#ওঁগো_বঁধু
পর্ব ৫
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
নিজের জন্য নির্ধারত শয়নকক্ষে প্রবেশ করার পরই রানু অবিরাম কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। নরম বিছানা, সাজানো, গোছানো, পরিপাটি, আভিজাত্য ও বিলাসিতা পূর্ণ কক্ষ এসব কিছুই টানছে না তাকে। পড়নে দামী শাড়ী, গহনা, এসব কিছু ছাপিয়ে সে যেনো ভীষণ ক্লান্ত, ভীষণ একাকী। বিয়ের দিনের পরে তার বাবা তাকে শুধুমাত্র একবারই কল দিয়েছিলো। সে হসপিটালে থাকা অবস্থায়ই কল দিয়ে কুশল বিনিময় করেছে নিজে থেকেই। কারন তার বাবা শাহের আলী এখন মহাব্যস্ত। রায়হান মাহমুদ ফ্ল্যাট ও নগদ পঞ্চাশ লক্ষ টাকার সাথে একটা প্রাইভেট গাড়িও গিফট করেছে তাদের। ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট আছে আর একটা গাড়ি নেই, কেমন দেখায়? এ চিন্তা থেকেই রায়হান সাহেব তাদেরকে একটা ব্র্যান্ড নিউ চৌদ্দ সিটের গাড়ি উপহার হিসেবে দিয়েছে। তাই গাড়িতে চড়ে গোটা ঢাকা শহর ঘোরাঘোরি ও শপিং এ ব্যস্ত তার গোটা পরিবার। রায়হান মাহমুদের থেকে প্রাপ্ত টাকায় তারা এখন নিজেদের ভিখারি বেশ আড়াল করে কোটিপতি বেশ ধারণে ব্যস্ত। নতুন নতুন কাপড় চোপড়, অলংকার ও প্রসাধনির আড়ালে তারা নিজের ভিখারি বেশ ঢাকতে মহাতৎপর।
রানু যখন তার বাবাকে কল দিলো তখন তার বাবার মুখভর্তি খাবার। সে মুখভর্তি খাবার চিবোতে চিবোতেই গদগদ স্বরে রানুকে বললো,
“হ্যালো রানু আম্মা, শিক্কাকাবাব খাই, শর্মাকাবাব খাই, আরো কত্ত কি, নামই জানি না এতকিছুর!”
প্রত্তুত্তরে রানু বললো,
” ও আইচ্ছা আব্বা, তোমরা সবাই কেমন আছো?”
গপাগপ আরো খেয়ে খাবারের চাপ না কমিয়েই শাহের বললো,
” মেলা ভালা আছি আম্মা, বড় হোটেলে খাইতেছি, খাবার সেই টেস আম্মা! তোমার শ্বসুর বাড়িতে সব আছে, ঐসব ভুড়িভুড়ি! খালি খাওনের উপর থাকবা কেমন?”
রানু এর কিছু উত্তর করবে তার আগেই তার বাবা বলে দিলো,
” আইচ্ছা আম্মা রাখি?”
বলেই লাইন কেটে দিলো সে।
এমনকি রানুর তিন বোন ও মা ও তাকে একবারের বেশি কল দেয়নি। কেউ একবারো তাকে এভাবে আদুরে স্বরে জিজ্ঞেস করেনি যে,
” ওখানে কেমন আছিস রে মা? সব ঠিক তো?”
