ওঁগো বঁধু পর্ব-০৪

0
1

#ওঁগো_বঁধু

পর্ব ৪

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

রায়হান মাহমুদ তালুকদাররা বনানীর যে বাড়িতে বাস করে তার নাম ‘মাহমুদ’স প্যালেস’।
এত বড় অত্যাধুনিক, সুসজ্জিত, বর্ণিল বাড়ি রানু বাবার জন্মে দেখেনি। বাড়ির প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে আভিজাত্য।
সমগ্র বিল্ডিংটা দশ তালা। নিচের তিন ফ্লোর জুড়ে শপিং মল। আর তারপর চার ফ্লোর বসত ফ্ল্যাট। সবই বিক্রিত, মালিকানাধীন। আর উপরের তিন ফ্লোর হোটেল। এই বিল্ডিং এর সপ্তম তলায় এক বিশাল ফ্ল্যাটে রায়হান মাহমুদের পরিবারের বাস। রায়হান মাহমুদের বয়োবৃদ্ধ বাবা মা’ও সেখানে বাস করেন তাদের সাথে। সাথে রয়েছে ডজন খানেক চাকর বাকর ও কেয়ার টেকার। এ বাড়ি ছাড়াও রায়হান- শায়লা দম্পত্তির আরো একটা বাড়ি ও আশুলিয়ার ফার্ম হাউজ রয়েছে। রাফসান-রানুর বিয়ে হয়েছে যে ফার্মহাউযে সেখানে মূলত তারা অবকাশ যাপন করে।

শায়লা ও রায়হান মাহমুদ দম্পত্তির চার সন্তানের মধ্যে তিন সন্তান রাফসান, মেহরোজ ও তটিনি মাহমুদ’স প্যালেসেই বাস করে। ছোটো ছেলে রুহশান দেশের বাইরে পড়াশুনা করে। সে থাকে বৃটেনে। বছরে একবার কিবা দুইবার রুহশান দেশে আসে।
রুহশান রাফসানের পুরোই উলটো। রাফসানের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোটো রুহশান। সে রাফসানের ন্যায় মোটেও বাবার ভক্ত নয়, বরং মায়ের পাগল।
বাবার নিয়ম শৃঙ্খলা নয় বরং মায়ের বিলাসিতা ও আভিজাত্যই তার পছন্দ। কন্যা দ্বয় মেহরোজ ও তটিনি হলো বাবা মায়ের মিশ্রন।

তবে ব্যক্তিজীবনে রুহশান স্বাধীনচেতা মানুষ। তাইতো বাবার কথা না শুনেই শুধু মায়ের তাবেদারিতেই সে বৃটেনে পাড়ি জমায় পড়াশুনার জন্য।
দেশ তাকে টানে না; মূলত সে দেশের বাইরেই স্থায়ী হতে ইচ্ছুক।

রুহশানের এমন আচরনে রায়হান মাহমুদ মোটেও কষ্ট পাননি। কারন ছোটোকাল থেকেই রুহশান এমনই, একরোখা, একগুঁয়ে ও স্বাধীনচেতা।
এটা তার জানাই ছিলো যে রুহশান নিজের ইচ্ছেতেই চলবে, তাই শুধুশুধু মনে কষ্ট নিয়ে লাভ কি?
অন্যদিকে রাফসান যেনো বাবার ইচ্ছের গোলাম। বাবার ইচ্ছেতেই সে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়, সাথে বাবার ইচ্ছেতেই সেনাবাহিনিতে যোগদানের জন্য আই এস এস বি এর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এবং বাবার মুখে বিজয়ের হাসি দেখার জন্যই এসব পরীক্ষার জন্য সে কঠোর অধ্যয়ন ও পরিশ্রম করে।
তার জীবনে বাবার ইচ্ছেরই প্রাধান্য বেশি। বাবাকে যে সে অনেক ভালোবাসে।
তাছাড়া বাবার নিয়ম শৃঙ্খলা মাফিক জীবন তাকে আকৃষ্ট করেছে খুব।
ছোটোকাল থেকেই রায়হান মাহমুদ রাফসানকে নিয়ে গর্ব করে বলে ” লাইক ফাদার, লাইক সান”!
রাফসানও এ ধরনের গর্বে যার পর নাই গর্বিত হতো।
তাই রাফসানের বিয়ের ব্যাপারেও অন্য কারো সাথে আলোচনা না করেই, সব ঠিকঠাক করে নেন তিনি। তবে পরে শায়লা সহ অন্যান্য সব সদস্যই অবশ্য রাজী হয়ে যান, তাছাড়া উপায় আর কি আছে?
দাদা দাদীরও সবচেয়ে প্রিয় নাতী রাফসান।

