ওগো বিদেশিনী পর্ব-০৫

0
129

#ওগো_বিদেশিনী
#পর্ব_৫
#সারিকা_হোসাইন

পাঞ্চ স্যান্ড ব্যাগ এ একের পর এক পাঞ্চ করেই যাচ্ছে ক্যাপ্টেন মাহাদ চৌধুরী।

কোনো ভাবেই সে নিজেকে সামলাতে পারছে না।পাঞ্চের কারনে তার হাতের বাইসেপ মাসেল গুলো বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছে।শরীর ঘেমে জপজপে অবস্থা।চোখ দুটো রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।

কেনো তার একান্ত ব্যাক্তিগত মানুষটি আজকে এমন রোগে ভুগছে? কেনো সে তার মনের কথা কাউকে প্রকাশ করতে পারেনা?

ক্যামেলিয়া যখন মাহাদের শার্ট এর কলার খামচে ধরেছিলো মাহাদ তার চোখে অনেক কথা বলার আকুতি দেখতে পেরেছিলো।কিন্তু ক্যামেলিয়া অস্ফুট স্বরে সরি শব্দটি ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেনি।

সবসময় ক্যামেলিয়া মত প্রকাশের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগে।নিজের প্রতি তার নিজের কোনো কনফিডেন্স নেই।

মাহাদ অনেক দেশ বিদেশের সাইকোলজিস্ট এর সাথে এই রোগের ব্যাপারে কথা বলেছে।
সবার এক কথা বেশি কেয়ার,বেশি টাইম স্পেন্ডিং আর মন ভালো রাখাই তার এক মাত্র মেডিসিন।

কিন্তু মেয়েটি সেভাবে কারো সাথে মিশতেই পারছে না।

কিভাবে সামাল দিবে মাহাদ এতকিছু?

এখন থেকেই প্রপার ট্রিটমেন্ট না নিলে একদিন ক্যামেলিয়া সুইসাইড এর পথ বেছে নেবে।তার কাছে তার জীবন তিক্ত হয়ে উঠবে।

ক্যামেলিয়া নেই,এই খবর মাহাদের কানে আসবে এটা মাহাদ কোনো ভাবেই সহ্য করতে পারবে না।

জোর করেও কিছু করা যাচ্ছে না।
মাহাদ আনমনে একের পর এক পাঞ্চ করেই যাচ্ছে।
এক পর্যায়ে স্যান্ড ব্যাগটি ছিড়ে ঝুরঝুরে করে বালি গুলো ফ্লোরে পড়তে লাগলো।

হুঁশে ফিরলো মাহাদ।

তার হাত ফেটে রক্ত ঝরছে,অথচ সেদিকে তার কোনো খেয়ালই নেই!!

নিজেকে স্বাভাবিক করে টাওয়েল দিয়ে ঘাম মুছে ওয়াশরুমে চলে গেলো মাহাদ।

লম্বা এক শাওয়ার নিয়ে বাদামি রঙের টু কোয়ার্টার একটি হাফপ্যান্ট পরে চুল মুছতে মুছতে বের হলো।

তখন বুঝা না গেলেও এখন হাতে বেশ ব্যাথা হচ্ছে।

মাহাদ তার ছোট বোন কে উঁচু আওয়াজে ডেকে উঠলো

“সুজানা,,,,,,

সুজানা তার পড়ার টেবিলে এসাইনমেন্ট করছিলো।
তার রুম আর মাহাদের রুম একই পাশে হওয়ায় মাহাদের ডাক শুনে দৌড়ে আসে।

এসে ভাইয়ের হাতের এমন দশা দেখে ঘাবড়ে যায়।

কিছু প্রশ্ন করতে নেবে তার আগেই মাহাদ গমগমে কন্ঠে বলে উঠে

“নো কুয়েশ্চেন প্লিজ”

“আমার হাত দুটো ব্যান্ডেজ করে দে।”..

