#ওগো_বধূ_সুন্দরী ( শেষ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
সেইদিন ছিল রবিবার | অর্নক হেলে দুলে ঘুম থেকে উঠে এগারোটার পর রান্না চাপিয়েছে | আজকের মেনু রুই মাছের কালিয়া আর ভাত | তবে ব্যাস, ওই রান্না টুকুই ওর দ্বায়িত্ব | কাপড় জামা কাচা তিতলিই করবে | আর বাসন মাজাটা মিউচুয়াল কনট্র্যাক্ট , সেটা দুজনে হাত লাগিয়ে দুটো থালা মেজে নেয় | ঠিকই আছে ! বিয়ে মানে তো 50 /50 | সব সময় একটা মেয়েকেই রান্না করতে হবে কেন ! আফটার অল দেশ স্বাধীন , নারীরা স্বাধীন ! এই সব মহান চিন্তা করতে করতেই অর্নক রান্না শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো | আর হঠাৎ বারান্দায় শুকনো দেয়া ওর শার্ট ,আর পাঞ্জাবিটার দিকে চোখ চলে গেল | তিতলি তো সকাল বেলা ওর সাদা শার্ট, পাঞ্জাবি কাচতে নিয়ে গিয়েছিল ! এই সাদা শার্ট , ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবি এই রকম ডিপ নীল রঙের কি করে হলো ? কথাটা ভেবেই অর্নক জোরে জোরে তিতলিকে ডাকলো | তিতলি সাবানের ফ্যানা কপালে হাতে মেখে হাজির | দেখে মনে হচ্ছে যেন বাথরুমে কাপড় জামা কাচছিল না , যুদ্ধ করছিল কারোর সাথে | অর্নক বেশ গম্ভীর ভাবে বলল ,
” তিতলি ? এটা কি হলো? এই শার্ট , পাঞ্জাবি এই রকম কি করে হয়ে গেল ?” ..
তিতলি এর উত্তরে বেশ গর্বিতভাবে বললো,
” কেন ! বুঝতে পারছো না ? উজালা দিয়ে ধুয়েছি তো | মিনতিমাসিকে তো দেখতাম, কাপড় জামা ডিটারজেন্ট এ দেয়ার পর উজালার জলে ডোবাতো | কিন্তু মিনতিমাসী খুব কিপ্টে জানো, কয়েক ফোঁটা উজালা দিত ! তাতে কি হয় বল ! আমি তো আজ হাফ সিসি ঢেলে দিয়েছি | কি ভালো পরিস্কার হয়েছে না ! দেখো |”…
কথাটা শুনে অর্নকের যেন কান্নাই পেয়ে গেল | আস্তে গলায় বললো , ” সেই , এত ভালো পরিস্কার হয়েছে যে জামার রংটাই বদলে গেল ! তিতলি, প্লিজ , বিয়ের পর এটা আমার সেকেন্ড রিকুয়েস্ট , আমার জামা কাপড় দারুণ ভাবে পরিস্কার করার দরকার নেই | একটু ডিটারজেন্ট এর জলে ধুয়ে দিও , তাহলেই হবে | আর সেটাও যদি না পারো, তাহলেই ইট’স ওকে , একটু জল ধোয়া করে দিলেও হবে |”.
…তিতলি কথাটার মাথা মুন্ডু কিছুই বুঝলো না, মুখ বেঁকিয়ে বললো, “তোমার না, কিছুই পছন্দ হয় না | যত সব |”…
সময়ের কাঁটা এইভাবেই আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে | আজ অর্নক আর তিতলির বিয়ের এক মাস পূর্ণ হয়েছে | তিতলি আজ সন্ধ্যেবেলা বেশ সেজেছে | অর্নক অফিস থেকে ফিরে অবাক , তিতলি না কি আজ নিজের হাতে রান্না করেছে ! ডাইনিং টেবিলে বেশ হাসি মুখেই বসলো ও , কে জানে আজ কি আছে মেনুতে ! তিতলি প্রথম রান্না করেছে বলে কথা | একটু ভয়ও লাগছিল, নুন ,ঝাল , মিষ্টি যেন ঠিকঠাক প্রপর্সনে হয় ! নইলে যে খাবে তার রিস্ক | এই সব ভাবতে ভাবতেই তিতলি হাজির, হাতে একটা বাটি | কি রান্না আছে ওই বাটিতে ? অর্নক বেশ আগ্রহ সহকারে বাটির ঢাকনাটা সরালো | আর যেটা পেল সেটা দেখে ও বাকরুদ্ধ | বাটিতে আলু সিদ্ধ মাখা |
তিতলি এক গাল হেসে বলল, “আজকের মেনু, আলু সিদ্ধ আর ভাত | আজ আমি প্রথম নিজের হাতে আলুর খোসা ছাড়িয়েছি, সেটাকে সিদ্ধ করেছি, তারপর তেল, পেয়াজ কাঁচালংকা দিয়ে জমিয়ে মেখেছি | আর সরি , ভাতটা একটু গলে গেছে ! আসলে প্রেসারে চারটে সিটি বেশি পড়ে গেছে তো | যাই হোক, আজ তো সবে শুরু, এরপর আস্তে আস্তে দারুণ রান্না শিখে যাবো আমি , সিওর |”…
