এ শহরে বৃষ্টি নামুক পর্ব-৪০+৪১

0
1242

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৪০

রাত গভীর হবার পথে। ঘড়ির কাঁটা গড়াচ্ছে আপন স্বভাবে, নিজগতিতে। আকাশ তারা নেই। চাঁদ নেই। মেঘগুলো সাদা হয়েছে খুব কিন্তু বৃষ্টি নামছেনা। কোথায় যেনো একটা বাঁধা। অদৃশ্য কাঁটাতার। বৃষ্টির জল আঘাত পাবে। সাদা শাড়িটা লন্ড্রি বিনে রেখে দিলো নিভ্রান। রক্ত মেখে আছে আঁচলে। দেখলেই কেমন ভীত হয়ে উঠে মন। একটা শনির আশঙ্কা। কম্পমান হৃদয়। শাড়ি বদলে দিয়ে একটা আকাশী রংয়ের পাতলা কামিজ রাত্রিকে পড়িয়ে দিয়েছে সে। মিস.নিকিতা বলে গিয়েছিলো একঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরবে অথচ দেড়ঘন্টার বেশি হয়ে গিয়েছে ও নড়েনি বিন্দুপরিমানও। ঘরের বাতি নিভানো। বাইরে থেকে আগত মৃদু আলোয় আঁধার কাটছে।
নিভ্রান রাত্রিকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে রইলো কতক্ষণ। শ্বাস- প্রশ্বাসতো একদম স্বাভাবিক। কপালে কি বেশি ব্যাথা পেয়েছে? মাথাব্যাথায় জ্ঞান আসছেনা? যেদিন বমি হলো সেদিনই মধ্যরাতে উঠে বসেছিলো মেয়েটা। পেটে ব্যাথা করছিলো নাকি। সে ভেবেছে নরমাল ফুড পয়জন। কিন্তু না হয়তোবা!
বাইরের একটা ধাবিত দমকা হাওয়া শরীর ঠান্ডা করে দিলো। রাত্রি অস্ফুট আওয়াজ করলো। হাল্কা গোঙানি। নিভ্রান মাথা উঠালো। মুখ বরাবর তাকিয়ে গালে হাত রেখে দ্রুত ডাকলো,”রাত? রাত? রাত উঠো।”
রাত্রি তাকালো। আধবোজা চোখ। দূর্বল চোখের পাতা। নরম দৃষ্টি। শুকনো রুক্ষ ঠোঁট নাড়ানোর চেষ্টা। মনে পরলো সেই মাথা ঘোরানো, চোখের সামনে আচানক সব কালো হয়ে যাওয়া। কপালে কি অসহ্য একটা ব্যাথা!
মুখে হাসি ধরা দিলো নিভ্রানের। মোটা ব্যান্ডেজের উপরই ঠোঁট ছোঁয়ালো সে। রাত্রি শক্তিহীন হাতটা তার ঘাড়ে রাখলো। নিভ্রান আবার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো একই জায়গায়। চাপা গলায় বললো,”ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে রাত, খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।”
রাত্রি হাসলো একটু। কোনরকমে ঠোঁট নাড়িয়ে তেজশূন্য কন্ঠে বললো,
—“ঠি ক আছিতো। শান্ত হন।”

নিভ্রান উঠে পরলো। আলো জ্বালিয়ে দিলো। রাত্রিকে দু’হাতে ধরে বিছানায় হেলান দিয়ে বসালো।
রাত্রি মাথা চেপে ধরলো সঙ্গে সঙ্গে। আয়নায় দেখলো কপালের ব্যান্ডেজ। আঙ্গুলের ব্যান্ডেজ টাও চোখে পড়লো সহজেই।
নিভ্রান বাইরে গেলো। ভাত নিয়ে আসলো প্লেটে করে। রাত্রি দাড়িয়ে পরেছে একা একাই। একহাতে বিছানার ব্যাকসাইড ধরে টলমলে পায়ের ব্যালেন্স রাখছে। নিভ্রান প্লেটটা নামিয়ে রাখতে রাখতে ধমকে উঠলো,

—“একা একা উঠেছো কেনো?”

