#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৫১.
নিশ্চুপ সন্ধ্যা। ট্যাপেইনারওয়েগের রাস্তা ধরে হাঁটছে তোহা। মাঝে মাঝেই দমকা বাতাস এসে তার মন ভরিয়ে দিচ্ছে। হাঁটতে ভালোই লাগছে। এখানে আমীরের সাথে তার মধুরতম স্মৃতি আছে। সেই স্মৃতিগুলো মনে করে অজান্তেই কান্না পাছে। জিন্সের পকেটে তার ফোনটা অনবরত ভাইব্রেট করছে। তোহা প্রথমে পাত্তা দিচ্ছিল না। কিন্তু এতোবার ফোন করার মানে কি? তোহা অসম্ভব বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরল। বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
” আপনার প্রবলেমটা কি আমীর? আমি তো বললাম আমার একটু স্পেস লাগবে। প্লিজ এভাবে ফোন দেওয়া বন্ধ করুন।”
আমীর খুব রূঢ গাম্ভীর্যতার সাথে প্রশ্ন করল,” তুমি কোথায় আছো?”
” আপনার কি? আমি যেখানেই থাকি!”
” বলো, আমার জানার দরকার আছে।”
” কোনো দরকার নেই। আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই। আপনি প্লিজ আমাকে বার বার ফোন করবেন না।”
আমীর তোহার লোকেশন আগে থেকেই ট্র্যাক করে রেখেছিল। সে গাড়ি নিয়ে বেরও হয়ে গেছে৷ ড্রাইভিং-এ থাকা অবস্থাতেই তোহাকে ফোন করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্যাপেইনারওয়েগে পৌঁছে গেল আমীর। তোহাকে খুঁজে পেতে তার বেশিক্ষণ সময়ও লাগল না। কারণ তোহা কোন কোন জায়গায় যেতে পারে সে সম্বন্ধে তার ভালো ধারণা আছে! তোহাকে খুঁজে পাওয়া গেল সবচেয়ে উঁচু জায়গায়, যেখানে আমীর তাকে রিং পরানোর জন্য প্রথমবার এনেছিল। হঠাৎ আমীরকে দেখে তোহা ভয় পেল আর ভীষণ চমকে উঠল।
” আপনি এখানে কি করছেন?”
” তুমি বলেছিলে আজ আসবে। আমি সারাদিন ওয়েট করেছি। কেন এলে না?”
তোহা চোখমুখ শক্ত রেখে বলল,” আপনি ওয়েট করেছেন কেন? আমি তো কথা দেইনি।”
আমীর খুব আক্ষেপ নিয়ে বলল,” তুমি বদলে যাচ্ছো মায়া। আমি তোমাকে চিনতে পারছি না। এই কঠিন মেয়েটি তুমি না। তুমি তো এরকম ছিলে না।”
” আপনিও এরকম ছিলেন না। আপনি কি কি করেছেন সে সম্পর্কে যদি বিন্দুমাত্র ধারণা থাকতো তাহলে বার-বার এভাবে আমার সামনে হাজির হতেন না।”
আমীর খুব ক্ষীপ্ত হয়ে তোহার হাত চেপে ধরল। তাকে টেনে দেয়ালের সাথে ঠেঁকিয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল,” আমি কি করেছি? কি এমন করেছি যে তুমি এইভাবে শাস্তি দিচ্ছো?”
তোহা আমীরের অগ্নিমূর্তি দেখে ভ্যাবাচেকা খেল। আগে কখনও আমীর তার সাথে এতো রেগে কথা বলেনি। তোহা সামান্য নিভল। চাপা গলায় বলল,” হাত ছাড়ুন। কথায় কথায় এভাবে চেপে ধরবেন না। আমি আপনার স্টাফদের মধ্যে কেউ না যে চুপচাপ আপনার মেজাজ হজম করব।”
আমীর রাগে দেয়ালে খুব জোরে ঘুঁষি মারল৷ তোহা আৎকে উঠল,” কি করছেন? আপনি কি এসব পাগলামি দেখানোর জন্য এখানে এসেছেন?”
