#ওঁগো_বঁধু
পর্ব ৯
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
নিখোঁজ হওয়ার প্রায় তিন ঘন্টা পর রাফসান বাড়ি ফিরলো। ততক্ষণে ঢাকা শহরের অর্ধেক খোজাঁ প্রায় শেষ! রাফসান যেহেতু আর্মি অফিসার; সেহেতু রায়হান মাহমুদ প্রথমেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ে জানিয়েছেন রাফসানের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টা। রায়হান মাহমুদ অবসরপ্রাপ্ত সেনা অফিসার, তার যেকোনো সমস্যা সবার অগ্রে গণ্য। তাছাড়া রাফসান এখনো সেনা বাহিনীরই একজন র্যাংকধারী অফিসার।
সকল আত্মীয় স্বজনের ওখানেও খবর পাঠানো হয়েছিলো দ্রুততার সাথে। যখনই রাফসানের ফোন ট্র্যাক করে তাকে তার লোকেশন জানার চেষ্ঠা করা হচ্ছিলো প্রতিরক্ষা দপ্তরে, ঠিক তখনি রাফসানের খবর এলো। সে তার মা শায়লার পাঠানো ভয়েস মেসেজের রিপ্লাই করেছে। সাথে একটা ভিডিও বার্তাও। তার চোখে মুখে একটা স্বস্তি। এই তিন ঘন্টা যে সে পরিবারের সবাইকে চরম ভয় আর আতঙ্কে রেখেছিলো সে সম্পর্কে তার কোনো অনুশোচনা বোধ যেনো নেই।
হারিয়ে যাওয়ার দু ঘন্টা পর একবার ফোন খুলেই সে মায়ের ভয়েস মেসেজ পেয়েছিলো।
এমন একটা ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েছিলো শায়লা যে,
“ঐ মেয়ে বাড়ি হতে আউট! সে এ বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে! টাকা পয়সা সমেত বিদায় দিয়ে দিয়েছি ওকে। এবার নিশ্চিন্তে ঘরে ফেরো বাবা!”
মা নিশ্চয় মিথ্যে বলেনি। ঐ কুক্ষণা মেয়ে বাড়ি থেকে আউট হয়েছে শুনে রাফসানের মনটা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। আর সাথে সাথেই মা’কে ব্যাক ম্যাসেস করলো,
” আমি আসছি মা!”
এত সহজে ঐ মেয়েকে বাবা, বাড়ি থেকে বের করে দেবে, এটা শুনে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না রাফসান। কারন বাবা আর ঐ মেয়ের বন্ডিং দেখে তার মনে হচ্ছিলো, মেহরোজ, তটিনি নয়, বরং রায়হান মাহমুদ ঐ মেয়েরই বাবা।
তার এক ঘন্টা পর রাফসান তার পাঠানো ভিডিও বার্তায় বললো,
” মা, একা একা হেঁটে হেঁটে ঢাকা শহরে ঘুরতে ভালোই লাগছে, আমার শত্রু বিদায় হয়েছে তাহলে? আমি ক্ষাণিক বাদেই ফিরবো”
তবে বাড়িতে প্রবেশ করেই সে প্রকৃত ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। তার দাদা দাদীও বাড়িতে নেই। দাদা দাদী আগেই বেরিয়ে গেছেন। রাফসান যখন ঢোকে তখন দাদার হুইল চেয়ার আর দাদীর ব্যবহার্য কিছু জিনিস এপার্টমেন্ট হতে বের করা হচ্ছিলো। তখনি মনটা খারাপ হয়ে গেলো রাফসানের।
নিজের অজান্তেই প্রশ্ন চলে এলো,
” ব্যাপার কি? তো, দাদা, দাদী যাচ্ছে কোথায়?”
তবে কেউ প্রশ্নের উত্তর দিলো না।
একজন কেয়ারটেকার দ্রুত দৌড়ে এসে বাসার সবাইকে খবর দিলো যে, রাফসান ভাইয়া ফিরেছে! শায়লা, মেহরো, তটিনি, মলি, জলির মুখে হাসি ফুটে উঠলেও রায়হান মাহমুদের মুখে ছিলো রাজ্যের কালোমেঘের ঘনঘাটা।
শায়লা যে প্রচন্ড কেঁদেছে তা তার চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো।
ছেলে প্রবেশ করতেই তিনি সহ মলি ও জলি মাহমুদ রাফসানকে জড়িয়ে ধরলো।
তবে রায়হান মাহমুদ যেনো রাফসানের ফিরে আসায় তিনি মোটেও সুখী হননি।
রাফসান প্রবেশ করেই দেখে রায়হান মাহমুদ চোয়াল শক্ত করে বসে আছেন। তার চোখ, মুখ থেকে ঝরে পড়ছে রাজ্যের বিষাদ, আর হেরে যাওয়ার ক্লান্তি।
তিনি একবারো রাফসানের সাথে কথা বললেন না।
আর না অন্য কারো সাথে।
একবারো সে রাফসানকে জিজ্ঞেস করলো না যে,
” কোথায় ছিলে তুমি বাবা?”
