#ওঁগো_বঁধু
পর্ব ২৪ (শেষ পর্ব)
#জান্নাতুল_মাওয়া_লিজা
নির্ভানা দৌড়ে গেলো ড্রয়িং রুমে তার বাবা মা বসে আছে শুনে। এতদিন পর বাবা মাকে দেখতে পেয়ে একদিকে আনন্দ আর অন্যদিকে অভিমান হলো তার।
আবার মনে মনে ভাবলো, না এসে ভালোই করেছে তারা। তারা আসলেও এটা জেনে কষ্ট পেতো যে, স্বামি, শাশুড়ী আর ফুপু শাশুড়ীদের খুশি রাখার জন্য এ বাড়িতেই ছিলো না সে এতদিন।
শাহের আলী মেয়ের কপালে একটা চুমো দিলো।
ছখিনাও মেয়েকে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো।
নির্ভানার মাথা ছুঁইয়ে আদর করে বললো,
” তোমারে নিয়া নিশ্চিন্তে ছিলাম আম্মা। জানতাম তুমি ভালোই থাকবা, বেয়াই সাব আমাগো কথা দিছিলো, যে করেই হোক তোমাকে খুশী রাখবে। তাই নিশ্চিন্তে সারাদেশ ঘুরতে পারছি।
শাহের আলী মেয়েকে আদর করে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
” আম্মা, আমারে মাফ কইরো, সারা জীবন খালি তোমার মায়ের লগে টাকা টাকা নিয়া ঝগড়াই করছি, তার বড় ইচ্ছা হইছিলো কক্সবাজার, সুন্দরবন ঘুরবো। আসলে সারা দেশই ঘুরতে মন চাইছিলো তার, তাই তোমার বোনদের নিয়াই ঘুরলাম সারা দেশ। মেলা কিছু দেখলাম, ওগোরেও দেখালাম। এখন মরলেও শান্তি। আর আজ বেয়াই সাবই আমাগো দাওয়াত করলো। কি এক বিশেষ খবর দিবে নাকি? ”
বোনরাও নির্ভানাকে জড়িয়ে ধরলো আনন্দে।
সবার মুখেই এক কথা, ” বুবু, বিয়ার পর তুমি কত্ত সুন্দর হইয়া গেছো! একদম বলিউডের নায়িকাগো মতো লাগে! ওমা গো! ”
ছোটোবোন ঝুমু নির্ভানার দু গালে হাত ছুঁইয়ে বললো,
“দুলাভাই বুঝি তোমারে অনেক ভালোবাসে? আদর করে, গেরামের মানুষ কইতো,শোয়ামির আদর পাইলেই নাকি বউ সুন্দরী হইয়া যায়!”
বলেই দুষ্টামির হাসি হাসতে লাগলো সে।
নির্ভানা বোনের এ কথার উত্তর খুঁজে পেলো না। কি বলবে সে বোনদের, যে তার স্বামি তাকে ঘৃণা করে? নাহ; বরং মনের মধ্যে পুষে রাখা বেদনাগুলো আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। যে স্বামি তাকে সহ্যই করতে পারে না সে আবার আদর করবে, ভাবাই যায় নাহ!
বোনরা ভাবলো স্বামির আদরের কথা বলায় তাদের রানু বুবু লজ্জা পাচ্ছে, তাই আর এ বিষয়ে কথা বাড়ালো নাহ।
রায়হান মাহমুদ ও শায়লা মাহমুদও ছুটে এলো বেয়াই বেয়াইনির সাথে কথা বলতে।
রায়হান মাহমুদ সবার সাথে কুশল বিনিময় করে নিলো। শায়লাও নিজের মনের বিরুদ্ধেই সবার সাথে হালকা কুশল বিনিময় করে নিলো।
এবার এলো রাফসানের পালা। রাফসানও নিজের মনের বিরুদ্ধে সামান্য কুশল বিনিময় করে নিলো।
কিন্তু মনে মনে কিটমিট করতে লাগলো একটা বাক্যই, ” সব ফকিন্নির বাচ্চাদের দল!”
