#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩০
ঘরে প্রকট নিরবতা। এয়ার কন্ডিশনারের ভনভনে ক্ষীণ একটা সুর শোনা যাচ্ছে। পর্দা টানা, আলো নেভানো। সূর্যের তেজ নেই আজ। পর্দা ফুড়ে কেমন আবছায়া সাদা। নিভ্রানের ঘুম ভাঙলো সাতটার দিকে। রাত্রি তখন তার শক্তশান্ত বাহুতে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। আলুথালু শরীরটা ঠান্ডায় চুপসে গেছে। এদিকে একটু উষ্ণতার ঠাঁই পেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে শুয়ে আছে সে। নিভ্রান হাই তুললো। ব্ল্যাঙ্কেট সরালো উপর থেকে। অপ্রস্তুত ভাবটা যেনো আচমকাই দলবল নিয়ে হানা দিলো মুখজুড়ে। রাত্রির শাড়ির আঁচল তার বুকের উপর লুঁটোপুঁটি খাচ্ছে। অনাবৃত নারী দেহের দিকে চেয়ে কিছুক্ষণ কেটে গেলো খুব নিভৃতে, অত্যন্ত অন্যচোখে। ভিন্ন অনুভূতিতে তপ্ত হয়ে উঠলো পুরুষালী মন। বিচলিত ভঙ্গিতে দৃষ্টি সরালো নিভ্রান। চোখের পলক পড়ছে ঘনঘন। শ্বাসপ্রশ্বাস অতি তীব্র। বুকের উপর থেকে আচঁল সরিয়ে রাত্রির কাঁধে টেনে দিল সে। ঘুমের ঘোরে মেয়েটার খেয়াল হয়নি হয়তো। ঘুমন্ত তৈলাক্ত মুখটা কি আশ্চর্য সুন্দর! ফোলা ফোলা চোখের নিচে তাকালেও যেনো শান্তি মিলে।
পাশ থেকে রিমোট নিয়ে এসি অফ করে দিলো নিভ্রান। গাল ছুঁয়ে দেখলো রাত্রির শরীর বরফ ঠান্ডা। শীতে কাবু খোদ তুষারকন্যা যেনো অগ্নিমানবের কাছে একটুখানি উত্তাপের আশ্রয়ে লেপ্টে রয়েছে।
নিভ্রান আবার হাই তুলল। আঙ্গুল দিয়ে চোখ ডললো। রাত্রি বাহুতে মাথা রেখেছে রাত দুটোর দিকে এরপর থেকে আর একরত্তি নড়েনি সে। রাতের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে যায় যদি?
পিঠের হাড় ব্যাথা করছে। শরীরে মনে হচ্ছে জং ধরে গেছে। অফিসেও যেতে হবে আজ। বিয়ে, বাকি গোছগাছ করে নেওয়া সব মিলিয়ে এ’কদিন একদম কাজ থেকে দূরে ছিলো। কতকত মিটিং পেন্ডিং পড়ে আছে। আবার শুরু ব্যস্ততা।
একহাতে রাত্রির মাথাটা আলগা করে উঠিয়ে বাহু সরিয়ে নিলো নিভ্রান। খুব সাবধানে বালিশ নিচে নামিয়ে সেখানে শুইয়ে দিলো। একটুপর ডেকে দিবে। ভার্সিটি আছে। তার জন্য মেয়েটার পড়ালেখায় কোন সমস্যা হোক সে চায় না।
মুখ হাত ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই দরজায় খটখট। এত সকালে কে এলো? মা- বাবার তো এতক্ষণে রওনা হয়ে যাওয়ার কথা। গলায় ঝুলানো টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে দরজা খুললো সে। বাইরে নিশাদ। সাদা শার্ট আর বাদামী রংয়ের প্যান্ট পরা চওড়া কাঁধের সুপুরুষ যুবক।
নিভ্রান ভ্রু কুচকে বললো,
—“রওনা দিসনি এখনো?”