রাত্রি থতমত খেয়ে মিনমিন করে বললো,”ওয়াশরুমে যাবো।”

নিভ্রান এগিয়ে গিয়ে দু’বাহু ধরলো। ভরাট গলায় বললো,
—“তো? আমাকে বললেই তো হয়। একা একা উঠবানা আর, খবরদার।”

—“উফফ! আমি ঠি ক আছিতো। আপনি অযথাই চিন্তা করছেন।”

ভাতের শেষ লোকমাটা মুখে তুলে দিয়ে নিভ্রান খেয়াল করলো রাত্রি একহাতে পেট চেপে ধরেছে। একপলক চেয়ে সে আস্তে করে বললো,
—“পেটে ব্যাথা?”

রাত্রি কপালে ভাঁজ ফেলে বিরক্তি নিয়ে বললো,
—“হু, তরকারিতে ঝাঁল বেশি হয়েছে। মরিচগুড়াটার রং সুন্দর না। আমি ভেবেছি ঝাঁল হয়না তাই পরে আরো দু’চামচ মিশালাম। এখন মুখেই দেয়া যাচ্ছেনা।”

—“দুপুরেও এটাই খেয়েছি তখন ঝাঁল লাগলোনা?”

রাত্রি ভাবলেশহীন বললো,”লেগেছে মনেহয়, তখন টের পাইনি।”

নিভ্রান নিশব্দে হাসলো। প্লেট রেখে পানি খাওয়ালো। ঠোঁট মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,”ডক্টর এসেছিলো। তোমার প্রেগনেন্সির টেস্ট দিয়ে গেছে।”
রাত্রি বিষম খেলো যেনো। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। কোনরকমে মুখের পানিটা গিলে নিয়ে অদ্ভুত কন্ঠে বললো সে,
—“জি?”

নিভ্রান গলা ঝেঁড়ে বললো,”মাথা ঘুরায়, বমি হয়, পেটে ব্যাথা এসব কি এমনি এমনি নাকি? বাসায় আসলেই দেখি তুমি ঝিঁমাও সারাক্ষণ। এইযে এখনো, খাবার মাঝে কয়বার হাই তুললে? চারবার। অথচ এতক্ষণ যাবত শুয়েই ছিলে। সকালে যাবো। টেস্ট করাতে। এখন ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়ো।”

সে রজনীতে বিস্তর শূণ্যের জলধারা রুষ্টই থাকলো। আসবে আসবে করেও শেষমেষ অনুপস্থিত সে। কাটলো সময়। সাদা মেঘের বর্ষণের বদলে রাঙা সূর্যের রং মাখলো পৃথিবীতে। সকাল হতেই তাকে নিয়ে হসপিটালে ছুটলো নিভ্রান। কি ভীষণ গরম পরেছে আজ। ভাদ্রমাসের মাঝামাঝি। তাল পাকা গরম। ভ্যাপসা পরিবেশ। গাড়ির জানালা বন্ধ করে এসি ছেড়ে রেখেছে নিভ্রান। গাড়ি চলছে ভার্সিটির পথে। ইউরিন টেস্ট করতে স্যাম্পল দিয়ে এসেছে ল্যাবে। আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করিয়ে এসেছে। সন্ধ্যায় রিপোর্ট নিয়ে আসবে। নিভ্রান বলে এসেছে আর্জেন্ট করে দিতে।
মাঝে তেমন কথা হলোনা। নিভ্রান এক দুইবার জিজ্ঞেস করলো শরীর খারাপ লাগছে নাকি। রাত্রি মাথা নাড়িয়ে না জানালো। গাঁট হয়ে বসে আছে মেয়েটা।
ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে অফিসে গেলো নিভ্রান। রাত্রির ফাইনাল পরীক্ষা কয়দিন পরই। বেশি হলে এক দু’মাস বাকি হয়তো। শুধু বাসায় নোটস এনে দিলে কুলাবে না তার। ক্লাস করাটা খুব জরুরি। প্রফেসরের লেকচার তো আর বাসায় পাওয়া যাবেনা। মেয়েটার পড়াশোনায় চুল পরিমাণ বাঁধাও আসতে দিতে চায়না সে।

