এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব-১৮+১৯

0
1391

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৮

নিভ্রানের মলিন ঠোঁটের কোণায়ও হুট করেই একটুকরো হাসি এসে হাজিরা দিয়ে গেলো।সামনের বসা অতি সাধারণ মেয়েটার অসাধারণ সারল্যতার ঘনবর্ষণে সিক্ত হয়ে উঠলো এতক্ষনের রুক্ষ,অশান্ত,বেদনায় জর্জরিত মনটা।কি নিদারুন কটুক্তিহীন বাক্যগুলো,”আমিতো পরে আগে তো আপনার মা।তাইনা?” লুকোনো হাসিটা ছোট্ট করে চারপাশে ছড়িয়ে দিয়ে একহাঁটুতে ভর দিয়েই অর্ধেক উঠে গেলো সে।রাত্রির বামগালে স্বস্নেহে হাত রেখে মাথাটা আলতো করে চেপে ধরলো বুকের মধ্যিখানটায়।এত মায়ামাখা এই দৃশ্যটা।রাত্রি চুপ হয়ে গেলো মূহুর্তেই।এই সময়টা,এই মূহুর্তটা,যখন যখন সে লোকটার বুকে মাথা রেখেছে,হাতে হাত বেঁধেছে,কাছাকাছি এসেছে সেই সবগুলো শুভক্ষণ তার গোনায় গোনায় মুখস্ত।নাম,তারিখ,স্হান সহ মুখস্ত।অজানা এক শান্তিতে আঁখিপল্লব নেতিয়ে গেলো।বুজে এলো চোখ।
নিভ্রান মোলায়েম স্বরে বললো,
—“তাইতো,মা ই তো আগে।মাকে কষ্ট দেয়াটা আমার উচিত হয়নি বুঝলাম।কিন্তু মা যে আমার রাতকে ওসব বললো তা কি ঠি ক?”

রাত্রি চুপ করে রইলো।সে জানে জবাবটা “না”।কিন্তু এই কথাটা বলে এখন নিভ্রানের রাগটা আরো চড়িয়ে দেয়াটা সমীচিন মনে হলোনা কিছুতেই।তার একটু চুপ করে থাকায় যদি মা-ছেলের সম্পর্কটা আবার আগের মতো হয়ে যেতে পারে তবে হোক না।এমন তো কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না তাতে।ভাবনার অকূল পাথারেই দরজায় খটখট শব্দ।নিভ্রান কিন্চিৎ বিরক্ত হলো।মেয়েটাকে একটু কাছে টানলেই যত বাঁধা এসে ‘দূরে সরো,দূরে সরো’ ধ্বনিতে হট্টগোল শুরু করে দেয়।কি দুর্বিষহ!
অনিচ্ছা সত্তেও রাত্রিকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়ালো সে।স্বাভাবিক কন্ঠেই দরজার ওপাশের মানুষটাকে অনুমতি দিলো,
—“আসো।”

দরজা ফাঁক হতেই নাহিদাকে দেখা গেলো।চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি লুকিয়ে সন্তর্পনে বেডসাইট টেবিলের দিকে চলে গেলো নিভ্রান।উল্টোদিকে ঘুরে উবু হয়ে ড্রয়ার খুলে অযথাই কিছু খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলো।নাহিদা শ্বাস আটকে ঘরে ঢুকলেন।রাত্রি উঠে দাড়িয়েছে ততক্ষনে।চোখেমুখে-মনমস্তিষ্কে অসচ্ছতা।
নাহিদা নিভ্রানের থেকে চোখ সরিয়ে রাত্রির দিকে তাকালেন।ঠান্ডা গলায় বললেন,
—“তুমি নাস্তা করে যেও।আগেই চলে যেওনা আবার।”

রাত্রি বলার মতো কিছু পেলোনা।মাথা কাত করে সম্মতি জানাতেই চোখের ভাষায় কিছু একটা ইশারা করলেন তিনি।রাত্রি না বুঝে মাথাটা একটু এগিয়ে বিচলিত কন্ঠে বললো,

—“জি?”

