#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৬
ঘটা করে সন্ধ্যা নেমেছে। পৃথিবীর চরণে মাথা ঠেকিয়েছে সূর্য। ঘনালি অন্ধকার শূণ্য গগনে। পাখিরা নীড়ে ফিরে গেছে। স্তব্দ পৃথিবীর নিস্তব্ধ আড়ালে কেউ হয়তো মত্ত হয়ে প্রহর গুনছে তোমাকে কাছে পাওয়ার।
ঘরটা অন্ধকার। বাতি নিভানো। হাসপাতালের চিরচেনা স্যাভলনের গন্ধ ছাপিয়ে কৃত্রিম এয়ার কন্ডিশনারের মিষ্টি ফুলেল ঘ্রান। রাত্রি আবছা অল্প চোখ মেললো। পিটপিট করলো। ঘন গুমোট ছাড়া কিছুই কালো কর্ণিয়ায় দৃষ্টিগোচর হলোনা। অতিদীর্ঘ ঘুমের রেশটা কাটতে বেশ সময় লাগলো। নড়চড়হীন পার হলো দু-তিনমিনিট। একটু সজাগ হয়ে উঠতেই টনক নড়লো। থতমত খেয়ে গেলো সে। অনুভব করতে পারছে। তার কাঁধের পাশের বালিশে মুখ গুঁজে তার উপরই উপুর হয়ে শুয়ে আছে একজন। মানুষটার হাতের গাঢ় চাপেই নরম বিছানার সাথে লেপ্টানো বামহাতটা। আর ডানহাতটা এতক্ষণ ঘুমের মধ্যেও মানুষটার বিশাল পিঠের মাঝখানটায় খুব যত্নে আঁকড়ে ধরেছে রয়েছে। কয়েকসেকেন্ড অতিবাহিত হলো একান্ত ঘনিষ্ঠ অনুভূতিতে। রাত্রি মাথা কাত করার চেষ্টা করলো। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে লেগে জ্বলে উঠলো তুলতুলে গাল। মুখ দিয়ে বের হলো চাপা আর্তনাদ,”উহ্।”
নিভ্রান দ্রুত মুখ তুললো। নামমাত্র দুরত্ব। দু’নাকের ডগা ছুঁইছুঁই। চোখে চোখ পড়েছে কিনা স্পষ্ট নয়। স্তুপাকার তীব্র অন্ধকারে একটা ফোঁটা বিন্দুও দৃশ্যমান না।
নিভ্রান আবারো মুখ ডুবালো কাঁধে। দেহ নি:সাড়।
পিঠের হাতটা সরিয়ে ঘাড়ের ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলের উপর রাখলো রাত্রি। যত্নমেখে বললো,
—“কি হয়েছে?”
নিভ্রান মুখ তুললোনা। কথা যেন কানে যায়নি। রাত্রি চিন্তিত ভঙ্গিতে চুলে হাত বুলাল,”কি হলো?”
নিভ্রান বিছানার চেপে রাখা হাতের জোর বাড়িতে দিলো। রাত্রি হকচকালো। কি হলো লোকটার? রেগে আছে নাকি?
নিভ্রান মুখ গুঁজেই ধীরকন্ঠে বললো,
—“মেন্টাল স্ট্রেস, খাওয়া দাওয়ায় চরম অনিয়ম, বিপি হাই ..এসবের মানে কি?”
রাত্রি গাল ঘুরালো। এবার দাড়িতে খোঁচা খেলেও শব্দ করেনি। মিনমিনে গলার স্বর,”জি?”
নিভ্রান মুখ তুললো। সরাসরি চোখে চোখ রাখলো বোধহয়। রাত্রি বুঝতে পারছে। একজোড়া নিমগ্ন চোখ হয়তো আকন্ঠ তৃষ্ণায় ডুবে স্হির চেয়ে রয়েছে। খুব খুব গভীর সেই দৃষ্টি, সেই গভীরতায় হয়তো ডুবা সম্ভব না। না তা পরিমাপ করা সম্ভব তার ছোট্ট মনের অপরিপক্ক স্কেলে।
নিভ্রান হঠাৎই কপালে কপাল ঠেকালো। অন্যরকম টানটান কন্ঠে বললো,
—“আমি যদি তোমাকে আজকেই বিয়ে করি তবে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে রাত?”
