ওঁগো বঁধু পর্ব-০৩

0
1

#ওঁগো_বঁধু

পর্ব ৩

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

রাত তিনটা। বিয়ের অনুষ্ঠানের ধকল পার করে বাংলো বাড়িতে থাকা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রায়হান সাহেব ভেবেছিলেন কম্পিউটারের সামনে বসে সারারাত জেগে ছেলের বাসর ঘরের কর্মকান্ড দেখবেন। তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যে, সেখানে একটা মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবেই হবে।
সোনার চামচ মুখে দেওয়া ছেলে রাফসান রানুকে যে ঘৃণা করবেই করবে এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিলেন।

কিন্তু রাত আড়াইটা নাগাদ হঠাৎই ক্লান্তিবশত: ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গেই সিসিটিভির ফুটেজে রাফসানের মাটিতে লুটিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখছিলেন রায়হান মাহমুদ। অন্তরাত্মা অজানা শঙ্কায় হতবিহ্বল হয়ে উঠলো। ঘুম থেকে অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে পড়ায় তারো কপাল ঘেমে উঠলো সাথে মাথা ঘুরিয়ে গেলো, তদুপরি তিনি দ্রুত হাঁক ছেড়ে ডাকলেন,

-“শায়লা, তটিনি, মেহরোজ, ইমরান, তোমরা কে কোথায়? ”

স্ত্রী শায়লা শোয়ার ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন। দুই মেয়ে তটিনি ও মেহরোজও ঘুমে। সবাই নিজেদের কামরা লক করে ভেতরে ছিলো। কেয়ার টেকার ইমরানও ছিলো ঘুমের রাজ্যে। চাকর বাকররাও সবাই ঘুমাচ্ছিলো। কেউ সাড়া দিলো না দেখে রায়হান সাহেব নিজেই দ্রুত পায়ে নিচতলা হতে দোতলায় উঠে যেতে লাগলেন। কিন্তু নিজেও ডায়াবেটিসের রোগী। ব্লাড সুগার সর্বদাই বেশি। ছেলের বিয়ের ব্যস্ততায় ইনসুলিন নিতেও ভুলে গিয়েছিলেন। তাই নিচ থেকে দোতলায় উঠতে বার বার পিছপা হয়ে যাচ্ছিলেন শক্তিহীনতায়।

ওদিকে রানু রাফসানকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে ” আল্লাগো, হায় হায়! কি হলো আপনার? ” বলে একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো।
একটু আগেই বকাঝকা করা লোকটি হঠাৎই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো কেনো, তা দেখতে দ্রুত বিছানা থেকে নেমে এলো সে। রাফসানের মুখমন্ডল ফ্লোরে লুটিয়ে রয়েছে। বৃহদাকার শরীরটা ফ্লোরে ওভাবে পড়ে যাওয়াতে মনে হলো যে, পাহাড় ধূলিসাৎ হলো। প্রচন্ড সুদর্শন এ মানুষটার দিকে দৃষ্টি পড়তেই রানুর বুকটা কেঁপে উঠলো। কারন রাফসানের ফর্সা মুখশ্রী মুহূর্তের মধ্যেই পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে।
রানু উপায়ান্তর না পেয়ে পাশেই রাখা একটি গ্লাস হতে পানি নিয়ে মুখে ছিটিয়ে দিলো। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না দেখে নাকে হাত দিয়ে দেখে নিলো নি:স্বাস-প্রশ্বাসও চলছে না। জীবিত আছে নাকি শুধু জ্ঞান হারিয়েছে তাও বুঝা যাচ্ছে না। হাত পা ও ঠান্ডা হয়ে গেছে রাফসানের।