—“দিবোতো, ভাবির সাথে দেখা করতে আসলাম।”
নিভ্রান ঘাড় বাকিয়ে বিছানায় তাকালো। উঁকি দিলো নিশাদও। রাত্রি তখনো গভীর ঘুমে। নিশাদ সোজা হলো।
—“তুই কি সবসময় ঘুমই পাড়িয়ে রাখবি? বিয়ের দিন থেকে এই যে ঘুম পাড়াচ্ছিস। বিয়ের আগে ঘুম, বিয়ে করে ঘুম। এখানে এসেও ঘুম। ভাবী তো ভাববে সে জামাইবাড়ি এলো নাকি ঘুমের ওষুধের কারখানায়? জামাই ধরে ধরে তিনবেলা ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।”
নিশাদ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই নিভ্রান চোখ রাঙালো,
—“ও নিজেই ঘুমাচ্ছে। আমি কিছু করিনি।”
—“তা করবি কেনো? তুই শুধু ঘুমাতেই দে। বিয়ের অভাবে বাবা ডাক তো শুনতেই পাচ্ছিনা এখন তোর মতিগতি দেখে বোধ হচ্ছে চাচ্চু ডাকটা শোনার ভাগ্যও হবেনা।”
নিভ্রান বিস্ফোরিত কন্ঠে বললো,”বিয়ের মাত্র দুদিন হয়েছে।”
—“তোহ?”
নিভ্রান হেসে ফেললো। কাঁধে চাপড় মেরে বললো,”মা কোথায়? নিচে নেমে গেছে?”
—“হুম, ভেবেছে তোরা ঘুম তাই আর বিরক্ত করেনি। আসি তাহলে। দরজাটা আটকে দিয়ে যা।”
নিভ্রান মাথা নাড়ালো। দরজা আটকে দেয়ার আগমূহুর্তে নিশাদ চিরচেনা ঠাট্টা বাদ দিয়ে বিষন্ন কন্ঠে বললো,”তুই একদিন ভাবিকে নিয়ে বাসায় আসলেই পারিস ভাই।”
উওরে নিভ্রান মলিন হাসলো শুধু।
___________________
ঘুম থেকে উঠেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছোটখাটো একটা কান ফাটিয়ে দেয়া চিৎকার করে উঠলো রাত্রি। নিভ্রান সবে একটু শেভিং ফোম মেখেছে গালে। রেজার দিয়ে একটা টান দিতেই রাত্রির চিৎকারে হাত কেঁপে গেলো তার। কেটে গেলো অনেকখানি। গালের পাতলা চামড়া কেটে বেরিয়ে এলো রক্ত।সাদা শেভিং ফোমে লাল রক্ত মেখে একাকার। নিভ্রান হন্তদন্ত হয়ে রেজারটা নামিয়ে বেরোতে বেরোতে বললো,কি হয়েছে?”
রাত্রি তখন দ্রুত বিছানা থেকে নামছিলো। নিভ্রানের প্রশ্নের উওরে না তাকিয়েই সে বললো,”কিছু হয়নি, আপনি আমাকে…”
বলতে বলতেই তাকালো সে। নিভ্রানের রক্তমাখা গাল দেখে দ্বিগুন জোরে চিৎকার করে উঠলো,”হায় আল্লাহ্! আপনার গাল। কি করেছেন? আল্লাহ্।” আতঙ্কে কন্ঠ কাঁপছে রাত্রির। কেমন একটা ব্যাথা, যন্ত্রনা, ভয়ের আভাস। যেনো কাঁটাটা তারই কেটেছে। নিভ্রান সে অবস্থায়ই ঠোঁট টেনে হাসলো। রক্ত গুলোকে ধন্যবাদ দিতে মন চাচ্ছে। তাদের জন্যেই তো প্রেয়সীর উৎকন্ঠা দেখার সৌভাগ্য হলো তার।
তাকে হাসতে দেখে মেজাজ চড়ে গেলো রাত্রির। নিভ্রানের হাত টেনে ওয়াশরুমে নিয়ে যেয়ে বেসিনের কল ছেড়ে হাত ভেজালো সে। নরম করে গালের ফোম আর রক্ত মুছে দিতে দিতেই কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো এতক্ষনের রুগ্নমূর্তি চেহারা,”বাচ্চা নাকি আপনি? একটু দেখে করবেন না। এমন করলে হয়?”
