ওঁগো বঁধু পর্ব-২৩

0
2

#ওঁগো_বঁধু

[পর্ব ২৩]

#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা

এপ্রিলের পর থেকে নগরীর উত্তাপ ক্রমশ বাড়তেই থাকে।
রাস্তায় রাস্তায় মোড়ে মোড়ে বসে আখ ও লেবুর শরবতের স্থায়ী অস্থায়ী অসংখ্য দোকান। নিম্ন- মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্ত তৃষ্ণার্ত লোকজন লাইন ধরে সেখান থেকে পানিয় কিনে নিজেদের তৃষ্ণা নিবারন করে। বিকেলে এর সাথে বসে ফুচকা, চটপটি ও অন্যান্য নানা ধরনের নাস্তার অস্থায়ী দোকান। তবে সবারই আকাঙ্খা থাকে এই উষ্ণতার মাঝেও সামান্য শীতলতার ছোঁয়ার। ওদিকে উচ্চবিত্তরা গাড়ি থেকেই নামে না। তারা ক্ষুধা তৃষ্ণা মেটাতে যায় বড় রেস্টুরেন্টে। শ্রেণি বৈষম্যের এ সমাজে ভালোবাসাও পায় অনেকে বৈষম্য করেই। কেউ বা জীবনে এত ভালোবাসা পায় যে গ্রহণ করতেই অপারগ হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ এত ভালোবাসার কাঙ্গাল জানতে বুঝতেই পারার আগেই বিরহ এসে পড়ে। তপ্ততাকে ছাপিয়ে হঠাৎই বাতাস ধেয়ে আসে সাথে আচানক বৃষ্টি। হঠাৎ ই বৃষ্টি নামায় সেখানকার দোকানপাট দ্রুত গুটিয়ে নিতে থাকে দোকানদারগণ আর ক্রেতারা ভিজে যাওয়ার আশংঙ্কায় দৌড়ায় নিরাপদ আশ্রয়ে।
চৌদ্দ তলার ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে নিচের রাস্তার এসবই দেখছিলো নির্ভানা। কোনো রকম আগাম সংকেত ছাড়াই বাতাস সহ ঝমঝমে বৃষ্টি নেমে গেছে, এ যেনো এক অনাকাঙ্ক্ষিত ভালোবাসার আগমন। রুহশান, তটিনি ও মেহরোজ ভিজছে সানন্দে। নির্ভানাও ভিজে গেছে। কিন্তু তার কাছে এসব অর্থহীন মনে হচ্ছে। সবকিছুই তার বিষময় মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে তার চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। তার মন আকাশের কালো মেঘের চাইতেও ভারী। মনটাকে হালকা করে অশ্রুরা মিশে যাক বৃষ্টির পানির সাথে, সেই আশায় সে কাঁদছে।

রাফসানের কথাগুলো তার কানে বিঁধছে শুধু বারবার। বিশেষ করে এই বাক্যটা,
” এমন ভাবে এই রুমে থাকবে যেনো বাতাসও টের না পায়!”

একথা বলার পরই ননদ দেবররা তাকে ডেকে ধরে বেঁধে ছাদে নিয়ে আসে। ওদিকে রাফসানকে যেনো স্থিতি জড়তায় ধরেছে। সে নিজ কক্ষেই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে স্থিত হয়ে। মাথা ব্যথার বাহানায় দুপুরের খাবার পর্যন্ত সে খায়নি। রাফসানের মন ও মগজে এখন শুধু একই চিন্তা, সে হেরে যাচ্ছে জীবনে। বন্ধু বান্ধব তাকে নিয়ে মুখরোচক মিমস বানাচ্ছে, যেখানে উচিত তাকে সমবেদনা জানানো।

নির্ভানা গোপনে গোপনে বৃষ্টির জলে তার কান্নাটা কেঁদেই নিলো।
রুহশান নিজের ওয়াটারপ্রুফ গো প্রো ক্যামেরায় অনেকগুলো ছবি তুললো সবার।
মূলত সে এক বিশাল ট্যুরের প্ল্যান করেছে, সেটাই সে সবাইকে জানাতে চেয়েছিলো। সবাইকে জানালো বটে, কিন্তু রাফসানের সাথে আলাপের সুযোগই হলো কই? আর রাফসান না গেলে নির্ভানাই বা কিভাবে যাবে?