রানু ভেবে নিলো, সে কেমন আছে, এটা ভাবার মতো বুদ্ধি হয়তো তার বাবা মায়ের হয়নি। কারন অভাবে পড়ে থাকা মানু্ষের কাছে টাকাই সব, টাকাই সব সুখের মূল উৎস। আর কিছুই নয়। যারা অভাবে বড় হয়ে তাদের কাছে অবস্তুগত জিনিস যেমন মায়া, মমতা, ভালোবাসা ইত্যাদির তেমন কোনো মূল্য নেই। কেউ মরে গেলেও তারা দু এক ঘন্টার বেশি কাঁদে না। তবে পেটের যন্ত্রনায় তারা দিনের পর দিন কাঁদে।
মায়ের সাথে যখন কথা হয়েছিলো তার মা ছখিনা হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়তে পড়তে বলেছিলো,
” বেয়াইয়ের দেওয়া নতুন এই বাড়ির বিছানা এত্ত নরম যে খালি খালি ঘুম আহে রে আম্মা, তাই তোর তিন বইন পেট ভইরা খাইয়া খালি ঘুমাইতাছে, আমিও খালি ঘুমাইতাছি আর ঘুমাইতাছি, যেনো নেশাপানি খাইছি, শুনছি তোর শ্বসুর বাড়ির বিছানা আরো নরম! তুইও ঘুমা গিয়া মা আরামে!”
বলেই সে মনের সুখে হাসতে হাসতে কল কেটে দেয়।
হায় রে মা বাবা! রানু কি সত্যিই এ বাড়িতে খেতে, পড়তে আর ঘুমাতে পারছে?
ভালোবাসার অনুভূতি বড়ই আজব অনুভূতি। মনের মানুষের ভালোবাসা না পেলে যে, প্রাচুর্যতাকেউ, অপ্রাচুর্যতা মনে হয়। সর্বসুখও ম্লান হয়ে যায়। হাসপাতালের বেডে শুয়ে প্রথমবার সে যখন রাফসানকে নিজের স্বামী হিসেবে জেনেছে, তখনই সে তাকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবেসে ফেলেছে। এক স্নিগ্ধ ও বৈধ ভালোবাসার আকাঙ্খায় সে নিজের শরীরের অঙ্গ দান করে গিয়েছে রাফসানকে। বোকা রানু একবারের জন্যও ভাবেনি যে, বিয়ের প্রথম রাতেই রাফসান তাকে জানিয়ে দিবে যে, সে তাকে ঘৃণা করে। তার বাবা মা, এমন কেনো? একটা অঙ্গের বিনিময়ে এত টাকা কেনো চাইতে হবে তাদের?
তাকে তার বাবা টাকা আয়ের উৎস বৎ আর কিছুই ভাবেনি, এটা মনে করে তার মনে ভীষণই যন্ত্রণার উদ্রেক হলো।
চোখে অশ্রুর লহর আরো দ্রুতবেগ পেলো।
কাঁদতে কাঁদতেই কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়লো রানু তা সে নিজেও জানে না।
সকালে কখন ঘুম ভাঙ্গলো তা ঘড়িতে দেখলো না রানু। ফ্লোরে বসে, বিছানায় মাথা রেখেই সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। দুর্বল শরীর ও ভার মস্তক নিয়ে আরো বেশকিছুক্ষণ পড়ে রইলো সে। হঠাৎ ই চোখ মুছে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো রানু।
নিজেকে দেখতে লাগলো সে। গা ভর্তি গহনা, দামী শাড়ী, ব্লাউজ; তথাপি রাফসানের পাশে ভীষণই বেমানান সে। শ্যামবর্ণের মুখশ্রী, অপরিস্কার দাঁত, অযত্নে পড়ে থাকা চুল ও নখ।
বাবার প্রতি ভীষণই অভিমান হলো তার।
সে কি দেখতে পাচ্ছিলো না যে, রাফসানের পাশে তার মেয়ে কতটা বেমানান। কেনো বিয়ে পর্যন্ত আলোচনা গড়াতে হলো?
রাফসানের দাসী হওয়ারো তো যোগ্যতা নেই রানুর!
