এলো প্রেমের মৌসুম পর্ব-৮+৯

0
2

#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ০৮

ডিনার টেবিলে এসে আরিশ দেখলো মেঘ রান্নাঘর থেকে একে একে সবকিছু এনে দিচ্ছে আর রেহানা বেগম টেবিল সাজাচ্ছেন। আরিশ চেয়ার টেনে বসতেই রেহানা বেগম বললেন…

‘ বুঝলি আরিশ, আজ মেঘনা আমাকে রান্নায় সাহায্য করেছে। ভাবছি আস্তে আস্তে রান্নার পুরো দায়িত্ব তোর বউয়ের হাতে দিয়ে দেবো ‘

‘ ওহ রিয়েলি? তারমানে তো আজকে ম্যাডাম অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে ‘

আরিশ এমন আহ্লাদী স্বরে কথাগুলো বললো, যে মেঘ নিজেই অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে নিলো! আফজাল সাহেব এবং আনিশাও এসে বসলো। মেঘ একে একে সবাইকে খাবার সার্ভ করে আরিশের কাছে আসতেই…

‘ম্যাডাম, আপনি বসুন এখানে। আপনাকে আজকে আর খাবার সার্ভ করতে হবে না ‘

আরিশ মেঘের হাত থেকে তরকারির বাটিটা নিয়ে ওকে টেনে নিজের পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজেই নিজের খাবার বেড়ে নিলো। ছেলের কর্মকাণ্ড দেখে আরিশের মা বাবা উভয়ই অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকালেন। আনিশা ভাইয়ের কান্ড দেখে মুখ চেপে হাসলো। শ্বশুর শাশুড়ির সামনে এমন করায় মেঘ কিছুটা বিব্রতবোধ করছে। কিছুটা রাগী স্বরে ফিসফিস করে আরিশকে বললো..

‘ কি করছো তুমি এটা?’

‘ আম্মুকে হেল্প করেছো বলে এপ্রিশিয়েট করছি। আম্মুকে হেল্প করতে গিয়ে নিশ্চয় অনেক এনার্জি লস হয়েছে তোমার। খাবার সার্ভ করতে গেলে আরো হবে, এরপর যদি দুর্বল হয়ে তুমি অজ্ঞান হয়ে যাও তখন কি হবে?’

চোখ গরম করে তাকালো মেঘ…

‘এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ‘

‘আমি তোমার কেয়ার করছি!’

ওদের দুজনের ফিসফিসানি দেখে আফজাল সাহেব গলা খেঁকিয়ে বলে উঠলেন…

‘কীরে, খাওয়া শুরু না করে কি ফিসফিস করছিস দুজনে? শুরু কর!’

‘হ্যা খাচ্ছি! তবে একটা কথা না বললেই নয়, আম্মুর মতো রান্না কেউই করতে পারবে না। মেঘনাও না, এটা আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি ‘

ছেলের কথা শুনে রেহানা বেগম জবাব দিলেন…

‘ভবিষ্যতে তো ওর হাতের রান্নাই খেতে হবে, তাই যেমনি হোক এই রান্না খাওয়ার অভ্যাসটা এখন থেকে করে নিতে হবে ‘

‘ আম্মু! তুমি রান্না বাদ দিও না প্লিজ! তোমার হাতের রান্না ছাড়া আমি খেতে পারবো না ‘

আফজাল সাহেব হেসে বলে উঠলেন…

‘ ওরকম মনে হয়, বিয়ের পর প্রথম প্রথম আমিও এমন ভাবতাম। এরপর তোর দাদী রান্নার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তোর মা চাচীর ওপর দিয়ে দিয়েছিলো, রান্না যেই করুক। পেট ভরানোটাই বড় বিষয় ‘

‘ তবুও বাবা, ওসব পরে দেখা যাবে। আপাতত আমার আম্মুর হাতের রান্নাই চাই।’

খাবার টেবিলে বাবা ছেলে মিলে মোটামুটি খোশগল্পে মজেছে, মেঘও বিষয়টা ইনজয় করছে কিন্তু ডান হাতের বুড়ো আংগুল কে’টে যাওয়ায় ঠিকমতো খাবার খেতে পারছে না। অনেক কষ্টে একটু একটু করে ভাত মেখে খাচ্ছে, খাওয়ার এক পর্যায়ে রেহানা বেগম মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন…