সত্যি এবার তিতলিকে রান্নাটা শেখাতেই হবে | আলু সিদ্ধ আর গলা ভাত খেতে খেতে অর্নক এটাই ভাবছিল | তবে মনে মনে , মুখে কিন্তু আলু সিদ্ধর সুনামে পঞ্চমুখ |
তারপর থেকে শনি রবিবার গুলো দুজনের রান্না ঘরেই কাটতো | তিতলিকে ধীরে ধীরে আলু ভাজা, ডাল , তরকারী সবই রান্না করতে শিখিয়ে দিয়েছে অর্নক|
এখন ৬ মাস কেটে গেছে ওদের বিয়ের | এর মাঝে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে ইডেন গার্ডেন , এমনকি দীঘাও দু দিনের জন্য ঘুরে এসেছে ওরা | ফিলিপ্স এর ক্যামেরার দু দুটো রিল শেষ, দীঘাতে ফটো তুলে | উফ,তিতলির কি সাজের বাহার সেখানে, টপ নাট , লিপস্টিক , ববি প্রিন্ট এর শাড়ি | সত্যি কথা বলতে কি , অর্নকের এই রকম সুন্দরী বউকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগে দারুণ | বেশ একটা গর্ব হয় নিজের ওপর | ক্যামেরাতে হাতটা বার বার আপনাআপনিই চলে যায় ওর | কেমন যেন মনে হয় আজকাল , মুহূর্ত গুলোকে ধরে রাখতে , একদম নিজের করে রাখতে |
এর মধ্যে দুর্গা পুজোর সপ্তমীর দিন তিতলি হঠাৎ সকালে উঠে অর্নকের হাতে একটা কচি কলা পাতা রঙের শার্ট ধরিয়ে দিল | নিউ মার্কেট ঘুরে ঘুরে না কি কিনেছে ও এই শার্টটা ,অর্নকের জন্য | আজ ওদের অর্নকের মেজ মাসির বাড়ি নেমন্তন্ন , তিতলির আবদার এই শার্টটা পরেই অর্নককে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যেতে হবে | অর্নকও কথাটা শুনে হাসি মুখে সম্মতি জানালো | কিন্তু মাসির বাড়ি গিয়ে আরেক কেস, মাসি তো অবাক ! দরজা খুলেই প্রথম কথা, —- “কিরে অর্নক ? এই কচিকলা পাতা রঙের জামা পরেছিস যে ? মনে আছে দু বছর আগে পুজোতে তোকে এই কালার এর একটা শার্ট এর পিস গিফ্ট করেছিলাম, আর তুই কেমন ফেরৎ দিয়েছিলিস | তোর না কি এই রং একদম চলে না | আজ নিশ্চয়ই বউ গিফ্ট করেছে | তাই চুপচাপ পরে ঘুরতে বেরিয়েছিস , কিরে তাই না ?”…
কথাটা শুনে অর্নক চুপ আর তিতলির মুখটা ফ্যাকাসে | সেই রাতে তিতলি ওকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো , “তোমার যখন এই রংটা পছন্দ ছিল না, তখন আমাকে বললে না কেন ? আমি চেঞ্জ করে আনতাম |”…
অর্নক সেইদিন তিতলির চোখে চোখ রেখে বেশ দৃঢ় গলায় উত্তর দিয়েছিল, — “আসলে সবাইকে না বলতে পারি , কিন্তু তোমাকে না বলাটা ঠিক আসে না | আর আজ থেকে কচিকলা পাতা রংটা আমার খুব পছন্দের |”….
কথাটা শুনে তিতলি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিয়েছিল | আর কোনো কথা খুঁজে পায়নি উত্তর দেয়ার মতন | এখন জানুয়ারি মাস | ১৯৯০ সাল এসে দরজায় করা নেড়েছে | তিতলি কিছুদিনের জন্য জলপাইগুড়ি এসেছে বাপের বাড়িতে | যদিও মনটা কলকাতাতেই পড়ে আছে | এই দু দিনে একটা চিঠিও লিখে ফেলেছে , আজ যাবে পোস্ট অফিস, পোস্ট করতে | এইসবই ভাবছিল তখনই কলিং বেলটা বেজে উঠলো | এখন সকাল ৮ টা বাজে, এত সাত সকালে কে এলো আবার ! এই সব ভাবতে ভাবতেই মায়ের গলার আওয়াজটা কানে এলো | — ” আরে জামাই এসেছে রে , তিতলির বাবা, কি গো , তুমি কোথায় আছো ? দেখো কে এসেছে !”..
