#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৩২.
নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে এয়ারপোর্টে বসে আছে আমীর। তার শূন্য মন ক্ষণে ক্ষণেই বিদ্রোহ করে উঠছে, কেন যেতে দিল? তাকে তো বেঁধে রাখার কথা ছিল নিজের কাছে।
একঘণ্টাও পার হয়নি তোহা যে চলে গেছে। এর মধ্যেই আমীরের মনে হচ্ছে শত সহস্র বছর যেন কেটে গেছে। কে তোহা? কেন সে এতো প্রভাব নিয়ে আমীরের হৃদয়ে বিচরণ করছে? কি অদ্ভুত! তোহাকে সে চাইলেই আর দেখতে পারবে না ভেবে এখন থেকেই শ্বাসকষ্ট অনুভব হচ্ছে। বাকি সময়গুলো কিভাবে পার করবে সে? আমীরের খুব অর্থহীন লাগছে জীবনটা। মনে হচ্ছে তার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যই ফুড়িয়ে গেছে।
সে ফোন থেকে তোহার ছবি বের করে তাকিয়ে রইল।জাবিদ সাহেবের ফোনে তোহার অনেক ছবি ছিল৷ সে প্রথমে চিন্তা করেছিল ফোনটাই নিজের কাছে রেখে দিবে। তারপর এই ফোন পেলে তোহা খুশিতে কি করে তা দেখার খুব আগ্রহ জন্মালো। তাই সে ছবিগুলো নিজের ফোনে ট্রান্সফার করে মোবাইলটা তোহাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। বাবার মোবাইল হাতে নেওয়ার পর তোহার চোখ দু’টো খুশিতে ঝলমল করছিল। সে আমীরকে সর্বোচ্চ দশসেকেন্ডের জন্য জড়িয়ে ধরেছিল…তাতেই আমীরের মনে হয়েছে সে জীবনের সর্ব সুখ পেয়ে গেছে!
উঠে দাঁড়াতেই বুকের একপাশে ব্যথা অনুভব করল আমীর। তার বুকপকেটে তোহার একটা কানের দুল। এটির ধারেই বুকে আঘাত লেগেছে, হালকা র-ক্ত বের হচ্ছে।সে তোহাকে কোলে নেওয়ার সময় খুব সতর্কতার সাথে দুলটি তার কান থেকে চুরি করেছিল। এই দুলটাই তোহার একমাত্র স্মৃতি হয়ে কাছে থাকবে। তোহা তো দূরে চলে গেছে! সে দুলটায় চুমু দিল আর তখনি মিষ্টি একটা আবেশে মন ভরে উঠল। আমীর মৃদু হেসে দুলটা আবার বুকপকেটে গুঁজে রাখল। দুলের ধারালো খোচায় বুক ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেলে যাক; তাও এটি এখানেই থাকবে, সযত্নে গচ্ছিত থাকবে।
গোল জানালা থেকে সাদা মেঘে আবৃত নীল আকাশটাকে সমুদ্র বলে ভ্রম হচ্ছে। খন্ড খন্ড মেঘরাশিকে মনে হয় ফেনীল ঢেউ। নিচের দিকে তাকাতেই পুরো শহর দৃশ্যমান হলো। যেন সমুদ্রের তলদেশে লুকানো কোনো গুপ্তরাজ্য এটি। এতো সুন্দর কেন লাগছে শহরটা! ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলে? তোহার বুক ধুকপুক করে উঠল। একটা কান্নার ঢেউ গলার কাছে আটকে আছে। সে ব্যাগ থেকে বাবার মোবাইলটা বের করল। ফোনের ওয়ালপেপারে নিজের হাসি মাখা মুখের ছবি দেখে ফুপিয়ে কেঁদে ফেলল। বাবা তাকে এতো ভালোবাসতেন যে নিজের বিছানার পাশেও তোহার ছবি রাখতেন। তার কান্নার শব্দে পাশের যাত্রী অবাক হয়ে তাকালেন। তিনি একজন বয়স্ক বিদেশী মহিলা। ইংরেজিতে জানতে চাইলেন,” তোমার কি হয়েছে?”
তোহা চোখের জল মুছে বলল,” আমি আমার বাবাকে খুব মিস করছি তো, তাই।”
ভদ্রমহিলা আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন,” আহারে, উনি তোমাকে সিঅফ করতে আসেননি?”
” না, উনি এই দুনিয়ায় নেই। কিভাবে আসবেন?”কথাটা বলে চোখে হাত রাখল তোহা। ভিজে আসছে তার দৃষ্টি। ভদ্রমহিলা তোহার মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।তোহার চোখমুখের রঙ হঠাৎ বদলে গেল। সে ক্রোধ নিয়ে উচ্চারণ করল,” এক নিকৃষ্ট জানোয়ার উনাকে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে!”
ভদ্রমহিলা বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইলেন,” ওহ গড! তোমার বাবার সাথে কি হয়েছিল?”
তোহা আগ্রহ নিয়ে তার বাবার গল্প বলতে লাগল৷ সে কথা বলতে ভালোবাসে। আর আলোচনার মূল বিষয় যদি বাবা হয়, তাহলে তো কথাই নেই। তোহার আলোচনা কোনোদিন শেষ হবে না। বাবাকে নিয়ে গল্প করতে তার আগ্রহে কখনও ভাটা পড়বে না। ভদ্রমহিলা তোহার গল্প খুব উৎসাহ নিয়ে শুনছিলেন। মিষ্টি একটা মেয়ে কি অদ্ভুত সুন্দর ভঙ্গিতে গল্প বলে যাচ্ছে। হঠাৎ তিনি খেয়াল করে বললেন,” তোমার কানের একটা রিং মনে হয় পড়ে গেছে।”
সাথে সাথেই তোহা নিজের কানে হাত রাখল। ছ্যাৎ করে উঠল তার বুকটা। আসলেই একটা দুল নেই। সে অস্থির হয়ে দুল খুঁজতে লাগল৷ এয়ারপোর্টে কোথাও পড়ে যায়নি তো? তাহলে আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়৷ তোহার মনটা ভার হয়ে এলো। এই স্বর্ণের দুলজোড়া ছোটবেলায় বাবা গড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে তার কানের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। তোহা কখনও হারাতে দেয়নি। আর আজ কি সহজেই একটা দুল হারিয়ে ফেলল! এমনটা কেন হলো?
______________
একটা নীরব জায়গায় এসে আমীর গাড়ি থামালো। তার সিটের সিকরেট পকেটেই ফীহার ডায়েরী। ঘরে বসে ডায়েরীটা পড়ার সুযোগ হয়নি বলে সে এই মুহূর্তে পড়বে বলে মনস্থির করল। তার মনে হয় ডায়েরীটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু স্নেহা এটা তোহাকে পড়তে দিয়েছে তার মানে নিশ্চয়ই তার কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্য তোহা না বুঝলেও আমীর অবশ্যই বুঝবে।
ডায়েরীটা হাতে নিতেই পুনরায় তোহার কথা মনে পড়ে গেল। এই ডায়েরীতেও তোহার ছোঁয়া লেগে আছে!