নিভ্রান হেসে ফেললো আবারো। এইযে রাতের কুঁচকে আসা চোখ, উপচে আসা কান্না, কান্না আটকে রাখার জন্য থরথর করে কাঁপা ওষ্ঠ। সবই তো তার ব্যাথায় ব্যাথিত হবার বহি:প্রকাশ।
নিভ্রান একটু ঝুঁকলো। গালের রাখা হাতের কব্জি ধরে চোখ মিলিয়ে বললো,”পুরো গালটা কেটে ফেলি? ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাক সব? আমার জখম দেখে তুমি আরো অস্থির হও। তোমার অস্থিরতায় আমিও একটু শান্তি পাই? ক্ষতটাও নাহয় এই নরম ছোঁয়ায়-ই সেড়ে উঠুক?
শেষের কথাটা শোনামাত্র হাত সরানোর চেষ্টা করলো রাত্রি। নিভ্রান ছাড়লোনা। রাত্রি চোখ নামিয়ে বললো,
—“আপনি সত্যি পাগল। পুরোদস্তর পাগল।”
নিভ্রান এলো চুল কানের পিছে গুঁজে দিতে দিতে বললো,
—“চিৎকার করলে কেনো তখন?”
রাত্রি ছোট্ট গলায় বললো,
—“দেরি হয়ে গেছে, আমি কখনো এত দেরিতে উঠিনা। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে চল্লিশ মিনিট পর।”
নিভ্রান হেসে বললো,
—-“দেরি হবেনা। ধীরেসুস্থে ফ্রেশ হও। ব্রেকফাস্ট করি। তারপর আমি পৌছে দিব সময়মতো।”
—“রাখেন আপনার ফ্রেশ হওয়া। আগে ব্যান্ডএইড লাগিয়ে দেই, চলুন”
শাড়ি বদলে থ্রিপিস পরে নিয়েছে রাত্রি। বেগুনী রংয়ের কামিজের সাথে বেগুনী ওড়না মাথায় মেয়েটা যেনো একটা সদ্য ফোঁটা রুয়েলিয়া ফুল। মন কাড়া বেগুনী রং!
রুবিনার সাথে দেখা করে, একসাথে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লো তারা। গাড়ির ভিতর বসে রাত্রি একমনে বললো,”জানেন, মা যে আমার সাথে থাকে। এই যে আমি সকালে উঠেই মাকে দেখতে পাই। হাত বাড়ালেই জড়িয়ে ধরতে পারি। আমার না বিশ্বাস হয় না। সত্যি বিশ্বাস হয়না।”
_______________
রাতে রাত্রির বেরোতে দেরি হলো। আটটার জায়গায় এখন আটটা পয়ত্রিশ। রাস্তার হলুদ হেডলাইটের আলোয় নিভ্রানকে দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ওপাশে গাড়ি পার্ক করে দরজার সাথে হেলান দিয়ে এদিকে ফিরে রয়েছে সে। কানে ফোন। রাস্তার এদিক ওদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে কথা বলছে। কপালের ভাঁজ আর মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে ফোনের ওপরপাশের মানুষটার সাথে তুমুল বাঁকবিতন্ডতা হচ্ছে।
নেভি ব্লু শার্টের ইস্ত্রি নষ্ট হয়ে গেছে। একহাত কনুই পর্যন্ত গুটানো আরেকটা ফুলহাতা। গালের ব্যান্ডএইড টা নেই। জায়গাটা লাল হয়ে আছে। রাত্রি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো।
লোকটার মেজাজ চরম খারাপ হয়ে আছে। সে যে দেরি করেছে এখন কি তাকেও বকবে?
গেটের সামনে রাত্রিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মেজাজ খারাপেও চেহারা ঠান্ডা হয়ে গেলো নিভ্রানের। ঠোঁটের কোঁণে ফুটে উঠলো হাসির রেখা। রাত্রি ততক্ষনে রাস্তা পার হয়ে প্রায় এসে পরেছে। নিভ্রান সোজা হয়ে দাড়িয়ে একহাত বাড়িয়ে দিলো। রাত্রি কাছে আসতেই এককদম এগিয়ে ভরা রাস্তায়ই মাথা টেনে ছোট্ট করে চুমু খেলো কপালে। ক্লান্তিপাখি যেনো ফুড়ুৎ করে উড়াল দিলো। অতিক্ষুদ্র এই ভালবাসার প্রকাশেই স্তব্দ হয়ে গেলো রাত্রি। চোখের কোঁণে জমা হলো বিন্দুকণা। রাস্তার আলোতে চিকচিক কর উঠলো জল।
নিভ্রান তাকে একহাতে আগলে ধরে কথা বলছে। ফোনের মানুষটার সাথে সেই আগের মতোই। রূঢ় কন্ঠ, ধমকাধমকি। দু’তিনমিনিট সেভাবেই কেটে গেলো। রাত্রি চুপসে দাড়িয়ে আছে। নিভ্রান গম্ভীর গলায় বললো,
—“আই’ল কল ইউ লেটার।”
ফোনটা কেটে হাতঘড়িতে সময় দেখলো সে। গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বললো,”এতো দেরি হলো যে? কতক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছি।”
রাত্রি আমতা আমতা করলো। কোন রকমে বললো,”আমি আসলে..”