‘ আর তুই আনিশা, শুধু খেয়ে গেলে তো কাজ হবেনা মা। রান্নাটাও তো শিখতে হবে, নাহলে দুদিন পর পরের বাড়িতে গিয়ে রান্না না করতে পারলে তারা আমাকে কথা শুনতে হবে ‘

‘ আম্মু প্লিজ এখন না, ফাইনাল এক্সাম শেষ করে তারপর না হয়…’

‘ এরকম কতো ফাইনাল এক্সাম গেলো? কালকে থেকেই আমার সঙ্গে রান্নাঘরে আসবি। আগে দাঁড়িয়ে দেখবি, দেখতে দেখতে শিখে যাবি ‘

মায়ের কথা শুনে আনিশা অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকালো, মেয়ের করুন দৃষ্টি দেখে আফজাল সাহেব বললেন…

‘ এখনই এতো চাপের কি আছে? বাচ্চা মেয়ে, রান্না শেখার আরো সময় পাবে। এখন বাদ দাও ‘

‘ এই তোমার আস্কারা পেয়েই মেয়ের এই অবস্থা হয়েছে আজকে। তুমি দয়া করে আর কিছু বলো না, ওকে টুকটাক কাজ শিখতে দাও ‘

খেতে খেতে আরিশ বললো…

‘ হ্যা, সব কাজকর্ম জলদি শিখিয়ে দাও। এরপর বিয়ে দিয়ে এই আপদ বাড়ি থেকে বিদায় করে দাও। ছোটো থেকে আমাকে অনেক জ্বালিয়েছে, ও গেলে বাড়িটা ঠান্ডা হবে ‘

‘ অ্যাহ! শোন ভাইয়া, এতো তাড়াতাড়ি আমি বিয়ে করছি না বুঝেছিস? আর যদি বিয়ে করতে হয় তাহলে ঘরজামাই রাখবো আর তোর স্বপ্নে পানি ঢেলে দেবো। কি শখ আমাকে বাড়ি থেকে তাড়ানোর। বাবা, তোমার ছেলেকে কিছু বলো ‘

‘ বাবা কি বলবে? বিয়ে করে তো একদিন না একদিন যেতেই হবে তোকে ‘

দুই ভাইবোন মিলে খাবার টেবিলেই ছোটোখাটো এক তর্ক যুদ্ধ শুরু করে দিলো, রেহানা বেগম ধমকে দুটোকে থামালেন। বয়স বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু দুজনের পুরোনো ঝগড়ার অভ্যাস আর গেলো না। খাওয়া শেষে মেঘ রান্নাঘরে প্লেট ধুচ্ছিলো, তখন আনিশা এসে ওকে বলে..

‘ ভাবী! আমাকে রান্না শেখানোর দায়িত্ব তুমি নাও। তুমি আমাকে সময় করে শেখাবে ‘

‘ আমি? আমি নিজেই তো ভালোভাবে পারিনা, তোমাকে কি শেখাবো?’

‘ তুমি তো তাও পারো, আমি রান্নার ব্যাপারে একেবারেই ঢেঁড়স। আম্মুর কাছে রান্না শিখতে গেলে অনেক বকা ঝাড়ি খাবো। আমি ওটা চাইনা ভাবী, প্লিজ তুমি দায়িত্ব নাও। দরকার পড়লে আমরা রান্নার বই দেখে রান্না করবো ‘

‘ কিন্তু, পাকাপোক্তভাবে রান্না শিখতে গেলে তো আম্মুর থেকে শেখাটাই বেটার হবে। আমি যদি..’

‘ একটু ভুলত্রুটি হলে কিছু হবেনা, আমরা ম্যানেজ করে নেবো। প্লিজ ভাবী, তোমার একমাত্র ননদ প্রথমবার তোমার কাছে হেল্প চাইছে।’

‘ আচ্ছা বেশ, শেখাবো! কিন্তু তুমি তো একটু আগেও আপত্তি করছিলে, হঠাৎ রান্না শিখতে নিজে থেকেই রাজি হয়ে গেলে যে?’

‘ কারণ আছে একটা, তোমাকে একটা শর্তে বলতে পারি। কাউকে বলবে না তো?’