ডায়েরী থেকে-
আমীর স্যারের সাথে স্নেহা আপুর বিয়ের কিছুদিন পরেই বাবা মা-রা গেলেন৷ বাবার মৃত্যুতে আমি প্রচন্ড আঘাত পেলাম৷ ভালোবাসার মানুষ হারানোর দুঃখ, বড় আপুর অত্যাচার, বাবার মৃত্যু সব মিলিয়ে আমার জীবনটা বিষণ্ণতায় ভরে উঠল। এমন অবস্থায় মা আমাকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু আমি বিয়েতে রাজি না। বিয়ে যাতে করতে না হয় সেজন্য একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই। আমার যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। ঢাকায় গিয়ে আমি আমীরস্যারের সাথে যোগাযোগ করলাম। তাকে জানালাম আমি বিয়ে করতে চাই না। পড়ালেখা শেষ করতে চাই। মা এসব মানছে না। আমার মায়ের মধ্যেও স্নেহা আপুর মতো কিছু একগুঁয়ে বৈশিষ্ট্য ছিল৷ তারা দু’জনই এক ইশারায় পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। মনের মতো কিছু না ঘটলেই প্রকাশ পায় তাদের হিংস্রতা।
আমীর স্যার পুরো পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরে আমাকে তার নিজস্ব একটা ফ্ল্যাটে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। অবশ্যই আপু এসবের কিছু জানতো না। এখানে আমার সময়গুলো বেশ ভালো কা-টছিল। কিন্তু আগেই বলেছি, আমি ভীষণ অভাগী। কচুপাতায় যেমন পানির বিন্দুটুকুও স্থায়ী হয় না তেমনি আমার ভাগ্যেও সুখের বিন্দুটুকু স্থায়ী হয় না৷
সেই রাতে আমি কোচিং শেষ করে রাত আটটায় বাড়ি ফিরেছি। বাতি জ্বালাতেই দেখলাম স্নেহা আপু আমার বিছানার উপর বসে আছে। তাকে দেখে আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলাম৷ ভয়ে রীতিমতো কাঁপতে লাগল আমার হাত-পা। স্নেহা আপু এসবের কিছুই তোয়াক্কা না করে হাসিমুখে জানতে চাইল,” কিরে, কেমন আছিস?”
আমি ভয়ে আড়ষ্ট গলায় উত্তর দিলাম,” ভালো। তুমি হঠাৎ এইসময়?”
” তোকে দেখতে এলাম। আমার ছোটবোন কত বড় হয়ে গেছে। সে এখন ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবে! তুই বিয়ে ক্যান্সেল করেছিস শুধু লেখাপড়ার জন্য? লেখাপড়া নিয়ে তোর এতো সিনসিয়ারিটি দেখে আমি কি যে খুশি হয়েছি! তুই ব্যাপারটা আমাকে বললেও পারতি। আমি কি তোকে হেল্প করতাম না? তুই তো আমার সাথে আমার বাড়িতেই থাকতে পারতি। এখানে একা থাকার কি দরকার ছিল? তোর কষ্ট হয়ে যায় না?”
আমার ভয় বেড়ে গেল। স্নেহা আপু হাসিমুখে কথা বলছে মানে পরিস্থিতিটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কারো সাথে হাসিমুখে কথা বলার মেয়ে সে নয়। আর আমার সাথে তো নয়ই। আমি তার কথায় কোনো উত্তর দিচ্ছি না দেখে সে উদাস হয়ে বলল,” এমনিতে তো আমীর কখনও আমার ঘরে আসে না। তুই থাকলে ও প্রতিদিন আসতো। যেমন এখানে আসে।”
আমার গা শিরশির করে উঠল। ঢোক গিলে বললাম,” এসব কি বলছো আপু? উনি এখানে কখনও আসেন না।”
স্নেহা আপু ভ্রু কুচকে আমার দিকে চাইল। কাছে এগিয়ে এলো। আমি ভয়ে পিছিয়ে গেলাম কয়েক পা। মন চাইছে দরজা খুলে একছুটে বেরিয়ে যাই। চিৎকার করে সবাইকে ডেকে আনি। কিন্তু সেই সাহসটাও পাচ্ছি না।
সে একদম আমার কাছে ঝুঁকে এসে উন্মাদের মতো প্রশ্ন করল,” আসে না মানে? নিশ্চয়ই আসে। মিথ্যা বলছিস কেন? সত্যি কথা বল, ও এখানে কয়দিন থেকেছে? তোকে আদর করেছে? কয়বার আদর করেছে, বল? ”
আমার দম বন্ধ হয়ে এলো। চোখ বড় করে তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। তার প্রশ্ন শুনে আমি বাকরুদ্ধ।সে আমার পেট খামচে ধরে বলল,” কথা বলছিস না কেন? নষ্টামি করে পেট বাঁধিয়ে ফেলিসনি তো?”
আমি ডুঁকরে কেঁদে ফেললাম,” এসব তুমি কি বলছো আপু? দোহাই লাগে, এমন কোরো না।”
আমার কথা শেষ হতেই সে আমার চুলের মুঠি টেনে ধরে মাথাটা নির্দয়ের মতো দেয়ালে ঠোঁকাতে লাগল৷ অশ্লীল ভাষায় এমন সব কথা বলতে লাগল যা কাগজে লেখা অন্তত আমার দ্বারা সম্ভব নয়। এক পর্যায় সে ক্লান্ত হয়ে আমায় ছেড়ে দিল৷ আমার অবস্থা তখন অর্ধচেতনের মতো। কিছু চিন্তা করতে পারছি না, সব অন্ধকার লাগছে। আপুর গলা শুনতে পেলাম। সে আমার জামা টেনে ছিঁড়ে ফেলল৷ আমার গায়ে আঁচড় কাটতে লাগল। আমি ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আমার কপাল থেকে শুরু করে সারা শরীর র-ক্তে ভরে গেছে তা উপলব্ধি করতে পারছি। কিছু বলতে পারছি না কেবল। চিৎকার করার শক্তিটুকুও আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। সেদিনই আমার ম-রে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত বেঁচে গেছি।
সকালে আমীরস্যারকে কিছু না জানিয়েই আহত অবস্থায় পালিয়ে নিজের গ্রামে ফিরে আসি। মাকে জানিয়ে দেই, বিয়ে করব। সব ভেজাল আমার জন্য লেগেছে। তাই নিজেই সবকিছু ঠিক করতে চাইলাম৷ যাতে আমীরস্যার অন্তত ভালো থাকে। আমার মতো তার জীবনটাও নরক হয়ে যাক তা আমি কি করে হতে দেই? হয়তো আমার বিয়ে হলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। মা অনতিবিলম্বে বিয়ের আয়োজন শুরু করল।
দুইদিন পর আমার বিয়ে। গায়ে হলুদের আগের দিন জানতে পারলাম ছেলে নেশাখোর। আগেও একবার বিয়ে হয়েছিল। বউ টেকেনি৷ আমার বিয়েটা ভেঙে গেল। আমীরস্যার মায়ের সাথে কথা বলল যাতে এখনি আমাকে বিয়ে না দেওয়া হয়। তার কথায় কনভিন্স হয়ে মা আমাকে পড়ালেখা করার সুযোগ দিল। আর এই বিষয়টা আপু মানতে পারল না।
আমার সাথে ওই ঘৃণ্য কান্ডের কথা জানার পর আমীর স্যার আপুকে ডিভোর্স দেওয়ার কথাও চিন্তা করেছিল একবার। কিন্তু সেটা করলেও বিপদ হতো আমার। আপু আরও হিংস্র হয়ে উঠতো আমার উপর। তাই আমীরস্যার চেষ্টা করেছিল আমার জন্য একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজবে যাতে আমি কখনও আপুর কবলে না পড়ি। কিন্তু আমি সেটা চাইছিলাম না। বরং আমি তো নিজের আপুর কবল থেকে আমীরস্যারকে বাঁচাতে উদগ্রীব ছিলাম। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করতো আপুকে মে-রে ফেলি। আমীর স্যার চাইলেই আপুকে খু-ন করতে পারতো। তার সেই ক্ষমতা ছিল। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সে আপুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল। আর সবচেয়ে আফসোসের ব্যাপার হলো, আমীর স্যার মেয়েদের হ-ত্যা করে না। হয়তো ছোটবেলায় নিজের মায়ের নিষ্ঠুর মৃ-ত্যুর সাক্ষী হওয়ার পর তার মধ্যে এমন মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে। সে কোনো নারীর আর্তনাদ সহ্য করতে পারে না!