সপ্তম শ্রেণি থেকেই পরিবারের জৌলুসতা থেকে দূরে থেকে কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা মাফিক হোস্টেলের জীবন পার করেছে রাফসান।
ত্যাগ করেছে আরাম, ঘুম বাবা বাবা মা, ভাই বোন, দাদা দাদীর সান্নিধ্য ও আদর ভালোবাসা।

এখন রাফসানের গ্লানির কোনো শেষ নেই! যার সুখের জন্য সে এত কিছু করলো সেই বাবাই তাকে পোড়া পাতিলের সাথে জোড় বেঁধে দিলো?

এখনো রাফসানের অনিময়ের অভ্যাস নেই। অসুস্থ্যতার জন্য চাকরি স্থগিত থাকলেও, তার সঠিক সময়ে সঠিক খাবার, সঠিক সময়ে ঘুম, ব্যায়াম, স্টাডি ইত্যাদির অভ্যাস। বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার সে জীবনেও খায় না।
শায়লা কোনোদিনই রান্নাঘরের হাঁড়ি ছুঁয়ে দেখেনি। তাই রাফসান বাসায় থাকলে তার দাদী উম্মে সালমা বেগমের রান্নাই সে খেয়ে থাকে।

বিয়ের সময়ও রুহশানের সেমিস্টার চলছিলো বলে সে বিয়েতে থাকতে পারেনি।
রাফসান মনে করে রুহশান না থেকে ভালোই করেছে। এটা কোনো বিয়ে হলো যে, এখানে পরিবারের সব লোকজনকে থাকতেই হবে? এমনকি যারা যারা এসেছিলো তাদের কাছে লজ্জায় সে বারবার মুখ লুকাচ্ছিলো।

বিয়ের পুরো আসর জুড়েই রাফসানের মুখে ছিলো বেদনা, যন্ত্রণা আর হতাশার কালো ছায়া।

হসপিটাল হতে ফিরে এসে নিজের শয়ন কক্ষে শুয়ে শুয়ে রাফসান সাত পাঁচ নানাটা ভাবছিলো।
তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। চাকরিতে যোগদান করতে পারলেও ভালো লাগতো। কিন্তু সে ধরনের মেডিক্যাল স্টেটমেন্ট সে পায়নি।
হয়তো বাইরে কোথাও বেড়াতে পারলেও ভালো লাগতো। কিন্তু ডাক্তার পুরোপুরি বেড রেস্ট দিয়েছে পরবর্তী এক মাসের জন্য।

হয়তো বন্ধুদেরকেউ সে একবেলা আড্ডা দেওয়ার জন্য ডাকতেও সে পারতো।
কিন্তু বন্ধুরাও সেই একই টপিক নিয়ে আড্ডা, আলোচনা, সমালোচনা শুরু করবে। কেউ কেউ মাথা ঠুকরে হয়তো বলবে,
” আহারে রাফু! তোর এটা কি সর্বনাশ হয়ে গেলো!/ সো স্যাড রাফু/ মিসফরচুন রাফ! ”
ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে এই ধরনের অস্তুতিপূর্ণ ও স্বান্তনাপূর্ণ বাক্য তার আর শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কারন স্বান্তনা তার মনের জ্বালা কোনোদিন কমায় নি, বরং কমিয়েছে ডাইরেক্ট একশন!
.
.
রাফসানের বেডরুম। অনাড়ম্বর তবে মূল্যবান সব এন্টিক আসবাবে রুম সাজানো। অপ্রয়োজনীয় ও অত্যাধিক কোনো জিনিসপত্র রুমে নেই।
ঘড়িতে সময় রাত বারোটা। টেবিল ল্যাম্পের স্তিমিত আলোয় রাফসানের আবছা অবয়ব। বিছানায় শুয়ে থেকেও রাফসানের দুচোখ নিদ্রাহীন।
লন্ডনের এখন সময় সন্ধ্যা ছয়টা। এসময় রুহশান বাসায় ফেরে।
তাই রুহশান এক্ষনে প্রতিদিনকার নিয়মে কল করে কথা বলে প্রিয় ভাইয়ের সাথে। ভাই অবশ্য ঘুমিয়ে থাকে, তবু ঘুমন্ত জাগিয়ে তুলে দু মিনিটের জন্য হলেও ভাইয়ের ঘুমন্ত কন্ঠের স্মান্য কথা সে শুনবেই শুনবে। প্রিয় ভাইয়ের প্রতি তার টানের কোনো শেষ নেই। বিয়ের দিন ও পরের দুই দিন অবশ্য কথা হয়নি। রাফসান হসপিটালাইজড ছিলো বলে বাবা মায়ের কাছ থেকেই ভাইয়ের খবর নিয়ে নিয়েছিলো রুহশান প্রতিদিন।