নাহিদা নিভ্রানের দিকে তাকালেন।সেকেন্ডে আবার রাত্রির চোখে চোখ রাখলেন।এবার কিছুটা হলেও ইঙ্গিতটা বোধগম্য হলো রাত্রির।ভাসাভাসা গলায় সে নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললো,”উনি খাবেন কিনা?”
নাহিদা অন্যদিকে তাকিয়ে মৃদু মাথা নাড়ালেন।রাত্রি প্রচন্ড ইততস্তবোধ করলো।সে কি বলবে এখন নিভ্রানকে?”আপনার মা আপনাকে খাইয়ে দিতে বলেছে,আমি কি আপনাকে খাইয়ে দিবো?”কেমন অদ্ভুত শোনায় এসব!
তবু মহিলাটা চেয়ে রয়েছে এক বুক আশা নিয়ে।মানা করার জো নেই।খানিক আমতাআমতা করে সে ঘাড় ফিরিয়ে ঘুরে বললো,
—“আপনি তো গতকাল থেকে কিছু খাননি।এখন খাবেননা?”

নিভ্রান একটু সময় নিলো।অত:পর না তাকিয়েই ছোট্ট শব্দে উওর দিলো,”খাবো।”

নাহিদা মনে মনে প্রসন্ন ভঙ্গিতে হাসলেন।রাত্রি তার দিকে ফিরতেই প্রকাশ্য মিষ্টি করে হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।নিভ্রান যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।তবে নিজের অস্বস্তিটা যাতে রাত্রি বুঝতে না পারে তাই দ্রুত আলমারি থেকে জামাকাপড় বের করতে করতে বললো,
—“শাওয়ার নিতে যাচ্ছি।আপনি এখানেই বসুন।আমাকে ছাড়া ঘরের বাইরে বেরোবেননা।”

—“কেনো?”

নিভ্রান শক্ত কন্ঠে বললো,”বলেছি তাই।”

রাত্রি থামলো।মানুষটা খুব অল্পতেই রেগে যায়।অন্যকেউ তাকে অযথা ধমকালে সে পাল্টা কত কথা শুনিয়ে দেয়।অথচ এর কাছে এলে সব যেনো ধুলোপানি।ধমকেও বোধহয় প্রেম ঝরে।
ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে নিভ্রান বললো,
—“আজ তো অফ ডে।ভার্সিটি নেই।পড়াতে যেতে হবে কোথাও?”

—“হু,বিকেলে।চারটার দিকে।”

—“আচ্ছা।”বলে আস্তে করে দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিলো নিভ্রান।
____________
ডাইনিং টেবিলে অস্হিতিশীল পরিস্থিতি।সবার চোখমুখ ধীরস্হির।রাত্রি মাথা নিচু করে চুপচাপ মুখে খাবার তুলছে।তার পাশে বসেছে নাহিদা।বড়দের সামনে নিভ্রানের গা ঘেঁষে বসে যাওয়াটা কেমন যেনো লজ্জা লাগছিলো রাত্রির।তাইসে নিজেই নাহিদার পাশে এসে বসেছে।নিভ্রান-নিশাদ দুজন অপরপাশে।নওশাদ সাহেব বসেছেন চারকোনা টেবিলের একা রাখা চেয়ার দুটোর একটায়।রাত্রি একদম কাছাকাছি।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ কেটে গেলে নওশাদ সাহেবই মুখ খুললেন,
—“নাম কি তোমার?”

রাত্রি একপলক তাকিয়ে ভদ্রভাবে উওর দিলো,
—“জি রাত্রি।”

নওশাদ সাহেব মাথা নাড়িয়ে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন।তার আগেই নিশাদ কপাল কুঁচকালো,”আপনার নাম না রাত?”
রাত্রি হতবিহ্বল চোখে তাকালো।নিশাদ তখনো ভ্রু কুঁচকে উওরের আশায় চেয়ে রয়েছে।রাত্রির সঙ্কুচিত অঙ্গভঙ্গি দেখে নিভ্রানই আগ বাড়ালো।গ্লাসের পানিতে চুমুক দিতে দিতে বললো,”ওটা আমি ডাকি।ওর ভালো নাম রাত্রি।”নিশাদ এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো যেনো খুব জটিল কিছু একটা বুঝে নিয়েছে।এরমধ্যেও বিদ্যমান মুখের ফিচেল মিটিমিটি হাসিটা।
নওশাদ সাহেব হাল্কা কেঁশে আবার বললেন,”কলেজ নাকি ভার্সিটি?কোন ইয়ার??”
রাত্রি আগের মতোই বিনীত কন্ঠে বললো,
—“ভার্সিটি,ফাইনাল ইয়ার।”

—“শুনলাম,তোমার মা চট্রগ্রাম থাকেন।বেশি ব্যক্তিগত না হলে কারণ টা বলা যাবে?”