নিভ্রান অর্ধেক ঢুকে তার সিটবেল্ট বেঁধে দিলো। দরজা লক করে বললো,
—“ক্লান্ত দেখাচ্ছে রাত। বসো, আমি ঠান্ডা পানি কিনে আনি।”
_______________
বাসায় এসে আবার জামা বদলে শাড়ি পরে নিয়েছে রাত্রি। খয়েরি রংয়ের একটা সুতি শাড়ি। গোসল থেকে বেরিয়ে আধভেজা চুলে সাদা তোয়ালে পেঁচিয়ে খাবার গরম করার জন্য রান্নাঘরে ঢুকলো সে। বুয়া সব রান্না করেই যায়। এখন শুধু গরম করে খেতে হবে। সব তরকারি গরম করে টেবিলে সাজিয়ে রুমে গেলো সে। নিভ্রান সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করছে। রাত্রি ঢুকতেই তার চোখ আটকালো নিষিদ্ধ জায়গায়। রাত্রি তোয়ালে খুলে চুল ঝাড়ছে। মোমের মতো মসৃন চেহারায় পানির ছিঁটাফোঁটা। শাড়ির আচঁল কোমড়ে গোঁজা। নিভ্রান ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। এই মেয়ের খামখেয়ালিপনা শেষ হবার নয়। তাকে অনূভুতির উত্তাল সাগরে চুবিয়ে চুবিয়ে মারবে তবু একবারে ডুবতে দিবেনা। কি অসহ্য! কি দূর্বিষহ!
—“রাতের খাবার খাবেন। উঠেন।”
নিভ্রানের ধ্যান ভাঙলো। মোহ কাটলো আবার কাটলো না। আবারো ফোনের দিকে দৃষ্টি স্হাপন করে সে বললো,
—“হুম?”
—“রাতে খাবেন না?”
—“খাবোতো।”
রাত্রি তোয়ালেটা ব্যালকনিতে শুকাতে দিয়ে ফিরে এলো। তাড়া দিয়ে বললো,”চলেন”।
নিভ্রান উঠে দাড়ালো। দৃষ্টি ঘুরাতে ঘুরাতে রাত্রির বাহু ধরে কাছে টেনে কোমড়ে গোঁজা আচঁল টা খুলে দিয়ে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,” “সামলে থাকোনা একটু”।
মূহুর্তেই বিহ্বল চোখে তাকালো রাত্রি। নিভ্রান তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে কানের কাছে ফিসফিস করলো,”আমি কিন্তু বেসামাল হবার পথেই আছি।”
________________
খাবার শেষে ব্যালকনিতে এসে দাড়িয়েছে রাত্রি। নিভ্রান রুমে অফিসের কি সব কাগজপত্র নিয়ে বসেছে। তাই আর বিরক্ত করেনি। স্হির দৃষ্টি নিবন্ধিত কালো কুচকুচে পানিতে। নদীর পানিরও কত রূপ। একবার মন কাড়ে। একবার ভয় জাগায়। আজকে চাঁদ উঠেনি। উঠলে হয়তো এই বিভৎস্য রুপ হতোনা জলের। রুপালি সৌন্দর্যে স্নিগ্ধতা ছড়াতো সে।
কাঁধের দিকটায় গরম নিশ্বাস। রাত্রি চমকে উঠলো। পিছে ফিরার আগেই তার পিঠে বুক ঠেকিয়ে দু’পাশ দিয়ে রেলিংয়ে হাত রাখলো নিভ্রান। লম্বা হওয়ার রাত্রি তার বুক অবধি আসে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করেই নিভ্রান আচ্ছন্ন কন্ঠে বললো,
—“কি দেখছো এভাবে?”
