এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব-২৪+২৫

0
1326

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৪

নিভ্রান অবাকচোখে ক্রন্দনরত মেয়েটার দিকে চেয়ে রয়েছে শুধু। চোখে বিস্ময়। রাত্রি হাউমাউ করে কাঁদছে। কান্নার দমকে শ্বাস আটকে আটকে আসছে। কয়েকবার মুখ হা করে দম নিতে হচ্ছে। নিভ্রান বিহ্বল চোখে চেয়ে দীর্ঘ:শ্বাস ফেললো। মেয়েটাকে এতোটা ভেঙে পড়তে দেখেনি কখনো। এমন পাগলের মতোকাদতে দেখেনি। রাত্রি আবারো মুখ হা করে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করলো। এবার তাকে বুক থেকে সরালো নিভ্রান।
গালে হাত রেখে চোখমুখ মুছিয়ে দিলো।লাভ হলোনা, পানি গড়িয়েই চলেছে।অবিশ্রাম, অনবরত।
রাত্রি থমকে থমকে বললো,”আ..আমার…মা..মাকে..ওরা..”উত্তেজনায় বাকিটা উচ্চারিত হলোনা।কন্ঠ আটকে গেলো।চিবুক উঁচিয়ে হেঁচকি তুললো সে।
নিভ্রান ফের চোখ মুছিয়ে দিলো। দু’গালে হাত রেখে মুখ বরাবর ঝুঁকে বোঝানোর মতো করে বললো,আচ্ছা ঠি কাছে,আমার কথাটা শুনো।এভাবে কাঁদলে হবে?বলেছিলাম না তোমাকে কান্না মানায় না।শান্ত হও,কাঁদেনা।দেখি।আর কাঁদেনা রাত,হয়েছে।”

রাত্রি মাথা নুয়ে ফেললো। থুতনির সাথে গলা ঠেকে গেছে। জোরে জোরে শ্বাস টেনে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো সে। ভয়ে আৎকে উঠছে মন। কখন যেনো মামা ফোন করে খারাপ সংবাদ শোনায়। এই মাকে ঘিরেই তো তার যতো উথাল পাথাল। জীবনযুদ্ধের উত্তাল ঢেউয়ে সে তো মা নামক খুঁটি টাকে ধরেই আটকে আছে। মা না থাকলে আর কি নিয়ে বাঁচবে?
রাত্রিকে কিছুটা শান্ত হতে দেখে নিজেকেও ধাতস্থ করলো নিভ্রান। গাল থেকে হাত সরিয়ে কপালের চুল সরিয়ে দিলো। সিটবেল্ট বেঁধে দিলো। ততক্ষনে কান্নার শব্দ থেমেছে রাত্রির। চোখের মনি লাল। গোলাপি ঠোঁট ফুলে মনে হচ্ছে টোকা দিলেই রক্ত গড়িয়ে পড়বে।যেনো কোনো রক্তে ভেজা লাল পাপড়ি।
নিভ্রান স্বস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।কোমলস্বরে বললো,
—“কি হয়েছে আন্টির?খুলে বলো।এভাবে কাঁদলে হবে?আমাকে বলতে হবে তো রে বাবা..”

রাত্রি ফোঁপানো কন্ঠে উওর দিলো,”মা..মা হসপিটালে।”

—“হসপিটালে কেনো? কি হয়েছে?”

—“আমি জানিনা। আমি..”কথা শেষ হলোনা। চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। পাপড়িগুচ্ছ ভিজে উঠছে আবারো।

নিভ্রান স্হির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। পকেট থেকে ফোন বের করলো। সময় দেখলো।ড্ রাইভ করে চট্রগ্রাম পৌছাতে পৌছাতে কম করে হলেও পাঁচ-ছয় ঘন্টা লেগেই যাবে। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো সে। গাড়ির চাবি ঘুরিয়ে ব্রেকে হাত চালাতে চালাতে বললো,
—“আচ্ছা ঠি কাছে,জানতে হবেনা।তুমি চুপ করে বসো।আমরা পৌছে যাবো সময়মতো।”

রাত্রি চোখ মুছলো।নাক টেনে ক্ষীণ কন্ঠে বললো,”আপনাকে বিরক্ত করলাম।”