রাত্রি অবাক হলো।লোকটাকে দেখে বেশ বদমেজাজি মনে হয়েছিলো।কিন্তু কথাবার্তায় কি সুন্দর স্নেহশীল,গোছানো,সুশ্রীল ভাব।রাত্রির মন গলে গেলো।

—“জি অবশ্যই।..চট্রগ্রামে আমার মামার বাসা।বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা ওখানেই থাকে।আমাদের বাসা চট্রগ্রামেই ছিলো কিন্তু মৃত্যুর পর বাবার বেশ কিছু ঋন থেকে যাওয়ায় সেটা বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।”
নওশাদ সাহেব আচমকাই নিজের একহাত রাত্রির মাথার উপর রাখলেন।আদরমাখা স্বরে বললেন,
—“মন খারাপ করোনা মা।মানুষের জীবনে কতকিছু হয়ে যায়।”রাত্রি থতমত খেয়ে গেলো।কস্মিককালেও ভাবেনি লোকটা এত ভালো।অচিরেই মাথা নত করে ফেললো সে।মৃদু কন্ঠে বললো,”এখন আর মন খারাপ হয়না আংকেল।সয়ে গেছে।”
নওশাদ সাহেব হাসলেন।মেয়েটাকে তার ভালো লেগেছে।বলতে গেলে খুবই ভালো লেগেছে।নিভ্রানেরবিষয়ে কোন কথা না বললেও এবারের ব্যাপারটা ভিন্ন।ছেলের পাগলামিতে একটা মেয়ে ঝামেলায় পরুক তা তিনি চাননি।সেজন্যই জীবনে প্রথমবারের মতো ছেলের এই ফ্ল্যাটে পা রেখেছেন।নয়তো এ কয়টা বছরে একবারো এখানে আসা হয়নি।জেদ বা চাপা অভিমানের রেশ ধরেই হয়তো।রাত্রির মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিলেন তিনি।বললেন,
—“তুমি ঢাকা এসেছো কতবছর হলো?”

রাত্রির মনে হলো এই বাবাতুল্য লোকটাকে সবকিছু বলে দেয়া যায়।নির্দ্বিধায়,অকপটে।অথচ নিভ্রান নাকি এই আশ্চর্য সুন্দর পরিবারটা ছেড়ে এখানে একা থাকে।হাহ্।
সে উওর দিলো,
—“জি চারবছরের মতো।কলেজ পর্যন্ত ওখানেই পড়েছি।ভার্সিটিটা শুধু এখানে।ঢাকায় আসার একবছরের মাথায়ই বাবা চলে যান।”

—“আচ্ছা আচ্ছা।তো তুমি নিভ্রানের অফিসে জব নিলেই তো পারো।এত কষ্ট করে টি উশনি করানোর কি দরকার?”

—“আমি..”রাত্রিকে মাঝপথেই চুপ করিয়ে নিভ্রান কঠোর গলায় বলে উঠলো,”ও টি উশনি করায় এটা নিয়ে আমার তো কোনো আপত্তি নেই।অন্যকারোর..”