রানু প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো। সবে কয়েকদিন আগেই মানুষটা আই সি ইউ থেকে মৃত্যু মুখ দেখে এসেছে। এত বড় বিপদ উগরে এসে এবারে সে ম’রেই গেলো না তো আবার! এতক্ষণ রানুর চোখ ছলোছলো চোখে থাকলেও এখন সে অশ্রু রানুর চোখ ঠিকরে বের হয়ে গেলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই হঠাৎ মনে হলো, নি:শ্বাস তো বন্ধ হয়ে গেছে, সুতরাং একটা উপায় তো বের করতেই হবে।
রাফসানের পড়নের শেরওয়ানি খোলা সম্ভব না হলেও রানু সেভাবেই বুকের নিচ বরাবর বারবার জোরে চাপ দিলো। কিন্তু তাতে কি? হার্ট বিট বোঝা গেলেও শ্বাস চালু হচ্ছিলো না।
রানু রাফসানের মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দেওয়ার চেষ্ঠা করলো, যদিও দ্বীধা হচ্ছিলো। পরক্ষণেই মনে মনে ভাবলো, সে তো আমার স্বামীই, তাকে স্পর্শ করলেই কি? আর মুখে মুখ লাগানোর অধিকারতো শুধু তারই আছে। তাছাড়া মানুষটার নি:স্বাস যদি চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়! একথা ভাবতেই রানুর বুকটায় মোচড় দিয়ে উঠলো।
আর বিলম্ব করার মতোও সময় নেই।
তাই সব সংকোচ আর দ্বীধা ভুলে দ্রুত সে রাফসানের ঠোঁটে ঠোঁট ছোয়ালো। প্রথমবারের মতো কোনো পুরুষের সাথে নিজের ওষ্ঠ ছোঁয়াতে খুবই সংকোচ হচ্ছিলো তার। নিজের শরীরে সে মৃদু কম্পন অনুভব করলো। তদুপরি মুখে কয়েকবার জোরে ফুঁ দেওয়াতেই জোরে কাশি দেওয়া পূর্বক রাফসানের নি:স্বাস চালু হলো। তবে সে চোখ মেলে চাইতে পারছিলো না।

রানু চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলো,

” এই যে, শুনছেন আপনে? শুনছেন আমার কথা? আল্লার দোহাই লাগে চোখ মেলেন! চোখ মেলেন আপনে..”

কিন্তু রাফসানের নির্বিকার, অচেতন, অসার দেহ মেলে ফ্লোরেই পড়ে রইলো।

রাফসান ডাকে সাড়া দিচ্ছে না দেখে পরবর্তীতে রানু কি করবে বুঝতে পারছিলো না। ইন্টারকমে কিভাবে কল দিতে হয় সেটাও ওর জানা নেই। তাই মাথার ব্রাইডাল দোপাট্টা হ্যাচকা টানে ফেলে দিয়ে, শাড়ির আঁচল কোমরে ভালোভাবে পেঁচিয়ে রাফসানকে আড়কোলা করে নিচে নামতে উদ্যত হলো। গ্রামের মেয়ে রানু, শরীরে বাঘের মতো শক্তি, গ্রামে মানুষের বাড়ি কাজ করার সময় এক মন ধানের বস্তা একাই তুলে ফেলতো। রাফসানের পেটানো ও পেশিবহুল শরীর তুললেও ও টলে যাচ্ছিলো না।
ইতিমধ্যেই শ্বসুরও চলে এসেছে দেখে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, ” আল্লাগো…শ্বসুর আব্বা উনার কি হলো? বাঁচান. ওনারে!.”

রায়হান সাহেব ঝটিকা গাড়ি বের করলেন। গাড়ি বের করার শব্দে শায়লাও ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে ছুটে এলেন। রানু নিজেই রাফসানকে আড়কোলা করে নিচে নামিয়েছে এবং গাড়িতেও তুলেছে। ঘুমন্ত ড্রাইভারকে আর কি উঠাবেন? রায়হান সাহেব নিজেই ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লেন। রানু আর শায়লা রাফসানকে পেছনে নিয়ে বসে পড়লো। গাড়ির স্পিড বাড়তে লাগলো, উদ্দ্যেশ্য নিকটতম হসপিটাল।
.
.
পরের দিন খুব ভোরে রাফসানের জ্ঞান ফিরেছে।

সবাই স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে খোদার শোকরিয়া জানালেন।

রানু হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে বসে সারা রাতই কাঁদলো।

ভোরে ডাক্তার রায়হান সাহেবকে ডেকে বলেছে,

” হি ইজ নাউ আউট অব ডেঞ্জার, তবে বেশি মাত্রায় এলকোহল পানের কারনে নার্ভাস সিস্টেম ব্রেক ডাউন হয়েছিলো। তবে সাথে সাথে মুখে মুখে লাগিয়ে নি:স্বাস চালু না করলে বড় রকমের ক্ষতির সম্ভাবনা ছিলো। ”

ডাক্তারের কথা শুনে রায়হান সাহেব আবারো রানুর প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধে আবদ্ধ হলো।

ক্রন্দনরত রানুর মাথায় হাত বুলালেন রায়হান সাহেব। নব স্বামির মায়ায় সারারাত নির্ঘুম কাটিয়েছে মেয়েটা! ডাক্তারকে বললেন,
” মেয়েটা একের পর এক ত্যাগ স্বীকার পূর্বক ছেলেটাকে বাঁচিয়ে তুলছে! ওর একটা কিডনি আমার ছেলের দেহে!”