______________
ওই বাসার টি উশনিটা ছেড়ে দিয়েছে মাসখানেক হলো। এখন বিকেলেই বাড়ি ফিরে যায় রাত্রি। মাঝেমধ্য নিভ্রানের অফিসে যায়। তারপর সেখান থেকে একসাথে বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায়। আজ অবশ্য ব্যাতিক্রম।
নিভ্রান নিজেই চলে এসেছে গাড়ি নিয়ে। ড্রাইভার দিয়ে পাঠায়নি। হসপিটালে যাবে সে। রাত্রি মিনমিন করে বললো,”এতো তাড়াতাড়ি তো রিপোর্ট রেডিই হয়নি। বললোনা সন্ধ্যায় যেতে?”

নিভ্রান শুনলোনা কিছুই। সোজা হসপিটালে গেলো। সকালেও সে এমনই করেছে। সবার আগে যেয়ে হলপিটালে পৌঁছেছে।
রিপোর্ট সত্যিই হয়নি তখনো। সাতটার পরে দিবে। এখন বাজে পাঁচটা চল্লিশ। পাগলটা একঘন্টা বিশমিনিট অপেক্ষা করলো সেখানেই। রাত্রি গাড়ির পিছের সিটে শুয়ে রইলো। ক্লান্ত লাগছে। লোকটা আসলেই পাগল। পুরো উন্মাদ।

কাগজে স্পষ্ট ইংরেজি গোটা গোটা অক্ষরে “Positive” লেখা। আল্ট্রা রিপোর্টে দেয়া বাচ্চার বয়স
১ মাস+ অর্থ্যাৎ ৫ সপ্তাহ। সুস্থ আছে একদম। নিভ্রান রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে বসে রইলো কতক্ষণ। চেয়ে থাকলো নির্নিমেষ। মিস.নিকিতা কিসব যেনো বলে যাচ্ছে রাত্রিকে। নিভ্রানের কানে ঢুকলোনা। উত্তেজনায় ভেতরটা কাঁপছে। বাইরেটা নিশ্চল, শান্ত। হুঁশ ফিরলো রাত্রির ধাক্কায়। তার বাহুতে হাত রেখে চাপা স্বরে ডাকছে।
নিভ্রান পলক ফেলে বললো,”কি হয়েছে?”
রাত্রি চাঁপা গলায়ই বললো,
—“আপু ডাকছেন আপনাকে।”

নিভ্রান রিপোর্টটা কোলের উপর রাখলো। কোনরকমে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,”জি বলুন ডক্টর।”

মিস.নিকিতা হাসলেন। হাসি বজায় রেখেই বললেন,”স্ত্রীর খেয়াল রাখবেন মিস্টার।”

নিভ্রান মাথা নাড়ালো। মৃদুস্বরে সম্মতি দিলো। তার লজ্জা লাগছে কেনো যেনো। অদ্ভুত!
________________

আকাশে চাঁদ উঠেছে। সরু অর্ধচাদ। হাসছে যেনো উচ্ছাসে ফেঁটে। ঠোঁট বাঁকা খুশির হাসি। নদীর পানিতে কি সুন্দর আলোর খেলা। ঝিলমিলে ঢেউ। হাল্কা হাল্কা স্রোত। শব্দ! দূরে একটা লন্চ যাচ্ছে। ভনভনে আওয়াজটাও মধুর শোনাচ্ছে। কি ভীষণ সম্মোহনী পরিবেশ! গাড়ি থামলো। সামনের হেডলাইটদুটো নিভলো। হাতের ড্রাই কেকের প্যাকেট থেকে শেষ টুকরোটা চিবাতে চিবাতে রাত্রি বললো,”এটা কোথায়?”