রাত্রি আমতা আমতা করলো। মানুষটা একটু এভাবে কথা বললেই তার কন্ঠনালিতে শব্দজট বেঁধে যায় যেনো। গোছানো কথাও অগোছালো হয়ে যায়। সময় ও যেনো ধীরে ধীরে চলে। পার হতেই চায়না।
রাত্রির নিরবতা দেখে নিভ্রানই মুখ খুললো। ধীর কন্ঠে বললো,”আমি কাছে এলেই যত আমতাআমতা তোমার।”
রাত্রি ফট করে বললো,”নদী দেখছিলাম।”
—“হুম? নদী দেখছিলে? নদীতে কি আছে?”
—“আপনি যানতো, কাজ করেন। আপনার এখানে কি?”
নিভ্রান দুষ্টুমিমেখে বললো,
—“এখানেই তো আমার সব।”
রাত্রি উশখুশ করলো। লজ্জামাখানো অধৈর্য কন্ঠে বললো,
—“যাননা।”
~চলবে~
#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৩১
নিভ্রানের ফোন বাজছে বিকট শব্দে। ঘুমের মধ্যই চোখমুখ কুঁচকে গেলো রাত্রির। ফোনটা বাজতে বাজতে একসময় থামলো। ঘরটা আবারো নিরবতায় ডুবে যেতেই চোখমুখ স্বাভাবিক করে ভালোকরে নিভ্রানকে আঁকড়ে ধরলো সে। ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। আজকাল বড্ড বাজে অভ্যাস হয়েছে। লোকটার বাহু ছাড়া ঘুম আসেনা। বুকে মুখ না গুঁজলে চোখের পাতা বন্ধই হয়না। নিভ্রান গতকাল অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছে। অফিসের কি সব কাগজপত্র ঘাটাঘাটি করতে করতেই রাত আড়াইটা বেজে গেছিলো। তারপর শুয়েছে। সেই ততক্ষণ তার চোখেও ঘুম ছিলনা কেনো যেনো।
মিনিট না পেরোতেই আবার দ্বিগুন উদ্যমে বাজতে লাগলো ফোন। এবার সরাসরিই চোখ মেললো রাত্রি। কোমড় থেকে নিভ্রানের হাতটা সরিয়ে একটু উঠে হাত বাড়িয়ে বালিশের পাশ থেকে ফোনটা নিলো। অফিসের ম্যানেজার ফোন করেছে। বাটন চেপে শব্দ বন্ধ করলো সে। মানুষটা একটু শুয়েছে তাও শান্তি নেই। সারাক্ষণ শুধু কাজ আর কাজ।
ফোনটা বালিশের নিচে ঢুকিয়ে নিভ্রানের দিকে তাকালো সে। মাথার ঝাঁকড়া চুল এলোমেলো। রাত্রি আলতো করে হাত চালিয়ে তা আরো অগোছালো করে দিলো। চোখের নিচে ভাঁজ পরে গেছে গভীর ঘুমের কারণে।গালের কাঁটা দাগটায়ও মানিয়ে গেছে সুদর্শন চেহারায়। রাত্রি হেসে ফেললো নিশব্দে। মাথা নামিয়ে কাছ থেকে দেখলো। কপালে কপাল ঠেকালো। কাটা জায়গাটায় আঙ্গুল ছুঁয়ে দিতেই নিভ্রান ঘুমমাখা অস্ফুট কন্ঠে বললো,”কে ফোন করেছিলো রাত?”
রাত্রি চমকে গেলো। থতমত খেয়ে সরে যেতে চাইতেই নিভ্রান আটকে ফেললো। পিটপিট করে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললো,”তুমি কি আমাকে ভয় পাও?”
—“ভয় পাবো কেনো? ছাড়ুন।”
—“ভয় না পেলে ছাড়বো কেনো?”