রাত্রি যেনো আচানক কথাটা সামলে উঠতে পারলোনা। কেমন চিনচিনে একটা অনুভূতি শিরায়- উপশিরায় ছিঁটকে পড়লো। মাথার ভোঁতা যন্ত্রনাটা চড়ে উঠলো। তবু কোথায় যেনো একটা খুব শান্তি। কোথায় যেনো এক আকাশ প্রশান্তি। হাতছানি দিয়ে ডাকছে আদরকন্যা। নিভ্রান চোখ বন্ধ করলো। আবার বললো,
—“আপত্তি আছে?” কন্ঠের টানটান ভাবটা এবার একটু মৃত। বুক চিড়ে আসা যন্ত্রনাটা বিদ্রুপ করলো হয়তোবা।
রাত্রি হাসলো। শব্দহীন। সব ছাপিয়ে আলতো করে হাত রাখলো নিভ্রানের দু’গালে। কপালে কপালের ঠেকানোটা আরো একটু দৃঢ় করে বললো,
—“আজই?”
—“এক্ষুণি।”
—“এক্ষুণি?”
—“হু।”
—“মা?”
—“জানে।”
—“বাকি সবাই?”
—“জানে।”
—“সবাই জানে?”
—“সবাই।”
রাত্রি হেসে ফেললো। হাসিতে কেমন যেনো ছন্নছাড়া ভাব। পিছুটান নেই। মুক্ত পাখির মতো ডানা ঝাপটানোর আভাস। জীবনে তো কতো কিছুই হুটহাট হয়ে যায়। এবার নাহয় একটু স্বার্থপর হয়ে গেলো। অন্যসব চিন্তাভাবনা ক্ষণিকের জন্য ভুলিয়ে দিলো। নামহীন অনুভূতিকে নাম দিয়ে দিলো। কি হবে বড়জোড়? কি ই-বা হবে?
নিভ্রান অন্ধকারেই যেনো সেই হাসি ছুঁয়ে ফেললো। অনুভব করে নিলো। মনে মনে তাল মিলিয়ে হেসেও নিলো খুবক্ষণ। তবে মুখে বললো,”আছে আপত্তি?”
রাত্রি হাসি থামালো,”থাকলে?”
—“জোর করবোনা।”
—“কেন করবেননা?”
—“হু?”
রাত্রি চুপ থাকলো অনেকক্ষণ। তম্রসারা কি যেনো করে গেলো। খুব নিরিবিলিতে কি যেনো একটা ঘটে গেলো হঠাৎই, খুব আকস্মিক। রাত্রি আদুরে গলায় উওর দিলো,
—“নেই।”
—“নেই?”
—“নেইতো।”
চেপে রাখা হাত ছেড়ে দিলো নিভ্রান। উঠে গেলো উপর থেকে। পাশের সুইচ টিপে লাইট জ্বেলে দিলো। রাত্রি সইতে না পেরে চোখ খিঁচে ফেললো। হাত দিয়ে দৃষ্টি আড়াল করলো। উঠে বসার শক্তি নেই শরীরে। কেমন কমজোর লাগছে। একহাতে চুল খামছে ধরলো সে,
—“আমাকে কি ইনজেকশন টি নজেকশন দিয়েছেন নাকি? এমন লাগছে কেনো? মাথা ধরে আছে। উফ!”
—“ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে ডক্টর। কতো দূর্বল তুমি জানো? খেয়াল তে থাকেনা কোনোদিকে।”বলতে বলতে তাকে দু’হাতে ধরে উঠিয়ে বেডসাইডে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলো নিভ্রান। পাশের টেবিল থেকে ঘোলাটে স্যালাইন পানি তুলে নিলো হাতে। ঠোঁটের সাথে ঠেকিয়ে বললো,”হা।”
—“আমি অসুস্থ না তো। এসব কেনো?”