বিয়ে ভাঙার পর থেকে আপুর অত্যাচার আমার প্রতি আরও বেড়ে গেল। মাও সুযোগ পেলেই খোঁটা দিতো আমি নাকি ঢাকায় থেকে আমীর স্যারের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছি। নিজের বোনের সংসার ভাঙতে উঠে-পরে লেগেছি৷ এগুলো সত্যি হলেও আমি নিজেকে সৌভাগ্যবতী ভাবতাম। অন্তত আমীরস্যার তো আমাকে ভালোবাসতো! কিন্তু মানুষটা কখনও আমাকে ভালোই বাসল না। সে আমাকে বলেছে, আমি নাকি তার ছোটবোন। কারো বোন হওয়া এতো বিষাদের ব্যাপার হতে পারে তা আমি আগে জানতাম না।
মায়ের কাছে দিন-রাত নিজের নামে জঘন্য অপবাদ শুনে আমি খুব কাঁদতাম। মাঝে মাঝে মন চাইতো আত্ম-হত্যা করি, ম-রে যাই। আমার জীবনটা দিন দিন জাহান্নামে পরিণত হচ্ছিল।
তারপর আর কোনো লেখা নেই৷ আমীর শেষ পাতার তারিখ লক্ষ্য করল। এর দুইদিন পরেই ফীহার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। সবাই সেটাকে আত্মহত্যা বলেই জানে। কিন্তু আমীর তা মানতে পারেনি। ফীহা আত্মহত্যা করার মেয়ে নয়। সে এই ব্যাপারে তদন্ত শুরু করল। পরে স্নেহা নিজেই স্বীকার করে নিল যে সে ফীহাকে খু-ন করেছে! তার যুক্তিতে এটা ভালোবাসা। কিন্তু আমীর জানে, ভালোবাসা নয়৷ এটা ক্রোধ, প্রতিহিংসা!
ডায়েরীটি বন্ধ করে কিছুসময় আমীর শান্ত হয়ে চিন্তা করল, এই ডায়েরী স্নেহার কাছে কি করে এলো? হয়তো ফীহাকে খু-ন করার আগে ডায়েরীটা পড়েছিল সে। তাই ফীহার মৃত্যুটাকে আত্মহত্যা সাজানোর যথার্থ চেষ্টা করেছে। সবকিছু এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যে লাশ দেখলে আর ডায়েরী পড়লে মানুষ বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে যে এটা আত্মহত্যা। স্নেহা অস্বাভাবিক ঠান্ডা মাথায় কাজগুলো করেছে৷
এতো ঠান্ডা মাথায় কেউ খু-ন করতে পারে না। কিন্তু পৃথিবীতে কেউ নিখুঁতভাবে অন্যায়ও ধামাচাপা দিতে পারে না। স্নেহার নিখুঁত পরিকল্পনায় কোনো অবিচ্ছিন্ন খুঁত নিশ্চয়ই আছে।
________________
দুইদিন ধরে আমীরের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। স্নেহা পাগলপ্রায়! সর্বক্ষণ আমীরের উপর নজরদারি করার জন্য একজনকে রেখেছে সে। দীর্ঘ তিনমাস ধরে আমীর কোথায় যায়, কি করে, সবকিছুর খবর স্নেহাকে জানায় লোকটি। তাকে গতকাল সকালে আহত অবস্থায় জঙ্গলের কাছে পাওয়া গেছে। সে আমীরের কোনো খোঁজ দিতে পারল না। সরবেরও কোনো খোঁজ নেই৷ তোহা যে ইটালি চলে গেছে সেই ব্যাপারে স্নেহা নিশ্চিত হয়েছে৷ কিন্তু আমীর বাড়ি কেন ফিরছে না তা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। চিন্তায় অস্থির থাকতে হচ্ছে সর্বক্ষণ।
অবশেষে স্নেহার অপেক্ষার অবসান ঘটল। রাতে আমীর ফিরল। খুব দেরি করেই ফিরল৷ স্নেহা তাকে দেখে উত্তেজনায় দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল। কণ্ঠে উদ্দীপনা ঢেলে প্রশ্ন করল,” কোথায় ছিলে? ফোন কেন বন্ধ তোমার? আমি কি পরিমাণ টেনশনে ছিলাম সেটা কি জানো?”
আমীর মৃদু হেসে তাকাল। স্নেহার গালে হাত রেখে বলল,” এইতো চলে এসেছি। আর টেনশন করার কিছু নেই।”
আমীরের কণ্ঠের কোমলতা স্নেহাকে চমকে দিল। সে বিস্ময় নিয়ে উচ্চারণ করল,” তোমার কি হয়েছে?”
” কিছু না। জাস্ট তোমাকে মিস করছিলাম।”
আমীর এই কথা বলতে বলতে নিজের বেডরুমের দিকে গেল। স্নেহা এক মুহূর্ত স্থবির হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল৷ তার মাথা ঝিমঝিম করছে। আমীর কি বলল এটা? সে মিস করছিল তাও আবার স্নেহাকে? কোনো স্বপ্ন নয়তো? স্নেহা ছুটে গিয়ে বলল,” তুমি কি আমার সাথে ইয়ার্কি করছো?”
আমীর সিরিয়াস গলায় বলল,” আমরা লাইফ নিয়ে অলরেডি যথেষ্ট ইয়ার্কি করে ফেলেছি। আর না স্নেহা, এখন থেকে আমরা শুধু ভালো থাকব।”
” মানে? কি বলতে চাও?”
“বসো, বলছি।”
স্নেহাকে ঘরে বসিয়ে রেখে আমীর বাথরুমে গেল ফ্রেশ হতে। স্নেহা আমীরের কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করতে লাগল। দুইদিন ধরে সে গায়েব ছিল। এর পেছনে অবশ্যই কোনো রহস্য আছে। স্নেহা ধরতে পারছে না কিছুতেই। আমীরের মতলবটা কি আসলে?
খোশমেজাজে গোসল সেরে বের হলো আমীর। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে স্নেহার পাশে বসল৷ স্নেহা বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। মেন’স শ্যাম্পুর চমৎকার গন্ধে ঘর ভরে উঠেছে। তার কেমন নেশা ধরে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে আমীরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তে। আমীর স্নেহার গা ঘেঁষে বসল। হৃষ্টচিত্তে বলল,” আমি আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে অনেক চিন্তা করেছি। এভাবে হচ্ছে না স্নেহা। আমাদের নতুন কিছু ভাবা উচিৎ। ”
স্নেহার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। সে কণ্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বলল,” আবার ডিভোর্সের কথা বলতে চাও? তাহলে আমি শুনব না। আমি জানতাম তোহা চলে যাওয়ার পর তুমি এটাই করবে। কিন্তু আমি তোমাকে কোনোভাবেই ডিভোর্স দিতে দিবো না আমীর। তুমি যা খুশি করো…”
স্নেহা কথা বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। আমীর তার হাত টেনে ধরল৷ তাকে নিজের কাছে বসিয়ে নরম করে বলল,” আমার কথা শোনো, প্লিজ। আগেই ট্রিগারড হয়ে গেলে আমি ভালো কথা বলব কিভাবে?”
