এ তুমি কেমন তুমি পর্ব-১২

0
511

#এ_তুমি_কেমন_তুমি
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্ব-১২

হসপিটাল থেকে বাড়ি আনা হয়েছে ফারহানকে। সে সুস্থ আছে তবে মাথায় আঘাত আর এতদিন কোমায় থাকায় মস্তিষ্ক পুরোপুরি সচল হয়নি। সবকিছু মনে পড়েনি, ডক্টর বলেছে সবার সাথে থাকলে ধীরে ধীরে সব মনে পড়ে যাবে। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে ফারহান। বিরক্ত লাগছে তার, অনেক কিছু মনে পড়েও পড়ছে না আবার কিছু কিছু স্মৃতি ধোঁয়াশার মতো লাগছে। ফরহান মনে করার চেষ্টা করছে তার এক্সিডেন্ট কীভাবে হয়েছিল। কিন্তু কিছু ধোঁয়াশা স্মৃতি ভেসে উঠছে চোখের সামনে। অনু ফারহানের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো ফারহান কী করছে। শুয়ে আছে দেখে চলে যেতে নিবে তখনই ফরহান দেখে ফেললো অনুকে।

কে ওখানে?

অনু থেমে গেলো ফারহানের কথা শুনে। ধীরে ধীরে সামনে এসে দাঁড়ালো ফারহানের। ফারহান অনুকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিলো।

অনুর ভীত মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, “কে তুমি?”

অনু অবাক চোখে তাকালো ফারহানের দিকে। ফারহান তাকে চিনতে পারছে না। কোথাও একটু কষ্ট হলো অনুর, যদিও জানে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে, তবু কষ্ট হচ্ছে।

ফারহান মৃদু আওয়াজে ধমকে উঠলো, “এই মেয়ে কথা বলছো না কেনো?”

রসগোল্লার মতো চোখে ফারহানের দিকে তাকালো অনু, “সব ভুলে বসে আছে কিন্তু ধমক দিতে ভুলেনি।”

“এই মেয়ে বিড়বিড় করে আবার কী বলছো?”

ভেঙে ভেঙে অনু উত্তর দিলো, “কিছু না।”

“কে তুমি, তোমাকে আমার এত চেনা চেনা লাগছে কেনো?”

অনু ছোট করে উত্তর দিলো, “অনু।”

ফারহান অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো অনু দিকে, “অনামিকা।”

চমকে উঠলো অনু, “আপনার সব মনে পড়ে গেছে।”

“কী মনে পড়বে?”

“কিছু না আপনি রেস্ট করুন, আমি আসছি এখন।”

অনু চলে যেতে নিলে ফারহান বললো, “আমার রুমে ভালো লাগছে না। আমাকে একটু বাইরে নিয়ে যাবে।”

অনু তাকালো ফারহানের দিকে। খুব অসহায় দেখাচ্ছে ফারহানকে। বড্ড মায়া হলো অনুর।

অনু বাইরে তাকিয়ে দেখলো সন্ধ্যা নেমে আসবে, “এখন কোথায় নিয়ে যাবো। একটু পরই সন্ধ্যা হয়ে যাবে।”

ফারহান নিজের মাথার চুল খামচে ধরে বললো, “জানি না। আমার এই রুমে দম বন্ধ হয়ে আসছে, মাথা যন্ত্রণা করছে।”

অনু এগিয়ে এসে ফারহানের হাত ধরে বললো, “চলুন।”

ফারহান একটা শব্দও করলো না। নিরবে অনুর সাথে যেতে লাগলো। অনু ফারহানকে নিয়ে ওদের ছাঁদে চলে এলো। সূর্যটা ততক্ষণে টকটকে লাল হয়ে গেছে। ফারহানদের ছাঁদটা পুরো সবুজে সবুজে ভরা। অনু ফারহানকে নিয়ে ছাঁদের পশ্চিম দিকে চলে গেলো।

হাত উঁচু করে দূরের সূর্যটাকে দেখিয়ে বললো, “দেখুন আকাশটা কত সুন্দর হয়ে উঠেছে।”

অনুর মুগ্ধ দৃষ্টি সূর্যের দিকে হলেও ফারহানের দৃষ্টি রক্তিম আলোয় রাঙা অনুর দিকে।

ফারহান অনুর দিকে দৃষ্টি রেখে বললো, “সত্যি অপরুপ।”