সারাটাদিনও তার মাথা ঝিম মেরে ছিলো বন্ধুদের তৈরি ওসব মিমস দেখে। যেখানে তাকে আর তার বউকে নিয়ে মজা করা হচ্ছে।
মানুষের আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। তারা শুধু পড়ে থাকে, মানুষের দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করার জন্য। আর রাফসানও সেসব দেখে নির্ভানার প্রতি থেকে মন আরো দূরে সরিয়ে নিয়েছে। নির্ভানার উপস্থিতিই যেনো তাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
রাতের খাওয়া শেষ করে নির্ভানার বাবা মা আর বোনদেরকে রাফসান বলে কয়ে তার রুমে নির্ভানার সাথে থাকার ব্যবস্থা করে দিলো। অন্ততঃ একটা রাত ঐ নির্ভানার সাথে তাকে শুতে হবে না এই উদ্দ্যেশ্যে । নির্ভানা প্রথমে বাবা মায়ের রুমেই গেলো। রাফসানের উক্ত আচরনেই শাহের আলীর আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, মেয়ে তার সুখে নেই।
কিন্তু নির্ভানা সেসব প্রকাশ করলো না। কিন্তু শাহের আলী নিজের মাথায় হাত রেখে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলো,
” মা! আমার মাথা খাও! বলো জামাই কি তোমারে মেনে নেয় নাই?”
উত্তরে নির্ভানা কিছু না বলে শুধু হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।
মা বাবা ও বোনরাও তার সাথে কাঁদতে লাগলো।
তাদের আর বুঝতে বাকি রইলো না।
” মা তোরে নিয়া চইলা যামু আমি, যেখানে ভালোবাসাই নাই, সেইখানে তোরে রাখমু না!”
শাহের মেয়েকে একথা বলায় নির্ভানা চোখ মুছতে মুছতে বলে উঠলো,
” না আব্বা কাইন্দো না, কেউ না চাইলেও আমার শ্বসুর আমারে বহু ভালোবাসে, আমি এই বাড়িতেই থাকমু যতদিন আমার শ্বসুর জীবিত আছে। তুমি ভাইবো না, আমারে নিয়া। ততদিনে আমি নিজেও পড়াশুনা শিখা কিছু একটা করমু! আমি এইভাবে চইলা গেলে আমার শ্বসুর অনেক কষ্ট পাবে।”
শাহের আলী ও ছখিনা মেয়ের কথায় অনেকটা নিশ্চিন্ত হলো।
ওদিকে রাফসান রুহশানের সাথে ঘুমাবে বলে তার রুমে গেলো।
ওদিকে রুহশান, তটিনি আর মেহরোজ নিজেদের প্ল্যান অনু্যায়ী কাজ করতে লাগলো। রুহশান তার ভাইকে নিজের কক্ষে নিয়ে গেলো।
রাফসান রুহশানের কক্ষে গেলো দেখে তার পরপরই তটিনি আর মেহরোজ নির্ভানা ভাবিকে তাদের রুমে নিয়ে গেলো পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক।
” ভাবি! আজকে বাবা যা এনাউন্সমেন্ট দিলো, আমি তো পুরাই হা হয়ে গিয়েছি! তোমাদের বেবি নিতে হবে..আমি তাহলে কয়েকদিনের মধ্যেই একটা ছোটো পুতুলের মতো বাবুর ফুপ্পি হবো।…ওলে গুলুগুলু!”
তটিনি অনেক আদুরে স্বরে নির্ভানাকে একথা বলে একটা আদুরে হাসি দিলো।
নির্ভানা মনে দু:খ গোপন করে নির্বাক রইলো । কারন রাফসানের বিষয় সে জানে। কোনোদিনও সে নির্ভানাকে নিজের সন্তনের মা বানাতে চাইবে না।
” ভাবি, বিশ্বাস করো, আমরা দুজনের একজনো তোমাকে প্রথম প্রথম ভাবি হিসেবে মেনে নেইনি। ভেবেছিলাম তুমি কোনোদিন পড়াশুনাও করবে না। কিন্তু তুমি দেখি ইংলিশে কথা বলাও শিখে গেছো। আর তুমি যে এত সুন্দরী, তা যখন দেখলাম, আর তোমার হাতের রান্না খেলাম, তখন তোমার ভক্ত হয়ে গেলাম। এখন আমরা দুজনেই তোমাকে ভালোবাসি। ভাইয়াও এখন তোমাকে ভালোবাসে? তাই নয় কি?”