‘ আরে নাহ, নির্দ্বিধায় বলতে পারো ‘

‘ আমি আসলে একজনকে রান্না করে খাওয়াতে চাই, তাই ভাবলাম রান্না শিখলে আমারই লাভ হবে। আমারও শেখা হবে আর তাকে খাওয়ানোও হবে’

‘ আচ্ছা? বিশেষ কেউ নাকি?’

একগাল হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো আনিশা, ননদের মুখের হাসি দেখে মেঘ নিশ্চিত হয়ে গেছে তার কিশোরী ননদের জীবনেও মনেও প্রেমের হাওয়া লেগে গেছে!
____________________________________

সব কাজকর্ম সেরে রুমে এসে টানটান হয়ে শুয়ে পড়লো মেঘ। আরিশ কম্পিউটারে কিছু করছিলো। কিছুক্ষন বিশ্রাম শেষে উঠে বসে মেঘ বললো…

‘ আরিশ, আজ টেবিলে যেটা করলে সেটা কিন্তু ঠিক করোনি। ভবিষ্যতে আর এমন কিছু করো না ‘

‘ কী করলাম?’

‘ ওভাবে আমার হাত থেকে বাটিটা টেনে নিয়ে আমায় বসিয়ে দিলে, তোমার মা বাবা সামনে ছিলো সে খেয়াল আছে?’

‘ তাতে কি?’

‘ ওনারা কি ভাববে বলোতো?’

‘ কিছুই ভাববে না, উল্টে আমি বউয়ের কেয়ার করছি ভেবে আমার বাবা আরো খুশি হবে। আর তাকে খুশি করতে পারলেই আমার ক্রেডিট কার্ডের ব্যালেন্স বাড়বে ‘

‘ ক্রেডিট কার্ড ছাড়া তোমার জীবনে আর কিছু নেই নাকি! অদ্ভুত সব কথা বলো ‘

আরিশ এবার কম্পিউটার ছেড়ে মেঘের দিকে ঘুরে বসে প্রশ্ন করলো…

‘ তোমার হাতে কি হয়েছে?’

আরিশের প্রশ্নে অবাক হলো মেঘ, কেউ যাতে না বোঝে তার জন্য এতো আস্তে আস্তে খাবার খেয়েছে। শেষমেষ আরিশের চোখে পড়ে গেলো?

‘ ও তেমন কিছুনা, সবজি কাটতে গিয়ে লেগেছে ‘

‘ আম্মুকে হেল্প করতে গিয়ে হাত কে’টে ফেলেছো?’

‘ তাতে কি হয়েছে? রান্নাবান্না করতে গেলে টুকটাক আঘাত লাগে, স্বাভাবিক!’

‘ বুঝলাম কিন্তু উনি আম্মুকে বলোনি কেনো? আমি এখন গিয়ে বলে দেই? তাহলে আর তোমাকে রান্নায় সাহায্য করতে ডাকবে না ‘

‘ মানে কি! আম্মুকে কিছু বলবে না, আমার সিরিয়াস কিছুই হয়নি ‘

আরিশ একরাশ বিরক্তি নিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা ব্যান্ড এইড বের করে মেঘের কাছে এলো..

‘ হাত দেখি ‘

‘ আমাকে দাও, নিজেই লাগিয়ে নেবো’

‘ নিজে কি করেছো আর নমুনা দেখেছি, তোমার আর কিছু করতে হবেনা’

মেঘের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো আরিশ, অবাক চোখে চেয়ে আছে মেঘ। ও নিজে থেকে তো হাত বাড়ায়নি, তাই আরিশ নিজেই ওর আঙুল টেনে এনে ব্যান্ড এইড লাগিয়ে দিলো। মেঘ নীরবে আরিশকে দেখে যাচ্ছে, এই মুহূর্তে ছেলেটা কি সত্যিই আমার কেয়ার করছে? তখনই দূর আকাশ থেকে মেঘের গর্জন ভেসে এলো। আরিশ উঠে কম্পিউটার বন্ধ করে দিলো, মেঘ বিছানায় উঠে জানালার কাছে গিয়ে বসলো। অন্ধকার আকাশে ক্ষণে ক্ষণে শব্দহীন বিদ্যুতের ঝলকানির দৃশ্য দেখতে দেখতে বললো…

‘ আকাশে মেঘ ডাকছে, বৃষ্টি হবে হয়তো’

‘ তোমার বৃষ্টি পছন্দ?’