১৮.
ফারহানের চোখে ভেসে উঠলো ঝাপসা এক স্মৃতি। আকাশী-নীল রঙের ড্রেসে একটা মেয়ে দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে। তার কালো মেঘের মতো চুলগুলোও দোল খাচ্ছে বাতাসে। মেয়েটার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। সে যেনো বন্য কোনো ঝর্ণা। মাথায় একটু চাপ দিতেই পুরো ঘটনা মনে পড়তে লাগলো ফারহানের। এমনই এক সন্ধ্যায় অনু ছাদে দাড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখছিলো। প্রকৃতির মাঝে এতটাই ডুবে গিয়েছিলো পাশের ছাদের একদল ছেলে তার দিকে তাকিয়ে আছে সে খেয়ালই করেনি। ফোনে দরকারী কথা বলতে বলতে ফারহান ছাদে এসে অনুকে দেখে প্রথমে মুগ্ধ হলেও পরে ছেলেগুলোকে দেখে রেগে যায়। এগিয়ে যায় অনুর দিকে। নিজের দিকে ঘুরিয়ে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় গালে। থাপ্পড়ের আওয়াজে অনুর সাথে পাশের ছাদের ছেলেগুলো কেঁপে উঠে।

অনু গালে হাত রেখে হতভম্ব হয়ে তাকায় ফারহানের দিকে, “ভাইয়া?”

ফারহান রেগে দাঁত খিঁচিয়ে বলে, “কী ভাইয়া হ্যা? এখানে কী রুপ দেখাতে এসেছিস? বেহায়ার মতো মাথার ওড়না ফেলে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? এই জন্য খালামণির বাসায় আসার জন্য এত লাফাচ্ছিলি?”

কান্নাভেজা গলায় অনু বললো, “এসব কী বলছেন ভাইয়া?”

রাগের পরিমাণ বাড়লো ফারহানের, “আরেকটা থাপ্পড় গালে পড়ার আগেই নিচে যা। এখনই বাসায় যাবি আমার সাথে, আমি আসছি।”

অনু গালে হাত দিয়ে দৌড়ে নিচে চলে গেলো। ফারহান পকেটে হাত রেখে এবার ছেলেগুলোর দিকে তাকালো। এতক্ষণ ফারহান আর অনুর কথা শুনলেও এবার ফারহানকে তাকাতে দেখে ভয় পেয়ে গেলো। ছেলেগুলোর বয়স অনু মতোই হবে।

ফারহান শান্ত গলায় বললো, “ছবি ডিলিট করো।”

একটা ছেলে ভয়ে ভয়ে বললো, “ছবি তুলিনি ভাইয়া।”

যে ছেলেটার বাসার ছাদ তাকে উদ্দেশ্য করে ফারহান বললো, “তোমার আব্বুকে কথাটা জানালে ফলটা ভালো হবে না। তোমাদের সবগুলো ফোন ভেঙে ফেলতে আমার কয়েক মিনিট সময় লাগবে।”

ছেলেটা বন্ধুর ফোন কেঁড়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি ছবি ডিলিট করে দিলো, “সরি ভাইয়া ভুল হয়ে গেছে।”

ফারহান চলে যেতে গিয়ে আবার ঘুরে তাকালো, “ক্যাকটাস ফুলগুলো দেখতে সুন্দর হলেও থাকে বিষাক্ত কাঁটায় ঘেরা। ফুল ছুঁতে গেলে মৃত্যুও হতে পারে।”

ছেলেগুলোকে নিরব হুমকি দিয়ে ফারহান নিচে এসে অনুকে খুঁজতে লাগলো। আয়াতের জন্মদিনে সবাই তানিশাদের বাসায় এসেছে। বাসায় অনেক মানুষ থাকায় অনু ছাদে গিয়েছিল আর সেখানেই এই কাহিনি। ফারহান অনুকে খোঁজে পেলো তানিশার বেলকনিতে দোলনায়। সে যেনো এক মায়াবিনী।

“চলুন নিচে যা-ই, সন্ধ্যা হয়ে গেছে।”

অনুর ডাকে ফারহানের অতীত বিচরণ সমাপ্ত হলো। অনুকে চিনতে আর অসুবিধা হলো না তার। অনু চলে যেতে নিলে ফারহান হাত টেনে ধরলো। অনু অবাক চোখে তাকালো ফারহানের দিকে।

“তুই সেই রাতে আমার ফোন রিসিভ করিসনি কেনো অনামিকা?”

