ওঁগো বঁধু পর্ব-১৫

0
10

#ওঁগো_বঁধু

পর্ব ১৫

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

নির্ভানার ভাবনাই সত্য হলো। তবে এটা তার চিন্তারো অতীত ছিলো। রাফসানই কল দিয়েছে তাকে। ইন্টারকমে, অর্থাৎ যেখানে শুধু একটা বাসার মধ্যেকার মানুষজনই শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে পারে । নির্ভানা রিসিভ করে চুপ রইলো। রাফসানের নি:স্বাসের শব্দ আসছে। রাফসানের নি:স্বাসের শব্দও সে চিনে রেখেছে।

প্রথমে একটা মৃদু কাশি দিলো রাফসান।

তারপর ধীর শান্ত সুমিষ্ট স্বরে শুধালো,

” এখনো জেগে আছো কেনো নির্ভানা?”

নির্ভানার বুকের ভেতরের হৃদপিন্ডটা একটা জোরে লাফ দিয়ে উঠলো এত আন্তরিকতার সাথে এ প্রশ্ন শুনে।

এ প্রশ্ন সে কাকে করলো? এত সুমিষ্ট কন্ঠে? এত নমনিয়তার সাথে?

নির্ভানার নিজ কানকে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। এত দিন রাফসানের শুধু চেঁচামেচিই সে শুনেছে। শুধুই নিজের প্রতি ঘৃণাই দেখেছে রাফসানের চোখে। আর এখন?

সে কী উত্তর দেবে আমতা আমতা করতে লাগলো। রাফসানের রুমে চলা টিভির সাউন্ড অফ হলো।
এবার পরিবেশে শুনশান পিন পতন নিরবতা।

এভাবে রাফসান তার সাথে কথা বলবে তা তার কাছে অভাব্য লাগছে।

সময় অতিবাহিত হচ্ছে। নির্ভানা উত্তর দেওয়ার মতো কোনো বাক্যই খুঁজে পাচ্ছে না। ওপাশ থেকে আসা রাফসানের নি:স্বাসের শব্দ শুনতে পারছে সে। নি:স্বাসের শব্দে স্পষ্ট অধীরতা। রাফসান যেনো উত্তরের প্রতিক্ষায়।

নির্ভানা কিছুই বলতে না পেরে হাঁশফাঁশ করতে লাগলো।

প্রায় দু মিনিট এভাবে দুজনে চুপ থাকার পর জবাবে রাফসানই বলে উঠলো,

” নির্ভানা, আমি আসলে তোমাকে স্যরি বলতে চাই, আমার ব্যবহারের জন্য! আমার ইত:পূর্বের ব্যবহারের জন্য আমি ভীষণই অনুতপ্ত, কিন্তু সামনা সামনি বলতে জড়তা কাজ করছিলো। তোমার সেলফোন আছে কিনা তাও জানি না, থাকলেও নাম্বার নেই আমার কাছে। তাই আর না ভেবে এ বাড়ির ইন্টারকমেই কল দিলাম। দাদা দাদী সহ বাড়ির কাজের লোক সব ঘুমাচ্ছে জানি। কেনো জানি মনে হচ্ছিলো তুমি জেগে আছো? কারন সেই বাসর রাত থেকেই দেখেছি, তুমি আমাকে জেগে জেগে দেখো!”

এটুকু বলতেই নির্ভানা কথা বললো,

” কিন্তু, আপনার ব্যবহারে আমি কিছুই মনে করিনি!”