‘ হুমম! হুট করে বৃষ্টি এসে প্রকৃতিকে কি সুন্দর ভিজিয়ে দেয়। ভালোই লাগে ‘

‘ বৃষ্টিতে ভিজেছ? ‘

‘ হ্যাঁ, তবে অনেক ছোটবেলায়। বড় হওয়ার পর আর ভেজা হয়নি। আম্মু ভিজতে দিতো না আর কি’

‘ অনেক সুন্দর জিনিস মিস করেছো, বৃষ্টিতে ভেজার মাঝে অন্যরকম একটা আনন্দ আছে ‘

‘ হুমম, হয়তো! ‘

মেঘ আবারও বাইরের দিকে তাকালো, প্রকৃতির অদ্ভুত লীলাখেলায় মনোযোগ দিলো। ফুরফুরে হাওয়ায় মেঘের খোলা চুলগুলো উড়ছে, আরিশ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে এক ধ্যানে তাই দেখে যাচ্ছে। খোলা জানালা দিয়ে মাঝে মাঝে দমকা হওয়া এসে মেঘের চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে, মেয়েটা আবার সযত্নে চুলগুলো ঠিক করছে। আরিশ যেনো কোনো এক ঘোরের মধ্যে চলে গেলো মেয়েটাকে দেখতে দেখতে। হঠাৎই খুব জোড়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো, মেঘ ভয় পেয়ে দ্রুত জানালা বন্ধ করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। হাসলো আরিশ…

‘ বাজ পড়ছে বলে ভয় পেয়ে গেলে? তুমি বাচ্চা নাকি? ‘

‘ কতো জোরে শব্দ হলো দেখলে না? ‘

‘ ওহ কাম অন! বাজ পড়ল শব্দ হবেই’

‘ আজ রাতেও বোধহয় এমন হবে, আরিশ তুমি আজকে প্লীজ জানালার ওই পাশে ঘুমাও। আমাকে এদিকে ঘুমাতে দাও, ওই আওয়াজে আমার ভয় হয়’

‘ আমি আমার সাইড ছাড়বো না, আর যেদিকেই ঘুমাও। আওয়াজ তো আর কম হবেনা ‘

আরিশের কথায় যুক্তি আছে বলে মেঘ আর কিছু বলতে পারলো না, মাঝ রাতে খুব জোড়ে বৃষ্টি নামতে শুরু করে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই আরিশ অনুভব করলো কেউ হয়তো ওকে ঘেঁষে শুয়ে আছে, ও আধো ঘুমের ঘোরেই চেয়ে দেখলো মেঘ একেবারে ওকে ঘেঁষে গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজে হালকা কেঁপে উঠছে, ভয় থেকে এমন হচ্ছে বুঝে আরিশ আস্তে করে মেঘের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে ঘুমালো। লোকমুখে প্রচলিত যে, ঘুমের মধ্যে কেউ যদি ভয় পায় তাহলে তাকে কেউ স্পর্শ করে রাখলে ভয়টা কেটে যায়। আরিশও সেই পন্থাই অবলম্বন করলো। ভোরের দিকে মেঘ একটু জেগে গেছিলো। চোখ খুলে যখন নিজেকে আরিশের বালিশে একদম ওর সঙ্গে ঘেঁষে শোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করলো কিছুটা অবাক হলো, তার ওপর যখন দেখলো আরিশ ওর হাত ধরে রেখেছে তখন রীতিমতো চমকে উঠলো! বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজে ভয় পায় মেঘ, বাড়িতে থাকলে এরকম পরিস্থিতিতে দুই বোন একদম জড়াজড়ি করে ঘুমাতো। এখানে সে সুযোগ ছিলো না কিন্তু ঘুমের মধ্যে নিজেই যে আরিশের দিকে চলে এসেছিলো তা বুঝতে বাকি নেই মেঘের। হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে উবু হলো মেঘ। কিন্তু আরিশ এমন শক্ত করে ধরে রেখেছে যে ছাড়াতে গেলে হয়তো জেগে যাবে। হাত ছাড়ানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে মেঘ আরিশের দিকে নজর দিলো। ঘুমন্ত অবস্থায় এলোমেলো চুলে এ মুহূর্তে আরিশকে একদম বাচ্চা লাগছে। মুচকি হাসলো মেঘ, ওর এলোমেলো চুলে অনেকদিন ধরেই হাত বোলানোর ইচ্ছা ছিলো মেঘের কিন্তু সুযোগ পায়নি। আজ সুযোগ পেয়েই আলতো হাতে ছুঁয়ে নিলো আরিশের এলোমেলো চুলগুলো!