—“অসুস্থ না তুমি? ডাক্তার তাহলে কাকে গাদা গাদা ওষুধ প্রেসক্রাইব করলো? আমাকে?”
—“ডাক্তাররা তো ওসব করেই। সব টাকার ধান্দা। আপনাকে দেখেছে বড়লোক মানুষ। চেহারা সুরতে আভিজাত্য,ব্যস ধরিয়ে দিয়েছে ওষুধপত্র।”
—“চুপ, হা করতে বলেছি।”
স্যালাইনটুকো একনিশ্বাসে শেষ করিয়ে গ্লাস নামালো নিভ্রান। ঠোঁট মুছিয়ে দিতেই রাত্রি বললো,
—“মা কোথায়?”
—“আছে।”
—“একা তো। ওখানে যাই।”
নিভ্রান কিছু বলবে তার আগেই দরজায় খটখট। রাত্রি চমকে উঠলো। তাকালো দরজার দিকে। দরজা হাল্কা ফাঁক করে নিশাদ উঁকি দিলো। একপলক রাত্রিকে দেখেই সালাম দেয়ার ভঙ্গি করলো। রাত্রি হতভম্ব। চোখে হাজারখানেক প্রশ্ন। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি। নিশাদ ফিচেল গলায় হাসলো। নিভ্রানের দিকে তাকিয়ে ঘাড় কাত করে ব্যাঙ্গ করে বললো,
—“তোর আজও আপুকে মানানো হবে নাকি আমি কাজি সাহেবকে নিয়ে চললাম।”
নিভ্রান আজ আর ধমকালোনা। বরং হাসি হাসি কন্ঠে বললো,
—“মেনে গেছে তোর আপু। আসছি যা।”
সে বিনাবাক্য চাপা হেসে দরজা ভিড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। রাত্রি হতবাকে কিৎকর্তব্যবিমূঢ়।
—“আপনি কি পাগল? ভাইয়া কোথা থেকে এলো? হসপিটালে কাজি,বিয়ে…কিভাবে?”
নিভ্রান হাসলো শুধু। রাত্রির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,”দাড়াতে পারবে? হাতটা ধরো।”
মায়ের কেবিনে যেতেই আরো একদফা অবাক হলো রাত্রি। একদফা বললে ভুল হবে বরং কয়েকদফা অবাক হলো এবং হতেই থাকলো অবিশ্রাম। নিশাদ, নাহিদা, নওশাদ সাহেব সবাই আছেন এই কেবিনে। কাজি সাহেব বসে আছেন প্রস্তুত হয়ে। মামা- মামিকে আশেপাশে দেখা গেলোনা। সবাইকে সালাম দিয়ে মায়ের কাছে যেয়ে বসলো সে। চোখের থমকানো ভাবটা কাটেনি এখন অবধি। নিভ্রান সজোরে চাঁটি মারলো নিশাদের মাথায়,
—“এই গাধাটাতে বলেছিলাম আমার কাবার্ডে রাখা বিয়ের শাড়িটা মনে করে নিয়ে আসতে। গাধাটা ভুলে বসে আছে।”
নিশাদ মাথা ডললো। তবে মুখে মিটিমিটি হাসি নিয়ে বললো,”কথা দিচ্ছি আপু, আপনাকে আমি নিজে গুনে গুনে দশটা বিয়ের শাড়ি কিনে একেবারে সাজিয়ে গুছিয়ে নিজদায়িত্বে দশবার বিয়ে দিবো। মানে ভাইয়ার সাথেই আরকি। এবার শুধু একটু এভাবেই ম্যানেজ করে নিন।”
রাত্রি ঠোঁট কোঁণ প্রসারিত করে হাসলো। মায়ের দিকে একবার তাকাতেই সে চোখের পাতা নামিয়ে সম্মতিসূচক বার্তা দিয়েছে। আর কোনো বাঁধা নেই বিধায় আপত্তি করার মতো কিছু পেলোনা। নাহিদার মুখে বিস্তর হাসি। যাক অবশেষে!
