#ওগো_বিদেশিনী
#পর্ব_২০
#সারিকা_হোসাইন
________
পেরিয়ে গিয়েছে দুর্বিষহ তিনটি দিন।এই তিন দিনের মধ্যে ক্যামেলিয়ার ধারে কাছেও কেউ ঘেঁষতে পারেনি।কাউকে দেখলেই অত্যাধিক চিল্লা চিল্লি আর কান্নাকাটি করে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ করে তুলেছে ক্যামেলিয়া।
সুজানা নিজেকে পুরোপুরি দায়ী ভেবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে শুধু।
শাহানা আর কুহুও চোখের জল ফেলছে ক্যামেলিয়ার জন্য।
মিসেস মিতালির হাই প্রেসারে সজ্জা গ্রহণ করেছেন।
বাড়ির এহেন দুর্দশাগ্রস্ত পরিস্থিতি একা হাতে সামলে যাচ্ছে হৃদিতা।
মাহতাব চৌধুরী এখনো বিজনেস ট্রিপ থেকে ফিরেন নি।
নাবিল হাসানের বাড়ির প্রত্যেক টা সদস্য চিন্তিত মুখে মাহাদদের ড্রয়িং রুমে বসে আছেন ।
ক্যামেলিয়ার হঠাৎ এই হাইপারনেস এর কারণ কারোরই বোধগম্য হচ্ছে না।
এদিকে মাহাদ বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্যকে ফোন করে সমানে গালিগালাজ আর হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছে।
মিসেস মিতালি বিছানা ছেড়ে কোনো মতে শাহানার কাছে এসে হাউমাউ করে কান্না জুড়ে বলে উঠলেন
“মেয়েটার করুন অবস্থা দেখেছেন আপা?
আপনার দুটো পায়ে পরি সত্যি করে বলুন কি করেছেন আপনারা ওর সাথে?
শাহানা অবাকের স্বরে চোখে জল এনে বলে উঠলো
“এইডা তুমি কি কৈলা মিতালি?আমি আর কুহু ওই দিনের ঘটনার পর থাইকা বৈদেশীর সামনেই যাই নাই আর।বিশ্বাস না হইলে বৈদেশিরে জিগাও।
“এত্তো বড় অপবাদ দিয়া ফালাইলা মিতালি?
বলেই আঁচলে মুখ গুজে ডুকরে কেঁদে উঠলেন শাহানা।
কোহিনুর কে জিজ্ঞেস করলে সেও ক্যামেলিয়ার কান্না কাটির বা শাহানা কুহুর গলার আওয়াজ পায়নি বলে জানিয়েছে সবাইকে।
সুজানার ভাষ্যমতে ক্যামেলিয়ার এরকম সিচুয়েশন এ কুহু আর শাহানার রুমের দরজা বন্ধ ছিল।
তারা সুজানা আর রিজভীর চিৎকার চেঁচামেচিতে আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে এসেছেন।
সবাইকে কোনো রকমে শান্ত করে ক্যামেলিয়ার কক্ষে প্রবেশ করলো হৃদি।
ধীরে ধীরে বিভিন্ন কথার ছলে নরম সুরে ডেকে উঠলো হৃদি―
“ক্যামেলিয়া বেবি,আর ইউ হিয়ারিং মি?
“নড়েচড়ে উঠলো ভীত ক্যামেলিয়া।
হৃদিকে দেখেই চট করে হাতের কাছে পরে থাকা একটা পেপার কাটিং কেচি তুলে নিলো।
সেটা উঁচিয়ে হৃদির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
“ডোন্ট ট্রাই টু গেট টু মি,আদারওয়াইজ আই উইল কিল ইউ”
হৃদি থমকে দাঁড়ালো এরপর মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলো
“ক্যামেলিয়া তো এমন মেয়ে নয়,তাহলে ক্যামেলিয়া কি ব্যাড গার্ল হয়ে গেলো?
ক্যামেলিয়া ভীত সন্ত্রস্ত গলায় বলে উঠলো
“হুশ কথা বলো না,প্লিজ কথা বলো না।এরিয়ানা আমাকে খুঁজে বের করে মে/রে ফেলবে।
বলেই মুখ চেপে কেঁদে উঠলো।
ক্যামেলিয়ার এহেন করুন অবস্থায় হৃদির মনে প্রচুর কষ্ট হলো।
মন খারাপকে এক পাশে রেখে তবুও হৃদি ক্যামেলিয়ার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো
“শাহানা ফুপি আর কুহু তোমাকে ভয় দেখিয়েছে বা মেরেছে ক্যামেলিয়া?