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]

#এলো_প্রেমের_মৌসুম
#লেখনীতে – #Kazi_Meherin_Nesa
#পর্ব – ০৯

আজ দুপুরে আনিশা মেঘের কাছে সিঙ্গারা বানানো শিখতে আবদার করলো, মেঘ সিঙ্গাড়া বানাতে পারে তাই শেখাতে রাজি হয়ে গেলো। প্রথমে সিঙ্গারার ভেতরের পুরটা আগে বানিয়ে নিলো মেঘ, আনিশা মনোযোগ দিয়ে দেখে নিলো। এরপর ময়দা মাখতে হবে, তো রান্নাঘরে কৌটায় ময়দা ছিলো না…

‘ এখানে তো ময়দা নেই ‘

‘ স্টোররুমে আছে ‘

‘ আমি গিয়ে নিয়ে আসছি, তুমি আলুটা একটু নেড়েচেড়ে দিয়ে। দেখো, আবার যেনো পুড়ে না যায়। একটু পরে নামিয়ে দিও’

‘ আচ্ছা ‘

মেঘ স্টোররুমে গিয়ে দেখলো ময়দার কৌটা অনেক ওপরে রাখা, ওখান থেকে নামাতে পারবে না। পরে ও রুমে গেলো, উদ্দেশ্য আরিশকে দিয়ে কৌটা নামাবে। আরিশ তখন গেম খেলায় ব্যস্ত।

‘ আরিশ, স্টোররুম থেকে ময়দার কৌটাটা নামিয়ে দাও। অনেক ওপরে রাখা, আমি নামাতে পারবো না’

‘ আমাকে গেমটা শেষ করতে দাও আগে ‘

‘ গেম তুমি পাঁচ মিনিট পরেও খেলতে পারবে, আমাকে আটা নামিয়ে দাও আগে ‘

আরিশ খেলায় এমনভাবে মগ্ন হয়ে আছে যে ওঠার নাম নেই, মেঘ ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বললো…

‘ আরিশ ওঠো!’

‘ পাঁচ মিনিট ‘

মেঘ আজকেও কম্পিউটার বন্ধ করতে যাচ্ছিলো কিন্তু আরিশ ওর হাত ধরে ফেলে..

‘ মেঘনা! ডোন্ট ইউ ডেয়ার!’

‘ ভালোভাবে বলছি, শুনছো না কেনো?’

মেঘ বুঝলো আরিশ আসবে না, তাই নিজেই চলে গেলো। স্টোররুমের লাইট হুট করে বন্ধ হয়ে গেছে, কে’টে গেছে হয়তো। মেঘ দরজা পুরোটা খোলা রেখেই পাশ একটা টুল আনলো। টুলের উপর উঠে হাত বাড়িয়ে কৌটা আনতে যাচ্ছিলো কিন্তু হাত ঠিকঠাক পৌঁছাচ্ছিল না, এরই মাঝে অন্ধকার ঘরে কারো ছায়া পড়লো। তা দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠে, পেছনে ঘুরে দেখতে গিয়ে পা পিছলে টুল থেকে সোজা আরিশের ওপর পড়ে যায় মেঘ! হ্যাঁ, ছায়াটা আরিশেরই ছিলো। ফ্লোরে পড়ে আরিশ পিঠ – কোমড়ে ব্যথা পেলো, মেঘ আরিশের বুকের ওপর থেকে মাথা তুলে প্রশ্ন করলো…

‘ আর ইউ ওকে?’

আরিশ উত্তর দিলো না ঠিকই তবে চোখমুখ দেখে মেঘ বুঝেছে যে ও ব্যথা পেয়েছে….

‘ তুমি! এরকম ভূতের মতো এসে দাড়িয়ে ছিলে কেনো?’

ধমকে উঠলো আরিশ…

‘ দাঁড়াতে পারলাম কোথায়? তার আগেই তো আমার ওপর পড়লে। তুমি বাচ্চা নাকি? এইভাবে চিৎকার করলে কেনো?’

‘ তুমি কথা না বলে চুপ করে এসেছো কেনো? আমাকে ভয় দেখাতে চেয়েছিলে?’