নওশাদ সাহেব গলা ঝেড়ে বললেন,”শুরু করুক তাহলে। ডাক্তাররা এসে আবার কখন ঝামেলা করে।”
নিভ্রান চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,”করবেনা। ম্যানেজ করা আছে সবাইকে।”
রাত্রি তখন মাথা নিচু করে সবটা হজম করার চেষ্টায় অব্যাহত। গালে অজান্তেই লালাভ আভা। তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? সত্যি সত্যি?
বিয়েটা পড়ানো হয়ে গেলো কিছুক্ষণের মধ্যই। আচমকা, হুট করেই। কবুল বলার সময়েও রাত্রির মনে হচ্ছিলো এখনই বুঝি ঘুমটা ভেঙে যাবে। উঠে দেখবে চিরচেনা বিষাক্ত পৃথিবীর ছোবলে তার মধুর সপ্নটা রক্তাত্ব হয়ে গেছে। কিন্তু এরকম কিছুই হলোনা। সপ্নটা ভাঙলো না বরং জন্ম দিলো আরো হাজারখানেক নতুন সপ্নের।
আকাশে মেঘ ডাকছে তখন। গুড়ুম গুড়ুম। সাদা মেঘের গুচ্ছ হাততালি দিচ্ছে যেনো। প্রাণ উজার করে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে সদ্য বিবাহিত দম্পতিকে। নিভ্রান খুব গোপনে রাত্রির কানের কাছে ফিসফিস করলো,
—“দেখো রাত, আজ বৃষ্টি নামবে।”
~চলবে~
#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৭
বৃষ্টি নেমে গেছে সময়মতো। প্রকৃতি ভিজছে। ভিজতে ভিজতে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে গাছের ডালে ডালে।অনিলের আক্রমনে তিরতির করে কাঁপছে চকচকে সবুজ পাতা। মেঘবালিকার অবশ্য কোনোদিকে খেয়াল নেই। সে তখন ঘুমে বিভোর। চলন্ত গাড়ির বেগে মাথাটা বারবার কাত হয়ে জানালায় ঠেকে যাচ্ছে। নিভ্রান একহাতে ড্রাইভ করছে। তার আরেকহাত ব্যস্ত স্ত্রীর পড়ে যাওয়া মাথা সোজা করে দিতে। জানালা খোলা। মেয়েটার মাথাটা সোজা থাকছেইনা। বারবার ঠুকে যাচ্ছে জানালায়। অবশ্য এতে তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছেনা বলেই স্বস্তি। ঘুম ভাঙার কথাও না। নিভ্রান নিজহাতে রাতের খাবারের পর কয়েকটা ওষুধের ফাঁকে একটা আস্ত ঘুমের ট্যাবলেটও খাইয়ে দিয়েছিলো। এই ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সকাল।
জানালার কাঁচ নামানো। তালমাতাল হাওয়া। পিছের সিটে বসে আছে নিশাদ। মুখের উপর জ্বলছে ফোনের আলো। রুবিনা, নাহিদা, নওশাদ সাহেব অন্য গাড়িতে আসছেন। এক গাড়িতে তো এত মানুষের জায়গা হবেনা। নিভ্রান অবশ্য রুবিনাকে এ গাড়িতেই আনতে চেয়েছিলো কিন্তু নওশাদ সাহেবের নাকি নিভ্রানের উপর একরত্তি বিশ্বাস নেই। সে নাকি রাত্রির খেয়াল রাখতে পারবেনা। মেয়েটার শরীর অসুস্থ। সে রাগের বশে কখন কি করে ঠি ক নেই। তাই নিশাদকে পাঠিয়েছে সাথে। উল্টোপাল্টা কিছু হলেও যেনো নিশাদ সামলাতে পারে। আর রুবিনার খেয়াল রাখার জন্য ওখানে নাহিদা আছে।
রাত্রির মাথাটা এবার বেশ জোরেসোরেই বারি খেলো। নিভ্রান টার্ন নিচ্ছিলো বিধায় খেয়াল করতে পারেনি।
নিশাদ গর্জে উঠলো,”বাবা তো ঠি ক ই বলেছে। ভাবির মাথা তো আজ ঠুকতে ঠুকতেই ফেটে যাবে। তুই তো বিয়ে করেই বউয়ের মাথা ফাটিয়ে রীতিমত হসপিটালে ভর্তি করবি। বুক নাই তোর? হ্যাঁ? বুক নাই? বুক ছাড়া মানুষ তুই?”