হৃদির মুখের দিকে অশ্রু ভেজা নয়নে ফ্যাকাশে বদনে তাকালো ক্যামেলিয়া।
এরপর মাথা নেড়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো
“কেউ কিচ্ছু করেনি আমাকে,এরিয়ানা এসেছে।ও আমাকে মেরে ফেলবে বলেছে।প্লিজ তুমি এই রুম থেকে চলে যাও।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
প্লিজ তুমি চলে যাও,না হলে আমি নিজেকে নিজেই শেষ করে দেবো।
বলতে বলতেই হঠাৎই ডেসপারেট হয়ে উঠলো ক্যামেলিয়া।
হাতে থাকা কেচি দিয়ে হৃদির উপর আক্রমণ করে বসলো।
ক্যামেলিয়া কে কোনো রকম সামলে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো হৃদি।
তার হাতের তালু পুরোটাই কে/টে ফিনকি দিয়ে র/ক্ত ঝড়ছে।
মিসেস মিতালি মেয়ের এমন অবস্থা দেখে কেঁদে উঠলেন।
“হৃদি রে আমার ছেলে ম/রে যাবে।আমার ছেলের কথা আমি রাখতে পারিনি।আমার বাবাকে দেয়া ওয়াদা আমি ভঙ্গ করেছি।
মা হিসেবে আমি ব্যার্থ।
মিসেস মিতালীর কান্না জড়িত আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠলো পুরো বাড়ি।
মিসেস মিতালিকে কোনো রকমে ধরে বেড রুমে নিয়ে চলে গেলেন নাজনীন সুলতানা।
এদিকে মাহাদ বার বার ফোন করে মাথা খেয়ে ফেলেছে সকলের।
হৃদিতাকে রিজভী ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছে আর পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দেবে সেই বিষয়ে কথা বলছে।
হঠাৎই হৃদির ফোন ভো ভো শব্দ তুলে কাঁপতে শুরু করলো।
স্ক্রিনে মাহাদের নম্বর দেখেই ভয়ে গলা শুকিয়ে কন্ঠ নালি রোধ হয়ে এলো হৃদির।
প্রথমে মনের ভেতর কথা সাজিয়ে নিলো হৃদি।এরপর বহু কষ্টে ফোন কানে তুললো হৃদি।
হৃদিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কান্না জড়িত কন্ঠে মাহাদ বলে উঠলো
“ক্যামেলিয়ার কি হয়েছে সত্যি করে বল আপু।আমি বাড়িতে এসে সব জ্বা/লি/য়ে দেবো বলে দিলাম।কে কি করেছে ক্যামেলিয়ার সাথে আমাকে সব খুলে বল।
পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য ধীর কন্ঠে হৃদি বলে উঠলো―
“দেখ মাহাদ সেরকম কিছুই নয়।আমি নিজে ক্যামেলিয়ার সাথে মাত্র কথা বলেছি।ফুপু বা কুহু কেউ কিছু করেনি ও নিজেই বলেছে।
বার বার এরিয়ানা নামক কারো কথা সে বলে চলেছে।
“আমার মনে হয় কিছু নিয়ে বেশি চিন্তা ভাবনা করতে করতে ওর হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।”
উত্তেজিত হয়ে চিল্লিয়ে উঠলো মাহাদ;―
“তোরা আমাকে বাচ্চা পেয়েছিস আপু?যা বুঝাবি তাই বুঝবো আমি?
আসার সময়ও পুরো সুস্থ ছিলো ক্যামেলিয়া।
“মাহাদ চিন্তা করিস না,সাইকিয়াট্রিস্ট কে ফোন করেছে রিজভী সে আসবে।তুই মাথা ঠান্ডা কর।
হৃদি মাহাদকে আরো কিছু বুঝিয়ে ফোন কেটে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
হঠাৎই রিজভী অপরাধীর ন্যায় কন্ঠ খাদে ফেলে বলে উঠলো
“সব দোষ আমার হৃদিপু”
অবাক হয়ে হৃদি বলে উঠে
“তুই কি করেছিস?
“আমি দুই ঘণ্টার জন্য সুজানাকে বাইরে নিয়ে গিয়েছিলাম,সুজানা বাসায় থাকলে হয়তো এরকম হতো না”
বলেই মাথা নিচু করে ফেললো রিজভী।
“কোথায় নিয়ে গিয়েছিলি তুই সুজানা কে?