রাফসান বিশাল বড় গ্রীলের জানালা দিয়ে বাইরে চাইলো।

বড় আকাশটা দেখা যাচ্ছে। দিগন্তের কাছে চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। তবে সে চাঁদের আলো চারপাশ আলোকিত করতে পারছে না। চারপাশে ভীষণ অন্ধকার।

রাফসান মৃদু হাসলো। তারপর বললো,

” আমার আচরনে কষ্ট পাওনি? অসম্ভব! খোদ কষ্ট দেওয়ার জন্যই আমি এমন আচরন করেছিলাম তোমার সাথে। আর বললেই হলো কষ্ট পাও নি? এমন অন্ধকার রাতের বেলা এভাবে মিথ্যে বলতে হয় না গো! ”

নির্ভানা এবার প্রত্তুত্তর খুঁজে পেলো,

” হ্যাঁ,এটা সত্য আমি কষ্ট পেয়েছিলাম তখন। তাহলে আপনি সত্যি বলেন তো? আমাকে মন থেকে গ্রহণ করেছেন?”

রাফসান নিরুত্তর থাকলো না, তার সহজ স্বীকারোক্তি,

” না প্রথমে গ্রহণ করতে পারি নি। তবে ধীরে ধীরে মনটাকে বুঝাতে পারলে দোষ কি? আর আমি এখন সেটাই করছি। বুঝাচ্ছি মনটাকে। এখন বলো আমায় ক্ষমা করবে তো, স্বামি হিসেবে? ”

নির্ভানা বুকে জমে থাকা শ্বাসটা কে ছেড়ে হালকা হয়ে বললো,

” আমরা নিচুস্তরের মানুষ! আমাকে গ্রহণ না করলেও কষ্ট পাবো না। তবে..”

নির্ভানাকে কথার মধ্যে থামিয়ে রাফসান বলে উঠলো ধীর স্বরে বিরতি দিয়ে দিয়ে,

” তবে গ্রহণ না করলেও বুকফাটা আর্তনাদ হবে, জানি আমি।
আসলে আমি তোমার জন্য না,
আমার জন্যই তোমাকে গ্রহণ করতে চাইছি, একাকিত্ব আমাকে গ্রাস করছে।
এই পৃথিবীতে বহু অবৈধ ও পাপের পথ আছে একাকিত্ব মোচন করার।
তবে পাপের পথে যেতে চাচ্ছি না।
তাই বৈধ পন্থাতেই একাকিত্ব মোচন করতে চাচ্ছি।
আমার সেই পথের সঙ্গী হবে তুমি?

কি হবে না?”

নির্ভানা হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না।

সে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে উত্তর দিলো,

” হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, হবো!”

এটুকু মুখে বলে মনে মনে সে বললো,

” যে আপনার জন্য আগুনে ঝাঁপ দিতেও রাজি আছি আমি, আর আপনি বলছেন শুধু সঙ্গি হতে? হবো না? আপনি নরকে গেলেও, সেখানেও আপনার সঙ্গি হবো আমি।”

রাফসান একটা “ইয়া হু” বলে হাত উঁচালো খুশিতে। নির্ভানাও মৃদু হাসলো তবে এখনো ভয়ে ভয়ে।

” তোমার রান্নার জুড়ি নেই। তোমার রান্না খেয়েই আমার মন ফিরলো বুঝি! রান্নায় কি মেশাও বলো তো? ”

এ প্রশ্ন শুনে নির্ভানা ভড়কে গেলো। তাকে আরো বেশি ভড়কে দিয়ে রাফসান হো হো করে হেসে উঠে বললো,

” এমনি বলেছি, যাস্ট ফান! আসলে তোমার রান্না দাদীর মতো! না না! দাদীর চেয়েও বেটার!কিভাবে শিখলে এত সুন্দর রান্না? থাক! আজ বলতে হবে না, আরেকদিন শুনবো, আচ্ছা? আর সকালের নাস্তায় ছোলার ডাল দিয়ে পনির আর পরোটা করো কিন্তু, আর এখন ঘুমাও!”

বলেই ফোনটা রেখে দিলো রাফসান।

নির্ভানার এখনো সবকিছুই স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো। সে নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখলো। না সপ্ন না! কিয়ৎ ক্ষণ পূর্বে যা হলো তা সত্যিই ছিলো।

এতক্ষণ রাফসানই তার সাথে কথা বলেছে তাহলে। তাকে সে জীবনসঙ্গী হিসেবে নিয়ে পথ চলতে চায়!