রায়হান সাহেব রানুর মাথায় হাত দেওয়াতে সে আরো আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলো। এত ভালো একজন শ্বসুর পাবে তা রানু জীবনেও ভাবেনি।
নিজের বাবাও কোনোদিন তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেনি। রানুর চোখে জল এসে গেলো।

” তুমি বাড়ি চলে যাও রানু!”

শ্বসুরের এমন কথাকেউ সে নাকচ করে দিয়ে বললো,

” না শ্বসুর আব্বা, আমি এখানেই থাকবো, যদি তার আবার র*ক্তের দরকার হয়, তাইলে কই পাইবেন র*ক্ত! তার চেয়ে আমি এখানেই থাকি, র*ক্ত লাগলে আমার র*ক্ত তো আছেই! তার চেয়ে আপনে শাশুড়ী আম্মারে লইয়া বাড়ি চইলা যান। আবার পরে আইসেন। ”

রায়হান সাহেব ভেবে অবাক হলেন, স্বল্পশিক্ষিত এ মেয়ের বিচার বুদ্ধি ও স্বামিপ্রেম দেখে। মনে মনে ভাবলেন, তিনি ঠকেন নি, ছেলেকে এই মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে। সেই সাথে তিনি বুঝতে পারলেন এখানে জোরাজোরি করা ফলপ্রসূ হবে না। তাই রানুকে হসপিটালে রেখেই সে আর তার স্ত্রী বাড়ি চলে গেলেন। তাছাড়া ব্লাড সুগার এক্কেবারে বেড়ে যাওয়ায় নিজের অবস্থাও কাহিল৷ তার বিশ্রাম নেওয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে৷

যাওয়ার আগে তিনি রানুর মাথায় হাত রেখে বললেন,

” তুমি নতুন বউ, তোমার এখানে থাকা ভালো দেখায় না!”

রানু হেসে বললো,

” নতুন জামাই যেখানে থাকবে, নতুন বউ তো সেখানেই থাকবে আব্বা, তাই না! আপনি বরং চলে যান শাশুড়ী আম্মাকে নিয়ে ”

রায়হান সাহেব অগ্যতা উপায় না পেয়ে রানুকে সব বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। মনে মনে রানুর তীক্ষ্ণ বিচার বুদ্ধির প্রশংসা করলেন। তার এবং শায়লা তালুকদারের বিয়ের প্রায় ত্রিশ বছর হতে চললো। বড়লোক বাবার বড়লোক মেয়ে ছিলো শায়লা। কোনো দিনই স্ত্রীর কাছ থেকে তেমন আদর, যত্ন, ভালোবাসা পান নি। শায়লা পুরোপুরিই একজন স্ট্যাটাসধারী আত্মকেন্দ্রিক নারী। চার জন সন্তানের কাউকেই সে নিজে যত্ন আত্মি করেন নি। সব আয়া আর ন্যানীরাই করতো। আর শায়লা শুয়ে পড়ে ঘুমাতো বা টিভি দেখে রিলাক্স করতো। নিজের শরীরের যত্ন নিতো বা শপিং এ যেতো, রেস্টুরেন্টে খেতে যেতো। এমনই ছিলো শায়লা। তাই রায়হান সাহেব বিবাহিত জীবনে মোটেও সুখী ছিলেন না। তবে রানুর মতো মেয়ে পেয়ে প্রথমে হতাশ হলেও এখন তার বেশ ভালোই লাগছে। তার ছেলে ও তার সন্তানদের যত্ন রানু বেশ ভালো করেই নেবে। গ্রামের অশিক্ষিত মেয়েরাই স্ত্রী হিসেবে বেশি ভালো হয়। তবে রাফসানকে এসব কে বুঝাবে!
রাফসান যে রানুকে ঘৃণা করে, তা ভেবেই আবার রায়হান সাহেবের ব্লাড সুগার বেড়ে গেলো দুশ্চিন্তায়।

.
.