নিভ্রান ভ্রু কুঁচকালো। ঘাড় ফিরিয়ে নিশাদকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিলো। নিশাদ তখনো কটমটে চোখে চেয়ে রয়েছে। রাত্রির দিকে তাকাতেই দেখলো মেয়েটা নেতিয়ে আছে। গাড়ির স্পিড স্লো করলো সে। হাত বাড়িয়ে আলতো করে মাথাটা টেনে নিলো বুকে। গায়ের ওড়না গুছিয়ে দিলো। ঘুমে অচেতন রাত্রিও কিভাবে যেনো টের পেলো প্রিয় মানুষটার উষ্ণতা। তন্দ্রাঘোরেও সে কেমন করে যেনো গুটিয়ে গেলো বুকের মাঝে।
নিশাদ চোখ নামালো। মিটিমিটি হেসে বললো,
—“তুই তো বেশ নির্লজ্জ হয়ে গেছিস ভাই। এবার আমাকেও নির্লজ্জ হওয়ার সুযোগ করে দে।”
নিভ্রান হাসলো। বাবার সাথে মাত্রাতিরিক্ত রেশারেশি হলেও ভাইয়ের সাথে তার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। একেবারে অচেনা, ছেলেমানুষী রুপটা কেবল নিশাদের সামনেই প্রকাশ পায়।
রাত্রির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সে ঠাট্টার সুরে বললো,
—“দিবো এক থাপ্পড়। সারাদিন তো বাবার আদেশে উঠানামা করতে করতেই তোর কোমড় বেঁকে যায়। বিয়ে করে বউকে কোলে নেয়ার আগে দেখবি বাবা তোকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে,”ওরে, আমার একমাত্র সোনার টুকরো ছেলেটা। বাবার কোল ছেড়ে কোথাও যেওনা।”
নিশাদ হাসলো। তবে এই হাসিতে কেমন যেনো একটা মন খারাপের আভাস, তিক্ততার ছোঁয়া। নিভ্রান না বললেও সে বুঝে যে নিভ্রানের একটা চাপা অভিমান আছে বাবার উপর। সে ভাবে বাবা হয়তো তাকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়। সেবার ঝগড়াঝাটির রেশ ধরে বাবা যখন ব্যবসার সব দায়িত্ব নিশাদকে দিয়ে দিলো তখন থেকেই কেমন যেনো নিজেকে গুটিয়ে একা করে ফেললো সে। আলাদা ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করলো। তারপর থেকে শুধু দুরত্ব আর দুরত্ব।
—“আমি বাবার একমাত্র ছেলে না ভাই। তুই কেনো বুঝিস না বাবা তোকেও সমান ভালোবাসে।”
—“তুই নিজেও জানিস তুই মিথ্যা বলছিস নিশাদ।”
নিভ্রানের কন্ঠটা এতোটাই গম্ভীর,ব্যাথাময় ছিলো যে বয়ে যাওয়া বাতাস গুলাও বুঝি থমকে গেলো। পরিবেশটাও কেমন আড়ষ্ট হয়ে উঠলো। নিভ্রান সহজেই ধরে ফেললো ব্যাপারটা। চন্চল নিশাদও তখন একদম চুপচাপ।
ড্রাইভ করতে করতেই নিভ্রান বুঝলো যতবার ভেজা দমকা হাওয়া শরীর ছুচ্ছে ঠি ক ততবারই রাত্রি থরথর করে কেঁপে উঠছে। তার সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। নিভ্রান নিজের পাশের কাঁচটা সুইচ টিপে উঠিয়ে দিলো। নরম গলায় ডাকলো,
—“নিশাদ।”
—“হুম?”