মেহরোজের এই প্রশ্নে নির্ভানা কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলো না। সত্যিটা কিভাবে সে মেহরোজকে বলবে? তার ভাই যে তাকে ভালোবাসে না, এই কথা সে কিভাবে বলবে, যেখানে সবার সামনে রাফসান নির্ভানার সাথে এত ভালো ব্যাবহার করে! আর বদ্ধ ঘরের ভেতরে এত খারাপ আচরন সে করে! তা অভাব্য।
ওদিকে রুহশান ভাইকে টেনে নিয়ে নিজের ঘরে গিয়েছে। নিজের বড় ভাইয়ের সাথে থাকবে এত
বছর পর! রুহশান বিছানার উপর লাফাতে লাগলো।
রাফসান জানে না তার পাগল ভাইটা কি বলার জন্য তাকে রুমে নিয়ে গেছে!
দুই ভাই রুমে ঢুকতেই রুহশান নিজের কামরার দরজা লক করে দিলো।
” ব্রো, তোমার জন্য একটা স্পেশাল গিফট আমি ইউ কে থেকে এনেছি, তা সবার সামনে বের করতে হ্যাজিটেড করছিলাম। আর বাবা কতোটা কনজার্ভেটিভ তা তো জানোই। এসব এনেছি জানলে আমাকে বাসা থেকেই বের করে দেবে; এই যে দেখো…! ”
বলেই সে তার লাগেজ হতে বের করলো এক বোতল রেড ওয়াইন। তারপর অত্যাশ্চার্যের ন্যায় চোখ করে ভাইকে বললো,
” ব্রো বিলিভ ইট অর নট! এই রেড ওয়াইনটা পাঁচশ বছরের পুরাতন। এর দাম পঁচিশ’শ পাউন্ড। আমি অনেক কষ্টে পাউন্ড জমিয়ে এটা কিনেছি। এত ছোটো বোতল! বাট এটি হ্যাভি ইউনিক ব্রো। এটা খেলে….!”
রাফসান ছোটো ভাইকে থামিয়ে দিলো। আর বললো,
” এটা খেলে হাতি ঘোড়া যাই ই হোক, আমি এসব খাই না! আর কোনো ভাবেই খাবো না। ”
রুহশান ভাইকে আষ্টেপৃষ্টে ধরলো।
” ব্রো, বহু কষ্টে আমি এটা তোমার জন্য এনেছি। আমি কি তোমার জন্য খারাপ জিনিস আনতে পারি? হিথ্রো এয়ারপোর্টে ফোর ফোর এইট লেয়ারের সিকিউরিটি লেভেল পেরিয়ে, আমি এটা তোমার জন্য এনেছি। এক চুমুক হলেও তোমাকে এটা খেতে হবে। আর এটা তো হেলদের জন্য খারাপ কিছু না, বরং অনেক ভালো এটা। কিচ্ছু না, যাস্ট ভালো মানের আঙ্গুরের ফার্মান্টেশনের মাধ্যমেই এটি বানানো হয়েছে। আর ওয়াইন যত পুরাতন সেটা তত বেশি ভালো। এটা খেলে নেশা তো হবেই না! একচুয়ালি ইট ওয়ার্ক ফর ম্যানুফেক্টার নিউ ব্রেইন সেল! সো প্লিজ ব্রো…প্লিজ৷ প্লিজ প্লিজ প্লিজ প্লিজ ”
এতগুলা কথা বলে কয়ে রুহশান রাফসানকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই একপ্রকার জোর করেই এক চুমুক খাইয়ে দিলো।
আর এক চুমুক খেয়েই রাফসান যেনো কি এক স্বাদ পেলো। সে রুহশানের নিকট হতে বোতল কেড়ে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো বোতলই সে খেয়ে সাবাড় করে নিলো।
তারপর বড় করে একটা ঢেকুর দিলো।
রুহশান ভাইকে বললো,
” আর ইউ ওকে ব্রো?”
” ইয়েস আ’ম ওকে!”