নিভ্রান আড়চোখে তাকিয়ে গাড়ি চালানোয় মনোযোগ দিলো।দাঁতে দাঁত চেপে ঠান্ডা গলায় বললো,
—“কান্না না করলে ঠাটিয়ে দুটো চড় লাগাতাম গালে। আমি কি মারা গেছি? এমন একটা সময় একা না এসে আমাকে বলা যেতোনা? যদি কিছু হয়ে যেতো? খারাপ মানুষের অভাব আছে পৃথিবীতে? ফোন পেয়ে কিভাবে এসেছি তা শুধু আমি জানি।”

নিভ্রানের কন্ঠে তীব্র ক্ষোভ,চাপা অভিমান,প্রিয়জনের চিন্তায় অস্থির হওয়া প্রেমিকের হাহাকার।রাত্রি প্রত্যুওর করলোনা।চুপটি করে বসে ব্যাগ থেকে ফোন বের করলো।কয়েকবার ফোন দিলো মামার নাম্বারে।ওপাশ থেকে রিসিভ হলোনা।
নিভ্রান লক্ষ্য করলো পুরোটাই। কিছু একটা ভেবে ভ্রু কুঁচকে বললো,
—“আন্টি না তোমার মামার বাসায় থাকেন?উনারা আছেনা সাথে?”

—“আছে।”

—“তবে?এত ভয় পাচ্ছো কেনো?”

রাত্রি ধীর গলায় উওর দিলো,

—“উনারা আছে দেখেই ভয় পাচ্ছি।”

—“মানে?”

কিছুক্ষণ চুপ!নিভ্রান উওরের অপেক্ষায়। রাত্রি মুখ তুলে কাতর চোখে তাকালো। একপলক সেই চোখে চোখ পড়তেই বাকিটা বুঝে ফেললো নিভ্রান। রাত্রি চোখ নামিয়ে নিলো। আচমকাই করে বসলো এক অদ্ভুত আকুতি,”আমার হাতটা একটু ধরবেন প্লিজ?”

নিভ্রান থতমত খেলো।শূন্যচোখে তাকালো।উতলা অবিশ্বাস ঘন্টা বাজাচ্ছে।মেয়েটা কি সত্যিই নিজ থেকে হাত ধরতে বলছে?নিজের কানকে মিথ্যাবাদির তকমা লাগিয়ে দিয়ে ভ্রু উচিয়ে সে বললো,”হু?”

রাত্রি আবার বললো,”ধরুননা।”কন্ঠে কাতরতা,অধৈর্য আবদার,আদুরে মিনতি।

প্রেমানুভূতিরা সাদরে অভিবাদন জানিয়ে আলিঙ্গন করে গেলো। নিভ্রান হাসলো মনে মনে। আলতো করে রাত্রির ছোট্ট নরম হাতটা টেনে নিলো নিজের শক্তপোক্ত হাতের মধ্যিখানে। আঙ্গুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে ঠোঁটের কাছে এনে আচমকাই তপ্ত এক চুমু খেলো উল্টোপিঠে। বললো,
—“কিছু হবেনা রাত।”

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। রাত্রির চোখে ঘুম নেই। চাতক পাখির মতো সূদুর রাস্তার পানে চেয়ে আছে নির্ঘুম নয়ন। নিভ্রান একমহূর্ত বিরতি নেয়নি। গাড়ি থামায়নি। অবসন্ন হাত অবিরাম গাড়ির চাকা ঘুরিয়ে যাচ্ছে রাস্তার বাঁকে বাঁকে। বৃষ্টির সুরের তাল কেটেছে। আকাশের মেঘ ফুরিয়ে গেছে। জলপাতে বিঘ্ন ঘটেছে।
নিভ্রান দেখলো রাত্রির চোখে দীর্ঘকায় ক্লান্তি। মেয়েটা তবুও চোখের পাতা বুজতে নারাজ।

—“রাত,ঘুমাও একটু।পৌছাতে আরো অনেকক্ষণ।”

—“ঘুম আসছেনা।”বাইরের দিকে তাকিয়েই নির্বিকার উওর দিলো রাত্রি। কন্ঠই বলে দিচ্ছে সে কিছুতেই ঘুমাবেনা।নিভ্রান শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো পাগল এক সন্তানের মায়ের প্রতি অগাধ ভালবাসা।