‘ তোমাকে আলাদা করে ভয় দেখাতে হবে নাকি? তুমি তো এমনিতেই ভীতু, সামান্য ছায়া দেখে ভয় পাও’

আরিশের সঙ্গে এক দফা তর্ক শুরু হয়ে গেলো মেঘের, এদিকে মেঘের আসতে দেরী হচ্ছিলো বলে আনিশা চুলা বন্ধ করে স্টোররুমে এলো। এসে দেখলো আরিশ নিচে পড়ে আছে আর ওর ওপর মেঘ। সঙ্গে সঙ্গে আনিশা চোখ বন্ধ করে নিলো। লজ্জা পাওয়ার ভান করে বললো…

‘ ওহ সরি! আমি বোধহয় রং টাইমে এসে গেছি। আই অ্যাম রিয়েলি সরি!’

আনিশার গলা শুনে দুজনেই থতমত খেয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো, আনিশা ওদের দুজনকে দেখে মুচকি হাসছে দেখে আরিশ ধমক দিয়ে প্রশ্ন করে…

‘ হাসছিস কেনো?’

‘ কিরে ভাইয়া! ভালোই, স্টোররুমে রোমান্স শুরু করে দিয়েছিস দেখছি। কিন্তু তোর এতো সুন্দর রুম থাকতে এখানে কেনো?’

‘বেশি পাকামো করিস না আনিশা ‘

‘ পাকামো কোথায় করলাম ভাইয়া? যা দেখলাম তাইতো বলছি, আচ্ছা। আমাকে ময়দার কৌটো দিয়ে দে, আমি নিয়ে যাই এরপর তোরা কন্টিনিউ কর কেমন?’

‘আনিশা, তুমি ভুল বুঝেছো! এমন কিছু হয়নি, আসলে আমি…’

‘ ইটস ওকে ভাবী! এক্সপ্লেইন করতে হবে না, ভাইয়া জলদি দে তো ‘

‘ আমাকে জ্বালানোর জন্যে বাড়িতে আগে এক তুই ছিলি এখন আরেকজন এসে জুটেছে!’

‘ আমাকে বললে নাকি?’

আরিশ রেগে একনজর মেঘের দিকে তাকিয়ে ময়দার কৌটো নামিয়ে আনিশার হাতে দিতেই আনিশা দ্রুত পায়ে চলে এলো। আরিশকে কোমড়ে হাত বুলাতে দেখে মেঘ প্রশ্ন করলো…

‘ তোমার কোমড়ে লেগেছে?’

‘ তোমার যে ওজন, একটু বেশি করে খাওয়া দাওয়া করো। নাহলে একটু জোরে হাওয়া দিলেই উড়ে যাবে’

‘ এক্সকিউজ মি! তুমি আমাকে ইনসাল্ট করছো?’

‘ না, প্রশংসা করছি!’

আরিশ গা ঝাড়া দিয়ে চলে গেলো, মেঘ নিজের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো। একটু শুকনো বলে আরিশ এভাবে অপমান করলো?
_____________________________________

ক্লাব হাউজে বসে আছে আরিশ, সঙ্গে অয়ন ও সুহানা। সুহানার বাবা ওর পছন্দের ছেলেকে বাদ দিয়ে অন্য জায়গায় জোর করে বিয়ে দিতে চাইছে। এই নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছে মেয়েটা। সুহানার প্রেমিক জয়, পেশায় একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। মোটামুটি একটা স্যালারি পায়। কিন্তু সুহানার বাবার মেয়ের জন্যে হাই সোসাইটির ছেলে পছন্দ, উনি মেয়ের সঙ্গে বিয়ের জন্যে ছেলেও ঠিক করে ফেলেছে। জয়কে ওনার কিছুতেই পছন্দ নয়। এখন কিভাবে বাড়িতে ম্যানেজ করে জয়কে বিয়ে করবে সেটা বুঝে উঠতে পারছে না সুহানা, বিগত কয়েকদিন ধরে এসব ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারেনি। আজ সময় পেয়ে এসেছে বন্ধুদের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে…

‘ বাবাকে কিছুতেই ম্যানেজ করতে পারছি না, জয়কে সে মানতেই রাজি না। উল্টে আমাকে বলেছে আমি বেশি জেদ করলে আমাকে বাড়িতে আটকে রেখে বিয়ে দেবে ‘