নিভ্রান তার সিটবেল্টটা খুলে দিলো। হাতের খালি প্যাকেটটা নিয়ে পকেটে ভরে ফেললো। আশেপাশে ডাস্টবিন নেই। ড্রয়ের থেকে পানির বোতল বের করে ঠোঁটের কাছে ধরে বললো,
—“হা করো, শুকনো জিনিস। গলায় আটকাবে।”

রাত্রি পানি খেয়ে আবার বললো,”বাসায় যাবেননা?” প্রশ্ন করে নিভ্রানের কব্জি টেনে ঘড়ি দেখলো সে। সাড়ে আটটার অনেক বেশি। নয়টা ছুঁইছুঁই প্রায়। তারপর আবার বললো,”দেখুন, ন’টা বাজে।”
নিভ্রান ঝুঁকে তার পাশের দরজার লক খুলতে খুলতে বললো,” এটা কোন নদীটা জানো? ওইযে ব্যালকনি থেকে দেখা যায়। তুমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখোনা? সেদিন বললে, সামনাসামনি দেখার খুব ইচ্ছে।…কাল নৌকা বানালে। বৃথা যাবে নাকি তোমার কষ্টটা? আমি নিয়ে এসেছি নৌকাগুলো। নদীর পানিতে ভাসাবো, চলো। আশেপাশে আর কোথাও নদী- নালা নেই রাত। নয়তো এতদূর কষ্ট করিয়ে আনতাম না তোমাদের।”

রাত্রি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো। বিস্ময়ে চোখ ছলছল করছে। কোঁণে জ্বালা করছে। নিভ্রানের নিরবতায় ভেবে নিয়েছিলো সে হয়তো খুশি হয়নি তেমন। বাচ্চাটা হয়তো তার জন্য অনাকাঙ্খিত। কিন্তু না! লোকটা হয়তো সবার মতো প্রকাশ করতে পারেনা। অন্যভাবে প্রকাশ করে। একদম অন্যভাবে। যা শুধু সেই বুঝে। আল্লাহ শুধু তাকেই এই ভিন্নতা বোঝার ক্ষমতা দিয়েছে। আর কাউকে না।

রাত্রির চোখের পানি লক্ষ্য করে মূহুর্তেই চোয়াল শক্ত করলো নিভ্রান। কাঠকাঠ গলায় বললো,
—“খবরদার! কাঁদবেনা রাত। একদম কাঁদবেনা! পানি যেনো না পড়ে। আমি কিন্তু এক্ষুনি গাড়ি ঘোরাবো।”

রাত্রি পানি গড়ানোর আগেই মাথা ঝুঁকিয়ে ফেললো। দু’হাত কঁচলে চোখ মুছলো। অশ্রুসিক্ত কন্ঠেই বললো,
—“আপনার বাচ্চা কিন্তু আপনাকে পাগল ভাববে নিশ্চিত।”

—“ভাবুক। ভাবার কি আছে ও জানুক ওর বাবা পাগল। ওর মা-ই তো বানিয়েছে।”

রাত্রি চোখে পানি নিয়েই হেসে ফেললো। নিভ্রান চেয়ে থেকে বিরবির করলো,

—“তুমি এভাবেই হাসো রাত। সবসময় হাসো। আমি আমৃত্যু সেই হাসিতে মুগ্ধ হতে থাকি শুধু।”