—“ওপাশের কাঁচটা একটু তুলে দে তো ভাই। ওর শীত করছে বোধহয়। কিভাবে কাঁপছে দেখ।”
নিশাদ হেসে ফেললো আবারো। সামনে ঝুঁকে জানালা লাগিয়ে দিলো,
—“তুই কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারবি,আমি কখনো ভাবিনি ভাই।”
নিভ্রান একনজর রাত্রির ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে আবিষ্ট কন্ঠে উওর দিলো,”আমিও ভাবিনি।”
________________
ভোরের আলো যখন প্রায় ফুরিয়ে গেছে। আকাশ থেকে ঝিঁমানো মেঘ ছুটি নিয়ে তেজি সূর্যের আবির্ভাব ঘটছে। তখনই অবিরাম চলতে থাকা গাড়ির ঘূর্ণায়মান চাকাটা রেহাই পেলো। গাড়ি থামলো নিভ্রানের বাসার গেটে। সিটবেল্ট খুলতে খুলতেই নওশাদ সাহেবদের গাড়ি পেছনে এসে দাড়ালো। এতো তড়িঘড়ি করে ঢাকায় ফেরার কারণ হলো রুবিনাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দিয়ে দিয়েছিলো সন্ধ্যার পরই। শুধু মাথার ক্ষতটায় ড্রেসিং করতে হবে রোজ আর কিছু ওষুধপত্র। ওখানে নিভ্রানের চেনা পরিচিত কেউ থাকেনা। আর রাত্রির মামার বাসায় থাকার তো প্রশ্নই উঠেনা। তাই হোটেল টোটেলের ঝামেলা না করে আজই ফিরে আসলো। নিভ্রান বলে দিয়েছে রুবিনা তার ফ্ল্যাটেই থাকবে রাত্রির সাথে। রাত্রি অবশ্য আপত্তি করেছিলো কিন্তু নিভ্রান তাকে এক ধমকে থামিয়ে দিয়েছে তখন। বলেছে,”তার সাথেও এখন রুবিনার একটা সম্পর্ক আছে। রাত্রি যেনো নাক না গলায়।”
নিশাদ গাড়ি থেকে বেরোতেই নওশাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,” মেয়েটা ঠি ক আছেতো?” নিশাদ উওর দেবার আগেই নিভ্রান দরজা খুললো। নওশাদ সাহেব এগিয়ে গেলেন। রাত্রিকে নিভ্রানের বুকের মাঝে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন। চাপা লজ্জা পেলো নিভ্রানও। তবে রাত্রিকে ছাড়লোনা। একপলক চোখাচোখি হলো। নিভ্রান দৃষ্টি নামিয়ে গাঢ় কন্ঠে বললো,”নামতে তো দিবেন?”
নওশাদ সাহেব সরলেন না। বরং রাত্রির কপালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে আৎকে উঠে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
—“গা টা গরম হয়ে আছে দেখছি। খালি তো পারো পাগলামি করতে। কে অসুস্থ কে সুস্থ সেটা দেখার তো সময় নেই। বলেছিলাম ঘুমের ওষুধ পুরোটা দিও না। ভেঙে দাও। একটা আস্ত পাওয়ারফুল ট্যাবলেট এইটুকুন মেয়েটার সহ্য হবে?”
নিভ্রান চোখ বুজলো। রাগ সংবরণ করলো। এই মানুষটা আর পারেই বা কি? ওর ভুল ধরতে পারা ছাড়া?