‘ এ তো সিরিয়াস ব্যাপার হয়ে গেলো, মনে হচ্ছে আঙ্কেল তোকে ধরে বেঁধে দিয়ে দিয়েই ছাড়বে

‘ আম্মুকে তাও রাজি করানো যায় কিন্তু তাকে রাজি করিয়ে তো লাভ নেই, বাবা রাজি না হলে কিছুই সম্ভব না ‘

‘ তুই ভাবিস না, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে ‘

অয়ন ও সুহানার কথোপকথনের মাঝে হুট করে আরিশ বলে বসলো…

‘ আমি একটা ভালো উপদেশ দেই? বিয়ে করিস না।’

‘ কেনো করবো না?’

‘ বিয়ে করেই লাভটা কি হচ্ছে? সিঙ্গেল জীবনের স্বাধীনতা, সুখ, শান্তি উপভোগ করতে চাইলে বিয়ে করিস না একদম! আমি পস্তাচ্ছি। আমাকে দেখ, বিয়ে করেছি পর একটা গেমও শান্তিতে খেলতে পারিনা মেঘনার জন্যে। প্রতিবার এসে বাঁধা দেয়’

আরিশের কথায় অয়ন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো…

‘ কি বলিস? তুই আবার বউকে দেখে ভয় পেতে শুরু করলি কবে?’

‘ কি বাজে বকছিস, আমি ওইটুকু একটা মেয়েকে দেখে ভয় পাবো কেনো?’

‘ না মানে তুই বলছিস ও এসে তোর গেমে বাঁধা দেয়, ও বাঁধা দিলেই তুই খেলা বাদ দিয়ে দিস? তার মানে তো এটাই দাড়ায় তুই ওকে ভয় পাস ‘

‘ আমার দুঃখ তুই বুঝবি না অয়ন, তুই তো আর বিয়ে করিসনি। বিয়ের পর এসে আমার সঙ্গে কথা বলিস। তখন দুঃখ ভাগাভাগি করবো আমরা দুজন ‘

‘ কীরে ভাই! তুই তো বিয়ের প্রতি আমার কনফিডেন্স লো করে দিচ্ছিস। নাহ, তোর মত বন্ধুর সঙ্গে থাকলে আমার আর বিয়ে করা হবেনা ‘

‘ ওহ স্টপ ইট গাইজ! আমি এখানে টেনশন করছি আর তোরা মজা করছিস?’

‘ আই অ্যাম সিরিয়াস সুহানা!’

‘ আরিশ! কোথায় তুই আমাদের চিন্তা দূর করার জন্য ভালো কিছু বলবি তা না করে ভয় দেখাচ্ছিস কেনো?’

‘ ভয় দেখাচ্ছি না আমি সুহানা! অ্যাজ অ্যা ম্যারেড পার্সন, নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি’

‘ তুই অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করেছিস, তোদের সম্পর্ক জুড়তে তো সময় লাগবেই তাইনা? কিন্তু আমাদের ব্যাপার তো আলাদা, জয়কে আমি এতো বছর ধরে ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবতেও পারিনা ‘

‘ প্রেম করছিস কর, আমি এখন বিয়ে করতে মানা করছি ‘

‘ দুদিন পরে হলেও বিয়ে করতেই হবে, এখন করলে সমস্যা কি! তাছাড়া আমারও কি ইচ্ছে ছিলো এখন বিয়ে করার? বাবার চাপে পড়ে বাধ্য হচ্ছি করতে ‘

‘ আচ্ছা, আমরা গিয়ে আংকেলের সঙ্গে একটু কথা বলে দেখবো? কি বলিস আরিশ, আমাদের যাওয়া উচিত?’

‘ মনে হয় না তাতে কোনো লাভ হবে, আঙ্কেল ভাববে আমরা জয়ের হয়ে সাফাই গাইতে গেছি ‘

‘ তাহলে এখন কি করবো আরিশ? আমার তো বাসায় গেলেই ভয় লাগে। কখন যেনো জোর করে ধরে বলবে বিয়ে করে নে। তোরা প্লিজ একটা উপায় বল, কি করা যায়?’

‘ সবচেয়ে সহজ উপায় এখন একটাই, তোরা রাজি থাকলে আমরা হেল্প করতে পারি ‘

‘ জয়কেই আমি বিয়ে করতে চাই আর তার জন্যে যা করার আমি করবো, জয়ও আমার সিদ্ধান্তেই রাজি!’