________________
নৌকাগুলো ভাসছে নদীতে। এত্তো সুবিশাল উদার নদীরও ক্ষুদ্র অংশ ঢেকে গেছে সযত্নে তৈরি করা কাগজের ভালবাসায়। পাড়ে বসে আছে দুজন মানব- মানবী। একজনের ঠোঁটে বাচ্চাসূলভ মিষ্টি হাসি। আরেকজনের চোখে সেই হাসির পানে চেয়ে থাকা গুচ্ছ গুচ্ছ মুগ্ধতা। হাত বাড়ালেই পানি। একদম ঘাটে বসে আছে তারা। এপাশটা এখন নিরব। খানিকটা দূরে নৌকা টোকা এসে ভিড়ছে। নিভ্রান আচমকাই রাত্রির কোলে মাথা রাখলো।
রাত্রি আৎকে উঠলো। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
—“আল্লাহ! কি করেন? গায়ে মাটি লাগবে। ঘরে যেয়ে মাথা রেখেন। এখন উঠেনতো।”

নিভ্রান পাত্তা দিলোনা। বরং পাশ ফিরে পেটে মুখ গুঁজে ধীর গলায় বললো,
—“ও কি বুঝতে পারছে ওর বাবা ওর কত কাছে? এইতো অল্প একটু দুরত্ব। নয়তো ওকে ছুঁয়ে ফেলতাম। তাই না রাত?”

রাত্রি হাসলো। ঝাঁকড়া চুলে হাত গলিয়ে বললো,”ওর এখনো হাত পা হয়ইনি মনেহয়। মাত্র তো ১ টা মাসই।”

~চলবে~

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৪১

নদীর পানি ঠান্ডা। পায়ের আঙ্গুল ডুবানো হিমজলের অতলে। বাতাসে গা শিরশির করছে। চোখের মনিতে ভাসছে স্রোতের প্রতিচ্ছবি। পেট থেকে মুখ সরিয়ে মাথা সোজা করলো নিভ্রান, একাধারে চোখ ডুবালো প্রিয়তমার অবাধ্য চুলে, মায়াবী মুখশ্রীতে, হৃদয় কাঁপানো চোখের মনিতে।
নওশাদ সাহেবের কানে খবরটা পৌছালো নিশাদের মাধ্যমে। রাত্রির প্রেগনেন্সি সিম্টমস্ দেখা দিয়েছে অথচ তার ছেলে একবার জানালোনা পর্যন্ত। তাকে জানায়নি ঠি ক আছে কিন্তু নাহিদাকে তো অন্তত জানাতে পারতো। রিপোর্টে কি এসেছে তাও জানালোনা। আর সেই খবর নিশাদও জানেনা। শুধু বললো, টেস্ট করতে দিয়েছে।
সাতপাঁচ না ভেবে তিনি আচমকাই ফোন লাগালেন নিভ্রানের নাম্বারে। বিগত কয়বছরে প্রথমবারের মতো।
শেষ কললিস্ট টা নেই। তারিখ টাও নেই। কতআগে কথা হয়েছিলো এই নাম্বারে তা যন্ত্রটাও ভুলে গেছে। তিনি তো মানুষ। তবু ভুলেননি। দিনটা ছিলো নিভ্রান বাড়ি ছেড়ে যাবার তিনদিন আগে। রাতে ফিরতে খুব দেরি করেছিলো ছেলে। নাহিদা কেঁদেকেটে অস্থির। তখন বাসায় আসার জন্য ফোন করেছিলেন তিনি।
ধ্যান ভাঙলো। রিং হচ্ছে। এক একটা শব্দতরঙ্গ যেনো অভিমান ধুলিস্যাৎ করার ধারালো ফলা। সব কাঁটাতার, বাধাবিগ্রহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিবে।
নিমগ্ন প্রণয়বিলাসের মাঝে হঠাৎ শব্দটা একেবারেই সহ্য হলোনা নিভ্রানের। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কপালে ভাঁজ পরলো। রাত্রি আস্তে করে বললো,
—“ফোন বাজছে আপনার।”