” তুমি কি চাও মায়া? কি করলে তুমি স্বাভাবিক হবে বলো? আমি সেটাই করব।”
তোহা কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে উচ্চস্বরে বলল,” আমি শুধু একটা উপযুক্ত ব্যখ্যা চাই। আপনি কি করেছেন এসব? কেন করেছেন? তার কারণ জানতে চাই। আমি আমার মনকে বোঝাতে পারছি না যে আপনি এতোটা বর্বর।”
” আমি বর্বর? তুমি আমাকে বর্বর বলছো? তাহলে তোমার ভাই কি? সে কি করেছে সেই সম্পর্কে তোমার ধারণা থাকলে তার মুখও দেখতে চাইতে না।”
তোহা চোখ সরু করল। হতবাক হয়ে জানতে চাইল,” মানে? আপনি কি আলিফ ভাইয়ের কথা বলছেন?”
” হ্যাঁ। তোমার আলিফ ভাই। যাকে তুমি পীর ভাবছো। সে ওইদিন আমার হোটেলে এসে তোমার সম্বন্ধে কি কি বলেছিল জানো? আমি যেন তোমাকে বিয়ে না করি সেজন্য তোমার নামে বীভৎস নোংরা কথা বানিয়ে বলেছিল। তার বিয়ের আগে নাকি তার সাথে তোমার অ্যাফেয়ার ছিল। ডিপ অ্যাফেয়ার। মানে বোঝো…”
আমীর এরপর যে কথা উচ্চারণ করল তাতে তোহা কেঁদে ফেলতে বাধ্য হলো। বজ্রকণ্ঠে বলল,” অসম্ভব। আলিফ ভাইয়া এরকম কিছু বলেনি। আপনি মিথ্যা বলবেন না।”
আমীর তাচ্ছিল্য হাসল। তীব্র গলায় উচ্চারণ করল,” হ্যাঁ, আমি যা বলব তা সব মিথ্যা। শুধু তোমার ভাই যেটা বলবে সেটাই সত্যি। তুমি শুধু তাকেই বিশ্বাস করবে। আমাকে করবে না। অথচ আমি তার একটা কথাও বিশ্বাস করিনি। ধরো আমি যদি সেদিন তার কথা বিশ্বাস করে তোমার কাছে কৈফিয়ৎ চাইতে আসতাম তাহলে কেমন লাগতো তোমার?”
তোহা চিৎকার করে উঠল,” একদম চুপ। আর একটা নোংরা কথা উচ্চারণ করবেন না। আমি আপনার চেহারাও দেখতে চাই না।”
তোহা দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল৷ তার পা কাঁপছে। মাথা ঘুরাচ্ছে। এদিকে আমীরের মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে গেল। সে তুমুল কণ্ঠে বলল,” মায়া, খবরদার তুমি কোথাও যাবে না।”
তোহা থামল না। সে অতি দ্রুত সিঁড়ি ভাঙছে। আমীর তেড়ে এসে তাকে ধরে ফেলল। তোহা ঝটিতে আমীরের হাত ছাড়িয়ে বলল,” ওই লোকটার কি দোষ ছিল? তাকে আপনি কোন সাহসে মেরে ফেললেন? একবারও কি চিন্তা করেছেন তার পরিবারের কি হবে? সেও কারো সন্তান, কারো স্বামী অথবা কারো বাবা!”
শেষ বাক্যটি উচ্চারণ করতে নিয়ে তোহার কণ্ঠ কেঁপে উঠল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল,” যে মানুষ খু-ন করে সে কখনও মানুষ হতে পারে না। আপনি মানুষ না। আপনি পিশাচ। বুঝতে পেরেছেন? পিশাচ আপনি!”
আমীর ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল,” আমার কথা শোনো। আমি সবকিছু ছেড়ে দিবো৷ আমি প্রমিস করলাম তো, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তুমি এভাবে চলে যেও না, প্লিজ।”
” কিছুই ঠিক হবে না। যে মানুষটিকে আপনি মে-রেছেন তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন না।”
” অন্তত প্রায়শ্চিত্ত করতে পারব।”
” কিভাবে করবেন প্রায়শ্চিত্ত?”