পরের দিনই রাফসানকে আইসিইউ হতে কেবিনে আনা হয়েছে। ইলোরা এসেছে দেখতে। ইলোরাকে দেখে রানু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। ইলোরাকে কোনোদিন সামনা সামনি না দেখলেও রানু তাকে চেনে। কারন বিয়ের রাতেই ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকে সে দেখেছিলো। রানু মনে মনে ভাবলো,

” ইশ! কি সুন্দর দেখতে সে! সে আমার স্বামির ছোটোবেলার বন্ধু লাগে! এক্কেবারে পুতুলের মতো সুন্দর! ”

ইলোরা রানুর পড়নের কাপড় দেখেই বুঝে ফেললো যে, এটাই রাফসানে বউ।
ওকে দেখে রাফসান মুখ ফিরিয়ে অন্যদিক ঘুরে শুয়ে পড়লো। ইলোরা টিপ্পনি কেটে বললো,

” বন্ধু বিয়ে করলে নাকি পর হয়ে যায়! তাই এভাবে এভয়েড করছিস! তাই এভাবে এত রুঢ়ভাবে নাকি? বউ পেয়েএক রাতেই এত পর হয়ে গেলি নাকি? সত্যিই সারপ্রাইজিং! ”

রাফসান রাগে ফোঁসফোস করতে করতে বললো,

– ” শাট আপ ইলোরা! এনাফ ইজ এনাফ! এখানে এসেছিস কেনো? মরলাম কিনা সেটা দেখতে? সেজন্যই তো! তাই না? ভাবিস না, মরলে কয়েকদিন পরই খবর পাবি!”

ইলোরা আইহাই করতে করতে বললো,

-” রাফু দোস্ত! এত সিরিয়াস হচ্ছিস কেনো রে দোস্ত? মরবি কেনো? তোর হায়াত আছে বলেই লাইফ সাপোর্ট থেকেও ফিরে এসেছিস। সবকিছু লাইট ভাবে নে রে দোস্ত! ডেসটিনি বলে যে কিছু আছে যে সেটা বিশ্বাস কর।

রাফসান উত্তেজিত স্বরে বললো,

– ” কি লাইটভাবে নিবো আর কি বিশ্বাস করবো? কিসের ডেসটিনি? কোনো ডেসটিনি ফেস্টিনি নেই। আমার বাবা ইচ্ছে করেই আমাকে ফাঁসিয়েছে, দারুনভাবে ফাঁসিয়েছে, সে ভালো করেই জানতো যে, তার কোনো কথাতেই আমি না করি না, সেজন্যই সে এই চালটা চেলেছে আমার সঙ্গে। আমি আমার ডেসটিনি নয় বরং তার কর্মফলে ভুগছি। আর তার এই চালে তোরা সবাই তাকে সাহায্য করেছিস। আবার বুঝাতে এসেছিস! ধুর বা*”

ইলোরা রাফসানের চোখে দৃষ্টি রেখে তার কোমড়ে মেরুদন্ডের একপার্শ্বে অবস্থিত স্থানে একটা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো,

-“রাফসান, এই যে এখানে অবস্থিত তোর এই কিডনিটা কিন্তু রানুর, সাড়ে সাতশ কোটি মানুষের পৃথিবীতে কেনো রানুর কিডনিই তোর সাথে ম্যাচ হলো? কেনইবা রেয়ার ব্লাড গ্রুপ টাও ম্যাচ হলো?তোর মা বাবা বা আত্মীয়-স্বজনদের টা তো হলো না? হোয়াট দ্যা রিজন রাফু?

ইলোরার এহেন প্রশ্নে রাফসান চুপ।

ইলোরা তারপর আস্তে করে বললো,

“আমার কিডনিটা তো ম্যাচ হলো না রাফু? এর পেছনে স্রষ্টার ইঙ্গিত ছিলো বলেই এসব ঘটেছে, নিশ্চয় এর মধ্যেই ভালো কিছু নিহিত আছে, তাই বলছি, রানুকে মন থেকে মেনে নে”
রাফসান এবারে উত্তেজিত স্বরে চিৎকার করে বললো,

” শুধু রানু রানু আর রানু! আই হেইট হার! প্লিজ আর ঐ নাম মুখে আনবি না!”

ইলোরা চুপ বনে গেলো।
রাফসানও আর কোনো কথা বললো না।
শুধু মনে মনে বললো, ” তোর সাথে কিডনি বা র’ক্তের কোন ম্যাচ না থাকতে পারে, তবে তোর সাথে তার চেয়ে বড় যে জিনিস ‘মন’ , সেটার তো ম্যাচ ছিলো, যা তুই কোনোদিন ই বুঝলি না ইলোরা, বুঝবিও না কোনোদিন”

ইলোরা ব্যস্ত মানুষ। একদিনের জন্য কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসেছিলো, রাফসানের কাছ থেকে বিদায় নিতে সে উঠে দাঁড়ালো।
হঠাৎ ই রাফসানও দাঁড়িয়ে ইলোরাকে নিজের বুকে চেপে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় ইলোরা হতবিহ্বল হয়ে গেলো। রাফসান এখন আরেক জনের স্বামি এটা ভেবে ইলোরা দ্রুত নিজেকে রাফসানের বাহুডোর হতে ছাড়িয়ে নিলো।

বিরক্তি চেপে হেসে রাফসানকে সুধালো, ” হোয়াই হাগিং?”