এবার রুহশান বলা শুরু করলো,
” ব্রো, ইউকে তে থাকতে তোমাকে আমি ভীষণই মিস করতাম! ”
রাফসানও বললো,।
” আমিও রে!”
” ব্রো, যখন যখন আমি ছ্যাঁকা খেতাম, তখন তখন তোমাকে বেশি মিস করতাম! কারন তুমি তো আমাকে প্রতিদিনই একটা কথা বলতে যে, নেভার ফল ইন লাভ! আসলেই লাভ বলে কিছুই নেই দুনিয়াতে!”
বলেই দুই ভাই হো হো করে হেসে দিলো।
রুহশান এবার প্রশ্ন করলো,
” ভাই, তুমি কি ঐ মেয়েকে আই মিন রানু! ধ্যাৎ আই মিন নির্ভানাকে মেনে নিয়েছো?”
রাফসানের নেশা এবার চরমে। নেশা জড়িত কন্ঠে সে বলতে লাগলো,
” নাহ! আমি তাকে কেনো মানবো? আই হেইট হার। আমি তাকে কোনোদিন মানিনি। শুধু সবার সামনে মেনে নেওয়ার নাটক করেছি…হা হা হা নাটক!
রুহশান চোখ কপালে তুলে বললো,
” ওহ রিয়েলি? নাটক! তাহলে বাচ্চা হবে কিভাবে? নাটক করে তো আর বাচ্চা আনা যাবে না। ইটস আ ম্যাটার অব ফিজিক্যাল ব্রো… ”
রাফসান উত্তর করলো,
” ওহ! আই হেইট হার, সো নো বাচ্চা নো টাচ্চা!
রুহশান পুনরায় বললো,
” তাহলে তো বাবা সম্পত্তি দেবে না তোমাকে!”
রাফসানের কূট উত্তর,।
” সম্পত্তি দেবে না তো কি? আমি ঐ মেয়েকে দিয়েই বাবার কাছে সম্পত্তি চেয়ে নিবো, ও চাইলে তো বাবা সবই দেয়! সুতরাং প্রোপারটিও পাবো। আমি গিয়ে ওকে বলি…”
বলেই রাফসান টলতে টলতে সেখান থেকে চলে গেলো।
রুহশানের প্ল্যান যেনো সঠিক হয়েছে। মনে মনে বললো,
” বাবা দেখেছো? বলেছিলাম না, ভাই ড্রামা করছে! এবার আসল কথা বের হয়েছে। আর এ সবই আমি আমার ফোনে ভিডিও করে নিয়েছি। ”
ওদিকে আলাপচারিতার পর মেহরোজ নির্ভানাকে একপ্রকার জোর করেই রুহশানের ইউ কে হতে আনা একট ওয়েস্টার্ন স্লিভলেস গাউন পড়িয়ে দিলো। তারপর মেহরোজ রুম থেকে বেরিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। নির্ভানা আয়নায় তাকে দেখছিলো।
“এ কি পড়িয়ে দিলো মেহরোজ তাকে! যাই।এটা চেইঞ্জ করে আসি!”
বলেই যেই না নির্ভানা ওয়াশ রুমে গিয়ে সেটা চেইঞ্জ করে আসতে যাচ্ছিলো হঠাৎ সে ভাবতেও পারেনি রাফসান রুমে এসে পড়েছে।
নেশার্ত চোখে রাফসান নির্ভানাকে দেখলো। তারপর বললো,
” ইউ নো? ইউ আর মাই ড্রিম গার্ল! বাবাকে এখনি বলো যেনো আমাকে আমার ভাগ দিয়ে দেয়। আমিও তোমাকে বেবি দেবো মাই বেইব…”
বলেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে রাফসান নির্ভানাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
নির্ভানা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো। নিজেকে ছাড়িয়ে নেবে? নাকি এতদিন পর তার ভালোবাসার মানুষের ডাকে সাড়া দেবে?