” এসো আমার সাথে।”
” না, আমি যাবো না।”
আমীর জোর করে তাকে পাজাকোলায় তুলল। তোহা ডাঙায় তোলা মাছের মতো ছটফট করে বলল,” কি করছেন? ছাড়ুন আমাকে। এসব করে কোনো লাভ নেই। আপনি আমার জেদ বাড়িয়ে দিচ্ছেন।”
আমীর তোহাকে এনে গাড়িতে বসালো। নিজে বসল পাশের সিটে। তারপর খুব দ্রুত ড্রাইভিং শুরু করল। তোহা ভয়ে জড়সড় হয়ে বলল,” আস্তে চালান। এক্সিডেন্ট করাতে চান?”
আমীর কোনো উত্তর দিল না। তোহা অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছে,” আমরা কোথায় যাচ্ছি? আপনি কি করতে চাইছেন?”
আমীর কোনো কথাই বলল না। চল্লিশ মিনিট সময়ের ব্যবধানে তারা একটা ছোট্ট বাড়ির সামনে এসে থামল। তোহা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,” কার বাড়ি এটা?”
আমীর গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে শান্ত গলায় বলল,” নামো।”
তোহা দ্বিধা নিয়ে নামল। আমীর তার হাত ধরে তাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। একজন বৃদ্ধা বসেছিলেন বসার ঘরে। তাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছিল এক ভদ্রমহিলা। আমীরকে দেখেই সে হেসে বলল,” ভালো আছেন?”
তাদের কথা শুনে মনে হলো বাঙালি। এই এলাকায় যারা থাকে তারা বেশিরভাগই বাঙালী পরিবার। আমীর বলল,” এইতো ভালো। আন্টি ভালো আছেন?”
” শরীর এখন অনেকটাই ভালো। আজকেই আপনার কথা মা বলছিলেন। আর আপনি চলেও এলেন। উনি কে?”
ভদ্রমহিলা তোহার দিকে তাকাল। আমীর বলল,” আমার গার্লফ্রেন্ড।”
” ও আচ্ছা। বসো না… ”
তোহাকে চেয়ার এগিয়ে দেওয়া হলো। তোহা বুঝতে পারছে না কি করবে। আমীরের দিকে তাকাল সে। এরা কারা? আমীর বলল,” বসো।”
তোহা বসল। বৃদ্ধামহিলা তোহার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” বাহ, তুমি তো খুব সুন্দর। আমীর যেমন বর্ণনা দিয়েছিল তোমাকে দেখতে একদম সেরকম।”
তোহা অস্বস্তি অনুভব করছে। দশ-বারো বছরের একটা মেয়ে এসে উঁকি দিল। আমীর হাত বাড়িয়ে ডাকল,” কেয়া, এদিকে এসো।”
কেয়া মাথা নিচু করে এলো। আমীর এবার তোহার দিকে তাকিয়ে বলল,” শপিংমলে যে লোকটি মারা গেছে, এটা তার মেয়ে। কেয়া।”
তোহা এই কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেল। বিস্ময়ে চোখ দু’টো প্রসারিত হলো। আমীর সহজ-স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পরিচয় করালো,” উনি হচ্ছে কেয়ার দাদী। আর উনি কেয়ার মা।”
তোহা একে একে সবার দিকে তাকাল। তার শরীর লোহার মতো শক্ত হয়ে যাচ্ছে। কেয়ার মা হাসি মুখে বলল,” আমীর সাহেব বলছিলেন, তুমি নাকি কেয়ার বাবার মৃ-ত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী ভাবছো? এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই। সে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। ওটা একটা দূর্ঘটনা। আমরা সব মেনে নিয়েছি। তুমিও মেনে নাও। আমীর সাহেব এই সংসারের সব ক্ষতি পূরণ করে দিয়েছেন। আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ।”
তোহা অবাক হয়ে বলল,” মানে কি?”