এখন ভাই বাড়ি ফিরে এসেছে শুনে সে কল করেছে। শুরুতেই সে তার স্বভাবজাত ভঙ্গিমায় বলে উঠলো,

” ব্রো, তুমি ঘুমাচ্ছিলে? জানো না কি হয়েছে আজ? ”

বলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে সে। যেনো পৃথিবীর সবচাইতে হাস্যকর ঘটনা তার সাথেই ঘটে গেছে।

হাসি সামান্য কমিয়ে সে পুনরায় বলে উঠলো,

” জানবে কিভাবে? আমি না বললে! শোনো তাহলে, এক মেয়ে না আমার উপরে ক্রাশ খেয়েছে, এক্কেবারে কালো চামড়া, আফ্রিকান!”

রাফসান ভাইয়ের কথায় হাসলো। রুহশানের একমাত্র কাজ তার স্বল্পভাষী ও স্বল্পহাসী ভাইকে প্রথম কথাতেই হাসানো।

শুনে রাফসান কৌতুহলের স্বরে শুধালো,

” তো, তারপর?”

রুহশান ঝেড়ে উত্তর দিলো,

” আমি রিজেক্ট করে দিতে যেয়েও করিনি ব্রো!”

” কেন কেন?”

” ভাবলাম, ভাইয়াকে কালো মেয়ের সাথে বিয়ে দিলে, আমি কেনো কালো বিয়ে করতে পারবো না? তখন দুই ভাই বরাবর হবো! আর এখন তো ব্রিটেনের রাজ পরিবারেও নিগ্রো ব্লাড ঢুকে গিয়েছে! ঐ যে রাজবধূ মেগান মার্কেলের বাবা তো ব্লাক ছিলো! ”

রুহশানের এহেন কৌতুকে রাফসানের মন ভারি হয়ে গেলো। সে বুঝলো মুখে না বললেও তার ভাইয়ের কালো নতুন বউকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না।

এবার মন ভালো করার উদ্দ্যেশ্যে রুহশান বলে উঠলো,

” ব্রো, ভেবোনা, আমি জানি এ বিয়েতে তুমি হ্যাপি নও, তোমার উপরে এ বিয়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাট ডোন্ট ওরি, আমি আগে দেশে ফিরি, তারপর ঐ মেয়েকে আমার ভাই এর লাইফ থেকে তুলোধূনা করে বের করবো। আমাকে তো জানোই কি বদমাইশের বদমাইশ আমি! ”

রাফসান ভাইয়ের কথা শুনে মুখ বাঁকিয়ে স্মিত হাসলো। পরিবারের কেউ এ বিষয়ে একটি বাক্য না উচ্চারন করতে পারলেও রুহশান ভাইয়ের সাপোর্টে এটুকু যে বললো তাতে রাফসানের মন ভালো হয়ে গেলো।

রুহশান ভাইকে চিল মাইন্ডে থাকার পরামর্শ দিয়ে ফোন রেখে দিলো।

সারাদিন শুয়ে, বসে, বাগান দেখে, টিভি দেখে, পায়চারি করে রাফসানের সময় কাটছিল না।

নিজের সোশ্যাল মিডিয়াও ডিজএবল করে রেখেছে সে। তবে এবার বিরক্তির চরমে পৌঁছে সেটাকেই রি ইনস্টল করলো সে, তারপর একটিভ করে নিলো। শুয়ে শুয়েই সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করছিলো সে। হঠাৎ ই চক্ষু বিস্ফোরিত হলো তার।