—“আমিতো সেভাবে বলিনি…”নওশাদ সাহেবের বিস্মিত,রাগী কন্ঠস্বর।

আরো একটা বড়সড় ঝগড়ার উৎপত্তি হতে দেখেই বুকটা ধরফর করে উঠলো রাত্রির।এখানেও কেন্দ্রবিন্দু সে।
তাদের কথা কাটাকাটি তে বাঁধা হয়েই সে দ্রুত বললো,
—“আমি আসলে এভাবে কিছু করাটা পছন্দ করিনা আংকেল।জব যদি নিতেই হয় তবে অনার্সটা শেষ হোক।তারপর এপ্লাই করবো।যোগ্যতা থাকলে তখনই হবে।”

নওশাদ সাহেব মনে মনে খুশিই হলেন।বুঝতে পারলেন রাত্রি বিষয়টা এড়াতে চাচ্ছে।মেয়েটা বুদ্ধিমতী,বিচক্ষণ।”
তিনিও প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে নরম গলায় বললেন,
—“আজতো শুক্রবার।তোমার তাঁড়া না থাকলে দুপুরে খাবারটা এখানেই করো।আমার ভালো লাগবে।”

রাত্রি মানা করতে পারলোনা।ছোট্ট করে সম্মতি দিলো শুধু।
______________
মধ্যাহ্নের প্রহর পেরিয়ে যাচ্ছে।দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে আসছে পৃথিবীতে।সূর্যের আলো একটু একটু করে ঘুমিয়ে পড়ছে পশ্চিমা আকাশের কোলে।ঘড়িতে তিনটা পঁচিশ।
অধৈর্য হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো রাত্রি।নিভ্রান শার্ট-প্যান্ট নিয়ে সেই যে ঢুকলো ভেতরে আর বের-ই হচ্ছেনা।
দশমিনিট বোধহয় হয়ে গেছে।চেন্জ করতে এতো সময় লাগে নাকি ছেলে মানুষের?এমনেই তার দেরি হয়ে যাচ্ছে।চারটার মধ্য ওই বাসায় থাকতে হবে।
ওয়াশরুমের দরজায় নক করার জন্য হাত বাড়াতেই খট করে শব্দ হলো।দরজা খুলে রাত্রিকে এভাবে হাত উঠিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে হেসে ফেললো নিভ্রান।বললো,”দেরি হবেনা রাত।সময় মতোই পৌছে দিব।”রাত্রি বোকা বোকা পায়ে সরে দাড়ালো।
আকাশী রংয়ের ফুলহাতা শার্ট গায়ে বেরোলো নিভ্রান।হাতাটা কনুই পর্যন্ত গুটানো।ঘনপশমে লেপ্টে থাকা পুরুষালী হাতটায় চোখ বাঁধছে বারবার।একহাতে ঘড়ি পড়ার ঢংটাও বেশ লাগছে।নিজের চিরচায়িত লাজুক স্বভাবটাকে কোঁণায় চাপিয়ে রাত্রির সুন্দর চোখজোড়া বেশ সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো আয়নার নিভ্রানকে।একদৃষ্টে,নিষ্পলক গতিতে।
আয়নার ভেতর দিয়েই মেয়েটার দিকে ধ্যান গেলো নিভ্রানের।রাত্রির চোখ তখন তার বুকের খোলা বোতামদুটোর মধ্যিখানটায়।মনে হচ্ছে কেউ খুব করে কাবু করে ফেলেছে তাকে।চোখের পাতা নড়ছেই না।
নিভ্রান প্রথমে কিছু বললোনা।যখন দেখলো রাত্রির দৃষ্টি কিছুতেই সরেছে না বুক থেকে তখন সে চুলটা ব্রাশ করে চিরুনি নামিয়ে রাখতে রাখতে বললো,
—“আপনি আমার দিকে সেভাবেই তাকাচ্ছেন যেভাবে আমি কাল আপনার দিকে তাকাচ্ছিলাম রাত।”কন্ঠটায় কি যেন একটা ছিলো।রাত্রি দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।মুখ কুঁচকে বিশ্রিকরে বলল,”ছিহ্!একদম না।”

নিভ্রান চট করে ঘুরে দাড়ালো।সময় না দিয়ে একহাতে বাহু ধরে রাত্রিকে কাছে টেনে নিলো।ফুঁ দিয়ে কপালের চুল সরিয়ে দুষ্টু গলায় বললো,
—“আমাকে ছিহ্ বলা হচ্ছে?”

