ওগো বধূ সুন্দরী পর্ব-০১

0
2

#ওগো_বধূ_সুন্দরী
#ঈপ্সিতা_মিত্র
দিনটা ১৯৮৯ সালের ২৯ শে এপ্রিল | বৈশাখ মাসের ভ্যাপসা গরমে অর্নক আর তিতলির জীবনে বসন্ত এসেছে | ওদের আজ বিয়ে | না , এই বিয়ের আগে ওদের জীবনে প্রেম এর ‘প’ ও পা দেয়নি ! অর্নক স্বভাবে বেশ লাজুক , তাই কলেজ ইউনিভার্সিটিতে সুন্দরী মেয়েদের দিকে আড় চোখে শুধু তাকিয়েই গেছে | লাইন মারা, প্রেম করা আর হয়নি ! আর তিতলির ব্যাপারটা উল্টো , ওর আজ অব্দি কাউকে বিশেষ পছন্দই হয়নি ! আর হবেই বা কি করে, গার্লস স্কুল , তারপর গার্লস কলেজ , তার ওপরে ওর বাবা ! না তিতলির বাবা অন্য বাবাদের মতন একটুও রাগী না, একেবারে বন্ধুর মতন | তাই বন্ধু হিসেবেই স্কুলে , পড়ার ব্যাচ এ , গানের ক্লাস এ দিয়ে আসতো আবার নিয়েও আসতো | পাড়ার ফাংসন থেকে পুজোয় ঠাকুর দেখা কোথাওই মেয়েকে একা ছাড়ার কোনো প্রশ্নই নেই | তাই সুন্দরী তিতলি ছেলেদের প্রেম পত্র অনেক খেলেও , প্রেম পত্র সমেত প্রেমিক কোনদিনও খুঁজে পায়নি | তাই অবশেষে দুজনেই মা কাকিমাদের স্মরনাপন্ন হয়ে , মিষ্টি আর রসগোল্লার প্লেট হাতে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায় | তবে অর্নক এর আরো একটা কারণ ছিল , ‘চিংড়ির মালাইকারী’| যেদিন তিতলিকে দেখতে গিয়েছিল ওদের বাড়িতে প্রথম , সেইদিন মিষ্টি, রসগোল্লা , সিঙ্গারার পর দুপুরে খাবার পাতে বাঁশকাঠি চালের সরু নরম ভাত, মাছের মাথা দিয়ে সোনামুগের ডাল , বেগুনি , পটল আলুর দম , চিংড়ির মালাইকারী , আমের চাটনি, পাপর, সন্দেশ , আর মিষ্টি দই খাইয়েছিল | সবই পাত্রী নিজের হাতে তৈরী করেছে | এখনো অর্নকের যেন রান্নাগুলো মুখে লেগে আছে , বিশেষ করে সেই চিংড়ির মালাইকারী | যেটা খেয়েই অর্নক মনঃস্থির করে নিয়েছিল , যে বিয়ে যদি করে তাহলে এই চিংড়ির মালাইকারীকেই করবে , সরি , মানে ইয়ে , ওই তিতলিকেই করবে |

বৌভাতের দিন যদিও সেই পচা গরমটা ছিল না জলপাইগুড়িতে | কালবৈশাখীর ঝড় আর বৃষ্টি শহরটা কে ভিজিয়ে দিয়েছে | আজ বেশ ভালো ঘুম হবে , এই ভেবেই অর্নক ঘরে ঢুকলো | এখন ঘরে শুধু ও আর তিতলি , আর একটা নিঃস্তন্ধতা ! তবে, ঘরে ঢোকার আগে একটু যে নার্ভাস হচ্ছিল না অর্নক , সেটা বললে ভুল বলা হবে | আসলে বিয়ে ঠিক হয়েছে ফেব্রুয়ারী মাসে, তারপর তিতলির সাথে দেখা হয়েছে হাতে গুণে পাঁচবার | ত়া ও মা কাকিমা, মাসিমা , পিসিমা সমেত | কথা হয়েছে , “কি কেমন আছো?” , ” হ্যাঁ ,আমি ভালো আছি ” ,শুধু ওই অব্দিই | আর ফোন করারও উপায় নেই, তিতলিদের বাড়িতে তখনও অব্দি ল্যান্ড ফোনের কানেকশন নেয়া হয়নি | আর বুথ এ দাঁড়িয়ে পা ব্যথা করে বকবক করার মতন কোনো ইচ্ছাই তিতলি নিজে থেকে দেখায়নি |

যাই হোক, এত কিছু ভেবে এখন আর কি হবে ! বিয়ে করেছে তো একসাথে একই ঘরে থাকার জন্যই | আর তিন দিন ধরে এই বিয়ের ধকল এর পর বিছানা যেন ওকে ডাকছে ! সেই সব ভেবেই ঘরের দরজাটা বন্ধ করলো | তারপর আস্তে আস্তে বিছানার দিকে এগিয়ে এলো | তিতলি লাল বেনারসী পরে কনের সাজে বসে আছে | বাহ, বেশ সুন্দর দেখতে লাগছে তো ! সন্ধ্যে থেকে আত্মীয় সজন, পারা পরশী , বন্ধু বান্ধবের ভিড়ে নিজের বউকে মন দিয়ে দেখার সময়ই পায়নি অর্নক | কিন্তু অর্নক বিছানায় এসে বসতেই হঠাৎ একটা উল্টো ঘটনা ঘটল !