নির্ভানার দুচোখ আনন্দাশ্রুতে প্লাবিত হলো।
.

.

ফোন রেখেই ক্ষাণিক ভড়কে যাওয়া রাফসান নিজেকে বুঝালো,

” নো রাফসান নো! ওকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবে তুমি যাস্ট তাকে এটা বুঝাবার জন্য যে, ইউ আর নট দ্যা রাইট পার্সন ফর হার। এবার তুমি নও, সে ই যেনো তোমাকে ছেড়ে পালায়। ”

নিজেকে এই বলে একটা শয়তানী হাসি হাসলো রাফসান।

.
.

ছেলে রাতে বাসায় ফেরেনি দেখে বরাবরের মতো শায়লার কল এলো রাফসানের ফোনে।

কিন্তু রাফসান অপেক্ষায় ছিলো বাবার কলের। বাবা তার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিলো ওই মেয়ের জন্য? এটা ভেবে নির্ভানার প্রতি ভীষণই হিংসা এলো রাফসানের।

আমাকে ওই মেয়ের জন্য পুত্র থেকে অপুত্র বানিয়ে দিলো? ত্যায্যপুত্র করবে? এই কষ্ট থেকে নিজেকে সামলে সে মায়ের কলটা রিসিভ করে নিলো।

মৃদু স্বরে বললো,

” হ্যালো মা, বলো”

শায়লার কন্ঠে উদ্বিগ্নতা,

” তুমি কোথায় রাফসান? এত রাত হলো, আর বাসায় ফেরোনি, এমন তো আগে কোনোদিন হয়নি! এখন ঘনঘন এমন করছো কেনো?

রাফসান পূর্বের ন্যায় ধীরেই বললো,

” আমি বাসায়ই আছি মা, আশুলিয়ার বাসায়। ”

শায়লা উত্তেজিত হয়ে সুধালো,

” আবার গিয়েছো ওখানে?”

রাফসান বললো,

” তুমি যা ভাবছো না নয় মা, এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, আর যাওয়ার পথে শরীরটা ভীষণই খারাপ লাগছিলো, তাই ভাবলাম, থেকেই যাই”

শায়লা বলা শুরু করলো,

” তুমি ভেবেছো তোমার দাদা দাদী ভালো মানুষ? আমাকে কোনোদিন মন থেকে গ্রহণ করেনি তারা। আর তোমার দাদা দাদীই হচ্ছে মেইন কালপ্রিট। ওরাই তোমার লাইফ স্পয়ল করে দেওয়ার ইচ্ছেতে তোমাকে ঐ ভিখারির মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়েছে। সোসাইটিতে তো আর তাদের চলতে হয় না৷ চলতে হয় আমাকে৷ আর আমার সামান্য মুখ নেই মানুষের সামনে। সবাই সুযোগ পেলে আমাকেই পিঞ্চ করে বলে যে, আমরা নাকি ভিখারিদের পুনর্বাসন চালাচ্ছি, আমাদের ঘরে। আমার ছোটো ছেলে রুহশানকে কবে আরেক ভিখারির মেয়ের সাথে বিয়ে দেবো, এমন প্রশ্নও করে আমাকে মানুষজন। আমার মুখ কই থাকে বলো? এসব শুনার জন্য আমি এত কষ্ট করে তোমাদের পৃথিবীতে এনেছি? ”

এসব বলতে বলতে শায়লা কেঁদেই দিলো। জীবনে এই প্রথম মায়ের কান্না শুনলো রাফসান। আর তার কাছে এই কান্না ভীষণই অর্থবহ মনে হলো।

রাফসান মাকে স্বান্তনা দিয়ে বললো,

” মানুষ কি বলে তা থেকে আপাতত নিজেকে দূরে রাখো মা। কিছুদিন ধৈর্য্য ধরো। আমি কথা দিচ্ছি, সব আবার ঠিক করে দেবো। আমার মায়ের চোখের জল এনেছে যারা তাদের আমার জীবনে রাখবো না আমি। দিনশেষে আমি দেখতে পাচ্ছি, একমাত্র তুমিই আমার ভালো চাও মা! ”