বৃদ্ধা মহিলাটি বলল,” মানে আমার ছেলে পাগল ছিল। সে আত্মহত্যা করার অনেক চেষ্টা করেছে। এইবার সফল হয়েছে। এটা কি তোমার দোষ? তোমার মতো সে আরও অনেক মানুষকে জ্বালিয়েছে। বলতে খারাপ লাগলেও তার মৃ-ত্যুতে আমাদের আফসোস নেই। তুমিও আফসোস করা ছেড়ে দাও।”
তোহা আমীরের দিকে তাকিয়ে রইল। আমীর হাত ভাঁজ করে বলল,” তোমার কি ওদের কিছু বলার আছে?”
তোহা কেয়ার দিকে তাকাল,” কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?”
কেয়া উত্তর দিল না। তার মা বলল,” ও কথা বলতে পারে না। ছোট থেকেই বাক প্রতিবন্ধী।”
তোহার খুব মায়া হলো। আহারে মেয়েটা… সে কেয়াকে কাছে টেনে বলল,” তুমি আমার সাথে বাংলাদেশে যাবে? আমি তোমাকে স্কুলে ভর্তি করাবো। লেখাপড়া শিখাবো।”
কেয়া আলতো হেসে মাথা নাড়ল। তোহার মন আনন্দে ভরে উঠল। কেয়াদের বাড়িতে তারা প্রায় একঘণ্টার মতো সময় কাটাল। তোহা ঠিক করে ফেলল দেশে যাওয়ার সময় কেয়াকে সাথে নিয়েই যাবে। বের হওয়ার পর তোহার মন হালকা হয়ে গেল। আমীর খু’ন করেনি। ঘটনাটা আসলেই আত্মহত্যা ছিল৷ অথচ আলিফ তাকে কত বড় মিথ্যা বোঝালো! তোহা এর একটা বোঝাপড়া করেই ছাড়বে। আলিফের উদ্দেশ্যটা কি?
” আপনি আমাকে আগে বললেই পারতেন যে খু’নটা আপনি করেননি।”
” আগে বললে কি তোমার বিশ্বাস হতো?”
তোহা মাথা নিচু করল। আসলেই তার বিশ্বাস হতো না। সে অন্ধের মতো কেবল বিশ্বাস করেছিল আলিফকে।
” আচ্ছা, আপনি ওদের কিভাবে খুঁজে বের করলেন?”
” তোমার থেকে ঘটনা শোনার পর শপিংমলে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। লাশ বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছিল, আমিও তাদের সাথে গেলাম।”
” ও আচ্ছা। খুব ভালো করেছেন।”
আমীর গাড়িতে উঠে প্রশ্ন করল,” এখন কি রাগ কমেছে ম্যাডাম?”
তোহা কোমল গলায় বলল,” আপনি এই অসহায় পরিবারটির দায়িত্ব নিয়েছেন, সেজন্য আমি অনেক খুশি। থ্যাঙ্কিউ। ”
তোহা একটা ছেলেমানুষী কান্ড করল যা আমীর ভাবতেও পারেনি। সে আমীরের গালে খুব যত্ন করে চুমু দিল। আমীর হাসল। তোহা লজ্জায় গুটিয়ে গেল। সে জানে না আমীর আজ তাকে অনেক বড় মিথ্যা বলেছে। সে কখনও এই ব্যাপারে জানবেও না। এই পরিবারের সাথে মৃ-ত লোকটির কোনো সম্পর্কই নেই। তোহাকে সামলানোর জন্য আমীর শুধু একটা নাটক করেছে। এই পরিবারটিকে কিছুসময়ের জন্য ভাড়া করা হয়েছিল। আমীর জানতো তাকে এমন পরিস্থিতি সামলাতে হবে। তাই আগেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল। তারা দূর্দান্ত অভিনয় করেছে। শুধু একটাই সমস্যা হয়ে গেল। তোহা কেয়াকে বাংলাদেশে নিতে চাইছে। এটাও কোনো সমস্যা না। তারা যাওয়ার সময় একটা বাহানা বানিয়ে কেয়ার ব্যাপারটা কাটিয়ে দিতে হবে। আমীর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। মানুষ বলে মিথ্যার জন্য নাকি সম্পর্ক ভেঙে যায়। কিন্তু আসলে সম্পর্ক ভাঙে সত্যের জন্য। একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে মিথ্যার কোনো বিকল্প নেই। এই যেমন আমীর কত সুন্দর মিথ্যা দিয়ে নিজের সম্পর্ক বাঁচিয়ে নিল!