রাফসানের কাছে বিষয়টা ভিষণই আনএক্সপেক্টবল মনে হচ্ছিলো।
তবে সে আর ঘাঁটতে চাইলো না কাউকে। সে ভাবলো, মেয়েটা চলে যাওয়াতে হয়তো বাবার মন খারাপ। এত আশা করে ধূমধাম করে বাবা বিয়ে দিয়েছিলো! তবে বাবার কষ্টে সে এতে ভেতরে ভেতরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো।
তটিনিকে রাফসান জিজ্ঞেস করলো, দাদা দাদীর বিষয়ে। তটিনি বোকা বোকা হেসে বললো, তার বোকা বোকা কথাবার্তা।
” দাদা, দাদী তো আশুলিয়ার বাড়িতে থাকবে এখন থেকে ভাইয়া, একচুয়ালি ওখানকার তাজা হাওয়া খেয়ে তাজা থাকতে চায় তারা! এসি তে নাকি তাদের এলার্জি হয়েছে! চুলকায় আরকি! ”
একথা বলার সাথে সাথে মেহরোজ তটিনির মাথায় আলতো করে চড় মেরে বললো,
” আরে কি বলিস এসব! ক্রেজি গার্ল! আসলে না ভাইয়া, ডক্টর দাদা দাদীকে এনভায়রনমেন্ট চেইঞ্জ করতে বলেছে, এই বয়সে বিদেশ হতে ঘুরে আসতেও চাচ্ছে না তারা। তাই তারা আপাতত আশুলিয়ার বাড়িতেই থাকবে। ”
মেহরোজের কথায় রাফসান স্বস্তি পেলো।
” ও আচ্ছা!”
রায়হান মাহমুদ নিজের কক্ষে থিতু হয়ে বসে আছে। নানা বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজেকে নিজেই প্রশ্নবানে ফেলে আশপিশ করছেন তিনি।
রাফসান শেষ পর্যন্ত নিজেকে জেতাতে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হওয়ার মতোই বেপরোয়া ছেলেমানুষী নাটক করতে পারলো?
ছোটো থেকেই সে যাকে নিজের আদর্শে বড় করেছে, সে আজ সেই আদর্শ থেকে এভাবে বিচ্যুত হচ্ছে?
এটা ভেবে তার মনটাও কষ্টে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছিলো।
তার এতদিনের গর্ব ছিলো তার রাফসান। কোনোদিন বাবার কথা ফেলতে পারেনি সে। সবার সামনে সে রাফসানকে নিয়ে দাম্ভিক স্বরে বলতো,
” লাইক ফাদার লাইক সান!”
আসলে বাবার কথা ফেলবে কি সে? অবিকল বাবার মতোই ছিলো তার পছন্দ অপছন্দ। ব্যাপারটা কাকতালীয় না হলেও, হয়তো জেনেটিক্যাল ছিলো।
সব ব্যাপারে বাবা ছিলো তার আদর্শ। বাবার মেধা, বুদ্ধি, যুক্তিগুণ সব পাওয়া স্বত্ত্বেও তার এই একটা পছন্দ যে বাবার সাথে মিলবে না, এটা রায়হান মাহমুদ ঘুণাক্ষরে ভাবতেও পারেননি।
বাবার প্রতি রাফসানের মনেও একরাশ ক্ষোভ। তাই সে রায়হান মাহমুদের সাথে বেশি কথা না বলে, এড়িয়ে চলে গেলো নিজের কক্ষে।
এমনকি এভাবে হারিয়ে যেয়ে বাবাকে দুশ্চিন্তায় ফেলার জন্য সে স্যরিটা পর্যন্ত বললো না সে।
শায়লার মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। একদিনে রাফসান যে আজ থেকে তার দলে যোগ দিয়েছে, তা ভেবে তার ভীষণই খুশি হচ্ছে। অন্যদিকে আজ সে নিজেকে অনেক অপমানিত বোধ করলো, শ্বসুর- শাশুড়ী তাকে যেসব কথা শুনিয়েছে, তা সে নিতে পারছে না। তার আফসোস, রায়হান মাহমুদ তাকে কোনোদিন বুঝতে পারেনি। কোনোদিনও তার মতামতকে গুরুত্ব দেয়নি, তাকে ভালোবাসেনি।
বাবার ঘরে সোনার চামচ মুখে করে জন্ম হওয়া শায়লা বড় হয়েছে অতি আধুনিকতা আর বিলাসিতায়। এটাই তার পছন্দ। সৌখিনতা, ভোগ বিলাসিতা এগুলোই তার জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দ্যেশ্য। তবে রায়হান বরাবরই এসব বিরোধী। কিন্তু এত বছর হয়ে গেলেও শাশুড়ি কোনোদিন এত কথা শুনায়নি। আর আজ কিনা ঐ কুলক্ষণা মেয়ের জন্য তার এত কথা শুনতে হলো?
তাও ঐ মেয়ের সামনেই?
ঐ ফকিরের মেয়ের সামনে তার স্বামী শ্বসুর শাশুড়ী তাকে অপমান করেছে! এই জ্বালা সে নিতে পারছে না।
রাফসান দ্রুত হেঁটে তার রুমে চলে গেলো।
দ্রুত ফ্রেশ হয়ে এলো ওয়াশরুম হতে। মেয়েটা আজ বাড়ি থেকে বিদায় হয়েছে, ভাবতেই তার মাথাটা হালকা হয়ে ঘুম চলে আসছে।
তবে রিলাক্স মুডে এবার সে ইলোরাকে কল দিয়ে বসলো।
ইলোরা বরাবরের মতোই ব্যস্ত। রাফসানের কল রিসিভ করেই সে মুখে রাজ্যের দ্বন্ধ আর সংকোচ নিয়ে বললো,
” যখন তখন ভিডিও কল দিস কেনো রে? অনেক পেসেন্ট এর চাপে আছি রে দোস্ত! আমার আজ নাইট!”
রাফসান রাগ দেখিয়ে শুধালো,
” এত ব্যস্ত থেকে তুই করবি টা কি? এত রোগী রোগী করিস কেনো? আমিও তো একটা রোগীই, আমাকে টাইম দে!”
রাফসানের এহেন কথা শুনে ডক্টর ইলোরা তার পেইসেন্ট সামনে রেখেই হেসে দিলো।
তবে প্রথম কথাতেই সে বললো,
” কি রে তোর বউ কই?”
এধরনের প্রশ্ন শুনেই রাফসানের হাসি মুখে কাঁদা পড়ে গেলো যেনো।
” ঐ মেয়ে ভাগছে!”
” হোয়াট! ”
” কেনো? কেনো?”
” আমি সবাইকে ব্যাপারটা বুঝাতে পেরেছি যে, ঐ মেয়ে এ বাড়িতে আমার সামনে থাকলে আমি অন্য কোথাও চলে যাবো, আর তাতেই কাজ হয়ে গেলো। কজ এভোব অল দেয়ার ফার্স্ট প্রায়োরিটি ইজ মি। ঐ মেয়ের দরকার টাকা, টাকা পেয়ে সে ভেগেছে, দ্যাটস অল!”
রাফসান মুখে চাতুর্যতাপূর্ণ হাসি হাসলো।
সে আরো যোগ করলো,
” আসলে ইলু, এত ভালোমানুষ হলে দুনিয়া চলে না, দুনিয়ায় চলতে হলে সামান্য খারাপও হওয়া লাগে, আর চালাকও হতে হয়। যেমন আমার বোকা বাবার একটা বোকামি, এটার জন্য আমি কেনো সারা জীবন ভুগবো? আমার অজান্তে আমারই বিয়ে ঠিক হবে, এটা কোন আইনে আছে? তুই ই বল?”
ইলোরা বিষন্ন বদনে উত্তর করলো,
” তোকে এই দুনিয়াতে আনার আগেও তো তোর বাবা মা তোকে জিজ্ঞেস করে নেয় নি, তাহলে তুই এই দুনিয়াতে কি করছিস? ”
ইলোরার এই প্রশ্ন রাফসান বুঝে উঠার আগেই ইলোরা পেইসেন্টের দোহাই দিয়ে কল কেটে দিলো।
রাফসান রে’গে গেলো। তার মুখের উপর মেয়েটা কল কেটে দিলো। অসভ্য! এরপর তোকে পেয়ে নেই!
.
.
সাত দিন পর।
“যে নারী রাঁধে, সে চুলও বাঁধে, বুঝলা? ”
মিনারা মাহমুদের চুলে বিলি কেটে তেল দিয়ে দিচ্ছিলো রানু, আর মিনারা আরামে চোখ বুজে এসব বলছিলো।
রানু তার কথার কিছু বুঝলো কি বুঝলো না তা বোধগম্য হলো না, তবে সে দাদী শাশুড়ীর বাক্যে মাথা দোলালো।
মিনারা যুক্ত করলেন,
” তুমি এত সুন্দর করে তেল দেওয়া কই শিখছো গো বুবু? ইশ কি শান্তি, আর শান্তি! ঘুম চলে আসতেছে এই সন্ধ্যাবেলাতেই। আর জানো? আজ তোমার রান্না খেয়ে তোমার দাদাজান ভেবেছিলো, আমি রান্না করছি, তোমার কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি রান্নাটা দারুন হয় তো! তবে পরে বুঝতে পারছে যে তুমি রান্না করছো, কারন ঝাল একটু সামান্য বেশি হইছিলো। ”
বলে হো হো করে হেসে উঠলো মিনারা মাহমুদ।
রানুও হাসলো। তবে তার মনটা ভার। এই সাত দিন সে নিজের সব দু:খকে হাজার বার জলাঞ্জলি দেওয়ার চেষ্ঠা করেও ব্যর্থ হয়েছে। রাফসানের সাথে ভালো কোনো স্মৃতিই তার নেই। তবে বিয়েতে তিন তিন বার কবুল বলার ব্যাপারটা মাথায় আসছিলো বার বারই।
যার সাথে তিনবার কবুল বলে পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, সে তার ছায়াই মাড়াতে চায় না! ঘৃণা করে তাকে! একথা ভাবতেই বুকটা ফেটে যায় রানুর।
তবু সে কষ্ট চাপা দিয়ে ধৈর্য্য ধরে দাদীর কথাগুলো শুনে। আনমনে থেকেও হঠাৎ দাদীর কথায় সে চমকে উঠে।
” জানো, রানু? তোমার একটা নাম ঠিক করেছি আমি, এটা শুধু আমি তোমাকে ডাকবো?”
দাদীর একথা শুনে রানু অনাড়ম্বর ভাবে জিজ্ঞেস করে,
” আইচ্ছা দাদী, রানু নাম ভালা না? আমি তো ভালো মন্দ এতো বুঝি না!”
দাদী হাসতে হাসতে বলে,
” বিয়ের পর তোমার দাদা আমার নাম রাখে বিলকিস। মানে রানী। আমি নাকি তার মনের রানী। বুঝলা? আমার খুব ভালো লাগতো আমাকে এই নামে ডাকলে। এখন আমার তোমার নাম রাখতে মন চাইছে, নির্ভানা। নির্ভানা অর্থ জানো?
রানু মাথা নাড়লো।
“নির্ভানা অর্থ গভীর নিরবতা। ”
রানু বুঝলো না এ মুহূর্তে কেনো তার নাম গভীর নিরবতা রাখতে চাচ্ছে। তবে সত্যিই তোভেতরে ভেতরে তার মনটা গভীর নিরবতা পালন করছে, তাও একমাত্র এক ব্যক্তি রাফসানের জন্য!
রানু এখন যে বাড়িতে উঠেছে সেটা ঐ ফার্মহাউজ। যেটাতে রানু আর রাফসানের বিয়ে হয়েছিলো।
বিশাল এই বাড়িটা এত সুন্দর যা বলার ভাষা নেই।
ডুপ্লেক্স বাড়িটা অনেক বড় জায়গা জুড়ে। সামনে বিশাল বাগান। পাশেই একটা লেক। আর প্রায় দুইশো গজ দূরেই শীতলক্ষা নদী। নদী আর লেইকের বাতাসে এ এলাকাটা বাতাসমুখর হয়ে থাকে সর্বদা।
রাফসানদের বাড়ির একটা ফটো এলবাম হতে সে রাফসানের একটা ফটো লুকিয়ে নিয়ে এসেছিলো। প্রতি রাতে জেগে জেগে সে ঔটাই দেখেছে।
দাদীকে তেল দেওয়া শেষ হতে না হতেই দাদী ঘুমিয়ে পড়লো। আর দাদাও ঘুমে টুপছে।
রানু নিজের কক্ষে বসে রাফসানে ছবি দেখতে দেখতেই হঠাৎ ই কার যেনো পায়ের আওয়াজ পেলো।
দরজার কি হোল দিয়ে বাইরে চোখ পড়তেই।
” একি? সেই মানুষটা যে!”
( চলবে)