এক নিকট বন্ধু তাকে নিয়েই পোস্ট দিয়েছে,

” আমাদের প্রাণপ্রিয় বন্ধু রাফসানের মহাবিবাহ ধূমধাম করে সম্পন্ন হলো।”
সাথে তার আর রানুর একটা ছবিও দেওয়া আছে। রাফসান স্পষ্ট দেখতে পেলো যে, সেই ছবিতে প্রায় পাঁচশ জন হা হা রি এক্ট দিয়েছে, আর নানা ধরনের নেগেটিভ কমেন্টে ভরপুর। তবে বেশির ভাগই রাফসানকে সান্তনা দিচ্ছে, যে কি থেকে কি হয়ে গেলো এটা!

মনটা তেতিয়ে উঠলো রাফসানের। আইফোনটা এক ঝটকা মেরে ফেলে দিলো ফ্লোরে। ভেঙ্গে একশ টুকরা হয়ে গেলো সেটা।

এ জীবনকালে হওয়া ক্লাশম্যাট, ব্যাচম্যাট কাউকেই সে এ বিয়েতে দাওয়াত করেনি। তার মধ্য থেকে এই ইতরটা কিভাবে বিয়ের ছবি পেলো? রাগে রাফসানের মাথায় অগ্নিকুন্ড জ্বলে গেলো। সে নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না। ঘরের অন্যান্য জিনিসও ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো সে।

হঠাৎই এক নারী কন্ঠস্বর শুনতে পেলো সে,

” আল্লাহর দোহাই লাগে, রাগ করবেন না, তাইলে আবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগবে!”

রাফসান নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো। হাসপাতাল তার নিকট ভীষণ বিরক্তিকর এক জায়গা। সে বারবার ওভাবে হাসপাতালে যেতে চায় না। তবে মেয়েটা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলো যে, মেয়েটা কি তাহলে সর্বক্ষণ তাকে চোখে চোখে রাখছে?

রাফসান দেখতে পেলো গেইট সামান্য খোলা। গেইটের নিকটে এসে প্রচন্ড শব্দ সহযোগে ঝপাৎ করে গেইট লক করে দিলো সে।

সেই গেইটের আড়ালে চাপা পড়ে গেলো রানুর কন্ঠস্বর।
.
.

রায়হান মাহমুদ বুঝতে পারলেন যে, রানুকে কিছুদিন আলাদা কক্ষে রাখাই শ্রেয়।
তাই তিনি একটি গেস্ট রুমে রানুকে থাকার জায়গা দেখিয়ে দিলেন। রাতে সবাই শুয়ে পড়ার পর এক কাজের লোকের সাথে কথা বলে সে রাফসানের কক্ষ চিনে নেয়। গেইট খুলে ভেতরে প্রবেশ করার সাহস হয়নি। তাই গেইটের বাইরে দাঁড়িয়েই, সামান্য খোলা গেইট দিয়েই সে রাফসানকে দেখছিলো।

এখন রাফসানের এহেন কথা শুনে সে আবার পা গুনে গুনে নিজের কক্ষে চলে গেলো।

একজন কাজের লোক এসে রানুর প্রয়োজনীয় সব জিনিস রানুর রুমে রেখে দিয়ে গিয়েছে। বাড়িতে প্রথম প্রবেশের সময় সবাইকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেও সে খেয়াল করেছিলো, কেউ তার মাথায় হাত বুলায় নি, একমাত্র রায়হান মাহমুদ ব্যতিরেকে।

কেউ তার দিকে স্নেহের দৃষ্টিতে তাকায় নি। বরং সবার দৃষ্টিতেই ছিলো কটাক্ষ ও বি*ষবাণ। যেনো এক আউটসাইডারের জোর জবরদস্তি অনধিকার প্রবেশ ঘটেছে এ বাড়িতে।

তবে রায়হান মাহমুদ সবাইকে কড়া ভাষায় বলে দিয়েছে, কেউ যদি রানুর সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাহলে খুব খারাপ হবে। তাই সবার কটাক্ষ চোখে বিরাজ করলেও মুখে তা কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারেনি।

রুমে এসেই রানু হঠাৎ ই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।

(চলবে)