________________
হাসপাতালে পৌঁছালো সকাল ন’টা নাগাদ। এদিকের পথঘাট নিভ্রানের চেনা নেই। রাত্রি দেখিয়ে দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। মামাকে ফোনে পেয়েছিলো একবার। সদর হাসপাতালে এডমিট আছে তার মা। কেবিন নাম্বার জেনে নিয়েছিলো তখনই বিধায় খুঁজে পেতে সমস্যা হয়নি।
রাত্রির ডানহাত নিভ্রানের শক্তমুঠোয় আবদ্ধ। কেবিনের সামনে যেতেই মামা লিয়াকত হোসেনকে দেখা গেলো। সাতসকালে রাত্রিকে দেখে তিনি যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকলেও নিভ্রানকে তার পাশে দেখে মূহুর্তেই চেহারার আকার বদলে গেলো। কুন্চিত হয়ে গেলো চোখ। কাছাকাছি আসতেই বাঁকা গলায় প্রশ্ন ছুড়লো,
—“এ কে?”

রাত্রি বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করলোনা। মানুষের উল্টো কথাবার্তাকে সে ইহজনমে দাম দেয়নি আর না এখন দিবে। নিভ্রানকে নিয়েও সে বিন্দুমাত্র বিচলিত না। কাঠকাঠ কন্ঠে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়লো,
—“মা কেমন আছে? ভেতরে ঢোকা যাবে? ডাক্তার কি বলেছে? আর হয়েছিলো কি? আমি তো গতপরশুও কথা বললাম তখনতো দিব্যি ভালোমানুষ। একদিনে তো কেউ এত অসুস্থ হয়ে যায়না মামা?”

লিয়াকত হোসেন কপালের ভাঁজের পরত বাড়িয়ে বললেন,
—“তুমি সঙ্গে পোলা মানুষ নিয়া আইসো কেন? এইসব কেমন বেহায়াপনা?”

—“যেটা বলেছি সেটার উওর দিন। কাকে নিয়ে এসেছি সেটা তো আপনার দেখার বিষয় না নিশ্চয়?”

লিয়াকত হোসেন দমে গেলেন। নিভ্রান তখন মনোযোগ দিয়ে ফোনে কাজ করছে। আজকে অফিসে যেতে পারবেনা। তাছাড়া সে যে রাতে বাসা থেকে বেরিয়েছে কেউ জানেনা। সময় নিয়ে নিশাদকে লম্বা টেক্সট করে ফোন নামালো সে। রাত্রির আর ভদ্রলোকের কথা কানে এসেছে। কিন্তু মাঝে একহাত বাড়িয়ে কথা বলেনি। সে জানে তার রাত একাই যথেষ্ট উল্টাপাল্টা মানুষের মুখ বন্ধ করার জন্য। রাত্রির কথার আকারে ইঙ্গিতে বোঝা হয়ে গেছে সামনের লোকটা অতি সম্মানীয় কেউ নন। সুতরাং শ্রদ্ধাভক্তির কোন মানে হয়না। কেবিন থেকে একজন নার্স বেরিয়ে এলো।নিভ্রান তাকে থামিয়ে বললো,

—“এক্সকিউজ মি? এই কেবিনের পেশেন্টের সাথে দেখা করা যাবে?”

নার্স সম্মতি দিলো।বললো পেশেন্টের জ্ঞান নেই তবে ভেতরে গেলে সমস্যা হবেনা।নিভ্রান আলতো করে রাত্রির হাতে টান দিলো,
—“আসো,আন্টির কাছে চলো।”

রাত্রি নামানো গলায় বললো,”বাকি বিষয়ে পড়ে কথা বলছি মামা। আগে মা কে দেখে আসি।”
বলে একপা বাড়িয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেলো সে।ব্যাগ খুলতে খুলতে বললো,”কত টাকা খরচ হয়েছে আপনার?”

লিয়াকত সাহেব চড়া গলায় উওর দিলেন,”সাতহাজার গেছে।”

রাত্রি মনে মনে শ্বাস ফেললো। গোলমেলে চিন্তাযুক্ত শ্বাস। তবে বাইরে একেবারেই প্রকাশ পেলোনা কিছু। ব্যাগ থেকে পাঁচহাজার টাকা বের করে লিয়াকত সাহেবের দিকে এগিয়ে দিয়ে স্পষ্টভাষায় বললো,”বাকি দু’হাজার পরে দিবো।আমাকে রিসিপ্টটা দেখাবেন।আপনি আদৌ সত্যি বলছেন কিনা আমারতো তা জানা নেই।”

নিভ্রান শুধু দাড়িয়ে দাড়িয়ে মত্ত হয়ে শুনলো তার প্রেয়সীরূপী শান্তশিষ্ট বাঘিনীটার তলোয়ারের মতো ধারালো শব্দবাচন।কে বলবে এই মেয়েটা কয়েকঘন্টা আগেও তার বুক ভাসিয়ে কাঁদছিলো?