সুজানা বুঝতে পারলো তার ভাইয়ের কিছু হয়েছে যা সে প্রকাশ করতে চাইছে না।

বাধ্য মেয়ের মতো ফার্স্ট এইডের বক্স নিয়ে কটন বাড এর সহায়তায় ধীরে ধীরে ওয়েন্টমেন্ট লাগাতে নিলে মাহাদ ধমকে উঠলো

“গায়ে জোর নেই নাকি তোর?

“এমন ভাবে করছিস সুড়সুড়ি লেগে যাচ্ছে,”

“জোরে দে, এসব ব্যাথা এই মাহাদ চৌধুরী গায়ে মাখে না”

সুজানা মাহাদের ধমকে চমকে উঠে দ্রুত মলম লাগিয়ে দুই হাত ই ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বেরিয়ে যেতে নিয়ে দরজার কাছে এসে পিছন ঘুরলো।

“ভাইয়া ঘটনা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পেরেছি,”

“তাই বলছি নিজেকে কষ্ট না দিয়ে সমস্যা সমাধানের পথ বের করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে”

সুজানা আর এক সেকেন্ড ও দেরি না করে গটগট পায়ে তার রুমে চলে গেলো।

ঘটনা কি সেটা তার নিজ চক্ষে দেখা চাই।

ঘড়িতে রাত আটটা বাজে মাত্র।
এখান থেকে খালামনির বাসা বিশ মিনিটের রাস্তা।

মিসেস মিতালি কে বলে সুজানা রেডি হয়ে টুটুল কে ফোন করলো।

টুটুল গাড়ি নিয়ে আসতেই সুজানা বলে উঠলো

“ছোট খালামনির বাসায় চলো টুটুল ভাই”

――――

পা টা ফুলে টনটনে ব্যাথা হয়ে আছে আর লাল টকটকে বর্ন ধারণ করেছে।

মাটিতে পা ই রাখতে পারছে না ক্যামেলিয়া।
বিছানা থেকে পা নামিয়ে শূন্যে ঝুলালেই শিরশিরে ব্যাথা করে উঠছে।।

রাতের খাবার একটু আগে টুসি আর মিসেস নাজনীন এসে খাইয়ে দিয়ে গেছে।

টুসি আজ রাতে এই রুমে থাকার জন্য জেদ শুরু করেছিলো কিন্তু ক্যামেলিয়া রাজি হয়নি।
একা থাকতে থাকতে কখন যে একাকীত্ব কেই বেশি আপন করে নিয়েছে এটা ক্যামেলিয়া টের ই পায়নি।
মানুষের সাহচর্য মোটেও ভালো লাগেনা এখন তার।

আবার মাঝে মাঝে মনে হয় অনেক আনন্দ আড্ডায় মেতে থাকতে।

ওই মানুষটার সাথে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো।
কিন্তু ভেতর থেকে কোনো কথাই আসছিলো না।

মানুষটা চলে যাবার পর অযথাই কান্না এসেছে।কোনো ভাবেই নিজেকে কন্ট্রোল করে সেই কান্না থামানো যায়নি।

ডিপ্রেশনের মেডিসিন গুলোও শেষ।
রাতে ঘুম হয়না বললেই চলে।

রিজভী কে নিয়ে একটা ভালো সাইকাইটিস্ট এর কাছে যেতে হবে।

“আমি মরতে চাইনা,আমি বাঁচতে চাই”

আমি টুসীর মতো দুরন্ত,হ্যাপি হতে চাই।

কিন্তু কবে মিলবে এই ব্যাধি থেকে মুক্তি?