—“আচ্ছা ভয় পাই, এখন ছাড়ুন।”
নিভ্রান হেসে বললো,”ভয় পাবা কেনো? আমি কি করেছি তোমাকে?” সদ্য ঘুম ভাঙা চেহারায় হাসিটা অবিশ্বাস্য সুন্দর দেখালো। রাত্রির চোখ আটকে গেলো। মন মিইয়ে গেলো। গাল রাঙা হলো। ভর করলো আছন্নতা, নিমগ্নতা।
নিভ্রান নরম গলায় বললো,”কি হলো?”
রাত্রি ঘোর কন্ঠে বললো,”আপনি এতো সুন্দর কেনো?
নিভ্রান হাসলো আবারো। আচমকাই দু’গালে হাত রেখে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বললো,”কে ফোন করেছিলো? দাওতো।”
রাত্রি সরে গেলো। বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে নিভ্রানের হাতে ধরিয়ে দিলো। নিভ্রান উঠে বসেছে ততক্ষনে। ঘুমটা পুরো হয়নি। গা ম্যাজ ম্যাজ করছে। ফোন চেক করলো। কলব্যাক করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো। রাত্রি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে চুলে হাত খোঁপা করলো। বিছানাপত্তর ঝেড়ে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।
_______________
নাস্তার টেবিলে বসে রাত্রি বললো,”আপনি খালা কে বলবেন উনার আর রান্না করা লাগবেনা। রান্না আমিই করতে পারবো।”
নিভ্রান চোখ ছোট ছোট করে বললো,”তুমি করবে কেনো? এত কষ্টের কোনো দরকার নেই।”
—“কষ্ট কোথায়? আমি তো আগে নিজের রান্না নিজেই করতাম।”
—“তো?”
—“তো এখনও আমি করবো। আপনার ভাললাগে রোজ রোজ একই খাওয়া খেতে?”
—“অভ্যাস হয়ে গেছে রাত।”
রাত্রি ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো,
—“আমার অভ্যাস নেই। আপনি মানা করে দিবেন মানে দিবেন।”
রুবিনার সামনে আর কথা বাড়ালোনা নিভ্রান। ছোট্ট করে উওর দিলো,”আচ্ছা, ঠি কাছে।”
_________________
ঝালমুড়ি হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে নিভ্রান। ঝালমুড়ির প্যাকেট চুপসে হাত হলুদ হয়ে যাচ্ছে অথচ মেয়েটার আসার নাম নেই। রোজ দেরি করে। নিভ্রান চুল ব্রাশ করতে করতে গেটের দিকে চেয়ে ছিলো একদৃষ্টে। সারাদিন দেখতে পায়না এমনেই। সন্ধ্যাবেলা কই একটু তারাতারি করবে। নাহ্। তাকে অপেক্ষা করিয়ে এই মেয়ে নিশ্চিত পৈশাচিক আনন্দ পায়।
হঠাৎ পাশ থেকে কেউ একজন ডাক দিলো,”বাবা, তোমার সাথে একটু কথা বলা যাবে?”
নিভ্রান ঘাড় ফিরালো। একজন মধ্যবয়স্ক লোক। পোশাক আশাকে বোঝা যাচ্ছে ভদ্রলোক ফালতু কথা বলার জন্য আসেনি। নিভ্রান নড়ে চড়ে দাড়ালো। ভদ্রভাবে বললো,”জি বলুন।”
ভদ্রলোক এবার হাসলেন। সহজ হয়ে বললেন,
—“কেমন আছো?”
নিভ্রান সৌজন্যমূলক হেসে বললো,
—“জি ভালো…কিন্তু আপনি কে? ঠি ক চিনতে পারলাম না আংকেল।”
—“আমাকে চিনবা না তুমি। চেনার কথাও না।”
নিভ্রান বলার মতো কিছু পেলোনা। ভদ্রলোক কিভাবে কথা এগিয়ে নিয়ে যাবে তাও বোধগম্য হলোনা। অপরিচিত একটা লোকের তার সাথে কি কথা থাকতে পারে?
ভদ্রলোক নিজে থেকেই একটু কাছে এসে দাড়ালেন। গলা নামিয়ে অনুসন্ধানি কন্ঠে বললেন,”তুমি রাত্রি মেয়েটাকে নিতে আসোনা? এই বাসায় পড়ায় যে?”
নিভ্রান কিন্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে বললো,”জি।”
ভদ্রলোকের চোখ চকচক করে উঠলো।
—“তুমি কি ওর আত্নীয়?”