. তিতলি কথাটা শুনে লাফাতে লাফাতে ড্রইং রুমে গিয়ে পা টা থমকে গেল | সামনে কলকাতায় ফেলে আসা চেনা মুখটা হাজির | অর্নকও স্থির দৃষ্টিতে তিতলির দিকে তাকিয়ে , মুখে একটা লাজুক হাসি |
এই দৃশ্য দেখে শাশুড়ি মা বলেই ফেললো , — “বুঝতেই পারছি , জামাই তো বউকে ছাড়া দু দিন ও থাকতে পারে না | কি টান |” …
তিতলি সেদিন ছাদে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো , ” ইশ , মা বাবা কি ভাবলো বলো তো ? আমি তো আজই চিঠি পোস্ট করতাম | আর তুমি যে এই ভাবে হঠাৎ চলে এলে , অফিসে ছুটি পেতে অসুবিধা হলো না ?”….
অর্নক বেপরোয়া ভাবে তিতলির হাতটা শক্ত করে ধরে উত্তর দিল, ” ধুর, যা ভাবে ভাবুক | আমার কি ! আমি তো আর অন্য কারোর বউ এর সাথে দেখা করতে আসিনি | আর ওই ফ্ল্যাটে একা থাকার অভ্যাস আমার শেষ হয়ে গেছে | ভীষণ খালি খালি লাগে | তাই অফিসে এপ্লিকেশন দিয়ে চলে এলাম |” ……
এই দিনের কটা মাস পরে আজ বছর পার হওয়ার দিন | ২৯ শে এপ্রিল | তিতলি আর অর্নকের বিবাহ বার্ষিকী | দুজনেই সকাল সকাল রেডি হয়ে নিয়েছে, বেশ সেজে গুজে | অর্নক তো বিয়ের সেই তসরের পাঞ্জাবিটা পরেছে | তিতলি সেজেছে লাল রঙের তাঁতের শাড়ীতে | দক্ষিনেশ্বর এর মন্দিরে পুজো দিতে যাবে | তারপর সিনেমা দেখে , হোটেল এ খেয়ে বাড়ি ফেরা , সারা দিনের প্ল্যান | সবই ঠিক চলছিল সকাল থেকে , কিন্তু হঠাৎ মাঝ রাস্তায় স্কুটারটা বিগড়ে গেল | আগের বছরই এই সেকেন্ড হ্যান্ড বাজাজ স্কুটারটা কিনেছিল অর্নক | এই বিবাহ বার্ষিকীর দিন যে এই ভাবে ভোগাবে এটা কে জানতো ! কিছু দূর গিয়ে গ্যারেজ | তসরের পাঞ্জাবি ঘামে একেবারে ভিজে গেছে স্কুটার ঠেলতে ঠেলতে | আর সঙ্গে আবার সুন্দরী বউ | রাস্তার সব লোকেরা ওদের দিকে তাকিয়ে | এত লজ্জা লাগছিল অর্নকের | তার ওপরে রাস্তার কিছু দুষ্টু বাচ্চা অব্দি ওদের আওয়াজ দিল , ” দাদার গাড়ি বিগড়ে গেছে, দাদার গাড়ি বিগড়ে গেছে |” … উফ, সকালবেলা কার মুখ দেখে যে উঠেছিল ! যাইহোক গাড়ি ঠিক হওয়ার পর দক্ষিনেশ্বরে পুজো দিয়ে গঙ্গার ধরে বসেছে ওরা |
অর্নকের মুখ ভার | সকালের ঘটনাটা ভুলতেই পারছে না ! তিতলি আর চুপ করে না থেকে বলেই ফেললো, — ” কি হয়েছে তোমার ? এত দুঃখ কিসের ?”..
. অর্নক মুখ ভার করেই উত্তর দিল , — ” ধুর , আজ যা হলো সকালে ! আমার ওই স্কুটার এর জন্য তোমারও লজ্জা | সরি তিতলি, আর তিন মাস সময় দাও, এইবার পুজোতে একটা নতুন স্কুটার কিনবোই |”….
তিতলি কথাটা শুনে হেসে ফেললো ,–
” কে বললো তোমাকে আমার লজ্জা লেগেছে ! আর আমি তো নিজের জীবনে টাটা বিরলা আম্বানিকে চাইনি | আমি তো প্রথম থেকেই এই রকম স্কুটার ওলা চশমা পরা একটা মিষ্টি বর চেয়েছিলাম | সেটা পেয়ে গিয়েছি , ব্যাস, যথেষ্ট | আর আমার নতুন স্কুটার চাই না |”…
কথাটা বলেই অর্নকের কাঁধে নিজের মাথাটাকে এলিয়ে দিল | এক বছর আগের দুটো অজানা অচেনা মন , আজ ৩৬৫ দিনের ব্যবধানে , খুব চেনা , খুব কাছের | প্রেম ওদের জীবনে এসেছে, সাত পাকে বাঁধা হয়ে যাওয়ার পর , অন্য স্বাদে , অন্য রূপে | ওরা কিন্তু নিজেদের পঁচিশ বছরের বিবাহ বার্ষিকীতেও দক্ষিনেশ্বর এর মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়েছে | তবে সেবার শুধু দুজন না, তিন জন মিলে | অর্নক আর তিতলির একমাত্র মেয়ে তমালিকার সঙ্গে | তবে বয়স বাড়লেও, প্রেমটা কিন্তু এখনো ওদের জীবনে একেবারে নতুন | ঠিক ২৫ বছর আগের মতো |
======================================
সমাপ্ত।