শায়লা আবারো ফুঁপিয়ে কেঁদে বলে উঠলো ছেলের একথা শুনে,

” কাঁদবো না কেনো? তোমার চাকরিও নাকি নেই শুনলাম? তুমি তো বলোনি আমাকে। ”

রাফসান অনুতাপের সাথে বললো,

” কিভাবে বলি মা, আসলে বলার কোনো স্কোপ ই পাইনি যে। তুমি যে অলওয়েজ বিজি। ”

শায়লা বলে উঠলো,

” বিজি তাতে কি? তোমাদের জন্যই তো বিজি থাকি। তোমার বাবা তোমার লাইফটা এভাবে হেল না করলেও পারতো”

রাফসান মা’কে অনুরোধের স্বরে বললো,

” মা আমার কিছু টাকা লাগবে, আই ওয়ান্ট টু স্ট্যান্ড মাই ওন বিজনেস?”

শায়লা বলে উঠলো,

” এখনি বিজনেস স্ট্যান্ড করানোর কি দরকার? তাছাড়া তোমার শরীরটা এখনো ঠিক হয়নি। ”

রাফসান বললো,

” দরকার আছে মা, দরকার আছে বলেই চাইছি। বাবা আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করতে চেয়েছিলো, তা শুনেছিলে তুমি? যদি কোনোদিন সত্যিই ত্যাজ্যপুত্র করে তাহলে আমিও তো সেইম পথের ভিখারি বনেই যাবো! তাই নয় মা?”

শায়লা শঙ্কামিশ্রিত স্বরে সুধালো,

” কত লাগবে তোমার?”

রাফসান উল্লসিত হয়ে বললো,

” মা তুমি তো জানোই, যত বড় বিজনেস, তত বড় ইনভেস্টমেন্ট, আর আমার বিজনেস অনেক বড়, তাই কম ছে কম আমার বিশ কোটি লাগবে”

শায়লা ক্ষাণিক ক্রুব্ধ হলো,

” বিশ কোটি তো, অনেক বড় এমাউন্ট! এত কেনো? কোন টাইপ বিজনেস এটা?”

রাফসান মা কে বুঝিয়ে বলতে লাগলো,

” মা, ইন্টারন্যাশনাল ড্রাগ ম্যানুফেকচার বিজনেস! তবে ভেবোনা! এই ড্রাগ মানে নেশা নয় মা, ঔষধ। এখানে আমাকে অনেক ফার্মাসিস্ট ও সাইন্টিস্ট হায়ার করতে হবে, তারা রিসার্চ করবে এন্ড দেন ম্যানুফেকচার করবে বিশ্বমানের ড্রাগ। তাই এত বেশি টাকার প্রয়োজন”

শায়লাও পালটা বুঝালো,

“লিসেন, তোমার হোল প্ল্যানিং পরে দেখবো, এখন যাস্ট একটা কাজ করো তোমার বাবার মন রাখার জন্য হলেও, তুমি ওই ভিখারির মেয়ে রানুর সাথে একটা মিউচুয়াল করে নাও। তাহলেই কেবল তোমার বাবা তোমাকে ফিনান্সিয়াল সাপোর্ট দেবে। সো ইউর ফার্স্ট ডিউটি ইজ টু মেইক আ মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং উইথ রানু।

রাফসান উপহাসের হাসি হেসে বললো,

” নো মা, রানু আর রানু নেই, দাদা দাদী তার নতুন নাম রেখেছে নির্ভানা!”

রাফসানের কথা শুনে শায়লা অট্টহাসি তে ফেটে পড়লো।

” মাকাল ফল, তার নাম আবার নির্ভানা! হা হা হা!”