হঠাৎই রাগ উঠে গেলো ক্যামেলিয়ার,রাগে দিকবিদিক শূন্য হয়ে কি করবে ভেবে পেলো না।নিজের চুল নিজেই খামচে ধরলো।
পায়ের ব্যাথা ভুলে রুমে ধপধপ করে পায়চারি শুরু করলো।

মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে

“তোর জীবন মূল্যহীন, তোর কোনো দাম নেই,তুই নিঃসঙ্গ,কেউ তোকে ভালোবাসে না।

“তুই মর,তুই মর,তুই মর।”

ক্যামেলিয়া রুমের সমস্ত কিছু উল্টাপাল্টা করে ফেলছে।

কানে বারবার তার একই কথাই বাজছে
“তুই মর”

হাঁটার চাপে পা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।সেদিকে তাঁর হুশ ই নেই।

টেবিলে থাকা সকল জিনিস দুই হাতের ঝটকায় ফেলে দিলো ক্যামেলিয়া।

হঠাৎ ই নিস্তব্ধ কক্ষ ঝনঝন আওয়াজে আলোড়িত হলো।

কানের কাছে থেকে কিছুতেই কথাগুলো সরছে না।

শরীরে আর মননে যুদ্ধ চলছে।

পিটুইটারি গ্রন্থিতে বার বার ছলকে উঠছে রক্ত।

ক্যামেলিয়ার কক্ষের ঝনঝন শব্দে সকলে দৌড়ে এসে দরজার কাছে ডেকে চলেছে আর দরজাতে ধাক্কাচ্ছে।দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

সকলেই দিকবিদিক শূন্য হয়ে দরজায় ধুপধুপ শব্দে আঘাত করে যাচ্ছে।

হঠাৎই কলিং বেল বেজে উঠলো।

বার বার কলিং বেল বেজে চলেছে কেউ দরজা খুললো না।

দরজার ওপাশের মানুষের কপালে চিন্তার সূক্ষ ভাঁজ পড়লো।

“রাত এতোটাও গভীর নয় যে সবাই বেভোর ঘুমে তলিয়েছে।”

ক্যামেলিয়া হাতের কাছে একটা এনটিকাটার খুঁজে পেলো।সেটা দেখে তার চোখ চকচক করে উঠলো।

এটা মাথার ঘিলুতে ঢুকিয়ে দিলেই সব কিছু শান্ত হবে,কানের কাছে আর কেউ বিকট স্বরে কথা বলতে পারবে না।

এনটিকাটার এর ব্লেড বের করতেই বেলকনির দরজা দিয়ে ঝড়ের গতিতে প্রবেশ করলো মাহাদ।

জাপ্টে ধরলো ক্যামেলিয়া কে।

এমন ভাবে জাপ্টে ধরেছে যেনো ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে।
কিছুতেই আর ছাড়বেনা মাহাদ তার বউকে।

“বউ যদি সত্যিই হারিয়ে যায় তাহলে তাকে কোথায় খুঁজবে মাহাদ?”

নিমিষেই নিস্তব্ধতা নেমে এলো কক্ষ জুড়ে।

দুজন মানুষের জোরে জোরে নিঃশাস নেয়া ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না।

বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মাহাদ।

ক্যামেলিয়ার হাতে থাকা এনটিকাটার এর অসাবধানতাবশত পোঁচ লেগে কেটে গেলো মাহাদের বুক।

সেসবে মাহাদের কোনো তোয়াক্কা নেই।

বিড়াল ছানার মতো মাহাদের বুকে ঘাপটি মেরে রইলো ক্যামেলিয়া।

এরপর ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

দরজার ওপাশ থেকে সবাই চিল্লিয়েই যাচ্ছে।

ক্যামেলিয়া কে বিছানায় শুইয়ে মাহাদ দরজা খুলে দিলো।

রক্তাক্ত মাহাদ কে দেখে সকলেই চমকে উঠলো।
মিসেস নাজনীন মাহাদ কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।

মাহাদ টুসীকে বললো
“মেইন গেট খুলে দে টুসি,সুজানা বাইরে একা দাঁড়িয়ে আছে।

******
ঝড়ের পর পরিবেশ যেমন নিস্তব্ধ থাকে ঠিক তেমনি ড্রয়িং রুম পিনপতন নীরবতায় ছেয়ে আছে।
সুজানা চোরা চোখে বার দুয়েক রিজভী কে দেখে নিলো।

সকলকে উদ্দেশ্য করে মাহাদ বলে উঠলো

“ওর সমস্যার কথা তোমরা তো সকলেই জানতে তাহলে একা ছাড়লে কেনো?