~চলবে~

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৫

বেডে অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন রুবিনা। কপালে মোটা ব্যান্ডেজ। রাত্রি তার ক্যানেলা লাগানো হাত ধরে কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে। চোখ বন্ধ। নিশ্চিত বুঝতে পারছে মায়ের মাথার ভয়াবহ আঘাতটাই তার অসুস্থতার পেছনের রহস্য। আর এই কাজটা যে তার মামির দ্বারাই হয়েছে সে ব্যাপারেও শতভাগ নিশ্চিত।
এই জন্যই তার মামির দেখা নেই আশেপাশে।
নিভ্রান কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। রাত্রি চোখ মেলে তাকালো। দৃষ্টিজোড়ায় রাজ্যের ক্লান্তি। নিভ্রান কাছে এসে আলতো করে মাথার উপর হাত রাখলো। নরম গলায় বললো,
—“ডক্টরের সাথে কথা বলেছি রাত। আন্টির কন্ডিশন এখন যথেষ্ট স্টেবল। চিন্তার কিছু নেই। স্যালাইনটা শেষ হোক। তারপর ডক্টর এসে দেখে যাবে। চিন্তা করোনা।”

রাত্রি মাথা নাড়ালো। মুখ ফুটে কিছু না বললেও নিভ্রান সহজেই বুঝতে পারছে মেয়েটার মাথাভর্তি চিন্তা। একয়দিনে এতটুকু অনন্ত চিনেছে সে যে রাত্রি মরে গেলেও মুখ ফুটে কিচ্ছু বলবেনা। মাথা থেকে হাত সরিয়ে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করলো সে। আলতো করে রাত্রির হাত টেনে মুঠোয় ধরিয়ে দিয়ে আস্তে করে বললো,”রাখো।”
রাত্রি চকিতে তাকালো। হাতের মধ্য মোটাসোটা ওয়ালেট। নিভ্রান হাত সহ মুঠ করে রেখেছে বিধায় ফিরিয়ে দেয়ার উপায় নেই। আমতাআমতা করলো। দ্বিধাগ্রস্ত কন্ঠ তার,”লাগবেনা..”
নিভ্রান স্নান হাসলো। একটু ঝুঁকে কানের পিছে চুল গুঁজে দিতে দিতে মোলায়েম স্বরে বললো,
—“এসব নিয়ে তোমার ভাবতে হবেনা রাত। বসো,আমি খাবার নিয়ে আসি। কিছু খাওনি। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে।”

—“কিন্তু…”

—“চুপ,বসো। কি খাবা? আমি নিয়ে আসি।”

রাত্রি চোখ নামিয়ে নিলো। মানুষটা কিভাবে পারে?
নিভ্রান হাসলো। ফিচেল গলায় বললো,
—“আচ্ছা বলা লাগবেনা। আর হসপিটালের বাদবাকি সব বিল দিয়ে দিয়েছি। শুধু তোমার মামার টাকাটা দিয়ে দিও। উনার চাহনীটা আমার জাস্ট সহ্য হচ্ছেনা।”

রাত্রি চোখ পাকিয়ে তাকালো।লোকটা এমন একটা অবস্থায়ও মজা করছে?কিভাবে পারে?

______________

রুবিনার জ্ঞান ফিরেছে। চোখ মেলে মেয়েকে মাথার কাছে বসে থাকতে দেখে যেনো আত্না জুড়িয়ে গেলো তার।
মা কে চোখ খুলতে দেখে মুখে হাসির ঝলক খেলে গেলো রাত্রির। ফ্যাকাশে চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। রাতভর নির্ঘুম থাকার ক্লান্তি যেনো নিমিষেই কেটে গেলো। ক্যানেলা লাগানো কাঁপা কাঁপা হাতেই রাত্রির মাথা টেনে কপালে চুমু খেলো সে। রাত্রি মিষ্টি করে হাসলো।
—“এখন ভালো লাগছে মা?

রুবিনা নিষ্প্রান স্বরে বললো,
—“তুই কখন আসলি? তোর মামা ফোন দিয়েছিলো?”