‘ ওকে, দ্যান আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান ‘

‘ কি প্ল্যান?’

আরিশ সুহানাকে একটা বুদ্ধি দেয়, যদিও সুহানা এটা নিয়ে কনফিউজড। আদৌ এমন কিছু করা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অনুযায়ী আরিশের কথাটাই ঠিক মনে হচ্ছে! বন্ধুদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর বাড়ি ফেরে আরিশ। বিছানার ওপর মেঘের ব্যাগ দেখে বুঝলো ও বাড়ি ফিরেছে, সময়মতো সন্ধ্যায়ই ফিরে এসেছে দেখে যেনো কিছুটা স্বস্তিবোধ করলো আরিশ। হাতমুখ ধুয়ে আরিশ একটু বিশ্রাম নিতে বসেছে তখন বাইরে থেকে এলো মেঘ…

‘ তুমি এসে গেছো? এই নাও!’

ছোটো একটা প্যাকেট আরিশের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে দিলো…

‘ এটা কি?’

‘ নিমকি এটা। চেনো তো নাকি?’

‘ আমি ভিনগ্রহের প্রাণী নই যে নিমকি চিনবো না ‘

‘ গুড! তাহলে খেয়ে দেখো, অনেক মজা ‘

‘ এগুলো বাসায় কে আনলো?’

‘ আমি এনেছি, আসলে আজ তো কোচিং সেন্টারে আমার ফার্স্ট ডে ছিলো। আই ওয়াজ ভেরি নার্ভাস, তখন নিহান আমাকে এগুলো খাওয়ার জন্যে দিয়েছিলো। পরে আসার সময় আমি বাড়ির সবার জন্যে কিনে এনেছি ‘

মেঘের কথা শুনেই আরিশের যেনো রাগ হলো। প্যাকেটটা থেকে অনেকগুলো নিমকি একসঙ্গে উঠিয়ে খেতে শুরু করতেই মেঘ ঠোঁট উল্টে বললো…

‘ আরে! এগুলো আমি আমার জন্যে এনেছিলাম, তুমি এতগুলো নিলে কেনো?’

‘ তুমিই তো খেতে দিলে ‘

‘ তোমাকে একটা টেস্ট করার জন্য দিয়েছি, পুরোটা দিয়েছি বলিনি। তোমার খাওয়ার ইচ্ছে হলে রান্নাঘরে বয়ামে রেখেছি, ওখান থেকে খাও ‘

‘ এই আমাকে খেতে বললে এখন আবার মানা করছো! আমার মনে হয় তোমার মাথায় সমস্যা আছে ‘

‘ জ্বি নাহ! তোমার বোঝার সমস্যা আছে ‘

ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরিশ, হাতে যে কয়টা ছিলো ওগুলো আবার মেঘের প্যাকেটে ফেরত দিয়ে দিতেই ঠোঁট চওড়া করে হাসি দিলো মেঘ…

‘ থ্যাংক ইউ!’

‘ তোমরা দুজনে একসঙ্গে বসে খেয়েছো?’

‘ হুমম! ক্লাস শুরুর আগে কিছু আলাপ আলোচনা করে নিচ্ছিলাম। জানো, ক্লাসের সবাই অনেক ফ্রেন্ডলী, আমি ভেবেছিলাম আমাকে কিভাবে না কিভাবে অ্যাকসেপ্ট করবে। এসব নিয়ে আলাপ করতে গিয়েই তো চা আর নিমকি খেলাম ‘

‘ টি – ডেট করতে গেছো না পড়াতে?’

‘ ডেট করতে যাবো কোন দুঃখে?’

‘ দুঃখে কেনো? সুখেই ডেট করবে ‘

‘ কি বলছো এসব! আমি কেনো নিহানের সঙ্গে ডেট করবো? আফটার অল, আই অ্যাম অ্যা ম্যারেড গার্ল। পরপুরুষের সঙ্গে ডেট কেনো করবো!’

কোচিং সেন্টারে গিয়ে নিহানের সঙ্গে বসে রোজই চা খাবে ভেবে আরিশের রাগ হয়েছিল বটে, তবে মেঘের কথাটা শোনামাত্রই সব রাগ উবে গেলো। মুচকি হাসলো আরিশ!

চলবে…

[ভুলত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন…!!]