রাফসান তারপর কোলে বসিয়ে মনের মাধুরী মাখিয়ে আদরে ভরে দিতে লাগলো তাকে। কি উদ্দ্যেশ্যে রাফসান আজ এহেন আচরন করছে? নির্ভানা নিজেকে কয়েকবার এসব প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পেলো না। নির্ভানাও নিজের নিয়ন্ত্রণ হারালো মনের মানুষের আহবানে।
পরদিন শেষ রাত্রে নির্ভানা নিজেকে আবিষ্কার করলো মেহরোজের কক্ষে রাফসানের একান্ত সান্নিধ্যে একই বিছানায় একই কম্বলের নিচে। সে কিভাবে এত গভীরভাবে ঘুমালো?
নির্ভানার মনে পড়লো। এক গ্লাস লেমন জুস তাকে দিয়েছিলো মেহরোজ। সেটা খেতে কেমন জানি উৎকট ছিলো। না খেলে মেহরোজ যদি আবার কিছু মনে করে, সেজন্য নির্ভানা সেটা খেয়েছিলো। আসলে সেখানে কিছু হয়তো মিশিয়েছিলো মেহরোজ, যেজন্য এত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো সে।
নির্ভানা দ্রুত উঠে গেলো ফজরেরও আগে। গোসল করে নামাজ পড়ে টিচার এসেছে বিধায় পড়ার কক্ষে গেলো।
সকালে মনের মাধুরী মিশিয়ে সবার জন্য হরেক রকম নাস্তা বানালো সে।
ওদিকে ঘড়িতে সময় গড়াতে গড়াতে দুপুর বারোটা। রাফসানের উঠার কোনো নামই নেই।
বারোটার কিছু পর রাফসান উঠলো।
আর রাফসানের মনে পড়লো রুহশান তাকে একটা রেড ওয়াইন খাইয়েছিলো। তারপরই তার পুরো দুনিয়া গুলিয়ে গেলো। তাহলে কি সে নির্ভানার সাথে একসাথে… ? সে ছি: করে উঠলো। আর মনে মনে বলে উঠলো।
” ঐ মেয়ের সাথে আমি সব করে ফেলেছি! সব হয়ে গেছে? শিট!”
রাফসান ক্ষোভে দাঁত দিয়ে আঙ্গুল কামড়াতে লাগলো। কিন্ত রাতে যা হওয়ার সব হয়ে গিয়েছে। সারা রাত সে নেশাগ্রস্ত হয়ে নির্ভানাকে আদর করেছে! মনে হতেই রাফসান পুনরায় ওয়াক থু! করলো। কিন্তু সে তো সবই করে ফেলেছে।
হঠাৎই রুহশান রুমে এলো ভাইকে ডাকতে। ভাইকে সে খবর দিতে এসেছে যে, বাবা তাকে ডাকছে। ভয়ে রুহশান আর রাফসানের সামনে পর্যন্ত এলো না, সে শুধু খবরটা দিয়েই চলে গেলো।
রাফসান দ্রুত গোসল সেরে চলে গেলো বাবার নিকটে।
রায়হান সাহেব থমথমে মুখে বললেন,
” রাফসান, দু:খিত আমি তোমাকে কোনো টাকাই দিতে পারছি না!”
রাফসানের করুন চোখে নির্লিপ্ত প্রশ্ন,
” কেনো বাবা? ”
” কারন প্রমাণ আমার হাতে, তুমি যে কোনো কোম্পানিরই নয় বরং টাকা নিয়ে বিদেশে পালাতে যাচ্ছিলে তার প্রমাণ রুহশান আমাকে দিয়েছে!”
রাফসান চেঁচিয়ে উঠলো,
” হোয়াট দ্য হেল!”
রায়হান মাহমুদ আর কথা না বাড়িয়ে রুহশানের সাথে রাফসানের গতরাতের আলোচনার ভিডিও সে জায়ান্ট স্ক্রিনে ছেড়ে দিলো। বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ সেখানে উপস্থিত। ভিডিও শেষ হলে রায়হান সাহেব গর্জে উঠলেন,
” এবার কি তুমি বলবে এসব মিথ্যা? আর কোনো অযুহাত আছে তোমার?!”
রাফসান হন্তদন্ত করে বলে উঠলো,
” হাউ ডেয়ার হি! ইটস আ কনসপাইরেসি! ষড়যন্ত্র সব? আমাকে ওয়াইন খাইয়ে ড্রাংক করে, আমাকে দিয়ে এসব বলিয়েছে রুহশান!