নিভ্রান বুঝতে পারলোনা কি বলবে। সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালো শুধু। ভদ্রলোকের কথাবার্তার শেষ টা কি দিয়ে হবে ভাবতেই মাথা ঘুরাচ্ছে।
ভদ্রলোক নিভ্রানের হাতের দিকে তাকালেন। ঝালমুড়ি দেখে বিস্তর হেসে বললেন,”ও কি তোমার বোন? তুমি বড়ভাই নিশ্চয়?”
নিভ্রান দুই ভ্রু উচিয়ে কয়েকবার পলক ঝাপটালো। কথাটা হজম করার চেষ্টা করতে করতে বললো,”সরি?”
ভদ্রলোক এবার আরো একটু এগোলেন। উজ্জ্বল চোখে চেয়ে বললেন,
—“আসলে ওকে আমাদের খুব পছন্দ বুঝলে? ও তো খুব চুপচাপ থাকে তাই ভাবছিলাম একেবারে ওর পরিবারের সাথেই কথা বলবো। আমার ভাতিজার জন্য…”
নিভ্রান খুক খুক করে গলা ঝাড়লো। একআঙ্গুলে কপালের কোণ ঘষে বললো,
—“রাত বিবাহিত আংকেল। আমি ওর হাসবেন্ড। ও আমার বউ, ছোটবোন না।”
ভদ্রলোক যেনো বিষম খেলেন। জোর গলায় বললেন,
—“বিবাহিত? কে বলেছে?”
নিভ্রান হতবিহ্বল কন্ঠে বললো,”আমার বউ, আমি জানবোনা ও বিবাহিত?”
—“না মানে…ও তো কখনো বলেনি।”
নিভ্রান বললোনা কিছু। হাসবে না কাঁদবে দোটানায় পড়ে গেছে।
ভদ্রলোক আবার বললেন,”ও আসলেই তোমার বউ?”
নিভ্রান হাঁফ ছেড়ে বললো,”জি আংকেল। আপনাকে কাবিননামার ছবি দেখাবো? আচ্ছা একমিনিট।” বলে সেকেন্ডেই ফোন বের করলো সে। ছবি ছিলো তার কাছে। বের করে জুম করে বললো,”এইযে আংকেল। পড়েন।”
ভদ্রলোক অসন্তুষ্টি নিয়ে চাইলেন। একপলক দেখে বললেন,”ও আচ্ছা আচ্ছা। কিছু মনে করোনা। আমি বুঝিনি।”
নিভ্রান ফোনটা পকেটে ঢুকালো। মেজাজটা চরম খারাপ হলেও মুখে বললো,”জি ঠি কাছে, সমস্যা নেই। কিছু মনে করিনি।’
ভদ্রলোক যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রাত্রির দেখা মিললো। গেটের সামনে দাড়িয়ে আছে রাস্তা ফাঁকা হওয়ার জন্য। এপাশে আসবে। একহাতে মাথার ওড়না ঠি ক করছে। নিভ্রান নিজেই এগিয়ে গেলো। ওপাশে পৌঁছাতেই রাত্রি হাত বাড়িয়ে দিলো ধরার জন্য। নিভ্রান হাসলো। প্রশান্তির হাসি, পূর্ণতার হাসি, প্রেয়সীর ভরসা অর্জন করতে পারা অদম্য দূর্বার হাসি।
সাবধানে রাস্তা পার করে গাড়িতে বসিয়ে ঝালমুড়ি ধরিয়ে দিলো হাতে। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতেই রাত্রি ঝালমুড়ি চিবাতে চিবাতে বললো,
—“আপনি রুমাইসার বাবার সাথে কি কথা বলছিলেন?”
নিভ্রান বুঝলো ভদ্রলোক রাত্রির স্টুডেন্টের বাবা। কি বিশ্রি অবস্থা! পড়াতে এসেও শান্তি নেই। বউ নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে গেছে।
গাড়ির চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে সে ফিচেল কন্ঠে বললো,
—“তোমার জন্য বিয়ের সমন্ধ এসেছিলো রাত। নাকচ করে দিয়েছি। আমার বউকে আমি কেনো বিয়ে দিবো?”
~চলবে~
[রি-চেক হয়নি। বানান ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন]