ওঁগো বঁধু পর্ব-১৪

0
31

#ওঁগো_বঁধু

পর্ব ১৪

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

মাথা নিচু করে ডায়নিং এ এগিয়ে এলো নির্ভানা। তার বুকের সাথে সাথে হাত পা ও থরথর করে কাঁপছে। এত জোরে হার্টবিট দিচ্ছিলো যে, এক মুহুর্ত তার মনে হলো তার হৃদপিন্ডের শব্দ অন্যদের কানেও যাচ্ছে।

“দাদা নির্ভানা কে? নতুন কাজের কেউ?”

একসাথে কয়েকটা পেয়ারার টুকরা মুখে পুরে গদগদ শব্দে রাফসান তার দাদাকে উক্ত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো।

দাদা তার মুখের হাসি ছড়িয়ে বললেন,
” না রে রাফু! নাতবউয়ের নাম রেখেছি নির্ভানা!”

” ও ভিখারির মেয়েকে তাহলে আধুনিক করার চেষ্ঠা চালাচ্ছো তাহলে?”

দাদা মনে মনে রাফসানের কাছ থেকে এরকম একটা প্রত্তুত্তর আশা করলেও, বাস্তবে তা হলো না।

বরং দাদার একথা শুনে রাফসানের মুখের কোনো পরিবর্তন না হলেও ভ্রু ও অক্ষি যুগল একবার লাফিয়ে উঠলো। তবে মুখে কিচ্ছুটি উচ্চারন করলো না।

সে আরো কয়েক ফালি পেয়ারার টুকরা মুখে পুরে বলে উঠলো,

” রিয়েলি? গুড নেইম ইনডিড! ”

দাদা রাফসানের এহেন উত্তর শুনে নির্ভয়ে বলে উঠলেন,

” জানো রাফসান, নির্ভানা মানে গভীর নিরবতামূলক ভাবনা। এই জীবনে বহু মানুষ আমি দেখেছি, শুনেছি, মিশেছি। তবে ঐ মেয়েটার মাঝে আমি গভীর কিছু খুঁজে পাই। পৃথিবীতে বহু বুদ্ধিমান মানুষ থাকলেও চিন্তার গভীরে যেতে পারে খুব কম মানুষজনই। তবে নাতবউ স্বল্পশিক্ষিত হলেও ওর চিন্তার গভীরতা ব্যাপক, এটাই পরিলক্ষিত হয়। তাই ওর এই নাম রাখা আরকি!”

দাদা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো ঠিক তখনি রাফসান তাগাদা দিয়ে বলে উঠলো,

” বেশ ভালো দাদা, তবে আপনার দার্শনিক কথাবার্তা কেনো জানি আমার এই খালিপেটে মাথায় ঢুকছে না। ক্ষুধাপেটে আর কয়টা পেয়ারা চিবুবো? আগে ভাত মাছ খেতে দিন তারপর সারারাত জেগে শুনবো ঐসব মহামূল্যবান কাব্যিক তথা দার্শনিক মতবাদ”

দাদা রাফসানের এ বাক্যটাকে শুধু একটা শুষ্ক ঢোক গিলে হজম করে নিলো। ছেলেটার যদি একটু দয়া হয় ঐ অভাগা মেয়েটার প্রতি, সে এই মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো। আর দাদী নির্ভানাকে পালটা তাগাদা দিয়ে বললো,

” তাড়াতাড়ি করো বুবু, যা যা রেঁধেছো, সব নিয়ে এনে রাফুকে খেতে দাও!”

নির্ভানার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে, রাফসান এখানে খেতে এসেছে, তাও তার হাতে? তার হাতের রান্না! এ কিভাবে সম্ভব? গত সপ্তাহেই যে তাকে এ বাড়িতে দেখে ব্ল্যাংক চেক দিয়ে বের করে দিতে চেয়েছিলো, সে আজ কিনা তার সব আত্মগরিমা জলাঞ্জলি দিয়ে তার হাতে রান্না করা খাবারই খেতে এসেছে। তাহলে খোদার দরবারে কান্নাকাটি করে সে যে প্রার্থনা করেছিলো তা কবুল হয়েছে?
যে মানুষটির জন্য তার কলিজায় এক পীড়ন ছিলো সে মানুষটি বুঝতে পেরেছে তার উদাত্ত আহবান?

নির্ভানা অতি সন্তর্পণে স্বামির পাতে বেড়ে দিতে লাগলো গরম গরম সাদা ভাত আর কয়েক পদের ভর্তা। রানুর মাথায় আধাখোলা ঘোমটা, মুখে তীব্র শঙ্কার জোয়ার। রাফসানের সেদিকে দৃষ্টি নেই।

ক্যাডেট কলেজে পড়া থেকেই রাফসান বরাবরই কাঁটাচামচ দিয়ে খাবার খেলেও এখন সে নিজের হাত দিয়েই চেটেপুটে খেতে লাগলো। দাদা এক পাশের চেয়ারে আর দাদী আরেক পাশের চেয়ারে বসা। তারা তাদের বরাবরের রুটিন মোতাবেক সন্ধ্যায়ই খেয়ে নিয়েছে। এখন রাত সাড়ে আটটা। রাফসানের খাওয়া দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে সারাদিন খায়নি। বেশি অভুক্ত মানুষ সুস্বাদু ও লোভনীয় খাবার পেলে যেমন গোগ্রাসে খায় রাফসান ঠিক সেভাবেই খাচ্ছে। দাদা দাদীর বিস্ময় কুলকিনারা পাচ্ছিলো না। এটা কি রাফসান, নাকি অন্য কেউ?
তারা নিজেরা নিজেদের চোখকেউ বিশ্বাস করতে পারছিলো না।

একে একে সব আইটেম সাবাড় করছে রাফসান। এবার নির্ভানা মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল রাফসানের পাতে বেড়ে দেওয়ার সময় তার ঝোল রাফসানের গায়ের সাদা শার্টের উপর পড়ে গেলো ঈষৎ।

নির্ভানার বুকের ভিতরটা জোরে লাফ দিয়ে উঠলো, আসলে সে ভীষণই শঙ্কিত হয়ে গেলো।

তবে নির্ভানার শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে রাফসান জোরে হেসে বলে উঠলো,

” ব্যাপার না, এমন মজার খাবার! আমার খাওয়া দেখে আমার শার্টেরও খেতে লোভ হচ্ছিলো বলে ঝোল টোল সব নিজের গায়ে মেখে খেয়ে নিলো!”

রাফসানের এমন অকস্মাৎ রসিকতায় তার দাদা দাদী হেসে উঠলো। নির্ভানাও ক্ষাণিকটা সহজ হয়ে নিলো রাফসানের এমন কথায়।

মানুষটাকে হাসলে এতো সুন্দর দেখায়! নির্ভানা রাফসানের হাসি দেখে আরেক দফা প্রেমে পড়লো। রাফসান স্পষ্টই বুঝতে পারলো যে, নির্ভানা তার থেকে দৃষ্টি সরাচ্ছে না। তাই বলে উঠলো,

” দাদী, কেউ ওভাবে চেয়ে থাকলে আমার…..

এটুকু বলেই সামান্য থেমে সবাইকে চমকে দিয়ে পুনরায় বলল,

“আমার খেতে কোনো সমস্যা হয় না! ”

দাদা দাদী একথা শুনে হেসে উঠলেন।

খাওয়া শেষে রাফসানের তোলা ঢেকুরের শব্দে দাদা দাদী পুনরায় হেসে দিলো।

তাদের হাসি দেখে রাফসান সামান্য বিরক্তি নিয়ে বললো,

” দাদা, দাদী, তোমরা কি আমার মাঝে কোনো জোকারের প্রেতাত্মা দেখতে পাচ্ছো? এত হাসছো কেনো আমায় দেখে বলো দেখি?”

একথা শুনে দাদা দাদী একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করলেন।

খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে মুছে বসে রাফসান একনাগাড়ে বলা শুরু করলো,

” দাদী তুমি চলে আসার পর থেকে মাহমুদ’স প্যালেসে শুধু মাটন বিফ আর চিকেনের ছড়াছড়ি! ডায়নিং এ সকালে বিফ দিয়ে তিন আইটেম তো লাঞ্চে চিকেন দিয়ে পাঁচ আইটেম। আর ডিনারে মাটন দিয়ে চার আইটেম। ওগুলা খাওয়া যায়?
শুধু মাটন, বিফ আর চিকেনময় হয়ে গেছে বাসা। সবাই যেনো মাংসাশী!
আর আমার হলো ডক্তরগুলো খাওয়া দাওয়ার যত নিয়ম বেঁধে দিয়েছে। এটা খাওয়া যাবে না তো ,ওটা খাওয়া যাবে না, সবজায়গায় শুধু ছুঁকছুঁক। তবে শুধুমাত্র আমার জন্যই এত নিয়ম করে কে রাঁধে? মা তো জীবনেও কিচেনে ঢুকবে না। সে তার বিজনেস গ্যাং আর সোসাইটি ডিল নিয়েই তো ব্যস্ত!
আর ফুপিরা তো সারাদিনই ভিডিও কলে ব্যস্ত। তাদের হাবি, কিডস সব তো বিদেশে। তারা কি আর আমার জন্য কিচেনে যাবে? তাছাড়া তারা তো আমাদের বারোমাসি গেস্ট। তাদের কি।রান্নাঘরে যাওয়া মানায়। বেশির ভাগ সময়ই তারা বাসায় খেয়ে আবার যায় রেস্টুরেন্টে খেতে। অস্বাস্থকর খাবার খেতে খেতে মলি ফুপি বাঁধিয়েছে হাইপার একটিভিটি আর জলি ফুপি বাঁধিয়েছে ইনসুলিন রেজিস্টেন্স। তার পরো তাদের কেউই সতর্ক হয় না।
অগ্যতা আমিই গেলাম রান্নাঘরে, ভাবলাম আলুর পরাটা আর একটা ভেজিটেবল রান্না করি। ও মা! কিচেনে কোনো জিনিসই পাচ্ছিলাম না। আমি খাই ভেজিটেবল অয়েল বা অলিভ অয়েল, সেখানে শুধু সয়াবিন আর খাই নন রিফাইন্ড ব্রাউন হোয়েট, পেলাম রিফাইন্ড হোয়াইট হোয়েট। ব্যাস! আর কি করার? কিচেন থেকে বেরিয়ে এলাম মলিন মুখে”

রাফসানের এতগুলা কথা এতক্ষণ দুজোড়া কান মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। এত সুন্দর স্পষ্ট ও ভরাট পুরুষ কন্ঠ রাফসানের! মুগ্ধ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে নির্ভানা এসব বুঝলো না, কারন তার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে আর তার এখনো আত্মা কাঁপছে।

দাদী বলে উঠলেন,

” তো রায়হান কি করে? ও তো দুইদিন যাবত এখানে আসছে না! কল করে শুধু বলেছে মহাব্যস্ত!”

” হ্যাঁ, বাবা হয়তো কোনো কারনে ব্যস্ত, তবে আমাকে বলেনি কিছু”

বলেই রাফসান এক দ্বীর্ঘশ্বাস ফেললো।
খাওয়া শেষে রাফসান সরাসরি চলে গেলো টিভির রুমে। একটা আরামদায়ক বিনব্যাগে ঝাঁপিয়ে বসে পড়লো। রিমোট হাতে তুলে একের পর এক চ্যানেল পালটে বিশ্বের সব খবর দেখতে শুরু করলো।

দাদা দাদী নতুন করে আর নির্ভানার বিষয়টা রাফসানের কাছে তুলে ধরলো না। যাক না কিছু সময়! যদি স্বয়ং উপরালাই তিন কবুল পড়ে গ্রহণ করা স্ত্রীর উপর রাফসানের মায়া মহাব্বত সৃষ্টি করে দেন?

ওভাবে টিভি দেখতে দেখতেই রাফসান ঘুমিয়ে পড়লো৷

রাত বারো টা।

রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলার অধীন আশুলিয়া থানার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অবস্থিত আশুলিয়ার জলাভূমি। এ স্থানটির নান্দনিক সৌন্দর্য বড়ই বিমোহিতকর। অদূরেই বয়ে চলে বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক খাল ও বুড়িগঙ্গা নদী।
নিজের বিছানায় বসেই এসব সৌন্দর্য উপভোগ করে নির্ভানা। মনটা এমনিতেই আজ উদাস উদাস লাগছে তার।
তাই পড়ার রুম থেকে চলে এসে নিজের কক্ষে শুয়ে একটা বই হাতে পড়ার চেষ্ঠা করছে। এ কয়দিনে সে বাংলা রিডিং পড়া শিখে গেছে। মাস্টার তাকে রিতীমত গল্পের বই পড়ে রিডিং ঝরঝরে করে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। সাথে প্রতিদিন একগাড়ি করে হোমওয়ার্ক দেয়। সেগুলো করতে করতে প্রতিদিন রাত একটাও বেজে যায়। তবু নির্ভানা হাল ছাড়ে না।

এখন নির্ভানার মনে দ্বীধা । মানুষটা এখন কি করছে? জেগে আছে নাকি ঘুমিয়েছে? টিভির সাউন্ড পাওয়া যাচ্ছে এখনো। ভয়েস অব আমেরিকার ইংরেজী নিউজ হচ্ছে। দাদা দাদী তো ঘুমাচ্ছে। কাজের মেয়ে মালতি ও ড্রাইভারও ঘুমাচ্ছে। নিচে সিকিউরিটিরা গার্ড দিচ্ছে। এ এলাকা এখন পুরোই শান্ত। নির্ভানা মনে করলো, রাফসান ডায়নিং এ খাওয়ার সময় নির্ভানার দিকে একবারো চায়নি। তার সাথে কুশল বিনিময় তো দূরের বিষয়। তাহলে সে কি শুধু খেতেই এসেছে এখানে? বাসায় ঠিকমতো খেতে পারছে না বলে?

থাক! সে তার মতোই চলুক। নিজের প্রাণের মানুষটাকে তার পছন্দমতো রান্না করে খাওয়াতে পারলেও মনে ভীষণই শান্তি পেতে চায়। নির্ভানা একবারের জন্যও ভেবে নিলো, মানুষটা যদি তাকে স্ত্রীর মর্যাদা না দিয়েও, শুধু তার হাতের রান্না খাবার খাওয়ার জন্যও তাকে রাখে, তবুও সে তার পায়ের ধূলো গায়ে মেখে সারাজীবন তার রান্নাবান্নার দাসিবাদী হয়ে জীবন কাটিয়ে দিবে।

এসব ভাবতে ভাবতেই নির্ভানার চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

এমন সময়ই ইন্টারকমে কল এলো।

নির্ভানার বুকটা দুরুদুরু করে উঠলো।

সবাই তো ঘুমিয়ে? তাহলে রাফসান ছাড়া আর কে কল দেবে?

কাঁপা কাঁপা হাতে সে রিসিভারটা উঠালো।

(চলবে)