তিতলি হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করলো ! অর্নক তো অবাক ! কি হলো ! কি করলো ও ! এই ভাবে কাঁদছে কেন রে বাবা ! … আমতা আমতা করে কিছু কথা সাজিয়ে অর্নক ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো , “তিতলি কি হয়েছে ? কাঁদছো কেন ? আমি তো কিছুই করিনি !” ….
তিতলি কেঁদে কেঁদে উত্তর দিল , “প্লিজ কিছু করবেন না ! প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন | আমি বাবার কাছে যাবো | এই রকম সারা রাত একটা অজানা অচেনা ছেলের সঙ্গে একই ঘরে থাকবো ! আমার ভয় করছে |” …

অর্নক কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লো , ” কি বলছ ? অজানা অচেনা ? কিন্তু আমি তো তোমার বর |” ……

তিতলি চোখের জল মুছতে মুছতেই উত্তর দিল, ” সে তো আজ হলেন ! এতদিন থরী ই না চিনতাম ! আগে এত ভয় লাগেনি | শাড়ি, গয়না , এত গিফটস এই সবের কথা ভাবতে ভাবতেই দিন কেটে গেছে ! কিন্তু আজ সত্যি খুব ভয় করছে | ” ………….

এর কি উত্তর দেবে অর্নক ! সত্যিই তো | অজানা অচেনাই বটে | তারপর তিতলিকে স্বান্তনা দিয়ে বললো , ” প্লিজ কেঁদো না তিতলি | তুমি আর একটু ভলিউম বাড়ালেই ঘরের বাইরে লোক জড়ো হয়ে যাবে ! কে বলতে পারে, ফুলসজ্জার রাতেই আমি বধু নির্যাতনের কেস এ ফেঁসে শ্রীঘরে চলে গেলাম | না বাবা, তার থেকে আমি সোফায় যাচ্ছি | তুমি আরাম করে হাত পা ছড়িয়ে খাটে ঘুমাও , নো প্রবলেম |”…..

কথাটা বলে কোনো ভাবে মেক আপ দিয়ে তিতলির কান্না থামিয়ে সেই রাতে অর্নক সোফার ওপরই নিজের শরীরটা এলিয়ে দিল | ঘুমোনোর আগে শুধু একটা কথাই মনে হলো , বাবার একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করা সত্যিই চাপের | তিতলির বয়স চব্বিশ হলেও চিন্তাধারা চোদ্দ বছরের ! কি লজিক ! গিফট আর গয়নার কথা ভাবতে ভাবতেই দিন কেটেছে, ফুলসজ্জার কথা তাই মনেই হয়নি ! যাই হোক, কি আর করা যাবে | এই ভাবেই মানিয়ে গুছিয়ে দিন কাটাতে হবে | একমাত্র বউ বলে কথা |

কিন্তু ফুলসজ্জার তিনদিন পর অর্নক আর মানাতে পারলো না সোফায় | রাত সারে বারোটায় তিতলিকে ঘুম থেকে তুলে রিকুয়েস্টটা করেই ফেললো , “তিতলি প্লিজ, আমি খাটে শুই | তোমার কোনো চিন্তা নেই , আমি এক কোণে ঘুমোবো | মাঝখানে দু দুটো পায়ের বালিশ থাকবে | আসলে এই তিনদিন সোফায় শুয়ে শুয়ে কোমড়ে ভীষণ ব্যথা ! আর নেয়া যাচ্ছে না |”….

ভেবেছিল তিতলি কথাটা শুনে আবার না সেইদিনের মতন কেঁদে ফেলে ! কিন্তু এবার ব্যাপারটা উল্টো হলো , তিতলি সমবেদনার দৃষ্টি দিয়ে অর্নকের দিকে তাকালো , …. “ইশ , আই অ্যাম রিয়ালি সরি | তুমি আগে বলনি কেন তোমার কোমড়ে ব্যথা ! আর আমিও কি ! ওই টুকু একটা সোফায় কেউ ঠিকভাবে শুতে পারে ! সরি , আমার জন্য তোমাকে এই ভাবে কষ্ট করতে হলো | তুমি প্লিজ খাটে ঘুমাও | আমার কোনো প্রবলেম নেই |”……….