নির্ভানা সন্ধ্যায় পড়তে বসে রিডিং রুমের লাইব্রেরিতে সে রাফসানের একটা ডায়রি খুঁজে পেলো। এটা মূলত তার একটা প্রতিদিনকার রুটিন সম্বলিত একটা সংকলন বলা যায়। বিভিন্ন কাজ, সেসব কাজের প্ল্যান ও রুটিন সম্পর্কে সেখানে লিখা আছে। কি চেয়েছিলো আর কি কি পেলো, সেসবের বিশাল সমগ্র এটা। দাদা দাদী ও শশুড় তাকে রাফসান সম্পর্কে বহু জানিয়েছে। তবে এখানকার লেখা কথাগুলো পুরোপুরি রাফসানের নিজের। তার উচ্চভিলাসী আকাঙ্খা, জীবনের লক্ষ্য অর্জনে ত্যাগ, তিতিক্ষা ও প্রচন্ড জেদ এসব সম্পর্কেও লিখেছে সে।
নির্ভানা পড়লো, রাফসানের জীবনের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো দেশের সেনাপ্রধান হওয়ার। যে লক্ষে সে যোগ দিয়েছিলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে। আর সেনাপ্রধাণরা ক্ষেত্রবিশেষে দেশের প্রধানমন্ত্রীও হয়ে যেতে পারে( এ আইন এখন বাতিল করা হয়েছে সংবিধান হতে)। তাই সে তার জীবনের সেরাটা দিয়েছে সর্বোচ্চ সফলতা পাওয়ার জন্য।
ডায়রিতে রাফসানের মির্জাপুর ক্যাডেটে পড়া অবস্থায় সেখানকার কিছু ছবি। নির্ভানা হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলো। ছোটোবেলা হতেই রাফসান হেরে যাওয়াকে ভীষণই অপছন্দ করে। তার প্রত্যেকটা ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সে পুরস্কার নিচ্ছে। কখনো সেনাপ্রধাণের নিকট হতে। আবার কোনোটা প্রেসিডেন্টের হাত থেকে।
আসচর্যজনক হলেও তার পছন্দের পুরুষ ব্যক্তিত্ব হচ্ছে জার্মান নাৎসি প্রধান হিটলার। অর্থাৎ যে নিজের মর্যাদা অক্ষূন্ন্য রাখতে প্রয়োজনে সারাজীবন লড়তে রাজী এবং পছন্দর জীবন সঙ্গী না পেলে সারাজীবন কুমার থাকতেও রাজী।

নির্ভানা ভেবে অবাক হলো এরকম শক্ত পার্সোনালিটির হওয়া স্বত্ত্বেও রাফসান কিরুপে জিতে যাওয়ার জন্য দ্বীমুখী আচরন করছে!
নির্ভানা শুধু ছবিগুলো দেখে আর দ্রুত পাতা উল্টিয়ে রেখে দিলো এটা। পরে পড়ার জন্য সে সেটা নিজের কাছেই রেখে দিলো।
কান্নাকাটি করে তার চোখ ও মাথা প্রচন্ড ধরেছে। রাই লেখার দিকে তাকাতেই কষ্ট হচ্ছে। রাফসানও হয়তো রুমের আলো নিভিয়ে শুয়ে আছে। তাই নির্ভানা স্টাডি রুমের টেবিলে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লো সন্ধ্যাতেই।

রাতে খাবারের টেবিলে জমায়েত হয়েছে পরিবারের সবাই। নির্ভানা সবার জন্যই রান্না।করেছে। একঘুম ঘুমিয়ে সে ও এসেছে ঘুম ঘুম চোখে, সবাইকে খাবার পরিবেশন করতে। রাফসানও বসেছে। খাওয়া।দাওয়া।ও আলাপচারিতার এক পর্যায়ে রায়হান মাহমুদ গর্জে উঠলেন,

” হাউ ডেয়ার হি! আমার কাছে সে সম্পত্তির ভাগ চায়? আমি কি ম’রে গেছি? আমি জীবিত থাকতেই আমার অর্জিত সম্পত্তির হিস্যা চায়,।এত সাহস ওর? ”

শায়লা স্বামিকে শান্ত হতে বলে বললো, তারপর সে ও মুখ ঝেড়ে বললো,

” ও তো খারাপ কিছু বলে নি, ওর কিছু টাকা দরকার, তাহলে ও কোথা থেকে পাবে এ টাকা? চুরি- ডাকাতি করবে? নাকি ব্যাংক লুটবে? নিজের বাবাকে বলবে না তো কাকে বলছে। তাই বাবাকে বলেছিলো। এমন নয় যে তোমার কাছে নেই টাকা?থাকতেও তুমি দিতে নারাজ হলে সেজন্যই তো সম্পত্তির ভাগ চাইলো, অন্যায় কি বলেছে আমার ছেলে? ”