রায়হান সাহেব হেসে বললেন,
” কোনো ষড়যন্ত্র টড়যন্ত্র নয় এটি, সব সত্য কথা তোমার মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছে। আর আমিই তোমাকে এটা খাওয়াতে বলেছিলা। আর তোমার তো আমেরিকার ভিসাও প্রায় রেডি। এ খবরও আমি তোমার ল্যাপটপ হ্যাক করে পেয়েছি। এই হলো তোমার ভিসার কাগজের পত্রের জেরক্স কপি, এই নাও দেখতে পারো… আর ওভার অল তুমি তো নির্ভানাকেউ ভালোবাসো না! আমার সামনে সব নাটক করছিলে তুমি, ওকে ভালোবাসার, যেনো আমি খুশি হয়ে তোমার কথা অন্ধের ন্যায় বিশ্বাস করে তোমাকে সব টাকা দিয়ে দেই, তাই নয় কি? আমার কথা অস্বীকার করতে পারবে তুমি?”
রাফসান রাগে ফোঁস করে বলে উঠলো,
” আমি তোমার কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দেবো। নাহ! আমি আর থাকবোও না, তোমাদের সাথে, ত্যাজ্যাপুত্রও করতে পারো তুমি! ”
রায়হান সাহেব শান্তস্বরে বললেন,
” তা আর হবে না রাফসান। তোমার কোনো সঞ্চয় নেই আর নেই কোনো একাউন্টস। আর একা একা চলার মতো শারীরিক অবস্থাও নেই তোমার।
তার চেয়ে বরং যা পেয়েছো সেটাই মেনে নাও। নিয়তি তোমাকে হারায়নি বরং জিতিয়েছে। নির্ভানার মতো স্ত্রী তুমি পেয়েছো। যে তোমাকে এত ভালোবাসে!
বলেই নির্ভানার দিকে আঙুলী নির্দেশ করলো রায়হান সাহেব। নির্ভানা নিরবে অশ্রু বিসর্জন করছে।
রায়হান সাহেব পুনরায় বলা শুরু করলেন,
“সেদিন লেকে তুমি ডুবে গিয়েছিলে, যা তুমি অস্বীকার করেছিলে। আর তোমার স্ত্রী জীবনের মায়া ছেড়ে তোমাকে উদ্ধার করেছিলো। আর এই ঘটনার ভিডিওটা সেখানের কেউ একজন ভিডিও করেছিলো। যা এখন ভাইরাল। যদি নির্ভানাকে তুমি ছেড়েও দাও, তাহলে তুমি লোকচক্ষুর কাছেও তুমি ভিলেন হয়েই থাকবে। এত ভালোবাসা যদি তুমি হেলায় ছেড়ে দাও, তাহলে বলে দিচ্ছি এ জীবনে তুমি আর প্রকৃত প্রেম পাবে না। এ আমার বদদোয়া বলতে পারো। ”
রাফসান বাবার এসব কথাকে অগ্রাহ্য করেই বের হয়ে গেলো রাস্তায়।
নির্ভানাও কেঁদে কেঁটে স্বামির পিছুপিছু চলে গেলো। মেহরোজ তাকে থামানোর চেষ্ঠা করেও পারলো না। নির্ভানা দৌড়ে ছুটে গেলো রাফসানের পিছু পিছু।
রাস্তায় নেমে রাফসান নির্ভানার দিকে অগ্নিদৃষ্টি ছুঁড়ে বললো,
” আজ তোমার জন্যই আমার আজ এই অবস্থা! দূর হও আমার সামনে থেকে। ”
বলেই দ্রুত কদমে হাঁটতে লাগলো। মাথায় তার এক সমুদ্র তেজ। রাস্তার যানবাহনেরো কোনো তোয়াক্কা নেই তার। দৌড়ে রাস্তার পর রাস্তা পার হতে লাগলো সে। নির্ভানাও দৌড়াতে লাগলো। মানুষটাকে সে এভাবে যেতে দিবে না। বাবা মায়ের কাছে বুঝিয়ে শুনিয়ে রেখে সে ই বরং তাকে ছেড়ে চলে যাবে চিরদিনের জন্য। এ কথাটা বলার জন্যই
নির্ভানা রাফসানের পিছুপিছু দৌড়াতে লাগলো।
দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎই একটা ট্রাক পেছন থেকে এসে ধাক্কা দিলো রাফসানকে। তবে ধাক্কা খাওয়ার সাথে সাথেই কার যেনো দুটি হাত তাকে সজোরে টেনে হিঁচড়ে রাস্তার পাশের খাঁদে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তারপর আর সে কিছুই জানে না। জ্ঞান হারালো রাফসান।