স্নেহা আশংকা নিয়ে বলল,” তোমার কাছে যেটা ভালো কথা আমার কাছে সেটা বাজে কথা। তুমি কি বলতে চাও ক্লিয়ারলি বলো।”
আমীর না হেসে থাকতে পারল না। স্নেহার চুলে হাত বুলিয়ে বলল,” আরে পাগলি, আমি তোমাকে আবার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন বলো এটা কি বাজে কথা?”
” কি?” স্নেহা পুরো বোকার মতো তাকাল। তার ঠোঁট দু’টো আলাদা হয়ে গেল।
” বিয়ের সময় তুমি প্রেগন্যান্ট ছিলে। ওই অবস্থায় আমাদের বিয়ে বৈধ হয়নি৷ রানু আন্টিও তাই বলে। সেজন্য আমি ঠিক করেছি আবার বিয়ে করে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করব। আগের সব ভুল শুধরে নিবো।”
স্নেহা অবিশ্বাসের কণ্ঠে বলল,” মিথ্যা কথা৷ নিশ্চয়ই তুমি মনে মনে অন্যকিছু ভাবছো। সত্যি করে বলো, তোমার উদ্দেশ্য কি? আমাকে বোকা পেয়েছো?”
আমীর স্নেহার কোমড়ের উপর হাত রাখল। তার ঠোঁটে খুব আলতো করে চুমু দিয়ে বলল,” সব ঠিক হয়ে যাবে, সুইটহার্ট। আই প্রমিস!”
স্নেহার মনে হলো সে এখনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। একবার মনে হচ্ছে এইসব অভিনয়। আমীরের নতুন কোনো পরিকল্পনার অংশ। আবার পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে, যদি সব সত্যি হয়! তার জীবনটা কি বদলে যেতে পারে না? স্বপ্নগুলো কি সত্যি হতে পারে না? স্নেহা আর কিছু ভাবতে পারল না। মোহগ্রস্তের মতো আমীরের কাছে গেল। পুনরায় কিস করল। আমীরও বাঁধা দিল না। স্নেহাকে কাছে টেনে নিল। তৃপ্তিতে স্নেহার দুই চোখ ভিজে আসছিল। মেঘের মতো নরম আর শীতল অনুভূতিতে মন ভরে যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরেই স্নেহা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আমীর বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
দরজার কাছে গিয়ে নূরজাহানকে ডাকল। দ্রুত পায়ে ছুটে এলো নূরজাহান।
“কি হয়েছে স্যার?”
আমীর বিছানার দিকে ইশারা করে বলল,” তোমার ম্যাডামের ড্রেস চেঞ্জ করে দাও।”
নূরজাহান বিচলিত হলো। জানতে চাইল,” ম্যাডামের কি হয়েছে?”
আমীর কঠিন গলায় বলল,” যা বলেছি চুপচাপ সেটা করো।”
নূরজাহান কপালে ভাঁজ নিয়ে তাকিয়ে রইল। দ্বিধান্বিত সে। স্নেহার ড্রেস কেন চেঞ্জ করবে? ড্রেস চেঞ্জ করার মতো কিছু হয়নি! তাকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমীর বলল,” তোমার ছোটবোন প্রি ক্যাডেটে পড়ে না?”
নূরজাহান একটু অবাক হয়ে মাথা নাড়ল। আমীর খোশমেজাজে বলল,” এখন থেকে ওকে চোখে চোখে রেখো। পৃথিবীতে খারাপ মানুষের অভাব নেই। যদি কিছু হয়ে যায়?”
নূরজাহানের বুক ছ্যাৎ করে উঠল। মুখের সব রক্ত গায়েব হয়ে গেল। আমীর বলল,” আমি বাইরে যাচ্ছি। চেঞ্জ করা হয়ে গেলে ডাকবে।”
সে দরজা ভিড়িয়ে চলে যায়। নূরজাহানের তখন হাত কাঁপছে। সেই কাঁপা হাতেই কোনোমতে স্নেহার পোশাক বদলে দিল।
ভোরের নরম আলো গায়ের উপর লুটিয়ে পড়তেই ঘুম ভাঙল স্নেহার। সে নিজেকে অচেনা জায়গায় আবিষ্কার করল। প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলেও পরে বুঝতে পারল, এটা আমীরের বেডরুম। মুহূর্তেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল তার৷ নিজের গায়ে নাইট ড্রেস দেখে স্নেহা হতভম্ব। আমীর তার পাশেই শুয়ে আছে, খালি গায়ে। স্নেহা চোখ বন্ধ করে আবার তাকাল। না এটা কোনো স্বপ্নদৃশ্য নয়। বরং সত্যিই! স্নেহার ধুকপুকানি বেড়ে গেল। কাল রাতে কি হয়েছিল তাহলে?
স্নেহা উঠে নিজের মুখে ম্যাসাজ করল। মাথায় ম্যাসাজ করল, তার কিছুই মনে আসছে না। যে প্রতিক্ষীত রাতের জন্য এতোদিন ধরে সে নিরবচ্ছিন্ন অপেক্ষা করে গেছে সেই রাত তার জীবনে কত সহজেই ধরা দিল অথচ সে কিছু মনেই রাখতে পারল না! কি আশ্চর্য!
আমীর পাশ ফিরল। স্নেহাকে উঠে বসতে দেখে মৃদু হেসে বলল,” গুড মর্ণিং।”
স্নেহা লাজুক কণ্ঠে বলল,” গুড মর্ণিং।”
আমীর বলল,” এতো দ্রুত কেন উঠলে?”
স্নেহা বিভ্রান্ত হলো। সে দ্রুত উঠেছে নাকি? মনে তো হচ্ছে ছয়-সাত ঘণ্টা ধরে ঘুমিয়েছে। তাকে কি নেশায় পেয়েছিল? কিছু মনে কেন পড়ছে না? নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হলো।
কিন্তু আমীরকে সে এই কথা ভুলেও বুঝতে দিল না। আমীর যদি জানে রাতের কথা সে সব ভুলে গেছে তাহলে নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে! স্নেহা আমীরের বুকে মাথা গুজে বলল,” কিভাবে ঘুমাই বলো? তুমি আমার ঘুম হারাম করে দিয়েছো।”
আমীর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। মনে মনে বলল,” তোমার বেঁচে থাকাও হারাম করে দিবো।”
স্নেহা আবেশে চোখ বন্ধ করল৷ লজ্জামাখা কণ্ঠে বলল,” আজকের সকাল আমার চব্বিশ বছরের জীবনের সবচেয়ে মধুরতম সকাল!”
