর মিনি ভার্সন! তাই হয়েছে, মেয়ে তার বাপের স্বভাব পেয়েছে। মেয়ের সঙ্গে দৌড় করতে করতে রীতিমত ক্লান্ত হয়ে যায় মেঘ! ওদের ফুল স্টাডি শেষ হয়েছে কিছুদিন হলো। আফজাল সাহেব ছেলেকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন এখনই ব্যবসার কাজে নজর দিতে হবে। আরিশও তাই মাঝে মাঝে এখন বাবার সঙ্গে অফিসে যায়, আজও গেছিলো কিন্তু দুপুরে চলে এসেছে। ফিরে এসে মেঘকে বিদ্ধস্ত অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলো…

‘ এভাবে পড়ে আছো কেনো!’

ক্লান্ত স্বরে মেঘ উত্তর দিলো…

‘ তোমার মেয়ে, আজকে খেতে গিয়ে সারা বাড়ি করিয়েছে আমাকে। আমি আর ওকে খাওয়াতে পারবো না, কয়েকদিন ওকে খাওয়ানোর দায়িত্ব তুমি নাও ‘

‘ ফাইন! আমি ওকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিলাম। তুমি এদিকে এসো, আমি একটু ঘাড়ে ম্যাসাজ করে দেই। ফ্রেশ লাগবে’

মেঘের প্রেগনেন্সির সময় আরিশ কয়েক ধরনের ম্যাসাজ শিখেছিলো, যা মেঘের প্রয়োজনে এখনও মাঝে মাঝে কাজে লাগায়। ঘাড়ে ম্যাসাজ করে দিতেই অনেক শান্তি লাগলো মেঘের!

‘ বুঝলে আরিশ, তোমার উচিত পার্সোনাল একটা ম্যাসাজ সেন্টার খুলে বসা ‘

‘ খুলতেই পারি, কিন্তু আমার কাস্টমার তো হবে সব মেয়ে। তুমি গিয়ে আবার তাদের সঙ্গে ঝগড়া করবে না তো!’

আরিশের কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে তাকালো মেঘ, এ কথা তো ভুলেই গেছিলো!

‘ আরে হ্যা! সত্যিই তো! না না দরকার নেই, তুমি আব্বুর ব্যবসাই সামলাও ‘

পুবের আকাশে কালো মেঘ করেছে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী তিনদিন ভারী বৃষ্টি হবে। আকাশ কালো হয়ে এসেছে দেখেই মেঘ দ্রুত বারান্দায় গেলো জামাকাপড় ঘরে আনতে, আরিশও ওকে হেল্প করলো। একটু পরেই শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, গ্রিলের বাইরে হাত বাইরে বৃষ্টিতে হাত ভিজিয়ে মেঘ বলে উঠলো…

‘ দেখো আরিশ বৃষ্টি হচ্ছে, বর্ষাকাল চলে এলো বলে! তোমার পছন্দের মৌসুম তো তাইনা?’

‘ তোমায় কে বললো আমার প্রিয় মৌসুম বর্ষাকাল?’

বিস্মিত হলো মেঘ!

‘ তাহলে! তোমার প্রিয় মৌসুম কোনটা? তোমার বৃষ্টি এতো পছন্দ বলে আমি তো ভাবতাম বর্ষাকাল তোমার পছন্দ ‘

‘ নাহ, আমার প্রিয় মৌসুম আমাদের বিয়েটা সময়টা ‘

‘ এখানে আমাদের বিয়ের কথা আসছে কেনো?’

‘ তোমার প্রশ্নের উত্তর দিলাম! ‘

‘ মানে? ‘

‘ আমার তেমন বিশেষ পছন্দের মৌসুম নেই, তবে তুমি যে সময় আমার জীবনে এলে সেটাই আমার জন্যে সেরা মৌসুম। আমার জীবনে আসা #প্রেমের_মৌসুম ‘

আরিশের কথা শুনে হেসে কুটিকুটি হলো মেঘ! ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরিশ…

‘ হাসছো কেনো!’

‘ আরিশ! সত্যিই, তুমি পারোও বটে। সবকিছুতে ফ্লার্ট না করলে চলে না?’

‘ ফ্লার্ট করলাম কোথায়?’

‘ অনেক ফ্লার্ট হয়েছে! ওঠো এবার, মেয়েকে ধরে নিয়ে এসো, গোসল করাতে হবে ‘

‘ ওকে ম্যাডাম!’

মেঘের কথা মতো মেয়েকে ধরে আনতে গেলো আরিশ, এবার রোজকার মতো মেয়েকে গোসল করানো নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে! অবশ্য আজ আরিশ যখন বাড়িতে আছে তখন আর অতো সমস্যা হবেনা, কারণ মেয়ে তার বাবার পাগল। মেয়ের দুষ্টুমি সঙ্গে তার বাবার হুটহাট বেড়ে যাওয়া ভালোবাসা নামক পা’গ’লা’মী দুয়ে মিলে বেশ চলছে মেঘের জীবন!

___ সমাপ্ত ___

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]