রায়হান সাহেব তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন,

” ওও! এখন তো বেশ আমার ছেলে আমার ছেলে করছো? কথাটা লেইম হলেও তাহলে তুমি ওকে টাকা দাও? আমি নই, কারন ও দিন দিন আমার ভরসা হারাচ্ছে।

শায়লা নিরুত্তর থাকলো।

তারপর রাফসানের দিকে ফিরে রায়হান মাহমুদ বললেন,

” ওকে রাফসান, আমি তোমাকে সম্পত্তির ভাগই দেবো, সেটুকু পাবে তা কড়ায় গন্ডায় দেবো। কিন্তু এক শর্ত আছে, সেটা তোমাকে মানতে হবে।

রাফসান ক্রোধান্বিত হয়ে সুধালো,

” তাই তো করবে তুমি? এখন শর্তও জুড়ে দিবে!”

শায়লা রাফসানকে থামতে বললো,

” আহা! রাফু থামো তো! ”

তারপর রায়হান মাহমুদের দিকে চেয়ে বললো,

“কি শর্ত বলো তুমি? ”

” রাফসান, তোমার শর্ত এটাই, তুমি যখন বাবা হবে তখন পাবে তুমি এই সম্পত্তির ভাগ। অর্থাৎ নির্ভানার গর্ভ হতে যখন তোমার সন্তান আগত হবে, তখনই তুমি পাবে এ সম্পত্তি। শুধু বিশ কোটি নয়। আমার এখন যে সম্পত্তি আছে তা আমার চার ছেলে মেয়ের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দিলে প্রত্যেক ছেলে পাবে একশ বিশ কোটি টাকার সম্পত্তি! সো বি কেয়ারফুল রাফসান। ”

একথা শুনে রুহশানের চোখ জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো খুশিতে। আর সে নাচতে নাচতেই বলে উঠলো,

” তার মানে আমিও? পাপা! আই মিন বাচ্চার বাবা হলে আমিও আমার ভাগ বুঝে পাবো?”

রুহশানানের উক্ত ঠাট্টায় তার বাবা বিরক্ত হলো।

” ওহ নাহ রুহশান! আমার মন জয় করতে পারলেই তুমি পাবে সম্পত্তি, নচেৎ নয়। আর রাফসান, তোমার তো এই শর্ত দুধ ভাত মনে করার কথা। নির্ভানাকে তো তুমি মেনেই নিয়েছো, এখন শুধু আমাকে নাতি নাতনির মুখ দেখাও। তাতেই আমার শান্তি!”

বলেই রায়হান সাহেব আবেগপ্রবন হয়ে উঠলেন।

রাফসান উপরে উপরে প্রকাশ না করলেও ভেতরে ভেতরে গর্জে উঠছিলো।
রুহশান তার ভাই রাফসানকে ফিসফিস করতে করতে বললো,

” ব্রো, পাপাকে বলো ডোন্ট ওরি। যাস্ট ওয়েট ফর সেভেন মান্থস!”

রাফসান চোখ গরম করে বললো,
” সাত মাস?”

রুহশান মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো,

” হ্যাঁ, আমি তো জানি সাত মাসেই বেবি এসে যায়!”

রুহশান ছোটোভাইয়ের মাথায় একটা চড় লাগালো।

” তোর মাথায় গোবর ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। দশ মাস লাগে বেবি হওয়াতে! ”
রুহশান নিজের মাথা চুলকাতে লাগলো।

তারপর রাফসান বাবার দিকে মোড়ে বললো,

” দশ মাস অনেক সময়, আমার টাকাটা এখনি লাগতো!”

রায়হান সাহেব আর কথা বাড়ালেন না, ছেলেকে চোখে শাসিয়ে শায়লাকে বললেন,

” শায়লা ওকে বলে দাও, বেবি কনসিভের খবর এলে প্রাথমিকভাবে এক কোটি পাবে। এসব কোম্পানি এত মুখের কথা না চালু করা। ”

নির্ভানা মা পিতা ও পুত্রদের এসব কথা শুনছিলো নিচের দিকে চোখ করে শান্তভাবে।

হঠাৎই সবার গোমট ভাব ভঙ্গ করে সাহায্যকারী তামান্না বলে উঠলো,

” ভাবী আপনের মা বাবা আইছে বাসায়! ড্রয়িং রুমে বসছে! ”

খুশিতে নির্ভানার চোখে মুখে একটা হাসি খেলে গেলো।

(চলবে)