বাবা বিনিময়ে টাকা না চেয়ে কাজ চাইতে পারতো সবার। রায়হান সাহেব তো না করতো না কাজ দিতে। এখন রাফসানের চোখে ভালোবাসা তো দূরের বিষয়! রানু ও তার পরিবার অর্থলোভী ও বাটপার ছাড়া আর কিছুই নয়।
এমন সময় রায়হান সাহেবের প্রবেশ ঘটলো রানুর রুমে।
দরজায় কড়া নাড়লেন তিনি। দরজা খোলাই ছিলো।
রানু মাথা নত করে তাকে সালাম জানালো।
রায়হান সাহেব রানুর মাথায় হাত রেখে দোয়া জানালেন।
অত:পর গম্ভীর স্বরে রানুকে সুধালে,
-” সকালের নাস্তা করোনি মা? শুনলাম, রাতেও খাওনি? এভাবে শরীর খারাপ হবে না? ”
রানু আমতা আমতা করলো তবে উত্তর দিতে ব্যর্থ হলো বিধায় থেমে গেলো।
রানু চুপ দেখে রায়হান সাহেব বললেন,
” নিজেকে কখনো ছোটো ভাববে না, তুমি আমার পুত্রবঁধু, রায়হান মাহমুদের পুত্রবঁধু! এবং নিজেকে রাফসানের অযোগ্য ভেবে হেয়ও করবে না, শুধু কয়েকদিন রাফসানকে মুখ বুজে সহ্য করো, ওর শারীরিক কন্ডিশন ভালো হলেই আমি ওকে আবার বোঝাবো।”
রানু মনোযোগের সাথে শ্বসুরকে শুনলো।
তারপর রায়হান সাহেবই বুঝিয়ে বুঝিয়ে ধীর স্বরে বললেন,
-” শোনো মা! তোমার আর রাফসানের জন্য আলাদা থাকার রুম দিয়েছি বলে আমার উপর তোমার অভিমান হতে পারে। তবে আমি কিছুদিন সময় চাই মা। রাফসান এই বিয়ের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না বিধায় এমন আচরন করছে। বাস্তবে ও অনেক শান্ত শিষ্ট আর বুদ্ধিমান এক ছেলে। কদিন যেতে দাও, তোমাদের স্বামি স্ত্রীর মধ্যে মিল মোহাব্বত উপরালাই সৃষ্টি করিয়ে দেবে।
আর হ্যাঁ তোমাদের জন্য আলাদা রান্না করা হয়েছে, দুজনেরই একই ডায়েট দিয়েছেন ডাক্তার, ভাজা পোড়া, তেলযুক্ত, মসলাদার, মিষ্টি ও লবণাক্ত খাবার খেতে নিষেধ করে দিয়েছেন। সুতরাং তুমি এখন ডাইনিং এ গিয়ে রাফসানের ঠিক পাশে গিয়ে বসবে। ও যা খাবে তুমিও তাই ই খাবে, তাই ফ্রেশ হয়ে দ্রুত আসো! আমি গিয়ে অপেক্ষা করছি”
বলেই রায়হান সাহেব চলে গেলেন।
রানুশ্বসুরের আদেশ অগ্রাহ্য করতে পারলো না। অনুযায়ী রানু দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ডায়নিং এ এলো। আঁচল মাথায় টেনে ঘোমটা বড় করে নিলো সে।
ডায়নিং এ রায়হান সাহেবের পরিবারের সবাইকে একসাথে দেখে রানুর বুক ধুকপুক ধুকপুক করতে লাগলো৷ রায়হান সাহেবের দুই বোনও সে বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। এতগুলো সুন্দর সুন্দর, স্মার্ট মানুষের মাঝে সে যেনো বড়ই বেমানান।
তার পা টলছিলো দেখে, রায়হান সাহেব জোর দিয়ে রানুকে বললেন,
” কি, আসছোনা যে, এদিকে আসো মা!”