সকাল থেকেই ডেকোরেশনের লোকজন এসে বাড়ি সাজানো শুরু করেছে। রাতে আমীর-স্নেহার বিয়ে। এলাহী আয়োজন হচ্ছে। সব স্নেহার তদারকিতে। রাশেদও কোমরে গামছা বেঁধে কাজে লেগে পড়েছে। স্নেহার অবশ্য ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না। সে এখন রাশেদকে নিজের আশেপাশেও সহ্য করতে পারছে না। একবার তো কড়া গলায় বলেই উঠল,” আমার সামনে আসবে না রাশেদ। এখান থেকে যাও৷ তোমাকে যেন আমার ত্রিসীমানায় না দেখি।”
রাশেদ দুঃখিত কণ্ঠে বলল,” স্যরি ম্যাডাম। আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি।”
” তুমি আমার সামনে এলেই আমি বিরক্ত হই। গেট লস্ট।”
রাশেদ বের হয়ে যায়। নূরজাহান সবকাজ ঢিমেতালে করছে। আর কেউ না জানলেও সে জানে, এই বিয়ের কোনো মূল্য নেই। পুরোটাই একটা সাজানো খেলা। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত সে স্নেহাকে কিছু বলতে পারছে না। সকাল থেকেই স্নেহা খুশিতে আত্মহারা। শুধু হাসছে৷ তার মুখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
নূরজাহানকে মনমরা হয়ে ঘুরতে দেখে স্নেহা বলল,” তোমার কি হয়েছে নূর? মনখারাপ নাকি? বুঝেছি, সরবকে নিয়ে টেনশন করছো?”
নূরজাহান মাথা নাড়ল। কি আর বলবে? সত্যি কথা তো আর বলতে পারবে না। স্নেহা সান্ত্বনা দিয়ে বলল,” আরে টেনশনের কিছু নেই। হয়তো আমীর ওকে জরুরী কাজে কোথাও পাঠিয়েছে৷ ফিরে আসবে। তবে তুমি চাইলে আমি আমীরকে জিজ্ঞেস করতে পারি। করব নাকি?”
” প্রয়োজন নেই ম্যাডাম।”
” ওকে। আমার ডায়মন্ড সেটটা নিয়ে আসোতো! ট্রায়াল দিয়ে দেখি।”
নূরজাহান মুখ গোঁজ করে ডায়মন্ড সেট এগিয়ে দিল। স্নেহা অকারণেই হেসে উঠল। আজ সে কথায় কথায় হাসছে!
সন্ধ্যা সাতটা। স্নেহা পিচ রঙের লেহেঙ্গা পরেছে। এটা আমীরের প্রিয় রঙ। সাথে ম্যাচিং করে ডায়মন্ডের জুয়েলারি। গাঢ় মেকাপ। হাতভরা মেহেদী৷ স্নেহার সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। কখনও ভাবেনি এতো দারুণ ভাবে আমীরের সাথে তার আবার বিয়ে হবে। খুশিতে দিশেহারা বোধ করছে সে। আয়নায় তাকাতেই দম আটকে এলো। এতো সুখ কপালে সইবে তো?
ড্রেসিংটেবিলের আয়না থেকেই স্নেহা দেখতে পেল আমীর তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। অচিরেই ভ্রু জোড়া কুচকে গেল স্নেহার। সে পেছন ফিরে অবাক হয়ে বলল,” তুমি এখনও তৈরী হওনি?”
আমীরের গায়ে সাদা টি-শার্ট, ট্রাউজার। হাতে একটা কাগজ। স্নেহার দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,” যার বিয়ে সে তৈরীই আছে৷ তুমি শুধু এখানে সাইন করে দাও।”
স্নেহা কিছু বুঝতে পারল না। কাগজটা হাতে নিতেই পাহাড় ধ্বসে পড়ল মাথায়। এটা তো ডিভোর্স পেপার! স্নেহা চোখ বড় করে তাকাল,” এসবের মানে কি? তুমি কি আমার সাথে গেইম খেলছো?”
আমীর শান্ত স্বরে বলল,” গেইমটা তুমি শুরু করেছিল। আমি শেষ করব।”
” এই ডিভোর্স পেপারের মানে কি আমীর?” স্নেহার কণ্ঠ ভেঙে এলো। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এলো।
” অর্থ হলো, এখন আমাদের ডিভোর্স হবে। ঠিক তারপরেই তোমার সাথে রাশেদের বিয়ে হবে।”
স্নেহা এতো অবাক হলো যে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়ে ফেলল। ‘ রাশেদ?’ থমকানো কণ্ঠে উচ্চারণ করল সে। ডিভোর্স পেপারটা তার হাত থেকে নিচে পড়ে গেল।
আমীর সেটা তুলে ফু দিয়ে পরিষ্কার করে বলল,” তোমার মনে আছে স্নেহা? শেষরাতে যখন ফীহার লাশটা তুমি গাছের সাথে ঝোলাতে গেলে তখন একজন ইমাম সেটা দেখে নিয়েছিলেন। উনি টর্চ মারতেই তুমি পালিয়ে এসেছো। তোমার মুখ আবৃত ছিল। তাই তিনি তোমাকে চিনতে পারেননি। শুধু তোমার গলার জন্মদাগ দেখেছিলেন। তারপর থেকে তুমি জন্মদাগ আড়াল করে রাখো। ওই ইমাম সাহেব কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে রাজি হয়েছেন। ”
স্নেহার মাথা পুরোপুরি খালি হয়ে গেল। সে নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। নড়াচড়াও করতে পারল না। আমীর কাছে এসে বলল,” এখন তুমিই ডিসাইড করো, কোনটা করবে? এই কেইস একবার কোর্টে উঠলে কিন্তু তোমার ফাঁসি নিশ্চিত। তুমি কি ফাঁসি নিতে চাও নাকি রাশেদকে বিয়ে করে একটা সুন্দর সংসার পেতে চাও? সিদ্ধান্ত তোমার। দশমিনিট সময় দিলাম তোমাকে৷ ভালোমতো ভেবে বলো। ”
আমীর বিছানার উপর বসে ঘড়ির দিকে তাকাল। যেন সে আসলেই দশমিনিট ধরে অপেক্ষা করবে। স্নেহা পাথুরে মূর্তি বনে গেল। একটু পর ড্রেসিংটেবিল থেকে পারফিউমের বোতল নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল। উচ্চস্বরে বলল,” আমি ম-রে গেলেও রাশেদকে বিয়ে করব না!”
আমীর ভ্রু উঁচু করে তাকাল,” তাই নাকি? যার সাথে ঘনিষ্ট মিলনে অসুবিধা হয় না তাকে বিয়ে করতে এতো অনীহা কেন?”
স্নেহা কেঁদে ফেলল৷ আমীরের সামনে হাঁটু মুঁড়ে বসে হাতজোড় করে বলল,” আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। তুমি এইজন্য আমাকে শাস্তি দিতে চাইছো তাই না? কিন্তু প্লিজ এতোবড় শাস্তি দিও না।”
” এটা শাস্তি না।আমি তো তোমাকে বর দিচ্ছি। তোমার এখন ফাঁসির আসামী হয়ে কাস্টাডিতে থাকার কথা। সেখানে আমি তোমাকে বিয়ে করতে বলছি। তোমার তো খুশি হওয়া উচিৎ। ”
ঝরঝর করে স্নেহার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে করুণ গলায় বলল,” আমি যা করেছি সব তোমার অভাব পূরণের জন্য৷ তুমি আমাকে বার-বার ফিরিয়ে দিয়েছো। তোমার অবহেলা সহ্য করতে না পেরে আমি ভুল পথে গিয়েছি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
” আমি তোমাকে ক্ষমা করব? কিন্তু আমি তো একদমই রেগে নেই। রাশেদকে দিয়ে যদি আমার অভাব পূরণ হয় তাহলে ইটস ওকে। তাকে বিয়ে করে তুমি হ্যাপি হও। তোমার তো অভাব পূরণের জন্য একজন হলেই চলে।”
স্নেহার কান গরম হয়ে উঠল। তীব্র লজ্জায় মাটির সাথে মিশে নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে মন চাইল।কাঁদতে কাঁদতে ব্যাকুল হয়ে বলল,” তুমি এসব কেন করছো? যদি তোমার এটাই উদ্দেশ্য হয় তাহলে রাতে ওসব কি ছিল?”