“তোকে তো বলেছিলাম টুসি রাতে ওর রুমে গিয়ে থাকতে।

ফার্স্ট এইড বক্স সেন্টার টেবিলের উপর রাখতে রাখতে টুসি বলে উঠলো
“গিয়েছিলাম ভাইয়া,জেদ ও করেছিলাম,কিন্তু ও রাজি হয়নি”

“জেদ করেই তো ভুলটা করেছিস,ওকে ওর মতো করে হ্যান্ডেল করতে হবে,হাসি তামাশা দুস্টুমির ছলে ওর মাইন্ড চেঞ্জ করতে হবে।

গলা খাকরি দিয়ে নাবিল হাসান বলে উঠলো
“তোমরা কি করে জানলে ও ঘরে এরকম করবে?

মাহাদ তুলা আর এন্টিসেপটিক এর সাহায্যে বুকের রক্ত মুছতে মুছতে বলে উঠলো
“সুজানা হঠাৎই জেদ ধরেছে এ বাসায় আসবে।”

“একা রাতের বেলা কিভাবে ছাড়ি?”

“আম্মুর শরীরটাও ভালো নেই,হঠাৎ প্রেসার ফল করেছে।”

“তাই আমি ওকে এগিয়ে দিতে এসেছি।
গায়ের পোশাক দেখেই বুঝতে পারছেন।”.

সকলেই মাহাদের পোশাকের দিকে নজর দিলো
একটা হাফপ্যান্ট আর টিশার্ট পরেই চলে এসেছে সে।

“এখানে এসে কলিং বেল চেপেই যাচ্ছি কেউ দরজা খুলছে না।আর বাইরে থেকে রিজভীর উঁচু আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো।”

“ঘটনা বুঝতে বিল্ডিং এর পেছনে সাইড যেতেই সকলের চিৎকার চেঁচামেচি পাওয়া যাচ্ছিলো।”

“সুজানা কে বাইরে দাঁড় করিয়ে পাইপ বেয়ে দুতলায় উঠতেই দেখি ক্যামেলিয়ার রুমের বেলকনির দরজা খোলা।”

“আর ও পাগলের মতো আচরণ করছে।”

“আরেকটু দেরি হলেই কিছু একটা করে ফেলতো বলে ফুঁস করে দম ফেললো মাহাদ।”

রিজভী এগিয়ে এসে বললো
“ভাই দাও আমি ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিচ্ছি
বলেই রিজভী মাহাদের কাছে গিয়ে বসলো।”

মাহাদ আশফিক হাসানের উদ্দেশ্যে অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো

“সব কিছু মেনে নিলে কি এমন ক্ষতি হতো দাদু?
নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে নেয়া কি অন্যায়?

শুধু শুধু তিনটে মানুসের জীবন ই ভুগলো এবং ভুগছে।

বৃদ্ধ আসফিক নিজের অপরাধ বোধে মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

মাহাদ নাজনীন এর উদ্দেশ্যে বললো
“খালামণি সুজানাকে কয়েকদিনের জন্য রেখে যাচ্ছি,ওকে আমি বুঝিয়ে দিয়েছি কিভাবে কি করতে হবে।”

“আর রিজভী ,কাল আমি তোকে সাইক্রেটিস্ট এর ঠিকানা পাঠাবো,সময় করে ওকে নিয়ে জাবি।”.

“খালু আজ আমি চলে যাচ্ছি,আপনাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, প্লিজ একটু খেয়াল রাখবেন”

#চলবে