রাফসানের কখন জ্ঞান ফিরলো সে সম্পর্কে সে অজ্ঞাত। সামনের কাঁচের গেইটে লাল অক্ষরে লিখা আই সি ইউ। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ, প্রচন্ড ব্যথা আর যন্ত্রণা। ক্যানোলা, স্যালাইন, ইঞ্জেকশন ইত্যাদি দেখতে দেখতেই কয়েক ঘন্টা পার হয়ে গেলো।
তারপর তাকে সেখান থেকে বের করে আনা হলো কেবিনে। বাসার সবাই সেখানে উপস্থিত। সবাই মৌন মুখে দাঁড়িয়ে। আশ্চর্য হলেও সত্য, রাফসানের নির্লিপ্ত চোখ দুটি একবারের জন্য হলেও খুঁজে বেড়ালো নির্ভানাকে।
এখনো তার শরীরে র*ক্ত পাস হচ্ছে। তার তো।রেয়ার ব্লাড। রাফসানের মনে এটাই খেলে গেলো তাহলে কি এটা নির্ভানারই র*ক্ত?
ডাক্টার এলো। রাফসানদের ফ্যামেলি ডাক্টার ডক্টর ধ্রুব; বয়সে রাফসানের প্রায় সমবয়সী। সে রাফসানের সর্বাত্মক অবস্থা পর্যবেক্ষণ পূর্বক বলা শুরু করলো,
” ইউ আর নাউ আউট অব ডেঞ্জার রাফসান ভাইয়া, আপনার ডান পায়ের টিবুলা ফ্র্যাকচার হয়ে গিয়েছে সেটা অপারেশন করা হয়েছে। আর ডান হাতের রেডিয়াস অস্থিটাও গুরুতরভাবে ফ্র্যাকচারড। তবে আপনি ভাববেন না, সুস্থ্য হয়ে যাবেন এক বছরের মধ্যে!”
রাফসান ডাক্তারের আশ্বাস শুনে মৃদু হাসলো। তারপর বললো,
” এক বছর!?”
তারপর ডক্টর ধ্রুব অন্যপাশ ফিরে বলা শুরু করলো,
” ভাবী! রাফসান ভাইয়া ধন্যবাদ না জানালেও আমি আপনাকে জানাচ্ছি। আপনার হাত দুটো ঐশ্বরিক নির্ভানা ভাবী! কিভাবে আপনি তাকে এত বারবার সেইভ করেন? ইটস আনবিলিভ এবল! ভালোবাসা এমনও হয়! নিজের জীবনকে মৃত্যু ঝুঁকিতে ফেলে দিয়ে আপনি বারবার আপনার হাজবেন্ডকে মৃত্যুমুখ হতে টেনে আনছেন, আর সে কিনা আপনার ভালোবাসা বুঝেই না!
রাফসান যা ভেবেছিলো তাই ঠিক। একই কেবিনে আরেক বেডে নির্ভানা শুয়ে। তার শরীর হতেই র’ক্ত সরাসরি রাফসানের শরীরে যাচ্ছে।
ডাক্তার তারপর রাফসানের দিকে মোড়ে সে বললো,
“ইটস আ ক্রাইম রাফসান ভাইয়া! ইটস আ ক্রাইম। ভাবী আপনাকে প্রথমে নিজের ভালো কিডনিটাই দিয়ে দিলো আর নিজের কতগুলি রেয়ার ব্লাড! আপনার কাছে তো এটা আবার কিছুই না! তারপর লেইকে ডুবে যাওয়া হতেও সে টেনে তুললো, তারপর আবার! আজ যেভাবে ভাবী আপনাকে দ্রুতগতির বাসের নিচ হতে বাঁচিয়েছে, তা অভাবনীয়। আর গত তিনদিনে আপনার শরীরে যা রক্ত লেগেছে সব নির্ভানা ভাবিই দিয়েছে। ”
দাদা দাদীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দাদী কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
” রাফু দাদাভাই, অনেক তো পালাবার চেষ্ঠা করলে। কিন্তু বাস্তবে উপরালা এই মেয়েটাকেই তোমার সঙ্গি করে রেখেছেন, একে মেনে নাও দেখো জীবনটাও সহজ হয়ে যাবে”
রাফসানের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। তার বিপরীত পাশের বিছানায় শোয়া নির্ভানার দিকে তার দৃষ্টি পড়লো। মেয়েটার চোখের পাশে অশ্রুজল। মুখটা শুষ্ক, চোখগুলো কেমন নেতিয়ে পড়েছে সে তারপরো রাফসানকে সে বিলিয়েই যাচ্ছে!