রানু সবাইকে সালাম দিয়ে ডায়নিং এ প্রবেশ করলো। রানুর প্রবেশের সাথে সাথেই দু জন কাজের লোক গা টিপে মুচকি হাসতে লাগলো। আর বাকি সবার মুখে বি’রক্তি ফুটে উঠলো।
রানুকে মা বলে ডাকায় শায়লার মেজাজ যেনো বিগড়ে গেলো। সে বি’রক্তিতে মুখ বাঁকালো।
রায়হানকে না শুনিয়েই বড় ননদ মলি মাহমুদকে ফিসফিস করে বললো
– দেখছেন, আপনার ভাইয়ের আধিখ্যেতা! ভিখারির মেয়েকে মা মা করে মাথায় তুলছে! আমি বলি, এত আদর তো আমার নিজের মেয়েদেরও সে করে না! ”
মলিও সেরকম মুখ বাঁকিয়ে বললো,
” তুমি চিন্তা করো না শায়লা, আমার ভাই একদিন বুঝবে, খাল কেটে কুমির আনার কি জ্বালা! তখন শিক্ষা হবে। ”
ছোটো ননদ জলি মাহমুদও নাক শিঁটকালো রানুকে দেখে। ভাইকে হুঁশিয়ার করে বললো,
” ভাইয়া, তোমার ছেলের বউ আবার ডায়নিং টেবিল ম্যানার সব জানে তো? জানোই তো আমার শুঁচিবায়ু রোগ আছে, যার তার সাথে বসে খেতে পারি না!”
রায়হান মাহমুদ ছোটো বোন জলি মাহমুদকে চোখে শাশিয়ে বললো,
” ধীরে ধীরে সব শেখাবো আমার বউ মা কে, তবে এখন তোমার সমস্যা হলে, তুমি অন্য কোথাও বসে খেতে পারো!”
ভাইয়ের মুখে একথা শুনে জলি মাহমুদ যার পর নাই অপমানিত বোধ করলো। সে সক্রোধে উঠে দাঁড়িয়ে ডায়নিং টেবিল ত্যাগ করলো।
চেঁচিয়ে কাজের বুয়াকে ডেকে বললো,
” কল্পনা! আমার খাবার আমার রুমে দিয়ে যা!”
রানুকে রাফসানের পাশের সিট দেখিয়ে দিলো রায়হান সাহেব।
রাফসান রানুকে দেখেই উঠে যেতে উদ্যত হলেও বাবার দিকে একপলক চেয়ে সে আবার ঠাঁই বসে রইলো। তবে রাফসানের চিবানো যেনো বন্ধ হয়ে গেলো।
রায়হান এবার যেনো গর্জে উঠলো,
” রাফসান, পেটপুরে খেয়ে গিয়ে ঔষধ খাও, স্বাস্থ্যের এই হাল থাকলে চাকরিতে জয়েন করা অনিশ্চিত হয়ে যাবে তোমার!”
বাবার ধমকানি খেয়ে রাফসান পুরোদমে খেতে লাগলো।
বাবার এরকম ধমকানিতে তার কণ্যাদ্বয় ইমরোজ ও তটিনিও সরে নড়ে বসলো।
খাওয়া শেষে রায়হান মাহমুদ ইমরোজ কে বললেন,
” আজ শুক্রবার আছে, তোমার ভাবিকে নিয়ে ঢাকা শহর ঘুরে আসবে, বুঝলে?”
ইমরোজ সোজা মানা করে দিয়ে বললো,
” কিন্তু বাবা আমার ভার্সিটিতে তো কাল প্রেজেন্টেশন, আমি ওগুলার স্লাইড বানাবো আজ সারাদিন, তাই কোনো সময় ই নেই”
রায়হান এবার ছোটো মেয়ে তটিনিকে রানুর সাথে ঘোরার নির্দেশ দিয়ে দিলো। ও লেভেল পড়ুয়া তটিনি মানা করার মতো কোনো কারনই বানাতে পারলো না। তাই মাথা নেড়ে বাবার আদেশ মেনে নিলো।
শায়লার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছিলো স্বামির এহেন কর্মকান্ডে, তথাপি সে বহু কষ্টে নিজেকে স্থির রাখলো।
রায়হান মাহমুদ চলে যাওয়ার পর ডায়নিং এ বসেই শায়লা রাফসানকে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলো,
” আর ইউ হ্যাপি উইথ দিস গার্ল?”
রাফসান সোজা উত্তর দিলো,
” নো!”
” ওকে, যাস্ট ওয়েট এন্ড সি, হোয়াট আই ডু ফারদার!”
রানু তাদের ইংরেজী কথাবার্তা না বুঝে অসার দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
(চলবে)