রাত্রি এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘুরালো।বুকে হাল্কা ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করে বললো,”হচ্ছেইতো।ছাড়ুন।”নিভ্রান ছাড়লোতো না-ই।বরং রাত্রির ছটফটানি বন্ধ করতে আরো শক্ত করলো হাতের বাঁধন।রাত্রির ফর্সা গাল ইতিমধ্যেই রক্তিম আভায় ছেঁয়ে গেছে।গায়ের মৃদু কাঁপুনিটা জানান দিচ্ছে মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে।খুব খুব লজ্জা পাচ্ছে।কিন্তু মুখে স্বীকার করতে চাচ্ছেনা।নিভ্রান তার গালটাকে আরো কয়েকগুন রাঙিয়ে দিতে টান টান কন্ঠে বললো,
—“কেন আপনি তাকিয়ে ছিলেন না আমার বুকের দিকে?এইযে আপনার মাথা বরাবর জাগাটায়?”

রাত্রি সুবিধা করতে পারলোনা কিছুতেই।বুকে জোরে ঠেস দিয়েও লাভ হলোনা।লোকটা একহাতে বাহু ধরেই এতো জোর অথচ সে দু’হাতে ঠেলে দিয়েও সরাতে পারলোনা?রাগে,দু:খে চেঁচিয়ে উঠলো সে,
—“দেখলে কি হয়েছে?”

নিভ্রান ঠোঁট চেপে হাসলো।রাত্রির অসহ্য লাগলো।চরম অসহ্য!গা হিম করা অসহ্য!কোনরকম আগাম বার্তা ছাড়া দরজার নব ঘুরলো তখনই।নিভ্রান সেকেন্ডে সরে গেলো।রাত্রি কিছু বোঝার আগেই হন্য বেঁশে ঘরে ঢুকলো নিশাদ।ঢুকেই দু’হাতের মাঝখানে দখল করে নিলো রাত্রির হাতজোড়া।চমকে তাকালো রাত্রি।
নিশাদ ভূমিকা না করেই গড়গড় করে বাক্য ছাড়লো,”আপু আপনার হাতে পড়ি আপনি এখানেই থেকে যান।আপনি গেলেই আপনার ‘এই উনি’ আবার ওমন হয়ে যাবে।জানেন কালরাতে আবার এত সাধের দামি হাতঘড়িটা টেবিলের উপর পেয়ে চুরমার করে দিয়েছে।আমি চাইনা আর কোনো হাতঘড়ির এমন অকাল মৃত্যু ঘটুক।আমার ঘড়ির জীবন রক্ষার জন্য হলেও আপনি থেকে যান আপু।”

নিশাদের খেই হারা,ছন্নছাড়া,উদ্ভট কথাবার্তায় কিছুক্ষণ বিহ্বল চেয়ে থেকে শব্দ করে হেসে ফেললো রাত্রি।হাসি যেনো থামছেই না।পেটে খিল ধরে যাচ্ছে।নিভ্রান ধমকে এগিয়ে এলো,
—“রাখ তোর ফালতু কথা।গাড়ির চাবি কই?চাবি বের কর।দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

নিশাদ কাতর চোখে তাকালো।পকেট হাতরিয়ে চাবি বের করে নিভ্রানের হাতে দিলো।গতকাল গাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর পকেট থেকে চাবিটা আর বের করা হয়নি।রাত্রি মুখে তখনো হাসি।নিশাদ বললো,
—“আপনি যাচ্ছেন আপু।মধ্যরাতে গন্ডগোল হলে আমি কিন্তু আবার আপনাকে ধরে বেঁধে নিয়ে আসবো।”

রাত্রি উওর দিলো,”আচ্ছা,নিয়ে এসেন।”

নিচতলায় নেমে গ্যারেজের দিকে যেতে গিয়েও থেমে গেলো নিভ্রান।রাত্রি সমেত বেরিয়ে এলো গেটের বাইরে।হাতের ইশারায় রিকশা দাড় করিয়ে বললো,
—“আজকে রিকশায় যাবো।উঠুন।”কথাটা বলতে বলতেই বাহুতে কপালের ঘাম মুছলো সে।রাত্রি লক্ষ্য করলো লিফট দিয়ে নেমে আসতে আসতেই মানুষটার পিঠের শার্ট ঘেমে ভিজে উঠেছে।ঘাড় গলা একাকার।

—“আপনিতো এখনই ঘেমে গোসল করে ফেলেছেন।এতদূর রিকশায় যেতে পারবেন?”