—“হু,উনার তো আছেই এককথা।টাকা টাকা টাকা।”

—“এভাবে বলেনা মা..”
রুবিনা আরো কিছু বলবে তার আগেই নিভ্রান ঢুকলো। হাতে খাবারের প্যাকেট। রুবিনাকে সজাগ দেখে বিনয়ী স্বরে সালাম দিলো সে। রুবিনা কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইলো। রাত্রি একপলক নিভ্রানের দিকে তাকালো। অত:পর মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
—“আমার বন্ধু।”

রুবিনা ভ্রু কুঁচকালো। চোখের মনি সরু। ঠোঁটের আগায় গভীর প্রশ্ন। এত বড় ছেলেটা তার মেয়ের বন্ধু?রাত্রি তো এর থেকে বয়সে অনেক ছোট হবে।
মায়ের না বলা সন্দেহপ্রবণ প্রশ্নগুলো সহজেই বুঝলো রাত্রি। গলা ঝাড়লো সে,”খুব ভালো বন্ধু মা। রাতের বেলা যখন তোমার খবর পেলাম তখন বাস পাইনি তাই উনি গাড়ি করে নিয়ে এসেছেন।”
রুবিনার মনের প্রশ্ন পরিষ্কার না হলেও থেমে গেলেন উনি। মেয়ের ওপর যথেষ্ট ভরসা আছে। আবেগ অনুভূতিতে গা ভাসিয়ে দেয়ার মতো মনমানসিকতা তার মেয়ের কোনোকালেই ছিলোনা।
নিভ্রান নিজেই এগিয়ে এলো এবার। প্যাকেট গুলো রাত্রির হাতে ধরিয়ে অমায়িক হেসে বললো,
—“এখন কেমন আছেন আন্টি?”
জবাবে রুবিনাও হাসলেন। ছেলেটার হাসিটা খুব আন্তরিক। হাবভাবে প্রাপ্তবয়স্কের একটা গভীর ছাপ আছে। মায়া কন্ঠে তিনি উওর দিলেন,
—“ভালো বাবা।”

রাত্রি তখনো খাবারের প্যাকেট খুলেনি দেখে নিভ্রান নিজেই টেনে নিলো। পলিথিন থেকে ভেজিটেবল রোলের প্যাকেট বের করলো। মোড়ানো কাগজ খুলে মুখের সামনে ধরে বললো,”হা করো।”
রাত্রি হা করলোনা। খানিক আপত্তি করতেই নিরবে চোখ রাঙালো সে।অর্থ,”এখন হা না করলে আমি ধমকাতে বাধ্য হবো।”
রাত্রি মুখ খুললো। এককামড় খেয়ে চিবাতে চিবাতেই রুবিনার দিকে তাকিয়ে বললো,
—“আপনার মেয়ে একদম নিজের খেয়াল রাখে না আন্টি।”

রুবিনা আবারো হাসলো। একরাশ প্রশান্তি নিয়ে চেয়ে রইলো সুন্দর মূহুর্তটায়। ছেলেটার এভাবে যত্নের সহীত খাইয়ে দেয়া, একটুপর পর কপালের চুল সরিয়ে দেয়া, থুতনির নিচে হাত পেতে পরে যাওয়া খাবার মুখে তুলে দেয়া সব কি শুধুই বন্ধুত্বের খাতিরে?
____________

মামির দিকে তীক্ষ্ণ চাহনীতে চেয়ে রয়েছে রাত্রি। চোখের দৃষ্টি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ,শাণিত। সেই ধারেই যেনো সামনের মানুষ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে। রাত্রির মামি লিমা। মধ্যবয়স্ক মহিলা। পেঁচানো মস্তিষ্কের অধিকারীনী।
রুবিনা তখন বেডসাইডে হেলান দিয়ে নতবদনে চেয়ে রয়েছে। তার পাশেই রাত্রি। মেয়ের স্বভাব চরিত্র চেনা আছে। এত সহজে সে লিমা কে ছেড়ে দিবেনা কখনোই। নিভ্রান তার কাছ ঘেঁষেই দাড়িয়ে আছে। রাত্রি প্রশ্ন ছুড়লো,
—“ডাক্তার বলেছে আপনারা যখন মাকে এনেছেন তখন মায়ের মাথায় গুরুতর আঘাত ছিলো। রক্তক্ষরণের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারতো। আমার প্রশ্ন সেই আঘাতটা মা পেলো কিভাবে?”