নিভ্রান ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো। পকেট হাতরালো। ফোন বের করে স্ক্রীনের দিকে অদ্ভুত চোখে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ইংরেজি অক্ষরে “Baba” দিয়ে সেভ করা নাম্বারটা। সে তো অন্য কোনো নাম্বার সেভ করেনি এই নামে। তবে? ফোনটা কি তারই? অবিশ্বাস নিয়ে হাত উল্টে ব্যাককভার দেখলো। হ্যাঁ, তারইতো। রাত্রি তাড়া দিলো,”ধরুন।”
নিভ্রান একপলক তাকিয়ে বললো,”তোমার ফোন কোথায়?”
রাত্রি এদিকওদিক তাকিয়ে দেখলো। সাথে ব্যাগ নেই। গাড়িতেই রয়ে গেছে। ফোন ব্যাগের ভিতরেই। নিভ্রানের প্রশ্নাত্বক চাহনীর বিপরীতে শূন্য মস্তিষ্কে সে বললো,
—“আমার ফোন? গাড়িতে মনেহয়।”

নিভ্রানের জট পাকানো চাহনী ধাতস্থ হলো এতক্ষণে,
—“তোমার সাথেই কথা বলতে চাইছে তাহলে। ফোনে পায়নি তাই আমাকে দিয়েছে। ধরো।”

—“উফফো, নাহ।” বলে নিজেই হাত বাড়িয়ে স্লাইড করে রিসিভ করে দিলো রাত্রি। শক্ত করে হাতটা টেনে নিভ্রানের কানে চেপে ধরলো ফোনটা। ওপাশ থেকে চেনা গলার স্বর,”হ্যালো”। নিভ্রান অপ্রস্তুত বোধ করলো। কিছুক্ষণ স্তব্ধ চেয়ে থেকে কোল থেকে মাথা উঠিয়ে বসতে বসতে বললো,”জি…বলেন।”
নওশাদ সাহেব এদিক ওদিক গেলেন না। সোজা প্রশ্ন করলেন,”রিপোর্ট হাতে পেয়েছো?”
নিভ্রান আবারো বিব্রত হলো। উনি জানেন বিষয়টা? অগোছালো স্বরে বললো,”পেয়েছি।”
নওশাদ সাহেবের তৎক্ষনাত পাল্টা প্রশ্ন,
—“কি এসেছে?”
এবার যেনো লজ্জার অথৈ সাগরে ডুবে গেলো নিভ্রান। শব্দভান্ডার ফুরিয়ে গেলো। কন্ঠনালি তে অপরাধবোধের বিদ্রোহ। তার আগেই জানানো উচিত ছিলোনা? প্রথমবার বাবা হবে। বাবাকেই জানানো হয়নি? ধুর, তাকে কেনো ফোন দিলো? রাত্রিকে দিলেইতো পারতো। নওশাদ সাহেব উওর না পেয়ে বললেন,”হ্যালো?”
নিভ্রান নিচু গলায় উওর দিলো,
—“জি, পজিটিভ।”

ওপাশে নিরবতা। তারপর খুব নরম গলার অতিপ্রসন্ন স্বর,”আগে জানাবেনা?”
নিভ্রানে চাঁপা হাসলো। মনে মনে হয়তো বিস্তর হাসলো। খুব গোপনে হাসি লুকিয়ে অন্যপাশের তুলনায় আরো কোমল গলায় বললো,
—“এখনো বাসায় পৌঁছিনিতো, পৌঁছেই জানাতাম।”