নিভ্রান তাকে হাতে ধরে উঠিয়ে দিতে দিতে ব্যস্ত গলায় বললো,
—“পারবো।গাড়ির তেল শেষ।আমি ভুলে গিয়েছিলাম।আপনার দেরি হয়ে যাবে।”কথাটা ডাহা মিথ্যা।গাড়িতে তেল আছে।ভরপুর তেল আছে।কিন্তু রিকশায় গেলে মেয়েটাকে একটু মন ভরে দেখা যাবে,নিশ্বাস-প্রশ্বাসের ঘনত্ব মাপা যাবে,হাত ধরে রাখা যাবে।গাড়িতে থাকলেতো ড্রাইভ করতে করতেই সময় শেষ।প্রেম করার জন্য রিকশা হলো উৎকৃষ্টতম প্রেমবাহন।
নিভ্রান উঠে বসলো।হুট তখন তোলাই ছিলো।

আকাশ সচ্ছ নীল।মেঘেরা ছুটি নিয়েছে।বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই।
মাঝপথেই নিভ্রান বললো,
—“আমি কিন্তু নিতে আসবো আপনাকে।দেরি হলেও অপেক্ষা করবেন।চলে যাবেন না খবরদার!”রাত্রি একপলক তাকিয়ে নিরবে সম্মতি জানালো।কেটে গেলো আরো কিছুক্ষণ।নিভ্রান মাথা একটু বাড়িয়ে আকাশ দেখলো।মুঠোয় থাকা রাত্রির নরম হাতটা একটু নাড়িয়ে চাড়িয়ে উদাসচোখে বললো,
—“আকাশে আজ মেঘ নেই কেনো রাত?মেঘ থাকলে বৃষ্টি হতো।ফেরার সময় ভিজতে পারতাম।”

রাত্রি চুপ করে রইলো।তবে মনে মনে বেশ মেজাজ দেখিয়ে শাসিয়ে শাসিয়ে বললো,
—“আকাশে মেঘ আসবে কোথা থেকে?স্বয়ং মেঘবালক যে আমার পাশে বসে আছেন।তাকে ছেড়ে বেহায়া মেঘবালিকারা আকাশে পাড়ি জমাবে?এত স্পর্ধা!”

তখনই কানে নৈশব্দ্যর মতো বেজে উঠলো,”আমি মেঘবালক হলে,আমার ব্যক্তিগত মেঘবালিকা আমার সাথেই আছে।অন্যরা চলে যাও আকাশে।এক্ষুণি বৃষ্টি নামিয়ে দাও।”

রাত্রি চমকে এদিক ওদিক তাকালো।নিভ্রান নির্বিকার আকাশে চেয়ে রয়েছে।কিন্তু সে তো স্পষ্ট শুনলো মানুষটার কন্ঠ!

~চলবে~

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৯

ছাত্রীকে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকেই জানালা দিয়ে বারবার আকাশের মতিগতি পরখ করে নিচ্ছে রাত্রি। পাথর পাথর মনটাও জানপ্রাণ দিয়ে চাইছে আজ যেনো বৃষ্টি নামে।কিন্তু মেঘ আর তার মনের কথা শুনছে কই?সে তো ভেসে ভেসে পাড়ি জমিয়েছে কোথাকার কোন শহরে।আর এদিকে মেঘবালকের ব্যক্তিগত মেঘবালিকার যে এ শহরে বৃষ্টি দরকার সেদিকে গোটা আকাশের কারো খেয়াল নেই।রাত্রি মুখ ভার করলো।বৃষ্টির সাথে আজ প্রচন্ড ঈর্ষা হচ্ছে।মানুষটার যে এই বৃষ্টি ভীষণ পছন্দের!

সন্ধ্যা ছ’টা…
রাস্তার হেডলাইট জ্বলছে নিভছে।আবার কতকগুলো একেবারেই নষ্ট।আলো নেই।কয়েকটা শুকনো পাতা বাতাসে লুঁটোপুঁটি খাচ্ছে।বৃষ্টি না হলেও বাতাস ছেড়েছে।ঠান্ডা বাতাস।চুল ওড়না এলোমেলো করে দিচ্ছে নিজ দায়িত্বে।
গেটের কাছাকাছি আসতেই রাস্তার ধারে নিভ্রানকে অপেক্ষা করতে দেখা গেলো।গায়ে সেই আকাশী শার্টটাই।ব্রাশ করা চুলগুলো বাতাসের ঝাপটায় একটু অগোছালো।রাত্রিকে দেখা মাত্রই দ্রুতপায়ে এগিয়ে এলো সে।
রাত্রির চেহারা তখন বিধস্ত,মলিনতায় ছেঁয়ে আছে।চোখ ভেঙে ঘুম পাচ্ছে।সটান হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়াটা এখন স্বর্গীয় সুখ মনে হচ্ছে।

—“আপনাকে অসুস্থ দেখাচ্ছে রাত।জ্বর আছে?দেখি।”বলে রাত্রির গালে-গলায় নিজের ঠান্ডা হাতটা ছুঁইয়ে দিলো নিভ্রান।সেই নিবিড় ছোঁয়ায় রাত্রি কেঁপে উঠলো খানিকটা।নিভ্রানের কপালে সুক্ষ চিন্তার বলিরেখা।প্রিয়জনের অসুস্থতার বেদনা!গা টা হাল্কা গরম।তবে জ্বর উঠেনি।
রাত্রিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে দ্রুত একটা রিকশা থামালো।চেহারায় চাপা রাগের পরিফুস্ট আভাস।
মাথাভর্তি চুল গুলা যখন হাত দিয়ে পিছের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে কি যে সুদর্শন দেখাচ্ছে মানুষটাকে।রাত্রি চোরা চোখে তাকালো।সোজাসাপটা তাকালে তো আবার ধরা পড়ে যাবে।নিভ্রান যে তাকে ধরে ফেলেনি সেটা ভুল কথা।রাত্রিকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে মাথা ঝুঁকিয়ে হাসি থামালো।হাত ধরে ব্যস্ত গলায় বললো,
—“উঠুন।”

রাত্রির ঘোর কাটলো।কি একটা অবস্থা!লোকটা রিকশা দাড় করিয়ে রেখে অথচ সে নাকি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে ছিলো।সে উঠে বসলো।নিভ্রান উঠলে রিকশা চলতে শুরু করলো।
লম্বা হওয়ার দরুন রিকশার হুটতোলা থাকলে মাথাটা একটু কাত করে নামিয়ে রাখতে হয় নিভ্রানের।নতুবা বারবার বারি লাগে।এই রিকশাটা বোধহয় একটু বেশিই ছোট।ফলাফল না চাইতেও রাত্রির মাথার সাইডের সাথে তার মাথা লেগে আছে।একহাত রাত্রির পিঠের পিছ দিয়ে নিয়ে রিকশার হুটের সাথে ঠেস দেয়া।মেয়েটার কপালের চুলগুলো উড়ে মুখের উপর সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে।রাত্রি লজ্জিত ভঙ্গিতে বারবার চুল,জামা ঠি ক করে যাচ্ছে।কামিজের দু’পাশে ফাঁড়া অংশটা বাতাসের উল্টো গতিতে কোলের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে।কি বিশ্রি অবস্থা!তার উপর লোকটা এত এত কাছে।নিশ্বাসের বহর তার উন্মুক্ত কাঁধজুড়ে।বাতাসে ঘোমটা পড়ে যাওয়ায় ওড়না নামিয়ে কাঁধের দু’পাশ দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলো।মনে হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।যতবার চুল ঠি ক করছে ততবার নিভ্রানের গালে হাতের উল্টোপিঠ লেগে যাচ্ছে।লজ্জায় বুঁদ হয়ে আরো একবার চুলের গোছা কানের পিছে গুঁজলো রাত্রি।হাত কাঁপছে।নিভ্রানের স্পষ্ট টের পাচ্ছে মেয়েটার কাঁপুনি।
খুঁকখুঁক করে গলা ঝাড়লো সে।রাত্রি একটু তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো।রাত্রিই চোখ নামিয়ে নিলো প্রথমে।নিভ্রান বারকয়েক পলক ঝাপটিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
—“এত লজ্জার কিছু নেই।আমিই তো।”