হঠাৎই ক্যামেলিয়ার কক্ষ থেকে ভাঙচুরের বিকট আওয়াজ এলো।
রিজভীকে কথা শেষ করতে না দিয়ে সবাই দৌড়ে দুতলায় উঠে ক্যামেলিয়ার রুমে ঢুকতে নিলো।
কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।
টুসি, রিজভী,হৃদি,সুজানা একের পর এক ক্যামেলিয়া কে ডেকে চলছে কিন্তু রুম থেকে ভাঙচুরের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না।
টুসি আর সুজানা ভয়ে কেঁদে উঠলো।
অন্ধকার কক্ষে ক্যামেলিয়ার এমন তান্ডবে ভয়ে খাঁচার ভেতর ডানা ঝাপ্টানি শুরু করলো ময়না পাখিটা।
*******
এদিকে মাহাদ তাকে ঢাকা এয়ারপোর্ট এর ফ্লাইট দেবার জন্য ঢাকা এয়ারলাইন্সের সাথে সমানে উন্মাদের ন্যায় যোগাযোগ করে চলেছে।
“স্যার প্লিজ লেট মি গো টু ঢাকা,মাই ওয়াইফ ইজ মেন্টালি সিক।
“নো ওয়ান ক্যান কন্ট্রোল হার”
“প্লিজ স্যার ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড মাই সিচুয়েশন”
ওপাশের ব্যাক্তি মাহাদের সমস্যা বুঝলো এবং মাহাদ কে বিচলিত না হয়ে শান্তনার বাণী ছুড়ে বলে উঠলো
“ডোন্ট ওয়ারি মাই বয়”
“আই উইল এরেঞ্জ এ ফ্লাইট ফর ইউ টু ঢাকা”
মাহাদ কান্না জড়িত কন্ঠে মোবাইলের অপর প্রান্তের ব্যাক্তি কে থ্যাঙ্কস জানিয়ে ঢাকা ফ্লাইটের সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
হোটেলের বন্ধ রুমে ছটফট করতে করতে ধবধবে সাদা ওয়ালে শক্ত এক ঘুষি মেরে দিলো মাহাদ।
এরপর দুই হাত দিয়ে দেয়ালে ভর দিয়ে শূন্য দৃষ্টি মেলে রাগে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠলো―
“যে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে তাকে ঠিক খুঁজে আমি বের করবো ক্যামেলিয়া।পাতাল থেকে হলেও তাকে আমি বের করে ছাড়বো।
ঘন্টা দুয়েক পর মাহাদের ইমেইল এ টুং করে মেসেজ টিউন বেজে উঠলো।
তড়িৎ গতিতে মাহাদ ফোন হাতে নিয়ে ম্যাসেজ ওপেন করলো।
“ডিয়ার স্যার ইউর ফ্লাইট ইজ টুমুরো মর্নিং এট ফাইভ ও’ক্লক”
“হ্যাপি জার্নি”
মেজাজ নিমিষেই বিগড়ে গেলো মাহাদের মেসেজ দেখে।এতো গুলো ঘন্টা কিভাবে কাটাবে সে?
যেখানে একেকটা সেকেন্ড বিষাক্ত লাগছে সেখানে এতো গুলো ঘন্টা?
________
নাওয়া খাওয়া ভুলে একই স্থানে হাঁটুতে মাথা নুইয়ে সতর্ক হয়ে বসে আছে ক্যামেলিয়া।
এরিয়ানা এলেই এই হাতিয়ার এর সাহায্যে ওকে খুন করবো আমি।
বলেই হাতের কেঁচির দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে হা হা করে হেসে উঠলো।
আজ চারদিন ধরে বাড়ির একটা মানুষও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছে না।
গত রাতেই মাহতাব চৌধুরী ফিরে এসেছেন।
এসেই শাহানা আর কুহুকে রাগের বসে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
কিন্তু মাহাদের এক জেদ।
“কেউ কিছুই বলবে না আপাতত শাহানা দের।যদি আসলেই তারা এবার ক্যামেলিয়া কে কিছু করে থাকে তবে সেই অপরাধের ভয়াবহ শাস্তি মাহাদ নিজেই তাদের দিবে।
গোপনে গোপনে রিজভী আর সুজানার উপর রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সুজানার গালে চড়িয়ে যাচ্ছেন মিতালি।
নিজেকে দোষী ভেবে সুজানাও নীরবে মার খেয়ে যাচ্ছে মুখ বুজে।
কেনো সে রিজভীর সাথে গেলো এই অপরাধ বোধ থেকে কোনো ভাবেই তার মুক্তি মিলছে না।
এদিকে রিজভিও লজ্জায় কারো সামনে মুখ দেখাতে পারছে না।
ক্যামেলিয়ার অসহায় ভয়ার্ত মুখশ্রী আর মাহাদের করুন অবস্থা মনে করতেই চোখের কোনে জল জমা হচ্ছে রিজভীর।
গভীর রাত হবার কারনে সবাই যার যার রুমে চলে গেলো।
কিন্তু রিজভী ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো ক্যামেলিয়ার দরজার কাছে।
*******
“মা কাজটা কি ঠিক হলো?মেয়েটা তো খুব ভয়াবহ অবস্থায় চলে গেছে!
“চুপ কইরা থাক,আমিও বুঝতে পারি নাই এক ডোজেই এমন হইবো।
মাহাদ আওনের আগে আগে বাড়ি ছাড়তে হইবো।
আর কেউ কিছু জিগাইলে এমন ভান ধর্বি যেনো বৈদেশীর কষ্টে আমরাও কষ্ট পাইতাসি।”
“যদি মাহাদ ভাই ধরে ফেলে তুমি এই কাজ করেছো তখন কি হবে ভেবে দেখেছো?
“আরে আমি চাইছি ভয় দেহাইয়া খেদায় দিমু এহন তো দেহি মাইয়া অন্য লেভেলে গেছে গা।
“খুব ভয় লাগছে মা,ক্যামেলিয়া না পরে আবার তোমার নাম বলে দেয়”
“ঘুম যা কুহু,এতো রাইতের বেলা এসব ফাও প্যাচাল ভালা লাগতাছে না।
কুহু আর কোনো প্রশ্ন না করে বিভিন্ন ধরনের ভাবনা ভাবতে লাগলো।
“তবে কি মাহাদকে তার আর পাওয়া হবে না?