আমীর অবাক হয়ে তাকাল,” কোথায়? কখন কি ছিল? আমার তো কিছু মনে পড়ছে না!”
স্নেহার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বেদনাসিক্ত কণ্ঠে বলল,” মানে? তুমি আমাকে কিস করেছিলে আমীর।”
” হ্যাঁ করেছিলাম৷ সেটা তো আমি মায়াকেও করেছি। কই ও তো আমাকে বিয়ে করতে বলেনি।”
স্নেহা চোখ বড় করে তাকাল। অসহায় কণ্ঠে বলল,” কেন হেঁয়ালি করছো? তুমি আমার সাথে…” থামল স্নেহা। তার আর কিছু মনে নেই। কি হয়েছিল কালরাতে? আদৌ কি হয়েছিল কিছু?
আমীর ঠান্ডা স্বরে বলল,” দশমিনিট শেষ। সবাই অপেক্ষা করছে স্নেহা। আমার মনে হয় সেকেন্ড অপশনটাই বেস্ট। অযথা কোর্ট-কাচারির ঝামেলায় আমরা না যাই৷ তুমি বিয়ে করে সুখে থাকো আর আমাকেও শান্তিতে থাকতে দাও।”
স্নেহা উঠে দাঁড়াল। হিংস্র হয়ে বলল,” আমি আত্মহত্যা করব। তবুও রাশেদকে বিয়ে করব না।”
আমীর বলল,” ওকে। এজ ইউর উইশ।”
সে পকেট থেকে বিষের শিশি বের করল তা দেখে স্নেহা হকচকিয়ে গেল। আমীর শিশিটা টেবিলের উপর রেখে বলল,” তোমার কাছে যদি সুইসাইডই বেস্ট অপশন মনে হয় তাহলে ঠিকাছে। তুমি এটা করতে পারো। আই হ্যাভ নো প্রবলেম। আমি শুধু তোমার জন্য ভালো কিছু চিন্তা করেছিলাম৷ একটা চান্স দিতে চাচ্ছিলাম তোমাকে। কিন্তু তুমি তো… যাইহোক,আমি আর ইন্টারফেয়ার করব না। ইউর লাইফ, ইউর রুলস। বেস্ট অফ লাক।”
আমীর বেরিয়ে যেতেই স্নেহা মাথার গাজরা ফুল ছিঁড়ে ফেলল। বজ্রাহত কণ্ঠে জানতে চাইল,” আমার সাথে এটা কেন করলে? কালরাত থেকে এসব নাটক কেন করলে? যদি এটাই তোমার উদ্দেশ্য হয়?”
আমীর ততক্ষণে চলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে স্নেহা মেঝেতে বসে পড়ল। আমীর যদি রাতেই তাকে এসব বলে দিতো তাহলে সারাদিন ধরে সে স্বপ্ন দেখতো না। স্বপ্ন যখন ভেঙে যায় তখন মৃ-ত্যুর মতো কষ্ট হয়। আমীর তাকে এমন মৃ-ত্যু যন্ত্রণা কেন অনুভব করালো? কেন? তার সব শেষ হয়ে গেছে। সে ভেতর থেকে একদম ম-রে গেছে। বিষের শিশিটা হাতে নিল স্নেহা।
চলবে
® Sidratul মুন্তায
#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৩৩.
নূরজাহান দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আমীর আর স্নেহার প্রায় সব কথাই শুনতে পাচ্ছিল। আমীর যখন ঘর থেকে বের হয়ে আসে তখন আচমকা চোখাচোখি হওয়ায় নূরজাহান কেঁপে উঠল। ভয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। ধরা পড়ার পর চোর যেমন অপ্রস্তুত হয়, সেও হলো।
আমীর তাকে কিছু বলল না। স্নেহা চলে গেলে নূরজাহান এমনিতেও এই বাড়িতে থাকবে না। সরবও নেই। খুব দ্রুত বাড়িটা খালি হবে। বিশ্বাসঘাতক মুক্ত পরিবেশ চায় আমীর। সে সোজা হেঁটে নিজের ঘরে গেল।
নূরজাহানের নিঃশ্বাসটা গলার কাছে আটকে ছিল এতোক্ষণ। এই বাড়িতে কত মানুষ ম-রতে দেখেছে সে। কোনোদিন নিজের প্রাণ নিয়ে সংশয় হয়নি। স্নেহাকে মাথার উপরের ছাদ ভাবতো। স্নেহা থাকতে তার কোনো ক্ষতি হবে না এই কথা চিন্তা করে নিশ্চিন্ত লাগতো। কিন্তু এখন স্নেহাও কেমন দূর্বল হয়ে পড়েছে। নূরজাহানের মনে হচ্ছে আর তার বাঁচার আশা নেই। স্নেহার সাথে সাথে তাকেও ম-রতে হবে। এতোদিন সর্বনাশের পথে হেঁটেছিল তাই সর্বনাশ আসন্ন।নূরজাহান স্ত্রস্ত পায়ে ভেতরে ঢুকতেই নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার মতো দৃশ্য অবলোকন করল।
স্নেহা বিধ্বস্ত অবস্থায় মেঝেতে বসে আছে৷ তার হাতে বিষের শিশি৷ শিশিটার দিকে সে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। চিৎকার করে নূরজাহান বলে উঠল,” ম্যাম কি করছেন? প্লিজ এটা করবেন না!”
স্নেহা বড় চোখে তাকাল। নূরজাহানের গলা কাঁপছে। সে যে স্নেহার কাছে গিয়ে শিশিটা হাত থেকে কেড়ে নিবে সেই উপায়ও নেই। স্নেহা ক্রোধে প্রায় হিসহিসিয়ে বলল,” কিভাবে ভাবলে আমি ম-রব? আগুন নিজে জ্বলে না, মানুষকে জ্বালায়। আর আমি আগুনের চেয়েও ভয়ংকর। বুঝতে পেরেছো?”
নূরজাহান কম্পনরত শরীর নিয়ে মাথা নাড়ল দ্রুত। স্নেহার অবস্থা দেখে তার ভয় লাগছে। গতরাতে সে স্নেহার কাপড় বদলেছিল। এই কথা স্নেহা জানতে পারলে তাকে মে-রে ফেলবে। অথচ ওই কাজটা তখন না করলে আমীর তাকে মে-রে ফেলতো! সে কোনদিক যাবে? বড় অসহায় লাগছে নিজেকে। গোলামি করাও কোনো সহজ কাজ নয়।
স্নেহা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” রাশেদকে ডেকে আনো। এই মুহূর্তে যেন ও আমার ঘরে আসে। ও নিজেকে কি ভেবেছে? আমাকে বিয়ে করার স্বপ্ন ও কিভাবে দেখল? ওর সাহস কিভাবে হলো?”
” যাচ্ছি ম্যাম..”
নূরজাহান প্রায় দৌড়ে বাইরে গেল। স্নেহা কোমরে হাত রেখে ঘরের এই মাথা থেকে ওই মাথা পায়চারী করছে। ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে তার। কষ্টের চেয়েও রাগ বেশি কাজ করছে। সে অন্যসব সাধারণ মেয়ের মতো নয় যারা প্রতারণা পেয়ে কাঁদে। স্নেহা ভয়ংকর প্রতিশোধপরায়ণা হয়ে উঠল। কেউ তাকে এক চুল কষ্ট দিলে সে একশো গুণ কষ্ট ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আমীরকে এটা বুঝতে হবে। সে কোনোভাবেই ছাড় দেবে না। তবে এর আগে রাশেদের একটা ব্যবস্থা করা জরুরী। স্নেহা দুইহাতে চোখ মুছল। আয়নায় নিজের হিংস্র প্রতিবিম্ব দেখে মুচকি হাসল।
রাশেদের গায়ে বিয়ের শেরয়ানি। মাথায় পাগড়ী। একদম বরের সাজে এসেছে। তাকে দেখে স্নেহার করুণা হলো। কত সহজ-সরল সে! ভেবেছিল স্নেহা সত্যিই তাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবে। এই কথা সে ভাবল কি করে?
” তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও?”
রাশেদ থতমত খেল। সে জানতো এই বিয়ে হবে না। তবুও আমীরের কথায় সে তৈরী হয়েছে। স্নেহা কাছে এসে আবার প্রশ্ন করল,” আমাকে ভালোবাসো?”
রাশেদ নিচু কণ্ঠে বলল,” স্যার আমাকে যা বলেছেন আমি তাই করেছি ম্যাডাম। কিন্তু আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি।”
স্নেহা মৃদু হাসল,” আমি যে প্রশ্ন করেছি তার উত্তর দাও রাশেদ। আমাকে ভালোবাসো তুমি?”
রাশেদ নির্দ্বিধায় বলল,” হ্যাঁ। আমি চাই আপনি সবসময় সুখে থাকুন।”
তাচ্ছিল্য হাসল স্নেহা। ঠাট্টার সুরে বলল,” তোমাকে বিয়ে করলে সুখে থাকব নাকি আমি?”
রাশেদ নিরুত্তর, তাকে অসহায় দেখালো। স্নেহা তার দৃষ্টি সরু করে বলল,” আমার জন্য সবকিছু করতে পারবে?”
রাশেদ মুখস্তের মতো বলল,” আপনার জন্য আমি সবসময় সবকিছু করতে প্রস্তুত।”
স্নেহা দুইপাশে মাথা নাড়ল। সামান্য পিছিয়ে বলল,” উহুম পারবে না। এখন আমি তোমাকে যেটা করতে বলব সেটা কিছুতেই তুমি করতে পারবে না।”
রাশেদ মাথা তুলে জানাল,” একবার বলেই দেখুন! আমি সব পারব।”
স্নেহা শিশি এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল,” বিষপান করতে পারবে?”
রাশেদ মোটেও অবাক হলো না। তবে মনে হয় সামান্য ভয় পেল। কিছুটা ভড়কে গেল।
স্নেহা বলল,” এটা খেলে তিনঘণ্টার মধ্যে মৃ-ত্যু অনিবার্য। আমার কথায় যদি তুমি এটা পান করো তাহলে বুঝবো সত্যি ভালোবাসো।”
রাশেদের চেহারায় আতঙ্কের সুক্ষ্ম ছাপ ফুটে উঠল। সে ঢোক গিলল। স্নেহা মুচকি হেসে বলল,” কথা দিচ্ছি তোমাকেই বিয়ে করব। তোমার জীবনের শেষ তিন ঘণ্টা হবে সবচেয়ে সুখের তিন ঘণ্টা!”
এইবার রাশেদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। স্নেহা হিংস্র গলায় বলল,” কিন্তু আমার সামনে দাঁড়িয়ে এখনি বিষ খেতে হবে। যদি না পারো তাহলে আর কখনও আমার সামনে আসবে না। তোমার এই মুখ আমাকে দেখাবে না। বলো রাজি?”
রাশেদ হতবিহ্বলের মতো দাঁড়িয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। স্নেহাকে না দেখে থাকার কথা সে ভাবতেও পারে না। কিন্তু ম-রে গেলে তো আর কখনোই স্নেহার সঙ্গে দেখা হবে না। স্নেহা আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,” আমি প্রলয়ংকরী ঝড় রাশেদ। আমাকে বিয়ে করলে তোমার জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠবে। তার চেয়ে ভালো আমাকে ভুলে যাও। আমীরের কাছে গিয়ে বলো তুমি এই বিয়ে করবে না। এই বাড়িতে আমার জন্য আসতে পেরেছিলে তুমি। এখন আমিই তোমাকে বলছি, এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও রাশেদ। ”
রাশেদ ধারালো গলায় কথা বলে উঠল,” না।আমি আপনাকেই বিয়ে করব।”
ভ্রু কুচকে পেছনে তাকাল স্নেহা। রাশেদের স্পর্ধা দেখে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠল। উচ্চ কণ্ঠে বলল,” তুমি কি জানো তুমি কি বলছো? খু-ন করে ফেলব রাশেদ।”
রাশেদ কাছে এসে স্নেহার হাত থেকে বিষের শিশিটা নিল। তার কান্ডে অবাক হয়ে চেয়ে রইল স্নেহা। রাশেদ বলল,” সত্যি আমাদের বিয়ে হবে তো ম্যাডাম?”
স্নেহা সামান্য চমকালো। রাশেদ কি সত্যিই বিষ খাবে? না, জীবন দেওয়া এতো সহজ নয়। সে স্পষ্টভাষায় বলল,” হ্যাঁ হবে। তুমি পারবে খেতে?”
স্নেহা কথাটা বলে চোখের পলক ফেলার আগেই রাশেদ এক নিঃশ্বাসে সম্পূর্ণ শিশি খালি করে ফেলল। স্নেহা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল তার এমন কান্ড দেখে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে নিল তার। রাশেদ কাঁপা স্বরে বলল,” আই লভ ইউ ম্যাডাম। আই লভ ইউ সো মাচ।”
এই কথা বলেই সে স্নেহার ডানহাত নিয়ে উল্টোপিঠে চুমু দিল। স্নেহা বিস্ময় সামলাতে পারছে না। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে উঠল,” এইটা কি করলে রাশেদ? তুমি কি পাগল?”
রাশেদ হাসিমুখে জানতে চাইল,” আপনি কথা দিয়েছেন ম্যাডাম। আমার জীবনের শেষ তিনঘণ্টা কি সবচেয়ে সুখের তিনঘণ্টা হবে?”
স্নেহা জানে না এই বিষ খেলে কেউ আদৌ তিনঘণ্টা বাঁচবে কি-না! সে রাশেদকে ভয় দেখানোর জন্য বলেছিল। হতাশ স্বরে বলল,” তুমি এতো সরল কেন রাশেদ? আমি বললাম আর তুমি সত্যি বিষ খেয়ে নিলে? নিজের জীবনটা কি এতোই তুচ্ছ তোমার কাছে?”