রাফসান চোয়ালদ্বয় শক্ত করে সুধালো,

” এজ আ এনিমি!”

ইলোরা হেসে দিলো।

“আমি তোর শত্রু? ”

রাফসান নিরুত্তর থাকলো। দ্বীর্ঘ একবুক শ্বাস টেনে আবার ছেড়ে দিলো। ইলোরা ব্যাপারটা বুঝলো। ইলোরাকে জড়িয়ে ধরার পেছনে তার একটাই কারন, শুধু রানুকে জ্বালানো, তাছাড়া হঠাৎ জড়িয়ে ধরে ইলোরাকে বিবৃত করার তার আর কোনো উদ্দ্যেশ্যই ছিলো না।

সত্যিই রাফসান বা ইলোরা কেউ না দেখলেও দূরে দাঁড়িয়ে থেকে রানু তাদের এ কাছে আসা দেখছিলো। কষ্টে তার বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো। পৃথিবীর কোনো নারীই তার স্বামির পাশে পরনারীর ছায়া সহ্য করতে পারে না।
তবে রানুর মতো দরিদ্রও তো আর এত সহজে রাফসানের ন্যায় রাজপুত্রের স্ত্রীর যোগ্য নিজেকে মনে করতে পারে না! রানু বরং নিজেকে অযোগ্য ভেবেই দমে রইলো। থাকলো দূরে দাঁড়িয়ে।

হসপিটালের ওটির বেডে শুয়ে শুয়েই যে মানুষটির প্রতি তার ভালোবাসা জন্মেছিলো আজ স্বামি হিসেবে পেয়েও সে মানুষটিকে হয়তো সে কোনোদিন পাবে না এ ভাবনায় রানুর গন্ডদেশ বেয়ে জল গড়িয়ে এলো। মনে মনে ভাবলো, আর কোথায় যাবে সে? স্বামি পর কাউকে ভালোবেসে যদি সুখ পায়, তবে পাক গে। সে দাঁতে দাঁত পিষে স্বামির দাসি হয়েই জীবনপাত করবে।

ইলোরা রাফসান কে বিদায় দিয়ে যাওয়ার সময় বার বার মনে পড়ছিলো স্কুল কলেজের সেই দিনগুলো, যখন একে অপরের জন্মদিনে তাদের সবচাইতে প্রিয় জিনিসগুলো উপহার দিতো। রাফসান ইলোরাকে একবার ওরই একটা ছবি এঁকে দিয়েছিলো যা ইলোরার ভীষণই পছন্দ হয়েছিলো। ঝগড়া হলে একে অপরের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতো, তবে চিঠি আদানপ্রদান করতো। চিঠিগুলোতে বেশির ভাগই একে অন্যের মান অভিমানগুলো শেয়ার করতো। এখনো কথা বলা বন্ধ করে এরকম করে রাফসানের সাথে চিঠি চালাচালি করতে মন চাইছে। কিন্তু কিছু চাওয়া কখনোই পূরণ হয় না, তাই সেগুলোকে মে’রে ফেলাই শ্রেয়।
.
.
দুইদিন পর রাফসান সুস্থ্য হয়ে বাসায় ফিরেছে। তবে ডাক্তার তাকে যেকোনো ধরনের নেশা বা উত্তেজিত হতে মানা করেছেন। প্রতিস্থাপনকৃত কিডনিটাও কাজ করছিলো না বলে ইমার্জেন্সি এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন ছিলো। ও নেগেটিভ ব্লাড ব্লাডব্যাংকে ছিলো না বলে রানুকেই রক্ত দিতে হয়েছে। রানু এ দুইদিন দিন-রাত এক করে স্বামির জন্য প্রার্থনা করেছে। বিয়ের রাতেই স্বামির কিছু হলে গ্রামে গঞ্জে সবাই তাকে কুলক্ষণা ও অভিশপ্ত নারী বলেই বিশ্বাস করে। ওর প্রার্থনা ও ফিকির দেখে রায়হান সাহেবের বোনরা টিপ্পনী কেটে বলেছে, “ভাই যেমন খাল কেটে কুমির এনেছে, এখন সেই কুমির আবার খাল ভর্তি করে সমতল বানাচ্ছে!”

রানু স্পষ্ট খেয়াল করলো, একমাত্র শ্বসুর মশাই বাদে পরিবারের সবাই তার দিকে আড় দৃষ্টিতে চাইছে।

(চলবে)