“ভালোবাসা কি সারা জীবন এক তরফাই থেকে যাবে?
“আমার ভালোবাসা কেনো তুমি বুঝলে না মাহাদ ভাই?
_______
দুপুর দুটো বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
মাহতাব চৌধুরীর বিশাল বড় ড্রয়িং রুমে সকলের সামনে রক্ত বর্ন চক্ষু নিয়ে হাত মুষ্টি বদ্ধ করে এলোমেলো ইউনিফর্মে বিধস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে মাহাদ।
ইন করা শার্টের কিছু অংশ কোমরের বেল্ট গলিয়ে বেরিয়ে এসেছে।
মাহাদের ঘাড়ের শিরা গুলো ফুলে ফুলে উঠছে থেকে থেকে।
গলার টাই টাকে টেনে খুলে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে গটগট পায়ে সিঁড়ি ভেঙে দুতলায় নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো মাহাদ।
নিজের রুমের সামনে আসতেই বেদনার নীল কষ্টে বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যাথায় মুষড়ে উঠলো মাহাদের।
যেই কক্ষে দুদিন আগেও দুজনে সুখের সাগরে ভেসেছে সেই কক্ষেই প্রানপ্রিয়া একাকী ভীত হয়ে কেঁদে চলেছে।
চোখের কোনে জমা জল আঙুলের সহিত মুছে নিজেকে শক্ত রেখে দরজায় মৃদু নক করে ডেকে উঠলো
“ক্যামেলিয়া”
মাহাদের প্রথম ডাকেই নড়ে উঠলো ক্যামেলিয়া।
কিন্তু ঠাহর করতে পারলো না এটা কার কন্ঠস্বর।
দ্বিতীয় বার মাহাদ আবার কান্না ভেজা আদুরে কন্ঠে ডেকে উঠলো
“ক্যামেলিয়া দরজা খুলবে না?
চারপাশে দৃষ্টি মেলে হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়ালো ক্যামেলিয়া।
এরপর ধীরে ধীরে দরজার কাছে এসে দরজার নব ধরে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো।
“দেখো ক্যামেলিয়া তোমার মাহাদ এসেছে”
মাহাদ নাম শুনেও ক্যামেলিয়ার মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলোনা।
তবুও তার মন বলছে দরজা খুলে দে কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে ভিন্ন কথা।
মন মস্তিষ্কের লড়াইয়ে মন কে জয়ী করে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দরজা অল্প খুললো ক্যামেলিয়া।
ভেতরে ঢুকে রুমের ঘুটঘুটে অন্ধকার দূর করতে লাইট অন করে দিলো মাহাদ।
পুরো রুমের অবস্থা ভয়াবহ,রুমের সমস্ত কিছু ভেঙেচুড়ে লন্ডভন্ড করে ফেলেছে ক্যামেলিয়া
ক্যামেলিয়ার এরকম বিধস্ত অবস্থা সইতে না পেরে শক্ত করে ঝাপটে ধরলো ক্যামেলিয়া কে।
ক্যামেলিয়ার কাঁধে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলো মাহাদ।
জড়িয়ে ধরাটাই কি কাল হলো মাহাদের জন্য?
হঠাৎই ক্যামেলিয়া ভয়ানক চিল্লিয়ে উঠলো।
মাহাদকে চিনতেও পারলো না ক্যামেলিয়া।
তার কাছে মাহাদকে সেক্সওয়াল হ্যারেস করা সেই প্লাম্বার বয় ছাড়া আর কিছুই মনে হলো না।
মাহাদের আদুরে স্পর্শ ক্যামেলিয়ার কাছে বিষাক্ত সুচের আঘাতের ন্যায় ঠেকলো।
ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো মাহাদ কে।
এরপর বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে মাহাদ আর ক্যামেলিয়ার বিয়ের দিনের আনন্দ ঘন মুহূর্তের ছবির কাচের ফটো ফ্রেম দিয়ে সজোড়ে আঘাত করলো মাহাদের মাথায়।
ঘটনা বুঝার আগেই মাথা ফে/টে কপাল গড়িয়ে চুইয়ে চুইয়ে লালবর্ণের রঞ্জন পদার্থ বেরিয়ে এলো।
সেটা দেখে ক্যামেলিয়া আরো হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোর থেকে কেচি তুলে মাহাদের বুকে বিধিয়ে দিলো।
এরপর এক চিৎকারে রুমের বাইরে বেরিয়ে আসতেই পিছন পিছন মাহাদ ছুটে এলো।
মাহাদের এমন আহত রক্তাক্ত অবস্থা দেখে বাড়ির প্রত্যেকে নির্বাক হয়ে উঠলো।
মিসেস মিতালি ডুকরে কেঁদে ছেলের সামনে এসে দাড়ালেন।
ক্যামেলিয়া দৌড়ে দরজার কাছে যেতেই সুজানা দুই হাত দিয়ে বাঁধা প্রদান করে বলে উঠলো
“কোথায় যাচ্ছ ভাবি?আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবো না”
ক্যামেলিয়া বাড়ির বাইরে বের হবার জন্য জোরে জোরে কান্না করছে আর কাকুতি মিনতি করেই যাচ্ছে।
তবুও সুজানা নাছোড়বান্দা।
মুহূর্তেই মাহাদ হুংকার তুলে গর্জে উঠলো
“ওর পথ ছেড়ে দে সুজানা”
“না ভাইয়া ভাবীকে আমি যেতে দেবো না।ভাবি চলে গেলে তুমি মরে যাবে”
সুজানা ক্যামেলিয়ার হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বিভিন্ন ধরনের কথাই বলে যাচ্ছে।
কিন্তু সেসব ক্যামেলিয়ার মাথায়ও ঢুকছে না।
ক্যামেলিয়ার অত্যাধিক হাইপার সিচুয়েশন দেখে মাহাদ গলার সর্বোচ্চ আওয়াজ দিয়ে গর্জে উঠলো
“ওর পথ ছেড়ে দে সুজানা না হলে আমার চাইতে খারাপ কেউ হবেনা”
বলেই হাটু মুড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো মাহাদ”
#চলবে।
#ওগো_বিদেশিনী
#পর্ব_২১
#সারিকা_হোসাইন
________
গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মাহাদ হসপিটালে ভর্তি।
মাথায় ছোট ছোট কাঁচের টুকরো গেঁথে গিয়েছে আর বুকে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।
মাহাদ জ্ঞান হারানোর সাথে সাথেই দ্রুত এম্বুলেন্স কল করে মাহাদকে সিএমএইচ এ আনা হলে তাকে ইমারজেন্সি অপারেশন এ নেওয়া হয়।
মাহাদ একজন বিমান বাহিনীর বড় অফিসার ছিলো বিধায় সিএমএইচ এ তার সকল চিকিৎসা এখনো বহাল আছে।
মিসেস মিতালি অসুস্থ শরীরে কেঁদে কেঁদে আরো অসুস্থ হয়ে গিয়েছেন।
মাহতাব চৌধুরী ওয়েটিং চেয়ার এর একপাশে বসে সমানে কপাল স্লাইড করছেন।
নিজের ছেলে ছেলের বউয়ের এরূপ করুন দশা কোনো ভাবেই মানতে পারছেন না ভদ্রলোক।
সুজানা মিসেস মিতালিকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে।
আধ ঘন্টা পর ওটি রুম থেকে ডিউটি ডক্টর ক্যাপ্টেন স্বর্গ বেরিয়ে এলো।
স্বর্গকে দেখেই মাহতাব চৌধুরী আর সুজানা দৌড়ে স্বর্গের কাছে গেলো।
মাহতাব চৌধুরী এক প্রকার কেঁদেই ফেললেন
” ডক্টর আমার ছেলে এখন কেমন আছে?”
“আংকেল ভয়ের কোনো কারণ নেই বুকে তিনটে সেলাই লেগেছে আর মাথায় ছোট ছোট কাঁচ বিধে ছিলো আমরা সব বের করে সেলাই দিয়েছি।
তিন চার মধ্যেই উনাকে রিলিজ করে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন।
স্বর্গের কথায় সামান্য ভরসা পেয়ে অশান্ত মন কে শান্ত করার চেষ্টা করলেন মিতালি আর মাহতাব চৌধুরী।
কিছুক্ষণ উশখুশ করে কৌতুহল দমাতে না পেরে সুজানা কে স্বর্গ জিজ্ঞেস করে উঠলো
“আচ্ছা সুজানা এভাবে মাহাদ ভাইয়া কিভাবে আহত হলো?
সুজানা কিছুক্ষন মৌন থেকে কান্না ভেজা ভাঙা কন্ঠে বলে উঠলো
“আপনি তো সেদিন ক্যামেলিয়া ভাবীর সব কিছু শুনেছেন।ভাবি হঠাৎই হাইপার হয়ে হ্যালুসিনেশন টার্মে চলে গিয়েছে।সে আমাদের কাউকেই চিনতে পারছে না।
বলেই সুজানা আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
স্বর্গ সুজানার চোখের জ্বল মুছে দিয়ে পিঠ চাপড়ে বলে উঠলো
“চিন্তা করো না।সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে”
হঠাৎই মিতালি চৌধুরী স্বর্গকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো
“ডক্টর আমার ছেলের জ্ঞান ফিরেছে?