রাশেদ হাঁটু গেঁড়ে বসল মেঝেতে। দুইহাত মাথায় ঠেঁকিয়ে বলল,” আমার জীবন আমার কাছে তুচ্ছ না ম্যাডাম৷ শুধু আপনি আমার কাছে জীবনের চেয়েও দামী।”
স্নেহা বুঝতে পারছে না কি করবে। সে শুধু রাশেদের থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল! কিন্তু কে জানতো রাশেদ যে এমন কান্ড করবে? তাকে দেখে মনে হচ্ছে খুব কষ্ট পাচ্ছে সে। একজন মৃ-ত্যু পথযাত্রীকে দেওয়া কথা কিভাবে ফিরিয়ে নেওয়া যায়? তাছাড়া অন্যকোনো উপায়ও নেই তার। স্নেহা এই কয়েক মুহূর্তে অনেক কিছু চিন্তা করল। রাশেদকে বিয়ে না করলে ফীহা হত্যা মামলায় জেলে যেতে হবে। আমীর এতোবড় সুযোগ পাওয়ার পর সহজে ছেড়ে দেবে বলে তো মনে হয় না। কিন্ত যদি বিয়ের পর রাশেদ মরে যায় তাহলে আমীরের সিমপ্যাথি আদায় করা যাবে। এই ভেবে স্নেহা রাজি হলো।
রাশেদ তার জীবনের সবচেয়ে সুখময় হাসি হাসল। সবকিছু আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। চোখের পলকেই যেন স্নেহা আর রাশেদের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের আগেও রাশেদ অসুস্থ ছিল৷ যেন দাঁড়াতেই পারছিলনা। অথচ বিয়ের পর সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেল। অকারণেই হাসতে লাগল। আমীর নিজের হাতে নিজের সদ্য তালাক দেওয়া স্ত্রীকে নিজের কর্মচারীর হাতে তুলে দিয়ে বলল,” সুখে থাকো তোমরা।”
রাশেদ উজ্জ্বল কণ্ঠে বলল,” থ্যাঙ্কিউ স্যার। দোআ করবেন।”
সে প্রায় আমীরের পায়ে ধরে সালাম করতে নিচ্ছিল। আমীর অবাক হয়ে তাকে থামিয়ে বলল,” আরে, কি করছো? পাগল নাকি? এদিকে এসো।”
আমীর বুকে জড়িয়ে ধরল রাশেদকে। স্নেহা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সবার চেহারা হাসি-খুশি। অথচ তার মাথা ভর্তি বিষাক্ত যন্ত্রণা। এই নাটক কখন শেষ হবে? রাশেদ কখন ম-রবে? বিয়ের খবরে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল রানু। সে বিদায়ের সময় স্নেহাকে দোআ করে বলল,
” খুব ভালো থেকো মা। শুধু একটাই অনুরোধ। আর কোনোদিন এই বাড়িতে এসো না যেন। ”
স্নেহা গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকাল। রানু বিগলিত হাসল,” ওমা, মুখটা ওমন কালো কেন? তোমার মনের ইচ্ছাই তো পূরণ হয়েছে। তোমার প্রেমিকের সাথেই বিয়ে হয়েছে।জীবনে কোনো স্বামীকে দেখেছো নিজের স্ত্রীকে তার প্রেমিকের হাতে তুলে দিতে?এমন কপাল কয়জনের হয়? ”
স্নেহার দুনিয়া কাঁপিয়ে গর্জন করতে মন চাইল। সবকিছু ভেঙে ফেললে শান্তি লাগতো। রাশেদ ম-রছে না কেন এখনও? ওই শিশিতে আসলেই বিষ ছিল তো? নাকি সবটাই পরিকল্পনা? এমন চিন্তা মাথায় আসতেই স্নেহার গলা শুকিয়ে গেল। সে চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে পেল।
রাত বারোটা বাজতে চলেছে। স্নেহা রাশেদের ছোট্ট ফ্ল্যাটের বেডরুমে শক্ত হয়ে বসে আছে। তার শরীর ঘামে ভেজা। এইখানে এয়ারকুলার নেই। প্রচন্ড গরম তার উপর হয়েছে লোড শেডিং। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। মোমবাতির শিখা নিভু নিভু করছে। স্নেহা একদৃষ্টে সেই অগ্নিশিখার দিকে চেয়ে আছে। রাশেদ ভেতরে ঢুকে বলল,” রাতে কি খাবে?”
স্নেহা অনুভূতিশূন্য দৃষ্টিতে তাকাল। কখনও স্বপ্নেও কল্পনা করেনি এইভাবে তার জীবনের মোড় ঘুরে যাবে। যাকে এতোদিন গোলাম ভেবেছে সে এখন স্বামীরূপে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তীব্র অধিকারবোধ নিয়ে প্রশ্ন করছে! স্নেহা রূঢ় গলায় বলল,” কিছু না।”
” রাতে না খেলে শরীর খারাপ করবে তোমার। কিছু একটা খাও প্লিজ।”
” আমার শরীর নিয়ে তোমার এতো চিন্তা করার দরকার নেই।” স্নেহার কণ্ঠে বিরক্তি।
” তুমি খুব ঘেমে গেছো। আমি কি তোমাকে বাতাস করব?”
রাশেদ স্নেহার বরাবর বসল একটা হাতপাখা নিয়ে। খুব যত্নে তাকে বাতাস করতে লাগল। স্নেহা কঠিন দৃষ্টিতে বলল,” তোমার উপর দয়া করে তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। আর তুমি কি করলে? বিশ্বাসঘাতক তুমি।”
রাশেদ সামান্য হেসে বলল,” এটা ঠিক যে আমি আগে থেকেই জানতাম ওই শিশিতে বিষ ছিল না। কিন্তু তার মানে এইটা না যে আমি তোমাকে ভালোবাসিনি। ”
স্নেহা ধাক্কা মেরে রাশেদকে সরিয়ে গমগম করে বলল,
” মিথ্যুক, বিশ্বাসঘাতক, তোর একটা কথাও আমি আর বিশ্বাস করি না।”
” এখন বিশ্বাস করা আর না করায় তো কিছু এসে যায় না। আমাদের বিয়ে হয়েছে স্নেহা। তুমি আমার স্ত্রী। প্লিজ সব ভুলে যাও।”
” খবরদার আমাকে স্ত্রী বলবি না।”
রাশেদ অবাক হওয়ার ভাণ ধরে বলল,” স্ত্রীকে স্ত্রী বলতে পারব না?তাহলে কি বলব?”
স্নেহা রাগে বিছানার চাদর উল্টে ফেলল। বালিশ নিয়ে ছুঁড়ে মা-রল। তার শরীর যেমন দরদর করে ঘামছে তেমনি চোখ-মুখ থরথর করে কাঁপছে। সে সব মানতে রাজি কিন্তু হার মানতে রাজি নয়। রাশেদ এতোক্ষণ চুপচাপ ছিল। স্নেহা ভাঙচুর করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যখন থামল রাশেদ তখন এক গ্লাস পানি এনে দিয়ে বলল,” এটা খাও।”
স্নেহা গ্লাসটা নিয়ে প্রথমে রাশেদের মুখে পানি ছুঁড়ে মারল। তারপর আছাড় দিয়ে গ্লাস ভেঙে ফেলল। এই পর্যায় রাশেদ সটান করে স্নেহার গালে চড় মারল। স্নেহা হকচকিয়ে গেল। আচমকা এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা তাকে হতভম্ব বানিয়ে দিল একদম। অবাক দৃষ্টিতে রাশেদের দিকে তাকাল সে। মনে হলো এই রাশেদকে সে চেনে না, কোনোদিন দেখেনি!
চলবে