কথা শেষ হলো ভালোভাবেই। তার সাথে কথা বলে রাত্রির সাথেও কথা হলো। এতদিনে এই প্রথম বোধহয় কোনরকম আগ্রাসী, বাকবিতন্ডতাহীন কথোপকোথন হলো বাবা-ছেলের।
______________
নিভ্রান মিষ্টি নিয়ে গেলো ব্যাকসিট পুরো ভর্তি করে। নিশাদ নওশাদ সাহেবের কাছ থেকে খবর পেয়ে আগে থেকেই দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে মিষ্টি দিয়ে বাসাভর্তি করে রেখেছে। শেষমেষ মিষ্টিতে মিষ্টিতে টি কতে না পেরে রাতেই পুরো বিল্ডিংয়ের প্রতিটা ঘরে ঘরে দেয়া হলো। আশেপাশের পরিচিতদের বাসায় বিতরণ করা হলো। রাত্রি বসে বসে আগাগোড়া তব্দা মেরে দেখেই গেলো দুই ভাইয়ের পাগলামি।
সেখানে থেমে গেলেও হতো। পরেরদিন নাহিদা, নওশাদ সাহেব দুজনই এলেন। তাদের আরেকদফা পাগলামি। নাহিদা হাতের চুড়ি খুলে রাত্রিকে পড়িয়ে দিয়ে গেলেন। নওশাদ সাহেব হাতে উপহার গুঁজে দিয়ে গেলেন। নিভ্রান মানা করলোনা কোনোকিছুতেই। প্রথমবার মা- বাবা হবার অনুভূতি তবে এতোই সুখের, আনন্দে ঠাসা?
সময় পেরোলো নিয়ম মেনেই। দিনের পর রাত। রাতের পর দিন। পেরিয়ে গেলো মাস। বদলে গেলো ঋতু, প্রকৃতি, জীবনধারা।
______________
দিনটা মঙ্গলবার। রাত্রির শরীরটা ভালো থাকেনা ইদানীং। তিনমাসে পেট উঁচু হয়েছে খানিকটা। শাড়ির উপর থেকে অবশ্য বোঝা যায়না তেমন। বারান্দার সন্ধ্যামালতী গাছে নতুন দুটো ফুল ফুটেছে। সাদা রং। সূর্যের আলোয় কী রুপ তাদের।
বুকের উপর বই রেখে ঘুমিয়ে পড়া রাত্রির হাত থেকে বইটা ছাড়িয়ে নিলেন নাহিদা। পাশে রেখে গায়ে চাদর টেনে দিলেন। আগামী সপ্তাহ থেকে পরীক্ষা। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যায় খালি। মেয়েটা ঘেমে গেছে এসির মধ্যেও। শাড়ির আচঁল দিয়ে গলা মুছিয়ে দিলেন তিনি। শেষমেষ ফুলগাছে পানি দিয়ে পর্দা টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে। এখানে এসেছে দু’সপ্তাহ হলো। রুবিনা নিজেই অসুস্থ। চাইলেও মেয়ের খেয়াল রাখাটা হয়ে উঠেনা তার। ওষুধের ডোজে বিছানায়ই পড়ে থাকেন সারাদিন। নিভ্রান অফিসে থাকে। ক’দিকে খেয়াল রাখবে সে?
রাত্রি উঠলো বিকেলের দিকে। চোখে তখনো ঘুমের রেশ। ক্লান্তি কাটেনি। ভার্সিটি বন্ধ এ সপ্তাহে। এতেই যেনো একটু স্বস্তি। টি উশনি ছেড়েছে আজ একমাস। আস্তেধীরে উঠে বাইরে গেলো সে। নাহিদা তখন রুবিনার রুমে বসা। গল্প করছে দুজনে। ঘরের দরজা খোলা বিধায় সহজেই রাত্রিকে চোখে পড়লো। নাহিদা তড়িঘড়ি করে এগোতে এগোতে চেঁচিয়ে উঠলো,”আহা! একা একা আসলে কেনো? ধুরো! মেয়ে আমার কথা শোনেনা একদম। দাড়াও, দাড়াও ওখানেই।”