আলিফ ফোন করছে। তোহা চোয়াল শক্ত করে ফোন কেটে দিল। তখনি আলিফ মেসেজ পাঠাল,” খুব ইমারজেন্সী তোহা। ফোন ধরো।”
আমীর জানে, তোহা ফোন ধরলেই বিপদ হবে। আলিফ নিশ্চয়ই পার্সেলের ব্যাপারে কিছু বলবে! আমীর মেসেজটা দেখা মাত্রই তোহার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে সুইচড অফ করে দিল। তোহা আশ্চর্য হয়ে বলল,” কি ব্যাপার?”
“আজকে সারারাত তোমার ফোন আমার কাছে থাকবে। আমরা গাড়ি নিয়ে শহর ঘুরবো। লং ড্রাইভ হবে।”
তোহার চোখমুখ ঝলমল করে উঠল,” সত্যি?”
” হুম।”
” কিন্তু রাতে বাড়িতে না ফিরলে সবাই টেনশন করবে।”
” আজাদকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে দিবো যে তুমি আমার সাথে আছো। কেউ টেনশন করবে না।”
তোহা আমীরের বাহু জড়িয়ে ধরে খুশি কণ্ঠে বলল,” ওকে।”
চলবে
®Sidratul মুন্তায
#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৫২.
আলিফ হন্তদন্ত অবস্থায় বাইরে এলো। তার মুখ দেখাচ্ছে করুণ। চেহারা ঘামছে ক্রমশ। ব্যতিব্যস্ত হয়ে সে আজাদকে আদেশ করল,” গাড়ি বের করো আজাদ। কুইক।”
আজাদ কৌতুহলী গলায় বলল,” স্যার, কি হয়েছে? এনি প্রবলেম?”
” তোহার ফোন সুইচড অফ দেখাচ্ছে। ওকে খুঁজতে যেতে হবে।” আলিফের কথা শুনে মনে হচ্ছে দুশ্চিন্তায় তার মাথা ফেটে যাবে।
আজাদ হাসি মুখে বলল,” কাম ডাউন স্যার। এতো প্রেশার নেওয়ার কিছু নেই। ম্যাম ভালো আছে।”
” তুমি কিভাবে জানলে যে ভালো আছে?”
” আমীর স্যার আমাকে ফোন করেছিলেন। উনি বললেন তোহা ম্যাম উনার সাথেই আছে। আজরাতে ফিরবে না।”
” ফিরবে না মানে? কেন ফিরবে না?” আলিফের মাথা গরম হয়ে গেল। আজাদ সরু কণ্ঠে বলল,
” সেটা তো আমি জানি না স্যার। আমাকে যেটুকু জানানো হয়েছে সেটুকুই আপনাকে বললাম।”
আলিফের ভয় হচ্ছে। তোহা আমীরের সাথে থাকলে ফোন সুইচড অফ রাখবে কেন? অথচ এই মুহূর্তে তোহাকে খুব বেশি দরকার। ভয়ংকর জরুরী ব্যাপার ঘটে গেছে। এই কথাটা সে তোহাকে কিভাবে জানাবে? দেরি হলেই তো সমস্যা!
” আজাদ, তুমি এক কাজ করো। আমাকে আমীরের হোটেলে নিয়ে চলো। তোহা ওর সাথে কি করছে তা জানা দরকার। ওর ফোন কেন সুইচড অফ থাকবে?”
আজাদ ইঙ্গিতপূর্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” স্যার, আপনি কি সত্যি ওখানে যাবেন? মানে আপনি শিউর?”
আলিফের মনে পড়ে গেল সেদিনের ঘটনা। তাকে টানা দুই ঘণ্টা পানিতে চুবানো হয়েছিল। সে কিছু সময় চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল,” না, না, আমি যাবো না। তুমি যাবে।”
” আমি কোথায় যাবো স্যার?”
” হোটেলে গিয়ে তোহাকে খবর দিবে যেন ইমিডিয়েটলি সে বাড়িতে আসে। তার সঙ্গে খুব জরুরী দরকার আছে আমার।”
” ওকে স্যার। আমি এখনি যাচ্ছি।”
” আচ্ছা, দাঁড়াও। শুধু এইটুকু বললে ও বুঝবে না। তুমি ওকে বলবে ওর বাবার ব্যাপারে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা। তাহলেই হবে।”
আজাদ ভ্রু কুচকে কিছু একটা চিন্তা করে বলল,” আচ্ছা স্যার, এটা কি ওই পার্সেল রিলেটেড?”
আলিফ কঠিন চোখে তাকাল। আজাদ মাথা নিচু করে বলল,” স্যরি।”
” হ্যাঁ পার্সেল রিলেটেড। তুমি তোহাকে অবশ্যই সাথে করে নিয়ে আসবে। ”
” আচ্ছা স্যার, পার্সেলটা কে পাঠিয়েছে? ”
আলিফ ধমক দিয়ে বলল,” তোমার এতোকিছু জানতে হবে কেন?”
” মানে পার্সেলটা কে পাঠিয়েছিল সেটা জানতে পারলে ভালো হতো। আমি শুনেছিলাম ম্যামের বাংলাদেশে কেউ নেই। তাহলে বাংলাদেশ থেকে তার জন্য পার্সেল কিভাবে এলো?”
” এতোকিছু তোমার জানার দরকার নেই। যতটুকু করতে বলেছি শুধু ততটুকু করো।”
” ম্যাম যদি প্রশ্ন করে পার্সেল কে পাঠিয়েছে তাহলে আমি কি বলব স্যার?”
আলিফ খুব রেগে তাকাল,” কিছুই বলতে হবে না। যাও।”
আজাদ বের হতে নিলে আলিফ আবার ডাকল। দরাজ গলায় বলল,” থামো, চলে যে যাচ্ছো হোটেলের এড্রেস জানো তুমি?”
আজাদ জীভ কেটে বলল,” না স্যার।”
“দাঁড়াও, টেক্সট করছি।”
আলিফ অগত্যা আজাদকে হোটেলের ঠিকানা টেক্সট করে দিল। তারপর আজাদ বের হলো। তার একটু হতাশ লাগছে। এতো কায়দা করেও পার্সেলের ব্যাপারে কোনো সঠিক ইনফরমেশন জানা গেল না।শুধু এইটুকু বোঝা গেল যে পার্সেলটা তোহার বাবার ব্যাপারে! এই খবরটাই আমীরকে জানাতে হবে। আজাদ ফোন করল,” হ্যালো স্যার।”
” হ্যাঁ বলো আজাদ।”
আমীর তখন তোহাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে আছে। খাবার অর্ডার করা হয়েছে। তোহা ওয়াশরুমে গেছে।
” স্যার, এই মাত্র আলিফ স্যারের সঙ্গে আমার কথা হলো। উনি তোহা ম্যাডামকে হন্যি হয়ে খুঁজছেন। পার্সেলের ব্যাপারে নাকি খুব জরুরী দরকার।”
আমীর সিরিয়াস হয়ে প্রশ্ন করল,” তুমি কিছু জানতে পেরেছো? কে পাঠিয়েছে ওই পার্সেল?”
“সেটা জানতে পারিনি স্যার। কিন্তু পার্সেলটা ম্যামের বাবার ব্যাপারে। আলিফ স্যার যেভাবে বলছিলেন তাতে মনে হলো খুবই জরুরী কিছু।”
আমীরের হাত কাঁপতে লাগল। এয়ারকুলারের নিচে বসেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। টিস্যু দিয়ে সেই ঘাম মুছতে মুছতে সে উচ্চারণ করল,” আর কিছু জানতে পেরেছো?”
” জ্বী না স্যার। তবে ছোটস্যার আমাকে বলেছেন তোহা ম্যাডামকে এই কথা জানাতে হবে। যেন উনি দ্রুত বাড়ি আসে। আমাকে হোটেলে যেতে বলেছেন। আমি কি আসব স্যার?”
” কোনো দরকার নেই। আমরা বাইরে আছি। যত জরুরী সংবাদই হোক মায়া আজরাতে ফিরতে পারবে না। এটা তোমার ছোটস্যারকে জানিয়ে দাও।”
” কিন্তু স্যার…”
আমীর কোনো কথা না শুনেই ফোন রেখে দিল। গলা শুকিয়ে আসছে তার। ওয়েটারকে ডেকে সে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি চাইল। তোহা সেই মুহূর্তে আমীরের পাশে এসে বসল। আমীরের মুখের অবস্থা খেয়াল করে বলল,”কি হয়েছে? শরীর ঠিকাছে তো?”
আমীর শুকনো ঢোক গিলে বলল,” ঠিকাছে।”
” শুনুন, আমি কিন্তু একটু পরেই বাসায় যাবো।”
” মানে? কিন্তু কথা তো ছিল আজকে সারারাত আমরা একসাথে কাটাবো।”
তোহা দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলল,” এটা সম্ভব না। সারারাত বাড়ি না ফিরলে ফুপু কি ভাববে? সব বাড়ির তো একটা নিয়ম-কানুন থাকে তাই না? রাতে বাড়ি না ফেরার ব্যাপারটা খুব খারাপ দেখায়। ”
” তার মানে তুমি চলে যেতে চাও?” আমীর মুখ গম্ভীর করে তাকিয়ে রইল। তোহা মুচকি হেসে বলল,” কাল সারাদিন আমরা ঘুরব। প্রমিস করছি। কিন্তু রাতে না, প্লিজ।”
” ঠিকাছে তুমি বসো। আমি ড্রিংকস অর্ডার দিয়ে আসছি।”
” অর্ডার দেওয়ার জন্য উঠতে হবে কেন? ওয়েটার ডাকুন।”
” ড্রিংকসটা উঠে গিয়েই অর্ডার করতে হয় এখানে।”
তোহা আশেপাশে তাকিয়ে বলল,” কই? সবাই তো বসেই অর্ডার দিচ্ছে। তাহলে আপনাকে কেন উঠতে হবে?”
আমীর তার কনিষ্ঠা আঙুল ইশারা করে বলল,” আমি ওয়াশরুমে যাবো। তখন অর্ডারটাও দিয়ে আসব।”
তোহা হেসে ফেলল,” আপনি এই সামান্য কথাটা বলতে এতো লজ্জা পাচ্ছিলেন? আশ্চর্য মানুষ। ঠিকাছে যান।”
আমীর দু’টো কোল্ড্রিংকস অর্ডার করল। তোহার গ্লাসে সে বাড়তি করে অ্যালকোহল মেশাতে বলে দিল। কাজটা অবশ্যই ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু তার কাছে অন্যকোনো পথ খোলা নেই। পার্সেলে কি আছে সেটা না জানা পর্যন্ত তোহাকে বাড়ি ফিরতে দেওয়া যাবে না।
অর্ডার দিয়ে আমীর চেয়ারে এসে বসল। তোহা বলল,” কতক্ষণ লাগবে?”
” তোমার কি বাসায় যাওয়ার অনেক তাড়া?”
তোহা লজ্জা পেয়ে বলল,” আসলে ফুপু টেনশন করবে সেজন্য। আপনি কি রাগ করছেন?”
আমীর জবাব দিল না। তোহা কাছে এসে আমীরের কাঁধে ভর দিয়ে বলল,” প্লিজ, রাগ করবেন না। আমার সিচুয়েশন বোঝার চেষ্টা করুন। আমি তো একটা ফ্যামিলির সাথে থাকি, তাই না?”
” হুম৷ আর আমার কোনো ফ্যামিলিই নেই। আমি কিভাবে বুঝবো ফ্যামিলির গুরুত্ব?”
আমীরের জবাব শুনে তোহা হতভম্ব হলো। আহত দৃষ্টিতে বলল,” এভাবে কথা বলছেন কেন? আমি এই কথা কখন বললাম?”
” বলোনি। কিন্তু কথাটা তো সত্যি।”
” আপনি কিন্তু অকারণেই রাগ দেখাচ্ছেন৷ এতো সামান্য একটা বিষয়ে রাগ করার কি আছে, বুঝলাম না।”
ওয়েটার দুই গ্লাস ড্রিংকস নিয়ে হাজির হলো। আমীর তোহার দিকে একটা গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,” তোমার জন্য স্পেশাল ড্রিংক।”
তোহা মনখারাপ করে বলল,” আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
আমীর কোমল গলায় বলল,” আচ্ছা স্যরি।”
তোহা আঁড়চোখে তাকাল। আমীর অনুরোধ করল,” এবার খাও।”
তোহা মুচকি হেসে গ্লাসে চুমুক দিল। সাথে সাথেই নাক কুচকে এলো তার। সন্দিহান গলায় বলল,” গন্ধটা এমন কেন? এতো তীব্র ঝাঁজালো টেস্ট…. হুইস্কির মতো লাগছে।”
” তুমি হুইস্কি ট্রাই করেছো?”
“করেছিলাম একবার। তাও ফ্রেন্ড ফোর্স করেছিল বলে।”
” তোমার কি এটা খেতে ভালো লাগছে না? চেঞ্জ করে দিতে বলবো?”
” থাক, দরকার নেই। শুধু শুধু নষ্ট হবে। খেয়ে নেই।”
এক গ্লাস খাওয়ার পর তোহার কেমন যেন অদ্ভুত অনুভব হতে লাগল। বুক জ্বালা করছে। তাও ভালো লাগছে। মাথার ওজন মনে হয় অনেকটাই হালকা হয়ে গেছে। আমীর ইচ্ছে করেই জানতে চাইল,” কেমন লেগেছে?”
তোহা মাতাল হাসি দিয়ে বলল,” দারুণ জিনিস।”
” আরেক গ্লাস দিতে বলি?”
” হ্যাঁ প্লিজ।”
সে পর পর পাঁচ গ্লাস শেষ করল৷ এবার মাথা তুলে বসেও থাকতে পারছে না। টেবিলে বেহুশের মতো মাথা কাত করে শুয়ে পড়ল। বিড়বিড় করে বলল,” আরও এক গ্লাস…. প্লিজ!”
” আর না, এমনিই অনেক বেশি হয়ে গেছে। এবার উঠো।”
” না, আমি উঠব না। ”
” তাহলে কি করবে?”
” এখানে ঘুমাবো।”
” এটা ঘুমানোর জায়গা না। গাড়িতে চলো।”
” গাড়ি কি তাহলে ঘুমানোর জায়গা?” তোহা খিকখিক করে হেসে উঠল। সবাই আগ্রহ নিয়ে এদিকে তাকাচ্ছে। আমীর অস্বস্তিবোধ করছে। তোহা সেটা বুঝতে পেরে ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরল। বাচ্চাদের মতো নাকী স্বরে বলল,” এতো জোরে হাসতে হয় না। শশশ!”
আমীর হতাশ ভঙ্গিতে তোহাকে কোলে ওঠালো। গাড়িতে বসে খুব গরম অনুভব করতে লাগল তোহা। সে ক্লান্ত গলায় বলল,” টপটা খুলে ফেলি? খুব গরম লাগছে।”
আমীর চোখ বড় করে তাকাল। বিপর্যস্ত গলায় বলল,” একদম না। এসি চলছে, তাও কেন গরম লাগবে?”
” জানি না। আমি খুলছি।”
” না, না!”
আমীর আটকানোর আগেই তোহা তার টপ খুলে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল। সেটা পতাকার মতো উড়তে লাগল বাতাসে। তোহা হাত তালি দিল। জোরে শিষ বাজালো। জানালা খুলে মাথা বের করল। তারপর হাত নেড়ে চিৎকার দিয়ে বলল,” টাটা, বাই-বাই, সি ইউ গাইজ। ”
আমীর হাত ধরে টেনে তোহাকে ভেতরে ