ওয়ান ফোর থ্রি পর্ব-২০+২১+২২

0
469

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
২০.
স্নেহাকে দেখার পর থেকে রানু প্রচন্ড রেগে আছে। তোহা জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিচ থেকে দেখছে ওদের। আমীর আর স্নেহা বাগানে দাঁড়িয়ে কি এতো কথা বলছে! রানু রুষ্ট স্বরে বলল,” এই ডাইনিটা আবার কেন এসেছে? কি চায়?”

তোহা বিরস হেসে বলল,” তার স্বামী যেহেতু এখানে আছে… সে তো আসবেই। তাই না?”

রানু ভর্ৎসনার সুরে শব্দ করল,” এহ, কিসের স্বামী? সব ঢং। এই মেয়ের সবকিছুই নাটক। ও হলো কালনাগিনী। উপরে ভালোবাসা দেখালে কি হবে? ভেতরে বিষ। তুমি ওকে চেনো না।”

তোহা চুপচাপ জানালায় মাথা ঠেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিরহী ভঙ্গিতে৷ রানু একটু কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,” আবিরকে এই কালনাগিনীর হাত থেকে বাঁচাও মা। এই মেয়ে আবিরের জীবনটা শেষ করে দিচ্ছে।”

রানুর কণ্ঠে দুঃখ, আফসোস। তোহা নিরুপায় হয়ে বলল,” আমি কিভাবে বাঁচাবো? আমীর সাহেব তো উনার স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসেন। তিনি হয়তো সুখেই আছেন স্নেহার সাথে।”

রানু ত্যক্ত কণ্ঠে বলে উঠল,” কিসের সুখে আছে?উপর থেকে যা দেখা যায় তা সবসময় সত্যি না। তুমি জানো এই মেয়ে কতবড় চরিত্রহীন? ও যখন আবিরকে বিয়ে করে তখন ওর পেটে অন্য পুরুষের বাচ্চা ছিল। ওদের বিয়েটাই তো বৈধ হয়নি। এক বেটার বাচ্চা পেটে রেখে কি অন্য বেটার সাথে বিয়ে হয়? জীবনে শুনেছো?”

তোহা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। মাথা নিচু করল। সে তো এসব আগে থেকেই জানে৷ কিন্তু স্নেহা আর আমীরের বিয়ে বৈধ হয়নি ভেবে তোহার কেন যেন খুব শান্তি লাগছে। একটু কৌতুহলী হয়ে সে প্রশ্ন করল,” আচ্ছা, তারপর বাচ্চাটার কি হলো?”

” বাচ্চা কি আর রেখেছে? কবেই তো ফেলে দিয়েছে। চরিত্রহীন মেয়েরা সহজে বাচ্চা নেয় না। তাহলে নষ্টামি করবে কি করে?”

তোহার অস্বস্তি লাগছে। কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। রানু আরও কাছে এসে বলল,” আবির যখন ওকে বিয়ে করে এই বাড়িতে আনে আমি তখনি বুঝে ফেলেছিলাম সে অন্তঃসত্ত্বা। তার কিন্তু ওই ছেলেটার সাথে এখনও সম্পর্ক আছে।”

” কোন ছেলে?”

“ওইযে দেখছো পেছনে বডিগার্ডের মতো দাঁড়িয়ে আছে লম্বা করে ছেলেটা? ওর নাম রাশেদ। ওর সাথে এই মেয়ে কয়বার শুয়েছে তুমি জানো?”

” এসব কথা থাক আন্টি।”

” থাকবে কেন? আমার আবিরের জীবন শেষ করে দিচ্ছে ডাইনিটা আর আমি চুপ করে থাকব নাকি?”

তোহা ডায়েরী পড়ার সময় বুঝতে পারেনি যে ফীহাদের বাড়ির রাশেদ আর এই রাশেদ এক কি-না। কিন্তু এখন রানু আন্টির কথা শুনে মনে হচ্ছে, এরা দু’জন একই মানুষ! তাহলে আমীরের তো এসব আগে থেকেই জানার কথা। তাও সে স্নেহার সঙ্গে সংসার করে যাচ্ছে কেন? কিসের ভিত্তিতে?

” আমীর সাহেব নিজেই যদি ওর সাথে থাকতে চায় তাহলে আমরা কি করতে পারি বলুন?”

” আবির থাকতে চায় তোমাকে কে বলল? আবির ওকে সহ্যই করতে পারে না। এতোগুলো দিন বিয়ে হয়েছে কিন্তু কখনও ওরা একসঙ্গে থাকেনি। বিশ্বাস না হলে তুমি জিজ্ঞেস করতে পারো।”

” আমি কেন এসব জিজ্ঞেস করতে যাবো?”

তোহা আড়ষ্ট হলো৷ রানু মুখ গোমরা করে বলল,

” এমনি কথার কথা বললাম। আমার মনে হয় ডাইনিটা আবিরকে কিছু একটা দিয়ে ভয় দেখিয়ে রেখেছে। এজন্যই আবির ওকে নিজের বাড়িতে রেখেছে। নয়তো কবেই বের করে দিতো। এমন নষ্টা মেয়ের মুখের দিকে তাকানোও তো পাপ। ছিঃ!”

হঠাৎ আমীর উপরে তাকাতেই তোহা সরে পড়ল জানালা থেকে। পর্দা টেনে দিল। একটু পরেই উপরে উঠে এলো আমীর। তোহা রানুর সাথে দুইতলার একটা ঘরে বসে আছে। আমীর সেই ঘরের দরজার কাছে এসেই দাঁড়াল। তোহা তাকে দেখেও না দেখার ভাণ করে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। আমীর বলল,

” রানু আন্টি, আমার একটা জরুরী ফোন এসেছে। আমি চলে যাচ্ছি।”

কথাটা রানুর উদ্দেশ্যে বলা হলেও আমীর কিন্তু তাকিয়ে ছিল তোহার দিকেই। তোহা সেটা খেয়াল করল না।

” তোর বউ কি এখানেই থাকবে?” ক্রোধ উপচে পড়ছে রানুর চোখ থেকে। আমীর সহজ গলায় বলল,” ও এখানেই থাকতে চায়। থাকুক। আমি সন্ধ্যায় এসে নিয়ে যাবো।”

” আমি কিন্তু তোর বউকে রান্না করে খাওয়াতে পারব না৷ আমার হাতে রান্না নাকি ওর ভালোই লাগে না৷ এতো যখন খুঁতখুঁতানি, নিজেই রেঁধে খাক।”

রানু কিছুক্ষণ ক্যাটক্যাট করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আমীর শান্ত দৃষ্টিতে তোহার দিকে তাকালো। তোহা একমনে জানালার দিকেই চেয়ে রয়েছে। রানুর কণ্ঠে বার-বার উচ্চারণ করা ‘ তোর বউ’ কথাটা তার কানে লেগেছে।তার চোখের পর্দায় ভাসছে সেই দৃশ্যটা। যখন স্নেহা দৌড়ে এসে আমীরের গালে চুমু দিয়েছিল। কি অসহ্যকর, কি বীভৎস! তোহার ভেতরটা ছিন্ন-ভিন্ন করার জন্য যথেষ্ট।

আমীর ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,” আসি।”

তোহার কোনো উত্তর না পেয়ে সে চলেই যাচ্ছিল। তোহা কথা বলতে চাইল না। তাও তার মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো,” এতোকিছুর পরেও আমাকে একা রেখে চলে যাচ্ছেন? যদি আমার কিছু হয়ে যায়?”

আমীর চকিতে পেছনে ফিরে তাকাল। তোহার দৃষ্টি তখনও জানালার দিকে। মুখ ভর্তি অভিমানের ছাপ। আমীরের বুকের বামপাশ শিরশির করে উঠল। তোহার অভিমানী মুখশ্রী একটা শীতল অনুভূতি ঢেলে দিয়ে গেল হৃদয়ে। সামান্য হেসে বলল,” ভয় নেই। স্নেহা আর কিছু করবে না। এতো সাহস ওর নেই। তাছাড়াও আমি সেইফটির জন্য দু’জন বডিগার্ড রেখে যাচ্ছি। ফয়সাল আর ওমর তোমার খেয়াল রাখবে। কোনো প্রয়োজন হলে ওদেরকে বললেই হবে। ওরা আমার কাছে ফোন করে দিবে।”

তোহা আর কিছু বলল না। আমীর চলে যেতেই সে চোখের জল মুছল।তার এতো কষ্ট কেন হচ্ছে স্নেহাকে দেখে? বাবা বেঁচে থাকলে সে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো। বাবা তার পরম আদরমাখা হাতটি তোহার মাথায় বুলালেই সব কষ্ট ধুঁয়ে-মুছে যেতো। আমীর চলে যাওয়ার পর তোহা আর ঘর থেকে বের হয়নি। সে একদম স্নেহার মুখোমুখি হতে চায় না।

দুইতলার করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় ঠিক তোহার ঘরের সামনেই এসে থামল স্নেহা। বিষণ্ণ ভঙ্গিতে তোহা দাঁড়িয়ে আছে। স্নেহা ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করল তাকে। ছোটখাটো, ছিপছিপে একটা শরীর। ফরসা, পাতলা মুখ, ছোট চুল। কই, এতো আহামরি সুন্দর তো না! কি আছে ওই চেহারায়? অথচ স্নেহা দেখতে লম্বা, তার কোমরের বাঁক, ধারালো নাক, আকর্ষণীয় ঠোঁট, সবকিছুই পারফেক্ট। সৌন্দর্য্যের দিক দিয়ে তোহা কখনও স্নেহাকে হারাতে পারবে না।

তবুও এতোগুলো দিন একসাথে থেকেও কখনও স্নেহা নিজের প্রতি আকৃষ্ট করতে পারেনি আমীরকে। সে জানতো পুরুষকে আকৃষ্ট করার জন্য শুধু একটা আকর্ষণীয় শরীরই যথেষ্ট। যে সম্পদ স্নেহার আছে। তবুও আমীর তার দিকে ওভাবে কখনও তাকায়নি৷ যেভাবে তোহার দিকে সে তাকায়। আজ সকালেও স্নেহা দেখেছে। আমীর তোহার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার দৃষ্টিতে ছিল তৃষ্ণা, আকুলতা, ব্যাকুলতা। এমনভাবে সে তোহাকে দেখছিল যেন তোহাই তার জীবনের একমাত্র চাওয়া-পাওয়া! স্নেহার ঠিক ওই মুহূর্তে ইচ্ছে করেছিল তোহাকে খু-ন করে ফেলতে। কি এমন ক্ষমতা আছে তার? যে ক্ষমতা দিয়ে সে আমীরকে ঘাঁয়েল করে ফেলল? আর স্নেহা এতো রূপসী হয়েও তা পারল না!

ক্রোধ সংবরণ করে ঠান্ডা মাথায় ঘরে প্রবেশ করল স্নেহা। মধুর কণ্ঠে বলল,” হ্যালো তোহা, কেমন আছো?”

তোহা একটু কেঁপে উঠল। স্নেহা হাসিমুখে বলল,” আমাকে দেখে কি তোমার মনখারাপ হয়ে গেছে? এমন কচ্ছপের মতো ঘরের মধ্যে লুকিয়ে আছো কেন?

তোহা হেসে ফেলল। তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,” তোমাকে দেখে আমার মনখারাপ কেন হবে? কি এমন আছে তোমার?”

স্নেহা আফসোসের স্বরে বলল,” তোমার যে মনখারাপ সেটা তোমার কণ্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে। আহারে, কান্না-কাটিও করেছো মনে হয়। চোখ এমন ফোলা দেখাচ্ছে কেন?”

তোহা কোনো কথা না বলে চলে যেতে চাইল। পেছন থেকে স্নেহা ডাকল,” এই ডায়েরীটা বুঝি তোমার? লিভিংরুমের সোফায় পেয়েছি।”

ধড়াস করে উঠল তোহার বুক। পেছন ফিরে দ্রুত ডায়েরীটা ছিনিয়ে নিল স্নেহার হাত থেকে। স্নেহা হাসতে হাসতে বলল,” ভয়ের কিছু নেই। এই ডায়েরী আমি নিজেই ওই ঘরে রেখেছিলাম। কারণ আমি চাই তুমি এটা পড়ো।”

তোহা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করল,” কেন?”

স্নেহা কাছে এসে বলল,” আমীরকে নিয়ে তোমার মনে যে ঘর বাঁধার স্বপ্নটা আছে, সেটা এই ডায়েরী পড়ার পর ভেঙে যাওয়ার কথা। যেমন ফীহার স্বপ্নও ভেঙে গেছিল। আফটার অল, একজন অক্ষম পুরুষকে নিয়ে তো সংসার করা যায় না।”

তোহা ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকাল। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” সামনে থেকে সরো। আমি তোমার সাথে কোনো কথা বলতে চাই না।”

সে যেতে নিলেই স্নেহা পেছন থেকে শক্ত করে তার হাতটা এমনভাবে চেপে ধরল যে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠতে বাধ্য হলো তোহা। চিৎকার করে বলল,

” হোয়াটস রং উইথ ইউ? ছাড়ো আমাকে!”

স্নেহা তাচ্ছিল্য হেসে বলল,” বুঝেছি। টাকা, তাই না? আমীরের টাকার জন্য ওর পেছনে পড়ে আছো তুমি। এজন্যই ওকে ভোলাতে চাইছো। তুমি কি ভেবেছো ও আমাকে ছেড়ে তোমার কাছে চলে আসবে? এতো সহজ! তোমাদের মতো মেয়েদের সহজ ভাষায় কি বলে জানো? বে-শ্যা!”

তোহা আর সহ্য করতে পারল না। একের পর এক নোংরা বাক্য তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিল। ঝটিতে স্নেহার হাত ছাড়িয়ে তাকে ধাক্কা মেরে সরালো তোহা। ক্রোধসিক্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” তুমি একটা সাইকো। আগে নিজের চরিত্র ঠিক করো তারপর আমাকে নিয়ে কথা বলতে এসো। তুমি কি ভেবেছো আমি কিছু বুঝি না? নিজের অন্যায় ঢাকতে তুমি আমীরকে ব্লেইম দিচ্ছো।”

স্নেহা ভস করে জ্বলে উঠল৷ দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,” আমি আমীরকে ব্লেইম দিচ্ছি মানে? কি বলতে চাও?”

” তুমি না সবার অতীত বুঝতে পারো? মানুষ চিনতে তো তোমার ভুল হয় না। তাহলে আমীর যে অক্ষম এটা তোমার আগেই জানার কথা। তবুও সেদিনরাতে তুমি আমীরের ঘরে সেজে-গুজে কেন গিয়েছিলে? কিসের আশায়?”

স্নেহা হুংকার ছেড়ে বলল,” সেই কৈফিয়ৎ আমি তোমাকে দিবো না।”

” দিতে তোমাকে হবেই। কারণ তুমি মিথ্যুক। নিজের রূপের প্রতি তোমার অহংকার অতিরিক্ত। যখন আমীর তোমাকে গ্রহণ করল না তখন নিজের এই আত্ম- অহংকার বজায় রাখতে তুমি তাকে পুরুষত্বহীন বানিয়ে দিলে। ওর নামে মিথ্যা রটিয়ে দিলে। তুমি হয়তো ভেবেছো এতে কোনো মেয়ে ওর কাছে আসবে না। আর ও তোমার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ হয়ে থাকবে।”

স্নেহা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ক্ষীপ্ত কণ্ঠে বলল,” এরকম কিছুই না। আমাদের বিয়ের এতোদিন হয়ে যাওয়ার পরেও সে আমাকে কখনও স্পর্শ করেনি। তোমার কি মনে হয় এটা কোনো স্বাভাবিক পুরুষের পক্ষে সম্ভব যদি সে অক্ষম না হয়?”

তোহা বাঁকা হেসে বলল,” এটা সম্ভব। কারণ তুমি চরিত্রহীনা। তোমাকে স্পর্শ করার জন্য রুচিহীন হওয়া জরুরী। আমীর এতোটাও রুচিহীন না।”

প্রচন্ড রাগে স্নেহার শিরা কাঁপতে লাগল। তার পরিবর্তন দেখে তোহা ভয় পেয়ে গেল। কেমন জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, চোখ দু’টি রক্তলাল। হিংস্র পিশাচিনির মতো দেখাচ্ছে। তোহা কয়েক পা পিছিয়ে গেল। স্নেহা এগিয়ে এলো। তারপর হঠাৎ তোহার চুলের মুঠি ধরে তার মাথাটা দেয়ালে ঠোঁকাতে শুরু করল। তোহা চিৎকার করে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো ভয়াবহ র-ক্তপাত। তোহা জ্ঞান হারিয়ে নিথর হয়ে পড়ে রইল মেঝেতে।

___________

চলবে

®Sidratul মুন্তায

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
২১.
ঘড়ির কাঁটা বারোটায় আটকে আছে। সময় বাড়ছে না।
ঘড়ি কি নষ্ট হয়ে গেছে? জাহাঙ্গীর সাহেব বিচলিত বোধ করছেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অল্প হাসলেন তিনি। আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন,” আমার আজকে একটা বিয়ের দাওয়াতে যেতে হবে। ”

সরবের চোখমুখ কঠিন। আঁড়চোখে আফশানের দিকে তাকালো। আফশান মোবাইল ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বলল,” স্যার চলে এসেছেন। আশেপাশেই কোথাও আছেন।”

জাহাঙ্গীর ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতে লাগলেন। সরব সামান্য ধমকের স্বরে বলল,” বসুন আপনি।”

সাথে সাথেই তিনি মুখ কালো করে বসে পড়লেন। হাতের কেনী আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলেন বাথরুম চেপেছে। কেউ কিছু বলল না। জাহাঙ্গীর সাহেবের অস্বস্তি লাগছে খুব। এরা মনে হয় বাথরুমেও যেতে দিবে না। তার পেশা হলো ক্রিমিনালদের ধমকানো। কিন্তু এখানে তাকেই ধমকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। চারদিক থেকে সবাই এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যেন তিনি নিজেই কোনো ক্রিমিনাল! অথচ নিজের অপরাধটা তিনি এখনও বুঝতে পারছেন না। হালকা গলায় জানতে চাইলেন,” আমাকে কেন এখানে আনা হয়েছে সেটা যদি কেউ বলতেন ভালো হতো।”

সরব গম্ভীর গলায় বলল,” স্যার এলেই সবকিছুর উত্তর পাবেন।”

জাহাঙ্গীর বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেন।সরব ভ্রু কুচকে তাকানো মাত্রই তিনি হাসার চেষ্টা করে জানতে চাইলেন,” মানে আর কতক্ষণ?”

অল্প সময়ের ব্যবধানে লিভিংরুমে প্রবেশ করল আমীর। জাহাঙ্গীর মাথা উঠিয়ে দেখলেন ধূসর ট্রাউজারের সাথে কমলা পোলো টি-শার্ট পরিহিত যুবক ভেতর ঢুকছে৷ প্রথম দর্শনে মনে হবে সাধারণ কেউ। কিন্তু যখন সবাই একাধারে সালাম দিতে লাগল তখনি জাহাঙ্গীর আলম নিজেও উঠে দাঁড়ালেন। বুঝলেন ইনিই আমীর বিন ইফাত। যার জন্য সকাল দশটা থেকে তিনি অপেক্ষায় বসে আছেন। বাথরুমে পর্যন্ত যেতে পারছেন না৷ আমীর সৌজন্যতার খাতিরে হাসল। বসার আগে জাহাঙ্গীরের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল,” বেশি লেইট করে ফেললাম নাকি জাহাঙ্গীর সাহেব?”

জাহাঙ্গীর অত্যন্ত বিনয়ের স্বরে বললেন,” একদম না। মাত্র দুইঘণ্টা দশমিনিট আর কি এমন সময় স্যার? আপনার মতো মানুষের সাথে মিটিং-এর জন্য তো চার-পাঁচঘণ্টাও অনায়াসে অপেক্ষায় কাটিয়ে দেওয়া যায়।”

আমীর মৃদু হাসল। রাসেলের দিকে চেয়ে বলল,” ওসি সাহেবের লাঞ্চটা নিয়ে আসো।

” জ্বী স্যার।” মাথা নত করে বেরিয়ে গেল রাসেল।

” লাঞ্চ করব না স্যার। আজকে আমাদের বিয়ের দাওয়াত আছে। আমার স্ত্রী অপেক্ষায়…”

জাহাঙ্গীরকে থামিয়েই আমীর দরাজ গলায় বলে উঠল,” অর্ণব সরোয়ারের কেইসটার কথা মনে আছে আপনার?”

জাহাঙ্গীর বিভ্রান্ত হয়ে তাকালেন। একটু ভেবে জিজ্ঞেস করলেন,” কোন অর্ণব সরোয়ার স্যার?”

আমীর ঠান্ডা দৃষ্টিতে ইশারা দিল সরবকে। সাথে সাথেই সরব আর আফশান মোটা দড়ি নিয়ে তেড়ে এলো হাট্টা-গোট্টা ভূড়িওয়ালা অফিসারের দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জাহাঙ্গীর আলমকে বেঁধে ফেলা হয়। প্রচন্ড আতঙ্কে ঘামতে লাগলেন জাহাঙ্গীর। হতভম্ব হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় শুধু বললেন,” স্যার,আমি তো কিছুই বুঝলাম না।”

” সব বুঝবেন এখন আপনি।” শান্ত কণ্ঠে এই কথা বলেই আমীর উঠে দাঁড়ায়। জাহাঙ্গীর অনুনয়ের স্বরে বললেন,” আগে আলোচনা করে নিলে ভালো হতো না স্যার? আমি সত্যিই চিনতে পারছি না কে এই অর্ণব সরোয়ার? কতবছর আগের কেইস স্যার? আমার মনে পড়ছে না।”

রাসেল প্লেটে করে কয়েকটি পিস্তল নিয়ে ভেতরে এলো। আমীর জাহাঙ্গীর আলমের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে। ত্রাসে কাঁপছে ভদ্রলোকের শরীর। আমীর ফিসফিস করে বলল,” প্রথমে অর্ণব সরোয়ারকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়েছেন। তারপর নিজের গা বাঁচাতে আমাকে বিভ্রান্ত করেছেন। আপনাকে খুঁজতে গিয়ে আমি জাবিদ আলমের মতো একজন নির্দোষকে হ-ত্যা করেছি। কি ভেবেছিলেন কখনও আপনার কথা জানতে পারব না? খেলা এখনও শেষ হয়নি অফিসার। যে আপনাকে সাহায্য করেছে সেই শাদীদও এখন কবরে। আপনাকেও তার কাছে যেতে হবে।”

জাহাঙ্গীর আলমের হৃৎস্পন্দন হাজার গতিতে ছুটতে লাগল। জাবিদ আলমের মতো পুলিশ অফিসারকে পর্যন্ত গুম করে দেওয়া হয়েছে সেখানে তার কি হাল হবে ভেবেই হাত-পা বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে এলো।

জাহাঙ্গীর করুণ আর্তনাদ করে বললেন,

” স্যার আমি তখন জানতাম না সে আপনার লোক। আমার অনেক বড় ভুল হয়েছে।আমাকে মা-রবেন না স্যার। আমি কিছু জানতাম না স্যার। আমাকে বলার সুযোগ দিন।”

আমীর ইজিচেয়ারে বসে নির্দেশ দিল যেন লোকটির বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। জাহাঙ্গীর আলম কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ সরব আর আফশান তাকে ছেড়ে দিতেই তিনি প্রায় অর্ধচেতনের মতো লুটিয়ে পড়লেন। কিছুসময় পার হতেই চোখ খুললেন তিনি। বিচলিত দৃষ্টিতে ইজিচেয়ারে বসে থাকা কালো ছায়ামূর্তির দিকে তাকিয়েই কেঁদে ফেললেন। পুনরায় তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে বললেন,” স্যার, আমাকে ছেড়ে দেন স্যার। আমি কোনো দোষ করিনি।”

তিনি ঝুঁকে এসে আমীরের পায়ে পড়তে নিলেই পেছন থেকে সজোরে আফশান চেপে ধরল তাকে। ধারালো গলায় বলল,” যা বলার দূর থেকে বলুন। কাছে গেলেই শ্যুট করব আপনাকে।”

জাহাঙ্গীর মাথা নত করে দুইহাত জড়ো করল। আকুতি-মিনতির স্বরে বলল,” স্যার, আমাকে ছেড়ে দেন। আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। এখন থেকে আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব। শুধু আমার কোনো ক্ষতি করবেন না। জীবন ভিক্ষা দিন আমার।”

আমীর উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে কাছে এসে সামান্য ঝুঁকে বলল,” হাঁ করুন।”

জাহাঙ্গীর আলম মাথা তুলে তাকালেন। আধো আলো, আধো ছায়ায় আমীরের কঠোর ও হিংস্র মুখটা দেখা মাত্রই কলিজা কেঁপে উঠে। রক্ত হীম হয়ে আসার মতো কণ্ঠে আমীর আবারও উচ্চারণ করল,” হাঁ করতে বলেছি।”

জাহাঙ্গীর হা করতেই আমীর পিস্তলটা তার মুখের ভেতরে একদম গলার আলাজিহ্বার কাছে চেপে ধরল। জাহাঙ্গীর ছটফটিয়ে উঠলেন। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। কালেমা মনে করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মনে আসছে না। বাঁচার কি আর কোনো আশা নেই? ঠিক এমন সময় তার পকেটের ভেতর থেকে মোবাইলটা বেজে উঠে।

আমীর ট্রিগার চাপতে নিয়েও থেমে যায়। কাজে বিঘ্ন ঘটায় যথেষ্ট বিরক্ত হলো সে। গরম চোখে সরবের দিকে তাকাতেই সরব নিচু গলায় বলল,” স্যরি স্যার। মোবাইলটা বের করতে ভুলে গেছিলাম।”

জাহাঙ্গীর আলমের চোখ দু’টি মার্বেলের মতো গোল; আতঙ্কে যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসবে এখনি। তার পকেট হাতড়ে সরব মোবাইল বের করে। স্ক্রিনে একটা বাচ্চা মেয়ের ছবি ভেসে উঠেছে। রিংটোনও কিছুটা অদ্ভুত। মেয়েটি আদুরে কণ্ঠে বলছে,” বাবা, বাড়ি আসো। বাবা, বাড়ি আসো।”

জাহাঙ্গীর আলমের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। তীব্র আকুলতা নিয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন আমীরের দিকে। কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থেকে আমীর খেয়াল করল, তার হাত কাঁপছে। সরব মোবাইলটা বন্ধ করে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার পরেও আমীর নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারল না। তার কানে বাজতে লাগল ছোট্ট মেয়ের মিষ্টি কণ্ঠে উচ্চারিত,’বাবা’ ডাকটা। ভেসে উঠল একটা মায়াবী মুখ৷ যে মুখটি তোহার মতোই সহজ, সরল আর ভালোবাসাময়। কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে আমীর ঝটিতে জাহাঙ্গীর আলমকে ধাক্কা মা-রল। মুখ থুবড়ে মেঝেতে উল্টে পড়লেন জাহাঙ্গীর।

আমীর শান্ত কণ্ঠে বলল,” ছেড়ে দাও উনাকে।”

প্রাণটা ঠোঁটের আগায় এসে আটকেছিল। এতোক্ষণে জাহাঙ্গীর শ্বাস নিতে পারলেন। ছটফট করতে করতে তুমুল আনন্দ নিয়ে উচ্চারণ করলেন,” আপনার অনেক বড় মেহেরবানি স্যার। আমি আল্লাহর কাছে আপনার জন্য খাস দিলে দোয়া করব৷ এখন থেকে আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব। আল্লাহ, আল্লাহ, তুমি স্যারের ভালো কোরো আল্লাহ।”

আমীর একবারও পেছনে ফিরে না তাকিয়ে লিভিংরুম থেকে বের হয়ে যায়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা প্রত্যেকেই হতভম্ব। আমীর কাউকে খু-ন করার জন্য ধরে এনেছে কিন্তু জীবিত অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছে এমন ঘটনা এর আগে ঘটেনি। তাই কেউ ব্যাপারটা সহজে হজম করতে পারছে না। একটু পর সরব নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,” গাড়ি বের করো। জাহাঙ্গীর সাহেবকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে।”

_______________
স্নেহা ঘেমে একাকার। কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে এসব কি হয়ে গেল? নিজেকে একদম সামলাতে পারেনি সে। উদভ্রান্তের মতো পায়চারী করতে লাগল ঘরময়; এ মাথা থেকে ও মাথা। নিচ থেকে সবাই উৎকণ্ঠা নিয়ে উপরে উঠে আসছে। তাদের পায়ের আওয়াজ শুনে স্নেহা ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল। রাশেদ সবার আগে ঘরে ঢুকল। স্নেহার বিচলিত অবস্থা আর মেঝেতে তোহার র-ক্তা-ক্ত দেহ দেখেই গা শিউরে উঠল তার।

ভেতরে যাতে কেউ আসতে না পেরে তাই খট করে দরজাটা বন্ধ করে ফেলল রাশেদ। উৎক্ষীপ্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল রানু,” দরজা কেন বন্ধ করলে? এই ছেলে দরজা খোলো। ভেতরে কে চিৎকার করেছে? তোহা কোথায়? দরজা না খুললে কিন্তু ভেঙে ফেলব। দরজা খোলো বলছি।”

রাশেদ ত্রস্ত পায়ে হেঁটে এলো স্নেহার কাছে। হাঁটু গেঁড়ে বসল তার সামনে। স্নেহার চিবুক স্পর্শ করে বলল,” ম্যাডাম, এটা কি করে ফেললেন? স্যার জানলে আপনার কি হবে?”

স্নেহার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। নাক, চিবুকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দৃষ্টি এলোমেলো। ভয়ে জড়োসড়ো কণ্ঠে স্নেহা প্রশ্ন করল” ও কি বেঁচে আছে রাশেদ?”

রাশেদ প্রবল আতঙ্ক নিয়ে বলল,” বুঝতে পারছি না। কিন্তু অনেক ব্লিডিং হয়েছে।”

স্নেহা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ধমক দিয়ে উঠল” আমার সামনে বসে না থেকে আগে চেক করো ও বেঁচে আছে কি-না! তারপর আমাকে দ্রুত জানাও।”

দরজার ওইপাশ থেকে অনেকগুলো হাত একসাথে বল প্রয়োগ করছে। যে কোনো সময় দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকবে ওরা। স্নেহার কণ্ঠমণি শুকিয়ে আসছে। বুক ঢিপঢিপ করছে। হাজার গতিতে ছুটছে হৃৎস্পন্দন। রাশেদ তোহার পালস চেক করল। নাকের কাছে আঙুল নিয়ে বুঝল এখনও শ্বাস চলছে। হাঁফ ধরা কণ্ঠে বলল,” থ্যাংক গড, শী ইজ এলিভ।”

স্নেহাও প্রাণ ফিরে পেল যেন। আরেকটু হলেই মার্ডার কেইসের আসামি হয়ে যাচ্ছিল। মাথায় হাত ঠেঁকিয়ে নিজেকে শান্ত করল। নিজের ক্রোধকে সে এতটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি৷ তোহাকে সে অবশ্যই মে-রে ফেলতে চায় কিন্তু এভাবে নয়। সরাসরি খু-ন করলে আমীর তাকে কখনও মাফ করবে না। বরং স্নেহা এমন কিছু করবে যাতে তোহার মৃ-ত্যু একটা দূর্ঘটনা মনে হয়। স্নেহা স্বাভাবিক হয়ে বলল,” দরজা খুলে দাও রাশেদ।”

রাশেদ আশ্চর্য হয়ে তাকাল,” কি বলছেন ম্যাডাম? মেয়েটাকে এই অবস্থায় রেখে দরজা খুলে দেব?”

“হ্যাঁ। যা বলছি তাই করো।”

রাশেদ দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকল রানুসহ আরও দুইজন। তোহার অবস্থা দেখে সবাই কিংকর্তব্যবিমুঢ়। ওমর বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করল,” ম্যামের এই অবস্থা কি করে হলো?”

স্নেহা দায়সারা কণ্ঠে জবাব দিল,” এক্সিডেন্ট।”

ফয়সাল বলল,” ওমর, ইমিডিয়েটলি এম্বুল্যান্স কল করো। কুইক!”

রানু মুখে হাত দিয়ে কান্না শুরু করেছিল। হঠাৎ স্নেহার দিকে আগুন ঝরা দৃষ্টিতে তাকাল সে,” এক্সিডেন্ট কিভাবে হলো?”

স্নেহা মোটেও ঘাবড়ালো না। নির্বিকার কণ্ঠে বলল,” আমি কি জানি? আমিও তো আপনাদের মতো ওর চিৎকার শুনে এসেছি।”

রানু ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। এমন পরিস্থিতিতেও নির্লজ্জের মতো দাঁড়িয়ে একের পর এক মিথ্যা বলেই যাচ্ছে স্নেহা। রানু কাছে এসে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চড় মা-রল তার গালে। চড়ের দমক সামলাতে না পেরে বিছানায় উল্টে পড়ে গেল স্নেহা। প্রচন্ড বিস্মিত হয়ে তাকাল। রাশেদ তেড়ে এসে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে কৈফিয়ৎ চাইল,” এটা কি করলেন আপনি?”
ওমনি রানু দ্বিগুণ তেজ নিয়ে রাশেদকেও চড় মারল। বিহ্বল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পড়ল রাশেদ। স্নেহা হাত ধরে তাকে শান্ত থাকতে ইশারা দিল। চড়ের প্রতিশোধ সে পরে বুঝে নিবে। আপাতত আগে এই ঝামেলাটা উতরে নেওয়া যাক।

_________
আমীর তার গাড়িতে এসে বসল। শ্বাস রুদ্ধ যন্ত্রণা হয়ে বুকের বামপাশে আটকে আছে একটা তীব্র ব্যথা। গত আটদিনে এই ব্যথা একফোঁটাও কমেনি। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই যেন বাড়ছে। গাঢ় হচ্ছে ব্যথার উৎস। অপরাধবোধ আমীরকে দূর্বল করে দিয়েছে। সে ভেঙে পড়ছে। ভেতর থেকে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। দিনের পর দিন চোখের সামনে নিজের এতোবড় সর্বনাশ দেখার পরেও সে কিছুই করতে পারছে না। বরং বার-বার ছুটে যাচ্ছে সর্বনাশের উৎসের কাছে। মায়ার কাছে! এই বিধ্বংসী অনুভূতির নামই কি তবে ভালোবাসা?

আমীরের ফোন বেজে উঠল। ফয়সালের নাম্বার দেখে বুক পাজরে টান অনুভব করল সে। তোহার কিছু হয়নি তো? ফোন রিসিভ করতেই ওই পাশ থেকে রানুর ক্রন্দনরত কণ্ঠ শোনা গেল,” বাবা আবির, কোথায় তুই? আমরা তোহাকে নিয়ে বারডেমে যাচ্ছি। দ্রুত সেখানে আয়। মেয়েটার অবস্থা খুবই খারাপ।”

” তোহাকে নিয়ে বারডেমে যাচ্ছো মানে? ওর কি হয়েছে?” আমীর অসম্ভব অস্থিরতা অনুভব করল।

রানু ক্রোধে চিৎকার করে বলল,” তোর বউ মেয়েটাকে খু-ন করতে চেয়েছিল। মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে দিয়েছে ওকে।”

আমীরের হৃৎস্পন্দন থেমে এলো এক মুহূর্তের জন্য। স্তব্ধ হয়ে কোনো কথাই বলতে পারল না। রানু এক নাগাড়ে স্নেহাকে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে। আমীর এসব কিছুই শুনতে পেল না। তার স্মৃতিতে ভেসে উঠল ফিরে আসার সময় তোহার সেই অভিমানী মুখটি। মিষ্টি অনুযোগে বলা কণ্ঠটি,” এতোকিছুর পরেও আমাকে একা রেখে চলে যাচ্ছেন? যদি আমার কিছু হয়ে যায়?”

আমীরের দুনিয়া অন্ধকার মনে হলো। ভূমিকম্প শুরু হলো বুকের ভেতর। যদি তোহার কিছু হয়ে যায়…এই ভেবেই নিঃশ্বাস আটকে এলো। প্রচন্ড অস্থিরতায় কাঁপতে লাগল হাত। সে ঠিকমতো স্টেয়ারিং ধরতে পারছে না কিন্তু দিশেহারার মতো ড্রাইভ করতে লাগল। তোহার কিছু হতে দিবে না সে, কিচ্ছু না!

চলবে

®Sidratul মুন্তায

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
২২.
হন্তদন্ত অবস্থায় হাসপাতালে পৌঁছালো আমীর। রানু কাঁদতে কাঁদতে চোখ দু’টো ফুলিয়ে রেখেছে। তার অবস্থা দেখে আমীর আরও ভয়ে অস্থির হয়ে উঠল। তোহার অবস্থা কতটা সিরিয়াস? তুমুল কণ্ঠে প্রশ্ন করল সে,” মায়া কোথায় রানু আন্টি?”

রানু ব্যথিত স্বরে বলল,” ইমারজেন্সী ইউনিটে আছে। এখনও জ্ঞান ফিরেনি। এতো র-ক্তপাত হয়েছে… ডাক্তার বলছিল আরেকটু দেরী করলেই নাকি অবস্থা সিরিয়াস হয়ে যেতো।”

আমীর পাগলের মতো ছুটে গেল ইমারজেন্সী ইউনিটে। কিন্তু সেখানে তাকে ঢুকতে দেওয়া হলো না। আরও পেশেন্ট ছিল। আমীর বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল৷ দূর থেকেই তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে দেখছিল তোহাকে। বুকের বামপাশে কি প্রচন্ড ব্যথা হলো তার! সবকিছু তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে যেন। তোহার নিষ্পাপ মুখটা দেখতে দেখতে নিজেকে আরও বেশি অপরাধী মনে হলো।

ফয়সাল আর ওমর মাথা নিচু করে করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদেরকে দেখা মাত্রই উত্তপ্ত মেজাজ নিয়ে ছুটে গেল আমীর। দরাজ গলায় কৈফিয়ৎ চাইল,” এতোবড় একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেল আর তোমরা কোথায় ছিলে?”

ফয়সাল নিম্নস্বরে বলল,” ঘরের ভেতর থেকে ম্যামের চিৎকার শুনেই আমরা দৌড়ে গেছিলাম স্যার। তারপর দেখি…”

আমীর ক্ষীপ্ত হয়ে বলল,” ছায়ার মতো ওর পাশে থাকতে বলেছিলাম আমি।”

ওমর বলল,” স্যার আমরা বুঝতে পারিনি ঘরের ভেতরেই এমন হবে। স্নেহা ম্যাডামকে আমি সাবধান করেছিলাম। তাও উনি তোহা ম্যাডামের ঘরে ঢুকেছেন।”

আমীর খিটমিট করে তাকাল,” তোমরা ওকে আটকাতে পারলে না?”

” কিভাবে আটকাবো? উনি তো কারো কথা শোনে না…”

আমীর রেগে শক্ত করে ওমরের কলার চেপে ধরল।রাশভারী গলায় বলল,” আমাকে ফোন করতে পারতে। আমি বলেছিলাম না ওর কিছু হলে কাউকে ছাড়ব না?”

রানু ছুটে এলো। আমীরকে থামিয়ে বলল,” ওদের দোষ নেই। বরং ওরাই দায়িত্ব নিয়ে তোহাকে সময়মতো হাসপাতালে এনেছে। কিছু যদি বলতেই হয় তাহলে তোর বউকে গিয়ে বল।”

আমীর তীব্র কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” স্নেহা কোথায়?”

” আমি কি করে জানব? ওর বডিগার্ড জানে।”

আমীর আশেপাশে তাকাল,” কোথায় রাশেদ?”

ফয়সাল জানাল,” একটু আগে রাশেদকে আমি ক্যান্টিনের কাছে দেখেছিলাম স্যার। ”

এমন সময় একজন নার্স এসে জানাল,” পেশেন্ট ভালো আছে। আউট অফ ডেঞ্জার। শুধু একটু ঘুমাবে। আপনারা বেশি টেনশন করবেন না।”

রানু খুশি হলো। স্বস্তিভরা কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” আলহামদুলিল্লাহ।”

আমীর উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল,” দেখা করা যাবে?”

” ঘুমাচ্ছে তো৷ এখন না যাওয়াটাই বেটার। একটু পর ডাক্তার এসে চেক করে গেলে তখন যেয়েন।”

আমীর ইউনিটের বাইরে বসে পড়ল। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে তোহাকে। ঘুমের মধ্যে মুচকি হাসছে সে। রানু ফিসফিস করে বলল,” মেয়েটার জন্য আমার এতো মায়া কেন লাগে বলতো বাবা!”

আমীর ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল,” জানি না রানু আন্টি।”

___________
পবিত্র ঈদের সকাল। অ্যালার্মের শব্দেও ঘুম ভাঙল না তোহার। সে যখন উঠল তখন সকাল সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। ধপ করে বিছানা ছেড়ে নামল। ঈদের নামায আর আধঘণ্টা পরেই শুরু হবে। বাবা রাতে বলেছিল সাতটায় ডেকে দিতে। তাছাড়া এখনও কিছু রান্না করেনি সে। বাবা কি খালি মুখেই ঈদের নামায পড়তে চলে যাবে? ইশ, খুব দেরি হয়ে গেল। অ্যালার্মের শব্দ শুনতেই পায়নি সে। কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়েছিল নাকি? হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে দৌড়ে গেল তোহা। খুব সুন্দর সুঘ্রাণ ভেসে আসছে। তোহা দেখল চুলার উপর ফিরনির পাত্র বসানো। আরে, ফিরনি কে রান্না করেছে? বাথরুম থেকে শাওয়ারের শব্দ পাওয়া গেল। বাবা তাহলে ঘুম থেকে আগেই উঠে গেছেন। ঈদের দিনেও তোহা বাবার আগে উঠতে পারল না। তার কিছুটা লজ্জা লাগছে। সে ভেবেছিল নিজহাতে বাবাকে ফিরনি রান্না করে খাওয়াবে। কিন্তু কি হলো?

তার হাতের মেহেদী লেপ্টে গেছে। তবে বেশ ভালো রঙ হয়েছে। এই মেহেদী দেওয়ার চক্করেই রাতে দেরী করে শুয়েছিল। ধূর, বিরক্ত লাগছে এখন।

জাবিদ সাহেব নতুন পাঞ্জাবী পরে গায়ে সুগন্ধি মেখে জায়নামায নিয়ে বের হয়েই দেখলেন তোহা টেবিলে ফিরনি সার্ভ করছে। তিনি অবাক হয়ে বললেন,” কিরে, তুই উঠলি কখন মা?”

তোহা অভিমানী স্বরে বলল,” আমাকে তুমি কেন ডাকলে না বাবা? ফিরনি কিন্তু আমার রান্না করার কথা ছিল।”

জাবিদ সাহেব স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বললেন,” তুই এমনভাবে ঘুমিয়ে ছিলি, আমার ডাকতে মায়া হচ্ছিল। তাই ভাবলাম আমিই রেঁধে ফেলি। চিন্তা করিস না,একদম তোর পছন্দমতোই তো রান্না করেছি৷ কিশমিশ দেইনি। কাঠবাদাম আর কাজু দিয়েছি। ঘিও দিয়েছি৷ ”

তোহা হাসতে হাসতে বলল,” তুমি যেভাবেই রাঁধো, আমার ভালো লাগবে বাবা। কিন্তু আমি মনখারাপ করছি অন্য কারণে।”

” কি কারণ?”

” ভেবেছিলাম আমার হাতে রান্না করা ফিরনি খেয়ে তুমি নামায পড়তে যাবে।”

” তাহলে রাতেই রান্না করে ফেলতি।”

” তুমি তো ফ্রীজের জিনিস খাও না বাবা। ঠান্ডা খেলে তোমার সমস্যা হবে না! এই ভেবে অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ভোরে উঠে রাঁধবো৷ কিন্তু উঠতেই পারলাম না।”

” আচ্ছা অসুবিধা নেই। সময় কি চলে গেছে? দুপুরের রান্না তুই করিস। পেঁয়াজ-মরিচ আমি কে-টে রেখেছি। মশলাও বাটা আছে ফ্রীজে। তুই শুধু রান্না চড়িয়ে দিবি।”

তোহা মিষ্টি করে হাসল৷ পেঁয়াজ কাটলে তার চোখ জ্বালা করে। বাবা সেটা দেখতে পছন্দ করেন না। তাই তিনি কখনও তোহাকে পেঁয়াজ কা-টতে দেননি। কিন্তু তোহার সবসময় ইচ্ছে করে বাবাকে রেঁধে খাওয়াতে। জাবিদ সাহেব তাই সময় পেলেই পেঁয়াজ কেটে ফ্রীজে রেখে দেন৷ তোহার যখনি রান্না করতে ইচ্ছে হয়, সে কেটে রাখা পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করে।

কাঁচের বাটিতে একটু ফিরনি নিয়ে জাবিদ সাহেব বললেন,” টেস্ট করে দ্যাখ মা, কেমন হয়েছে?”

তোহা বাবার মুখের দিকে তাকালো। তিনি খুব চিন্তায় আছেন। ফিরনি তোহার মনের মতো হলো কি-না এই ভেবে বিচলিত বোধ করছেন। বাবার টেনশন কমাতে তোহা ফিরনি মুখে নিল। তারপর চোখ বুজে বলল,” অসাধারণ। আমি এতো মজার ফিরনি কখনও খাইনি।”

” তাই নাকি? ভোরবেলা উঠে রান্না করাটা স্বার্থক তাহলে।” জাবিদ সাহেবের চোখ-মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

তোহা বাবার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলল, “ঈদ মুবারক, বাবা।”

” ঈদ মুবারক, মামনি।”

কিছুক্ষণ বাবার প্রিয় মুখটির দিকে চেয়ে থেকে সে আবেগী কণ্ঠে বলল,” আমার জীবনে তুমি কখনও কিছুর অভাব হতে দাওনি। মাঝে মাঝে তো আমি ভুলেও যাই যে আমার মা নেই। ছোটবেলায় তুমি এই নিয়ে খুব আফসোস করতে৷ মা না থাকায় আমার কষ্ট ছিল না। কিন্তু তোমার অনেক কষ্ট ছিল। এখন একটা কথা ভেবে দেখো তো, আমার সব বন্ধুদের মা আছে। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি ঈদের দিন সকালে কারো মা এতো যত্ন করে বসিয়ে নিজের হাতে তুলে ফিরনি খাইয়ে দিবে না। ”

তোহা কাঁদছে। জাবিদ সাহেব তার চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন,” আমার মা, আমার লক্ষী মা!”

তোহা বাবার হাতটা নিয়ে চুমু দিয়ে বলল,” আমি অনেক ভাগ্যবতী বাবা। যার তোমার মতো বাবা আছে তার মায়ের কোনো দরকারই নেই৷ আমি শুধু তোমার সাথে থাকতে চাই বাবা। তুমি আমার পৃথিবী।”

জাবিদ সাহেবের হাস্যোজ্জ্বল মুখ হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল। তোহা চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” শুধু আমাকেই তো খাওয়ালে। তুমি খাবে না? এসো বাবা আমি তোমাকে খাইয়ে দেই এবার।”

জাবিদ সাহেব হাত বাড়িয়ে বাঁধা দিলেন,” আমি খাবো নারে মা।”

” কেন বাবা? সকাল সকাল খালি পেটে নামাযে চলে যাবে? তোমার ক্ষিদে পাবে না?”

” মৃত মানুষের ক্ষিদে পায় না।”

খুব শীতল আর নিদারুণ শোনালো জাবিদ সাহেবের কণ্ঠ। তোহার হাত থেকে চামচটা পড়ে গেল৷ কিছুক্ষণ নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে শুধালো,” এসব তুমি কি বলছো বাবা?”

জাবিদ সাহেব উঠে দাঁড়ালেন৷ আচমকা তার চারদিক কেমন ধোঁয়াময় হয়ে উঠেছে৷ তোহা বাবার মুখটা ঠিক-ঠাক দেখতে পাচ্ছে না৷ বুকে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে তার। বাবা কি তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে?

তোহাও উঠে দাঁড়ালো। ব্যাকুল কণ্ঠে বলল,” আমাকে ছেড়ে যেও না বাবা। আমি একা একা কিভাবে থাকব? আমার ভীষণ কষ্ট হবে। আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি। তোমাকে না দেখলে আমি ম-রে যাবো।”

জাবিদ সাহেব ভেজা কণ্ঠে বললেন,” একদম এসব কথা বলবি না। আমার সময় শেষ তাই আমি চলে যাচ্ছি। তুই আরও অনেক দিন বাঁচবি। বিয়ে করবি, তোর সংসার হবে। বাকি জীবনটা তোর আমাকে ছাড়াই কাটাতে হবে। বাবা-মা কারো সারাজীবন বেঁচে থাকে না।”

তোহা চিৎকার করে বলল,” বাবা আমি তোমাকে যেতে দিবো না। আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। প্লিজ বাবা, তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না।”

তোহা যতই আর্তনাদ করুক। প্রকৃতির নিয়ম বদলাবে না। একবার যারা চলে যায়, তারা আর ফিরে আসে না। জাবিদ সাহেবও ফিরে আসবেন না। যে আদরের মেয়ের কান্না শুনলে একসময় সব ব্যস্ততা তুচ্ছ করে ছুটে আসতেন সেই মেয়ের তীব্র হাহাকার শুনেও তিনি আজ কিছু করতে পারবে না৷ বড় নিষ্ঠুর এই নিয়ম।

________
তোহা ছটফট করছে৷ তার কান্না শুনে আমীর দ্রুত ভেতরে ঢুকল। নার্স বললেন,” কাছে আসবেন না। পেশেন্ট ঘুমাচ্ছে। মাথাব্যথার জন্য এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে তাছাড়া অনেক রক্তক্ষরণ হওয়ায় শরীর দূর্বল। উনার এখন অনেক ঘুম দরকার।”

” আমি কোনো কথা বলব না। শুধু পাশে গিয়ে বসব। ও কাঁদছে কেন সেটা দেখব।”

” হয়তো দুঃস্বপ্ন দেখে কাঁদছে। ওয়ার্ডে অন্য পেশেন্টও আছে। আপনি বসে থাকলে অন্যদের সমস্যা হতে পারে। প্লিজ যান এখান থেকে।”

আমীর কঠিন গলায় বলল,” আমি যাব না কোথাও।”

” আশ্চর্য তো!”

আমীর দৃঢ় কণ্ঠে বলল,” আমি ওর পাশে বসব।”

রানু আমীরের আচরণ দেখে হেসে ফেলল। সে জানতো তোহার প্রতি আমীরের বিশেষ দূর্বলতা আছে। সেটা আমীরের তাকানো দেখলেই বোঝা যায়। ছোটবেলা থেকে যাকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে তার মনের কথা রানু বুঝবে না? তা কি হতে পারে? একটু কাছে এসে রানু কোমল গলায় বলল,” ওকে ভেতরে থাকতে দিন প্লিজ। পেশেন্টের সাথে একজন তো থাকা দরকার। ”

নার্স বলল,” আমি তো আছি পেশেন্টের সাথে।”

” তবুও ওকে যেতে দিন।”

নার্স হার মেনে বলল,” ঠিকাছে থাকুন। কিন্তু শুধু একজনই।”

আমীর ত্বরিত গতিতে ভেতরে ঢুকল। তোহার বিছানার পাশে ঝুঁকে দাঁড়ালো। এতোক্ষণ বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছিল তোহা। আচমকা দুঃস্বপ্ন দেখেই কেঁদে উঠল। ‘বাবা- বাবা’ বলে আর্তনাদ করতে লাগল। আমীর তোহার একটা হাত ধরে মৃদু কণ্ঠে ডাকল,” মায়া।”

তোহা মুখ ভেঙে কেঁদে উঠল,” বাবা।”

আমীরের বুকের ভেতর উথাল-পাথাল শুরু হলো। পুড়ে যাচ্ছে ভেতরটা। কাতর কণ্ঠে বলল,” মায়া,ভয় নেই৷ আমি আছি।”

তোহা উতলা হয়ে বলল,” বাবা, আমার বাবা!”

আমীরের চোখ দিয়ে এবার নির্গত হলো অশ্রু। মুহূর্তেই চশমা ঝাপসা হয়ে উঠল। চোখ থেকে চশমাটা টেনে খুলে নিল। সিক্ত দৃষ্টিতে ভীষণ চাপা কষ্ট আর তীব্র অপরাধবোধে জ্বলতে জ্বলতে উচ্চারণ করল,” আই এম স্যরি।”

তোহা একমনে আর্তনাদ করে গেল,” বাবা, যেও না বাবা। যেও না প্লিজ। এই পৃথিবীতে তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই।”

আমীর আলতো হাতে তোহার চোখের কার্ণিশ মুছে দিতে দিতে বলল,” কেঁদো না মায়া, প্লিজ!”

তোহা ঘুমের মাঝেই মুঠো করে আমীরের হাতটা চেপে ধরল, খুব শক্ত করে। এখানে বসার কোনো জায়গা নেই। আমীর নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একদম নড়ল না। তোহার ঘুমন্ত মুখটা দেখে যে একটা সুখ সুখ অনুভূতি তার হচ্ছে সেই অদ্ভুত ভালো লাগাটা পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যাবে না। এই সুখ শুধু তোহার কাছেই আছে। তার ওই নিষ্পাপ মায়াবী মুখটাই সকল সুখের উৎস!

_____________

চলবে

‌®Sidratul Muntaz