রাত্রি চেয়ার ধরে দাড়িয়ে গেলো। মাথাটা আসলেই ঘুরাচ্ছে। দুপুরে যা খেয়েছিলো তা সঙ্গেসঙ্গেই বমি করে ফেলে দিয়েছে। তারপর আর পেটে কিছু পরেনি। নাহিদা এসে ধরলেন। চেয়ার টেনে বসালেন। পানি খাওয়াতে গেলেই রাত্রি বললো,”না না, বমি হয়ে যাবে। খাবোনা।”

নাহিদা গ্লাসটা ঠোঁটের সাথে ঠেকিয়ে একরোখা কন্ঠে বললেন,”এটা পানি। পানি খেলে বমি হয়না।”

—“হবে মা, বিশ্বাস করেন।”

তার কাতর কন্ঠে হেরে গেলেন নাহিদা। পানিটা নামিয়ে রাখলেন টেবিলে। মাথার চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
—“বমির জন্য না খেয়ে থাকবে?”
রাত্রি ছোট্ট গলায় উওর দিলো,”নাহ্, খাবোতো। পরে।”

আটটা দশ।
কোলের উপর বালিশ রেখে খাতায় কি যেনো লিখছে রাত্রি। সামনে পড়ার বই খোলা। সেখান থেকে দেখে দেখেই কিছু একটা লিখছে সে। নাহিদা ঢুকলেন। ড্রেসিং টেবিল থেকে তেল নিলেন। বিছানায় উঠে পিছে বসে তালুতে ঘঁষতে গেলেই রাত্রি আৎকে বললো,”না, তেল না। মা, কেমন চটচটে লাগে, প্লিজ।”

নাহিদা শুনলেন না। এত্তগুলো ঢেলে দিয়ে হাত দিয়ে ঘঁষে দিয়ে বললেন,
—“চুপ, পাজি মেয়ে। মাথাব্যাথা করবে খালি। তেল দেয়না একটু। এতসুন্দর চুলগুলো সারাক্ষণ জট পাকিয়ে রাখে। চুপ করে লিখো। আমি তেল দিবোই।”
রাত্রি চোখমুখ কুঁচকে বসে রইলো। নাহিদা তেল মাখালেন আচ্ছামতো। বিলি কেটে কেটে গোড়ায় গোড়ায় ডলে দিলেন। রাত্রি মাথা পিছে ঠেলে নাহিদার পেটে ঠেকিয়ে চোখ বুজে রইলো। হাল্কা গলায় বললো,
—“আপনার ছেলে কখন আসবে মা? আমার ভালো লাগছেনা।”

নাহিদা ভেতরে ভেতরে হেসে ফেললেও মুখে রাগ দেখিয়ে বললেন,
—“খাবেনা দাবেনা। ছেলে আসলেই ভালো লাগবে নাকি?”

—“লাগেতো। আপনার ছেলে আসলে আমার খুব ভালোলাগে।”

—“আসবে মা, ওরোতো কাজ থাকে তাইনা?”

রাত্রি উওর দিলোনা সাথেসাথেই। তবে কিছুক্ষণ পেরোতেই অবুঝের মতো কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
—“ফোন দিননা মা। আসছেনা কেনো? এতক্ষণে তো চলে আসেন উনি।”

নাহিদা উপায় না পেয়ে ফোন দিলেন। মেয়েটা যখন তখন মন খারাপ করে ফেলে আজকাল। নিভ্রান ধরলো প্রথমবারেই। অস্থির গলায় বললো,”কি হয়েছে মা? রাত ঠি ক আছে?”

নাহিদা ফোঁস করে বললেন,
—“তুই ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারিসনা? জানিসইতো দেরি হলে কান্নাকাটি করে। এত দেরি হয় কেনো তোর? ফাজিল ছেলে।”

নিভ্রান স্বস্তির শ্বাস ফেলে বললো,”আবার কান্নাকাটি করছে? আচ্ছা, দাও ওকে। আমি বুঝাই। দাও।”

~চলবে~