কথাটা শুনে অর্নকের মুখে হাসি | যাক, বাঁচা গেল | আসলে তিতলি এই তিন দিনে এই অচেনা ছেলেটাকে একটু হলেও চিনেছে ! একে ভালবাসা যায় কি না ,এখনো অব্দি ওর জানা নেই ! তবে ভয় পাওয়ার মতন এই ছেলের মধ্যে একটা লক্ষণও নেই |

এই সবের পর দু সপ্তাহ কেটে গেছে | আজ ওরা কলকাতার ফ্ল্যাট এ এসেছে | অর্নক কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গ্রুপ এ অফিসার | তাই জলপাইগুড়িতে আসল বাড়ি হলেও , পেটের দ্বায়ে কলকাতা নিবাসী | তিতলিও এর আগে অনেকবারই কলকাতা এসেছে | আত্মীয় , স্বজনদের বাড়িতে | কিন্তু আজকের আসাটা একটু অন্য | আজ ও এসেছে সংসার করবে বলে | সেইদিন ফ্ল্যাটের দরজা খুললো যখন , ঘড়িতে বাজে দুপুর একটা | অর্নক পাশের হোটেল থেকেই খাবারটা নিয়ে এলো | তিতলি স্নান সেরে খাবার খেয়ে দারুণ একটা ঘুম দিয়েছে | সন্ধ্যের পর বারান্দায় এসে রাতের কলকাতার দিকে তাকিয়েছিল ও , হঠাৎ অর্নকের কথায় হুঁশ ফিরলো , ” বল , তাহলে রাতে কি খাবে ? আমি বলি সিম্পেল এর মধ্যে রাখো | চিকেন কারী আর ভাত , শেষ পাতে বাড়ি থেকে আনা লাড্ডু তো আছেই, মিষ্টি মুখের জন্য |” .. বেশ হেসেই বললো কথাগুলো ও |
তিতলিও ঘাড় দুলিয়ে সম্মতি দিল, ” হ্যাঁ, তাই ভালো | চিকেন কারী আর ভাত |”……. কথাটা বলেই আবার আনমনে রাতের কলকাতার দিকে মন দিল | গুণগুণ করে গানও শুরু করলো, “ঘরে তে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে |”…….
কিছুক্ষণ বাদে দরজায় বেল বাজলো | দরজা খুলতেই অর্নক হাজির | হাতে এক থলি বাজার , আর একটা প্ল্যাস্টিক এর ভেতর কাঁচা মুরগীর মাংস | তিতলি চোখ বড় বড় করে বললো, “এগুলো কি ? এগুলো দিয়ে কি হবে ?”……

অর্নক এক গাল হেসেই উত্তর দিল, “আরে বাড়িতে তো আলু ,পিয়াঁজ কিছুই ছিল না ! চিকেনটা রান্না হবে কি দিয়ে ! আমি সঙ্গে আদা রসুন টমেটোও নিয়ে এসেছি | যাই হোক, নাও এগুলো ধরো | বেশ জমিয়ে রান্না করো তো |” ……….

এগুলো শুনে তিতলি শুকনো মুখে উত্তর দিল, ” কিন্তু , মানে , আমি তো রান্না পারি না | আমি ভেবেছিলাম তুমি সামনের হোটেল থেকে সকালের মতন চিকেন কারী নিয়ে আসবে |” ….
অর্নকের যেন ধাক্কা লাগলো কথাটা শুনে। ও চোখ বড় বড় করে বললো, ” কি ! রান্না পারো না মানে ! সেইদিন যখন দেখতে গেলাম, কত কি করেছিলে তো | পটল আলুর দম, চিংড়ির মালাইকারী | এত তাড়াতাড়ি সব ভুলে গেলে না কি ?”…..

তিতলি নির্বিকার গলায় সত্যবাদী যুধিষ্টির মতন উত্তর দিল , “সেইদিন তো সব রান্না মিনতিমাসী, মানে আমাদের বাড়ির কাজের মাসী করেছিল | আমি তো সারাদিন বসে বসে শুধু সেজেছিলাম , ছেলে দেখতে আসছে বলে কথা |”…
অর্নকের তো কথাটা শুনে চোখ কপালে !, ” মানে ? সেইদিন যে তোমার মা বাবা বলল সব রান্না পাত্রী করেছে | আমি তো সেই চিংড়ির মালাইকারী খেয়েই হ্যাঁ বললাম |”……

তিতলি মিনমিন করে উত্তর দিল , “সেই জন্যই তো বলেছিল, মিথ্যে কথা | পাত্রী রান্না করতে জানে না শুনলে তো সুপাত্র পটবে না | তাই |” … না, আর কোনো কথা আসছে না ! অর্নক চুপচাপ গিয়ে সোফায় বসলো | মুখটা এখন থমথমে | এই সব আগে জানলে মিনতিমাসীকেই বিয়ে করত ! কিন্তু এখন তো আর সেটাও সম্ভব না | তাই এই ভুমিকম্পের আফটার শক কাটিয়ে অর্নক রান্না ঘরে গিয়ে গ্যাস জ্বালালো | কলেজ লাইফ থেকে একা থাকার অভ্যাস | তাই রান্নাটাও পারে , চালিয়ে নেয়ার মতন | শুধু এটা ভাবেনি যে বিয়ের পরেও ‘চালিয়ে নেয়ার মতন’ নিজের হাতের রান্না খেয়েই দিন কাটাতে হবে ! তবে তিতলি সেদিন বলেছে, অর্নকের হাতের চিকেন কারীর না কি দারুণ টেস্ট | দিন কাটছে নিজের তালে | অর্নক আর তিতলি কলকাতায় এসেছে দশ দিন হয়ে গেছে |

চলবে।