অনু অবাক হবে নাকি খুশি হবে বুঝতে পারছে না, “আপনার মনে।”

ফারহান এক টানে অনুকে নিজের কাছাকাছি এনো দাঁড় করালো, “হ্যাঁ মনে পড়ে গেছে। এখন বল সেই রাতে ফোন কেনো রিসিভ করিসনি।”

অনু কাঁপা গলায় বললো, “কবে?”

“যে রাতে আমার এক্সিডেন্ট হয়। আমি বারবার তোকে কল দিচ্ছিলাম আর ড্রাইভ করছিলাম। পাশ থেকে আসা গাড়ি খেয়ালই করিনি। তুই কল রিসিভ করলে হয়তো এমন হতো না।”

“আমার ফোন বেলকনিতে ছিল। আমি কী করে জানবো আপনি আমাকে কল দিবেন?”

“এখন আমার জীবনের ছ’মাস ফিরিয়ে দে।”

অনু করুন দৃষ্টিতে তাকালো ফারহানের দিকে, “সেটা কীভাবে সম্ভব?”

“তাহলে তোর বাকি জীবনটা আমাকে দিয়ে দে।”

অনু মায়াবী দৃষ্টিতে তাকালো ফারহানের দিকে, “ভালোবাসেন আমাকে?”

ফারহানও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনুর দিকে,”তুই ভালোবাসিস আমাকে?”

অনু মুচকি হাসলো, “যদি বলি না।”

ফারহানও বাঁকা হাসলো, “তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। হয় তুই আমার জীবনের ছ’মাস ফিরিয়ে দিবি। নাহয় তোর বাকি জীবন আমাকে দিবি।”

সেলিনা জুনায়েদের উদ্দেশ্যে বললো, “ভাইয়া অনু আর ফারহানের বিষয়টা নিয়ে এবার মনে হয় চিন্তা ভাবনা করা দরকার।

জুনায়েদ লম্বা শ্বাস টেনে বললো, ” ফারহান কেবল এতবড় একটা বিপদ থেকে উঠলো। ও সুস্থ হোক, আবার অফিস জয়েন করুক। ওর সাথে আগে ভালোভাবে কথা বল, ও কী চায়। আমি চাই না আবারও কোনো ঝামেলা হোক।”

সেলিনা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, “আমি মা হয়ে ছেলের মনের কথা বুঝতে পারিনি কোনোদিন। যার জন্য আজ আমার ছেলে দু’টোর জীবন এমন। বড় ছেলে তার ভুল শুধরে নিয়েছে এবার ফারহান নিজেকে সামলে নিলে আমার শান্তি।”

দেখতে দেখতে আরও কিছুদিন কেটে গেলো। ফারহান পুরোপুরি সুস্থ হয়ে নিজের আগের অফিসেই জয়েন করলো। ড্রাইভ করতে এখনো কিছুটা ভয় কাজ করে তাই ড্রাইভার রাখা হয়েছে।

১৯.
কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে ড্রয়িংরুমে মানুষ দেখে অবাক হলো লিজা। এতগুলো অপরিচিত মুখ দেখে অবাক হওয়ারই কথা। লিজা কিছু বুঝে উঠার আগেই তার মা তাকে টেনে রুমে নিয়ে গেলো।

লিজা বললো, “এত মানুষ এলো কোথা থেকে?”

লাবণি বললো, “তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে শাড়িটা পড়ে নে।”

লিজার বুঝতে বাকি রইলো না তার মা জেদের বশে এসব শুরু করেছে। মায়ের দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকালো লিজা।

“একবার শুধুমাত্র তোমার জন্য আমি অপমানিত হয়েছি মা। তুমি আবার শুরু করেছো?”

লাবণি ধমক দিয়ে বললো, “আমি মা হয়ে তোর খারাপ চাই না নিশ্চয়ই। যা করছি তোর ভালোর জন্যই করছি। ছেলে ডক্টর ফারহানের থেকেও যোগ্য পাত্র আর সবচেয়ে বড় কথা ছেলে নিজেই তোকে পছন্দ করে পরিবার নিয়ে এসেছে।”

চলবে,,,