রাফসানও বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসলো তার মায়ের সাথে।

” মা যা তুমি এখন ভাবছো, তা আমি আগেই ভেবে কাজ শুরু করে দিয়েছি! আম মোর এডভান্স দেন ইউ, ভেবোনা মা, কাজ হয়ে যাবে!”

শায়লা নিশ্চিন্তচিত্তে বললো,

” রিয়েলি? পারবে তো? দেখো আবার যেনো ঐ মেয়ের প্রতি উইক না হও, ওরা ছোটোলোকেরা তো আবার ব্লাক ম্যাজিক ট্যাজিক করে মানুষকে বশ করে নেয়। সো বি কেয়ারফুল, আর আমি নিশ্চিত, রায়হানকে যদি এই বিশ্বাস ধরাতে পারো যে, ঐ ভিখারির মেয়েকে তুমি গ্রহণ করেছো, তাহলে তোমাকে শুধু বিশ কোটি কেনো পঁচিশ কোটিও দিতে নারাজ হবেনা!”

মা কে বিদায় জানিয়ে রাফসান ঘুমাতে গেলো।

পরদিন সকালে ছোলা পনিরের মোঁমোঁ গন্ধে রাফসানের ঘুম ভাঙ্গলো। সকাল সকাল উঠার অভ্যাস রাফসানের। তার কিচেনে গিয়েই এক চামচ চেখে দেখার প্রবল ইচ্ছে হলো। কিন্তু না! এমনটি করলে দাদা দাদী হাসবে। খাবার দাবারের সুগন্ধকে উপেক্ষা করেই দাদার সঙ্গে আগে এক কিলোমিটার হেঁটে আসলো সে। কারন এভাবে ঘুম থেকে উঠেই ডায়নিং খেতে বসতে দেখলে দাদা দাদী তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করবে সে জানে।

সে ছোটোবেলা থেকেই বিদেশি খাবার পছন্দ করেনা, বাবা দাদা দাদীর মতোই।

খেতে বসেই রাফসান তো মহাবাক।

এ তো বিয়ে বাড়ির আয়োজন। সে ভেবেছিলো শুধু ছোলা পনিরই রান্না হবে, সাথে আরো ডজন খানেক আইটেম।

বুটের বরফি, সূতা কাবাব, মুর্গ মাসাল্লাম, সবজি টিক্কা, সবজি রোল ইত্যাদি নানা আইটেম।

রাফসান সকাল থেকেই বেশ কয়েকবার কথা বলার চেষ্ঠা করলো নির্ভানার সাথে, কিন্তু পারলো না সংকোচে। মিথ্যে অভিনয় সে জীবনেও করেনি, তাই অভ্যাস নেই। নির্ভানাও রান্না ঠিকই করেছে। তবে তার বুকের মধ্যে কচকচ করছে সংকোচ, জড়তা, ভয় ও আনন্দের এক মিশ্রিত অনুভূতি।

রাতে যে রাফসান ফোন করে তার সাথে কথা বলেছে, সেকথা সে দাদা দাদীকে বলতে পারলো না।

তবে খাবার টেবিলে বসে দুজনের টুকটাক কথাবার্তা যেমন, ” কি দেবো? এটা খেয়ে দেখবেন একটু? পানি লাগবে? অথবা, ঐ কারিটা দাও, আর দিও না প্লিজ ” এই জাতীয় ছোটোখাটো সংলাপের রহস্য দাদা দাদী বুঝতে পারলো না। তবে মনে প্রশ্নের উদয় হলো,

” এরা কখন নিজেদের মধ্যে সব ঠিক করে নিলো?”

খাওয়া শেষে দাদার এহেন প্রশ্নে দাদী নিচুস্বরে বললেন,

” ঠিক করে নিলেই বাঁচি, কত চিন্তা করলাম, রাফু এই মেয়েটাকে ঠিকভাবে মেনে নিবে কিনা? কত আল্লাহ আল্লাহ করলাম, আর আল্লাহ সব ঠিক করে দিলেন!”