সে নিজের ইচ্ছায় রাতকে ওষুধ দিয়েছে? ডাক্তার ই তো বলেছে পুরোটা খাওয়াতে। রাত্রি যত স্ট্রেস ছাড়া আরামে ঘুমাবে ততই ভালো। তবে মুখে এসব কিছুই বলা হলোনা। শুধু বললো,
—“সরুন। নামতে দিন।”
নওশাদ সাহেব চেঁতে উঠলেন,পারো কি শুধু একরোখাপনা ছাড়া? সারাটাদিন পুরো ওলোট পালট করে বিয়ে করলে। মেয়েটার উপর দিয়ে এতো ধকল গেলো সেটার কোনো তোয়াক্কাই নেই। তোমার বাবা আমি। আর যেখানে যাই করো না কেনো। অন্যর মেয়েকে নিয়ে এমন উড়োস্বভাব আমি সহ্য করবোনা বলে দিলাম।
—“আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন ও এখন আমার স্ত্রী। আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। অন্যর মেয়ে অন্যর মেয়ে বলাটা কি আদৌ সমীচিন?
—“বিয়ে করেছো বলে কি যা ইচ্ছে তাই করবে? মেয়েটা আমার মেয়ের মতো। ওর সাথে তো তোমাকে এভাবে অত্যাচার করতে দিবোনা আমি।”
নিভ্রান চিল্লিয়ে উঠলো এবার,
—“আপনার কোনদিন দিয়ে মনে হচ্ছে আমি ওর সাথে অত্যাচার করছি?”
নিশাদ এগিয়ে এলো। বাবার হাত টেনে সরিয়ে বললো,”বাবা, এখানে চিৎকার চেঁচামেচি করোনা। উপরে যাও। আমরা আসছি।”নওশাদ সাহেব গেলেননা। নাহিদা রুবিনাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে ততক্ষনে।
রাত্রিকে বুক থেকে সরিয়ে বেরিয়ে এলো নিভ্রান। ওপরপাশে যেয়ে দরজা খুলে বাবার সামনেই পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলো তাকে। গেট পেরিয়ে ঢুকতে ঢুকতে গলা বাড়িয়ে বললো,” গাড়ি টা পার্ক করে দিস নিশাদ।”
___________
নিজের ঘরেই রাত্রিকে শুইয়ে দিয়েছে নিভ্রান। ঘরে এসি চলছে। মেয়েটা রীতিমত ব্ল্যাঙ্কেটের ভিতর মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যেই রুবিনাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে,”রাত্রি নাকি ছোট থেকেই ঠান্ডা একদম সহ্য করতে পারেনা। অল্পতেই দাঁত কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। মেয়েটা খুব উষ্ণপ্রিয়।”
নিভ্রান আনমনেই হাসলো। সে ছোট থেকে এসিতে অভ্যস্ত। বাসা থেকে বের হওয়ার পর সামান্য লিফ্ট দিয়ে নিচে নেমে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতেই ঘেমে একাকার হয়ে যায় শরীর। তারপর গাড়িতে এসি। অফিসেও সারাদিন এসির মধ্যে। আর মেয়েটা কিনা ঠান্ডা সহ্য করতে পারেনা? হাহ্!
বাইরে প্রায় সকাল হয়ে গেছে। রুবিনার শোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছে সে। বাকি সবাইও হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। কম খাটুনি তো হয়নি। একদিনে যেয়ে আবার একদিনে ফিরে আসা। যে সে ব্যাপার নয়।
ঘরের বাতি নিভিয়ে রাত্রির পাশেই শুয়ে পড়লো নিভ্রান। কনকনে ঠান্ডায় জমে আসা বিছানায় একটুখানি তপ্ত সংস্পর্শ পেয়ে সুড়সুড় করে নিভ্রানের অনেকটা কাছে চলে গেলো রাত্রি। নিভ্রান হঠাৎই হাসলো। এসির রিমোটের বাটন চেপে তাপমাত্রা কমিয়ে দিলো আরো কয়েক ডিগ্রি।
~চলবে~
[বানান ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। রিচেক হয়নি।]