পনেরো দিন পর এক হাত আর এক পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে রাফসান ফিরলো মাহমুদ’স প্যালেসে। ছয়টা মাস সে মোটে এক হাত আর এক পা দিয়েই পার করলো কারন তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হলো নির্ভানার দু হাত আর পা। তার উঠা, বসা, খাওয়া দাওয়া সব কাজের সার্বক্ষনিক সাহায্যকারী নির্ভানা সাথে তার মনের খোরাক জোগানোর সাহায্যকারীও যেনো সে।
নির্ভানা এখন ছয় মাসের গর্ভবতী, তার পরো রাফসানের সেবা যত্নের ব্যাপারে সে জিরো টলারেন্ট।
রাফসানের আজ ব্যান্ডেজ খোলার দিন। চিৎকার করে তার বলতে ইচ্ছে করছে,
” নির্ভানা! আই লাভ ইউ!”
কিন্তু লজ্জা, সংকোচে সে আড়ষ্ট।
এমন সময় রুহশানের প্রবেশ। সে দুইটা এয়ার টিকেট এনেছে ইংল্যান্ড ঘুরে আসার।
ভাইয়াকে সে টিকিট দুটি বুঝিয়ে দিয়ে বললো,
” ভাইয়া! লন্ডনের ইয়েলো পার্কে প্রেমিকদের জন্য একটা প্লেস আছে, যেখানে প্রেমিকরা তাদের প্রেমিকাকে চিৎকার করে প্রপোজ করে। ইউ মাস্ট স্যুড ট্রাই!”
রাফসান ফিসফিস করে ভাইকে বললো,
” আরে ভাই, তুই না বলতেই মনের কথা বুঝিস কিভাবে রে?”
রুহশান এক চোখ টিপে বললো,
” ব্রো, একশ প্রেম করেছি, এ না বুঝলে আর হলো? তবে রিয়েল প্রেম পাইনি কোনোদিন। তাই যখন নির্ভানা ভাবির প্রেমের কাহিনী দেখলাম, তখন মন বললো, এই প্রেমটা জোড়া না লাগালেই নয়, সেজন্যই তো তোমাকে ওভাবে ফাঁসালাম, এখন দেখো আমি কী ভুল করেছিলাম?”
রাফসান হাসলো ভাইয়ের কথায়। ভাই তার ভুল করেনি, ভুলতো করেছিলো সে, নির্ভানাকে ওভাবে ফিরিয়ে দিয়ে।
.
.
লন্ডনের ইয়েলো স্টোন ন্যাশনাল পার্ক!
পার্পল কালারের একটা সেমি সিল্ক শাড়ী পড়ে নির্ভানা দাঁড়িয়ে। তার সামনে রাফসান হাঁটু গেঁড়ে বসে একটা ডায়মন্ড রিং প্রদর্শন করে বলে উঠলো,
” ইউল ইউ বি মাইন ফর এভার!”
নির্ভানা হেসে উঠলো খিলখিলিয়ে। হাসি অক্ষুণ্ণ রেখেই বললো,
” ইয়েস! আই উইল!”
রাফসান নির্ভানাকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো পরম শান্তভাবে।
নির্ভানার গর্ভের শিশুটি মা বাবার খুশিতে হেসে উঠলো সুখে।
—————(সমাপ্ত)—————-