স্বর্গ নিজের হাতের ঘড়ির দিকে দৃষ্টি দিয়ে ঠোঁট গোল করে ফোস করে নিঃশাস ছাড়লো।এরপর মিতালীর দিকে এগিয়ে গিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো
“আন্টি উনি মনে হচ্ছে কয়েকদিন ধরেই বেশি চিন্তিত আর নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে।
শরীর বেশ দুর্বল মনে হলো।
সাথে কিছু ব্লিডিং হয়েছে।
আমি ইনজেকশন পুশ করে স্যালাইন দিয়ে দিয়েছি।
আশা করছি আগামী কাল সকালেই জ্ঞান ফিরবে।
ভয়ের কিছুই নেই সেরকম ডার্ক ইনজুরি হয়নি।
সকলের উদ্দেশ্যে স্বর্গ মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলে উঠলো
“আপনারা চিন্তা করবেন না আমি মাঝরাতে আবার এসে দেখে যাবো।
এখন আমাকে যেতে হবে আমার আরেকটা ওটি আছে
বলেই সাথে থাকা নার্স দুটোকে সব বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলো স্বর্গ।
*********
বাড়িতে শাহানা কুহু আর কোহিনুর রয়েছে।
হসপিটালে কি না কি হচ্ছে সেটা ভেবে ছোট কোহিনুর থেকে থেকে ভীত হয়ে যাচ্ছে।
রাতের রান্না শেষ করে সব কিছু ধুয়ে মুছে রাখতেই কোহিনুর এর নজর যায় রান্না ঘরের চুলার নিচের কেবিনেট এর কোনার হুকের দিকে।
ভ্রু কুঁচকে কোহিনুর নিচু হতেই চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়।
হুকের সাথে ছোট কাপড়ের ছেড়া টুকরো লেগে আছে।
কোহিনুর সেটা হাতে নিয়ে ভালো মতো পরখ করতেই ঘটনা অর্ধেক বুঝে গেলো।
চুপচাপ কাপড়ের টুকরো নিয়ে কোহিনুর নিজের রুমে গিয়ে বিছানার তোষকের নীচে রেখে আবার রান্না ঘরে চলে এলো।
এরপর আরো অনুসন্ধান চালাতেই ময়লার বালতির চিপায় একটা কালো পলিথিন দেখে অবাক হয়ে গেলো।
“প্রতিদিন তো ময়লা সাফ করি তাইলে এই প্যাকেট কই থাইকা আইলো?”
চতুর কোহিনুর সেই পলিথিন এর গিট খুলতেই পোড়া পাবদা মাছ দেখে নির্বাক হয়ে যায়।
এরপর দ্রুত ফ্রিজ খুলে পাবদা মাছের পোটলা খুঁজতে থাকে।
কিন্তু কোনো মাছ না পেয়ে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে
“মাছ কেরা পুড়লো?আর ভাবীর কাপড় এর টুকরা এই হানে কেন?
হঠাৎই বাজখাই গলায় শাহানা ডেকে উঠলো
“কিরে মাইয়া আইজ খাওন দিতি না?
শাহানার আওয়াজ পেয়েই কোহিনুর দ্রুত মাছের পোটলা লুকিয়ে বলে উঠলো
“এতো দুর্ঘটনার পরেও আপ্নের খাওনের লাইগা ইচ্ছা হৈতাসে?
শাহানা কোহিনুর এর কথায় ধাক্কা খেয়ে আমতা আমতা করে বলে উঠলো
“ভাত খাওনের পর ওষুধ খাইতে হইবো রে তাই আরকি কইলাম।”
এই মহিলাকে কোহিনুর দু চক্ষে সহ্য করতে পারেনা
তবুও এখন এই মহিলার সাথে কোহিনুর কোনো কথা বাড়াতে চায় না।
তাই নিজেকে রিজার্ভ রেখে কোহিনুর বলে উঠলো
“ক্যামেলিয়া ভাবীর লাইগা আমার চিন্তা হৈতাছে, টেবিলে খানা দেয়া আছে আফনে লইয়া খান!”
বলেই নিজের রুমে গিয়ে দুম করে দরজা আটকে দিলো কোহিনুর।
কিছুতেই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে পারছে না কোহিনুর।
“ভাবি রান্না ঘরে কেন গেছিলো?কখন এই কাম হইলো?
বহু চিন্তাভাবনার পর মোবাইলে সময় দেখে নিলো কোহিনুর।
“রাইত একটা বাজে ঘুমাইতে অইবো।সকালে আমার ম্যালা কাম”
এদিকে হৃদি তার ছোট বাচ্চাটিকে ঘুম পাড়িয়ে সুজানার থেকে বার বার বিভিন্ন খবর নিচ্ছে আর চিন্তিত হচ্ছে।
দীর্ঘ দিন পর সে এসেছিলো বাবা- মা, ভাই -বোন, ভাইয়ের বউয়ের সাথে হাসিখুশি মিষ্টি একটি সময় কাটাতে।
নিমিষের ব্যাবধানেই পরিস্থিতি এমন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি হৃদি।
নিজের ভাইয়ের এমন করুন পরিস্থিতিতে চোখের কোনে জল জমে উঠলো হৃদির।
কালকের মতো আর কখনোই মাহাদ কে এমন অসহায় দেখেনি হৃদি।
———-
শহরের উঁচু উঁচু বিল্ডিং পেরিয়ে পুব আকাশের টকটকে অঙ্গার বর্ণের সূর্য উকি দিয়ে জানান দিচ্ছে ভোর হয়েছে।
চারপাশে ফিনাইলের উটকো গন্ধ আর রোগীদের আহাজারি তে সুস্থ মানুষ ও অসুস্থ হবার উপক্রম।
থাই জানালা ভেদ করলেও ভোরের আলো হসপিটালের মোটা পর্দা ভেদ করতে পারলো না।
তবুও নির্জন অন্ধকার কক্ষ সকল কালিমা কাটিয়ে সামান্য আলোকিত হলো।
ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো মাহাদ।
হাত পা শরীর সব কিছু অবশ লাগছে।
মাথা ঝিম ঝিম করছে।
হাত নাড়াতে গেলেই স্যালাইন এর পাইপ সমেত টান লেখে ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো মাহাদ।
বুকে তার অসহনীয় ব্যাথা।
সময় কতো হয়েছে ?সে কতক্ষন ধরে ঘুমুচ্ছে কিছুই ঠাহর করতে পারলো না।
চিৎ হয়ে শুয়ে গতকাল দুপুরের কথা মনে পড়তেই চোখের কার্নিশ থেকে খসে পড়লো দুফোটা জল।
“তুমি আমাকে আরো আরো অনেক ব্যাথা দাও ক্যামেলিয়া তবুও আমাকে ছেড়ে যেও না”
“আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায়।”
“তোমাকে আমি কতোটা ভালোবাসি তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না”
কিছু সময় গড়াতেই মেডিসিন ট্রলি তে করে মাহাদের রিপোর্টস সহ মেডিসিন নিয়ে দরজায় খটখট নক করে দুজন নার্স কেবিনে ঢুকলো।
মাহাদ কে জাগনা দেখেই দ্রুত মাহাদের পাশে এসে বেড এর হুইল ঘুরিয়ে মাথার অংশ উঁচু করে আধ শোয়া করে ফেললো।
এরপর প্রেসক্রিপশন দেখে একটা ইনজেকশন নিয়ে মাহাদের হাতে লাগানো ক্যানোলাতে পুশ করে দিলো।
এরপর মাহাদ কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
“দ্রুত খাবার খেতে হবে স্যার ,আপনার আরো অনেক গুলো মেডিসিন আছে।
মাহাদ শুকনো ঢোক গিলে গলা ভেজানোর চেষ্টা করলো কিন্তু কাজ হলো না।
টেবিলের উপর থেকে নার্স ঝটপট পানির বোতল নিয়ে মাহাদ কে পানি খাইয়ে দিলো।
মাহাদ জড়িয়ে যাওয়া নিচু কন্ঠে ফ্যাসফ্যাস করে বলে উঠলো
“আমার বাবা আর মাকে ভেতরে আসতে বলুন”
নার্স মাহাদের আদেশ অনুযায়ী মিতালি আর মাহতাব কে ডাকলেন।
হুড়মুড়িয়ে দুজনে রুমে ঢুকতে নিলেই নার্স কড়া সতর্ক বাণী ছুড়ে দিলেন।
“পেশেন্ট যেনো কোনো ভাবেই উত্তেজিত না হয় আর অল্প সময়ের মধ্যেই কথা শেষ করে তাকে খাবার খাওয়ানোর ব্যবস্থা করবেন।
মাহতাব চৌধুরী নার্সকে আস্বস্ত করে কেবিনের ভেতর ঢুকতেই মাহাদ অসহায় বদনে বলে উঠলো
“আমার বউ কোথায় আছে বাবা?
“বউ কি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে?।।
ছেলের এমন আকুল প্রশ্নে বুকের ভেতর সূক্ষ্ণ ব্যাথার অনুভূতি পেলেন মাহতাব চৌধুরী।
নিজের জীবন যেখানে বিপন্ন হতে ছেলেছে সেখানেও মাহাদ ক্যামেলিয়ার চিন্তাই করে যাচ্ছে।
মিসেস মিতালি মাহাদের বেডের পাশের চেয়ার টেনে বসে মাহাদের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠলেন
―তোর খালামনির বাসায় আছে।
মাহতাব চৌধুরী অস্থির হয়ে বলে উঠলেন
“ঠিক সময়ে সাইকিয়াট্রিস্ট না এলে কি যে হতো উপরওয়ালাই জানেন”
বুকে আর মাথার কাটা জায়গায় টনটনে ব্যাথায় চোখ বন্ধ করে বালিশে হেলান দিলো মাহাদ।
এরপর শুষ্ক ঠোঁট জোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে মাহাদ কাতর কন্ঠে বলে উঠলো
“ক্যামেলিয়ার ভিসার মেয়াদ আমি বাড়াতে পারিনি মা,আর দুদিন পরে ওকে চলে যেতে হবে,!
“এই কঠিন পরিস্থিতিতে আমি কিভাবে একা ছাড়বো ওকে?
আমি কিছুই ভাবতে পারছি না।বুকের এই খানে খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা”
“আমি বোধ হয় আর বাঁচবো না।
“ক্যামেলিয়া নামক ডাইমিথাইল-মার্কারি বিষে আমি ধীরে ধীরে বিষাক্ত হয়ে গেছি।”
“আমাকে বাঁচতে হলে প্রতিদিন এই বিষ পান করতে হবে আমার”
মাহতাব চৌধুরী নরম স্বরে বলে উঠলেন
“সাইকিয়াট্রিস্ট এর সাথে কথা হয়েছে আমাদের,কোনো বিষয়ে চরম ভয় থেকে এমন অস্বাভাবিক আচরণ করেছে ক্যামেলিয়া”
“ওকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে,লম্বা ঘুম দিলে কিছুটা স্বাভাবিক হলেও হতে পারে”
তুমি অযথা বেশি চিন্তা করে নিজের ক্ষতি করো না মাহাদ,বাবা মা হয়ে এসব সহ্য করতে খুব কষ্ট হয় আমাদের।
বলেই মাহতাব চৌধুরী নিজের ফোন বের করে কারো নম্বর ডায়াল করলেন।
“আমাকে দ্রুত বাসায় নেবার ব্যাবস্থা করো বাবা,আমি ক্যামেলিয়া কে দেখতে চাই”
হঠাৎই কেবিনে স্বর্গ প্রবেশ করলো।
“ক্যাপ্টেন মাহাদ আপনার শরীর খুবই দুর্বল আর আপনার একদম উত্তেজিত হওয়া উচিত নয় এই মুহূর্তে”
“তিন দিন অবজারভেশন না করে কিছুতেই আপনাকে আমরা ছাড়তে পারবো না”
কিছুক্ষন বাদেই একজন ওয়ার্ড বয় ট্রেতে করে চিকেন স্যুপ, ডিম আর দুটো রুটি নিয়ে মাহাদের সামনে রেখে বলে উঠলো
“দ্রুত খেয়ে নিন স্যার।”
সকাল সকাল এমন বিচ্ছিরি খাবার দেখে পেট গুলিয়ে উঠলো মাহাদের।
খাবার খাওয়ার কোনো ইচ্ছেই তার এই মুহূর্তে নেই।
মিসেস মিতালি একটু রুটি চিরে মুখে দিতেই বমির উদ্রেক হলো মাহাদের।
একটু পানি খেয়ে স্যুপ খেয়ে মেডিসিন নিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো মাহাদ।
কোথায় থেকে কি শুরু করবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না সে।
মাথায় চাপ প্রয়োগ করতেই শিরশিরে ব্যাথায় যন্ত্রনা করতে লাগলো।
এরপর চট করে উঠে বসে হাতের ক্যানুলা খুলে ব্যাথায় কোকাতে কোকাতে দাঁড়িয়ে গেলো মাহাদ।
নার্স আর স্বর্গ বাধা দিতেই মাহাদ হাত দিয়ে তাদের থামিয়ে দিলো।
স্বর্গ বিচলিত হয়ে বলে উঠলো
“ক্যাপ্টেন মাহাদ আপনি অসুস্থ, কাঁচা সেলাই,নিজেকে রিস্কে ফেলবেন না প্লিজ।!”
“ডক্টর স্বর্গ সাময়িক রিস্ক নিলেও আমি বেঁচে থাকবো কিন্তু প্রাণ চলে গেলে কিভাবে বাঁচবো?
বলেই হসপিটাল এর পেশেন্ট ইউনিফর্ম খুলে সাদা ব্যান্ডেজ জড়ানো উদোম শরীর নিয়েই বেরিয়ে এলো।
নার্স বা স্বর্গ কেউ মাহাদ কে বাধা দিতে পারলো না।
ছেলের পিছে পিছে মিসেস মিতালিও বেরিয়ে ডেকে উঠলেন
“বাবারে এই ভাবে যাস না, মরে যাবি”
কিন্তু মাহাদ সেসব কানে না তুলে লম্বা লম্বা পা ফেলে সামনের দিকে এগুতে লাগলো।
মাহতাব চৌধুরী স্বর্গের সাথে কথা বলে মেডিসিন আর প্রেসক্রিপশন বুঝে নিলেন।
মাহাদের এরূপ করুন অবস্থা দেখে সুজানা কেঁদে বলে উঠলো
“ভাইয়া নিজেকে একটু তো সামলাও প্লিজ”
সুজানার কথা,কান্না কোনোটাই মাহাদের কানে গেলো না।
______
এদিকে কেবলই টুটুল লিফট ধরে ছয় তলায় উঠে মাহাদের কেবিনের দিকে অগ্রসর হয়েছে।
মাহাদকে এরূপ অবস্থায় দেখে ভয়ার্ত স্বরে টুটুল ডেকে উঠে
“স্যার”
টুটুলের দেখা পেয়ে মাহাদ যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি পেলো।
দ্রুত টুটুলের সামনে গিয়ে ওর্ডার দিয়ে বলে উঠলো
“আমার বউয়ের কাছে আমাকে নিয়ে চলো টুটুল।
#চলবে