নাজিম মাহমুদও বললেন, ” শোকরিয়া প্রভু”

ওদের ছোটোখাটো কথাবার্তা শুনেই মিতারা মাহমুদ আর নাজিম মাহমুদ দুজনের কন্ঠেই স্বস্তি।
.
.

সকাল আটটাতেই আকাশে চকচকে সূর্যালোক। সকালের সূর্যই জানান দিচ্ছে দিনটা কেমন প্রখর হবে। রাজধানীর ব্যস্ততা আরো আগে শুরু হলেও ঢাকার এ অংশটায় লোকবসতি কম বলে ব্যস্ততা তেমন পরিলক্ষিত হয়না।

খাওয়া শেষে রাফসান দাদাকে জানালো,

” দাদা এমন অলস দিনযাপন আমার আর ভালোলাগে না। বাবা ব্যস্ত নিজের ব্যাবসা নিয়ে, মা ও ব্যস্ত তার ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে, দুই বোন এক ভাই সবাই নিজেদের লাইফে ব্যস্ত, একমাত্র আমিই এভাবে পড়ে আছি জড়বস্তুর ন্যায়। আমার ভালো লাগে না এসব!”

দাদা প্রত্তুত্তরে সুযোগ বুঝে বললো,

” তোমাকে অত ব্যস্ত হতে হবে না এখন, ব্যস্ত না হলেও চলবে তোমার এখন। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ঘুরে এসেছো তুমি আড়াই মাস আগেই। আল্লাহ তোমার হায়াত রেখেছেন, আরো হায়াত দান করেন দোয়া করি। তোমার ভালো রিজিকও তিনি রেখেছেন। রায়হানের সুপুত্র তুমি। ছোটোবেলা হতে কোনোদিন আমাদের কথার অবাধ্য তুমি হওনি। এবার হয়েছিলে, আমরা ধৈর্য্য ধরেছিলাম। এখন তোমাকে স্বাভাবিকতা দেখে খুশি লাগছে আমাদের। ভীষণই খুশি হচ্ছি তোমাকে দেখে। তুমি আপাতত নির্ভানাকে নিয়ে ঘুরে আসো কোথাও হতে। মেয়েটা তোমার আশায় বহু চোখের পানি ফেলেছে। ”

দাদার কথার সাথে দাদী তাল মিলিয়ে বললেন,

” চাইলে আমাদেরো নিতে পারো, আমারো ঘুরতে মন চায়। দুই জোড়া কপোত কপোতি হবো তাহলে!”

দাদীর এ কথায় দাদা হো হো করে হাসলেন।
আর বললেন,

” দু কদম হাঁটতেই তোমার হার্ট ব্লক হয়ে আসে, আবার চাও হাঁটতে?”

দাদার একথায় দাদী মুখ মুচকে দিয়ে বললেন,

” শোনো সামনে নকল দাঁত আর হার্টে তিনটা রিং লাগিয়েছো বলে বুঝা যায় না, বয়স কিন্তু আমার আশির উপরে, আর তোমার নব্বইয়ের উপরে, তার পরো মনের শক্তির জোরে বাইরে যেতে চাই, কয়জন পারবে মনে এত শক্তি আনতে?”

দাদা দাদীর এরকম অনাহুত তর্ক থামিয়ে রাফসান বললো,

” স্টপ, বোথ অব ইউ৷ দ্রুত রেডি হয়ে এসো সবাই৷ তোমরাও যাবে! আমিই নিতামই তোমাদেরকে, আর তোমরাও সব ড্রামাবাজ, এই বুড়ি বয়সেও দাদী তোমার ড্রামা বন্ধ হলো না। ”

বলেই সে ও হো হো করে হেসে দিলো।

নির্ভানা দূরে দাঁড়িয়ে শুনছিলো সবার কথাবার্তা।

সেও হাসলো, দ্বীর্ঘদিন পর এমন নির্মল সুখের হাসি!

(চলবে)