লিমার দৃষ্টি অস্থির। চোর ধরা পরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি। অগোছালো স্বরে বললেন তিনি,
—“কলপারে পরে গেসিলো। অসাবধানতায়…”

—“ধাক্কাটা নিশ্চয়ই আপনিই দিয়েছিলেন মামি?”

রাত্রির সরাসরি প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেলো লিমা। আমতা আমতা করে বললো,”আমি কেনো দিমু?”
হুঁশ হারিয়ে ফেললো রাত্রি। বসা থেকে দাড়িয়ে সজোরে চিৎকার করে উঠলো,
—“আপনারা কি মানুষ? একজন বয়স্ক মহিলা নিরুপায় হয়ে আপনাদের বাসায় থাকে। কিভাবে পারেন এমন আচরণ করতে? যদি মার কিছু হয়ে যেতো? আপনার তো আপন বোন মামা। আপনি কিভাবে পারেন? একটু মায়া হয়না?”

রুবিনা মৃদু স্বরে তার হাতে টান দিলো,”রাত মা, চুপ কর।”

—“কেনো চুপ করবো মা? এরকম চলতে থাকলে তো উনারা তোমাকে একদিন মেরেই ফেলবে। তারপর বলবে ভুলে মেরে ফেলেছি। আর আপনারা, মা তো আপনাদের কাছে বিনা পয়সায় থাকেনা মামা। আমাদের বাসা বিক্রির টাকা দিয়ে বাবার ঋন শোধ করার পর বাদবাকি টাকা তো ব্যাংকে আছে। মাসে মাসে সেখান থেকে তো টাকা পান আপনারা। সেটা দিয়েই তো মায়ের প্রয়োজন মিলে যায়। বাড়তি প্রয়োজন হলে আমি পাঠিয়ে দেই। শুধু বাসায় থাকে বলে এতো সমস্যা আপনাদের? আমি তো বলেছি ভার্সিটি টা শেষ হলেই মাকে এখান থেকে নিয়ে যাবো। ততদিন পর্যন্তও একটু অপেক্ষা করতে পারবেন না? এত পাষাণ কেনো আপনারা? কেনো এতো বিবেকহীন?”

লিমা যেনো সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো।সুযোগ বুঝেই সে বললো,
—“তোমার মা রে আমরা আর রাখতে পারুমনা। আমাদের ই ঝামেলার শেষ নেই। উনার দুইদিন পরপর অসুখ আর পোহানোর ক্ষমতা নাই আমার।মা রে পারলে এহনই নিয়া যাওগা।”

লিয়াকত হোসেন চুপচাপ দাড়িয়ে আছেন। তার নিরবতাই বলে দিচ্ছে স্ত্রীর সাথে সে শতভাগ সহমত।
রাত্রি ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তাকালো,”আপনার মতো খারাপ মানুষ আমি দেখিনি মামী।”এরইমাঝে একজন ডাক্তার উঁকি দিলো কেবিনে।একনজর দেখে বললো,”এটা হাসপাতাল,চিৎকার চেঁচামেচির জায়গা নয়।অন্যদের সমস্যা হচ্ছে।”

উনি চলে যেতেই নিভ্রান মুখ খুললো এবার,
—“আপনাদের আর রাখতে হবেনা। আন্টিকে রিলিজ দিলেই আমরা তাকে ঢাকায় নিয়ে যাবো। ফাইন?”

লিয়াকত হোসেন তাচ্ছিল্য করে বললেন,তোমার মাইয়া নতুন নাগর জুটাইছে বুবু। তার তাগদেইতো এতো দেমাগ ঝরতেছে।”

রাত্রি চোখ জ্বলে উঠলো। হুঙ্কার দিয়ে উঠলো সে,”খবরদার মামা! উনাকে নিয়ে একটা বাজে কথাও বলবেন না। আপনারা উনার..”অতিরিক্ত চাপ আর নিতে না পেরে কথা মাঝেই আটকে গেলো। মূর্ছা গেলো রাত্রি। শরীর অসাড় হয়ে লুটিয়ে পরলো রুবিনার কোলের উপর।

নিভ্রান একমূহুর্ত দেরি না করে আলতো করে তাকে উঠিয়ে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো।দু’হাতে আগলে ধরে মামা-মামীর দিকে চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
—“আর একটা কথা বললে আমি ভুলে যেতে বাধ্য হবো আপনারা বয়সে কত বড় বা সম্পর্কে কি হন।”

~চলবে~