কথাটা যেনো লজ্জা উপশমের বদলে তা আরো শক্তপোক্ত করে দিলো।রাত্রি দিরুক্তি করলোনা।তবে মনে মনে খুব চেঁচালো,”আপনি বলেই তো এত লজ্জা লাগছে।”
কেটে গেলো আরো কিছুক্ষণ।সন্ধ্যা হয়ে গেছে বিধায় চারিপাশে তেমন আলো নেই।সব আবছায়া,আলোকশূন্য।রাত্রির চোখ পড়লো নিভ্রানের পায়ের দিকে।লোকটা দিব্যি এই ক্ষত পায়ে জুতো পড়ে আছে।ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলো।আসার সময় খেয়াল করেনি।কে জানে সেটাও খুলে ফেলেছে কিনা?
খানিক আমতা আমতা করে সে প্রশ্ন করলো
—“আপনি এই পায়ে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেনো?”

নিভ্রান আবারো উষ্ণ প্রশ্বাসের ঝড় বইয়ে দিয়ে উওর দিলো,”ব্যান্ডেজ করা আছে তো।সমস্যা নেই।”

রাত্রি শিরশির করে উঠলো।কাঁধের পাশটা মনে হচ্ছে অবশ হয়ে যাবে আজ।সাধারণ কথাটাও কেমন ভয়ংকর ঠেকছে।কথা বলা যাবেনা।কোনো কথা বলা যাবেনা।সে কথা বললে নিভ্রানও কথা বলবে।আর নিভ্রান কথা বললেই বিপদ।ঘোর শনি!তার সেই ভাবনা চিন্তাটা এক ধাক্কায় গুঁড়েবালি করে দিলো ফোনের রিংটোন।নিভ্রানের ফোন বাজছে।রাত্রি দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো।অদৃশ্য কোনো হাত যেনো ঠাস ঠাস করে কপাল চাপড়ে দিলো।নিভ্রান ফোনটা পকেট থেকে বের করতেই দ্রুত তার হাতের কব্জি ধরে ফেললো সে।নিভ্রান প্রশ্নাত্বক চাহনী নিক্ষেপ করতেই কাটকাট গলায় বললো,
—“আপনি ফোন ধরবেননা।”

নিভ্রানের প্রশ্ন আরো গাঢ় হলো।রাত্রি তখনো হাত ধরে আটকে রেখেছে।বিস্মিত কন্ঠে সে বললো,”কেনো?”

রাত্রি চোখ সরিয়ে বললো,”বলেছি তাই।”

নিভ্রান কিছুক্ষণ নিমীলিত,নিমজ্জিত চোখে মেয়েটাকে দেখে নিলো।তারপর সাইড বাটন চেপে রিংটন বন্ধ করে হাতটা হাঁটুর উপর নামিয়ে রাখলো।একটু সময় যেতেই আবার স্বউদ্যমে বাজতে শুরু করলো ফোন।নিভ্রান একপলক তাকালো।দ্রুত রিসিভ করে অধৈর্য গলায় বললো,
—“ইম্পর্টেন্ট কল,একটামিনিট রাত।”
রাত্রির যেনো দমবন্ধ হয়ে আসলো।নিভ্রান ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথা বলে যাচ্ছে।বোঝা যাচ্ছে,বেশ জরুরি।আচ্ছা,সে কি এখন অজ্ঞান হয়ে যাবে?মাথা ঘোরাচ্ছে কেনো?
নিভ্রান ফোন নামালো একটু পরেই।পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে ঠাট্টার স্বরে বললো,
—“আপনি এতো লজ্জা পান রাত।এখনতো আমারই লজ্জা লাগছে।মনে হচ্ছে কথা বলাটাও অপরাধ।”

রাত্রি ফাঁকা ঢোক গিললো।চাপা গলায় জোর দিয়ে বললো,”অপরাধই,আপনি চুপ করুন।”

নিভ্রান দূর্বোধ্য হাসলো।দুরত্ব কমিয়ে জ্বালাময়ী কন্ঠে বললো,
—“আপনাকে লজ্জা পেলে ভীষণ সুন্দর দেখায় রাত।আপনাকে লজ্জা দেয়ার জন্য হলেও আমি এখন অনবরত কথা বলে যাবো।”

~চলবে~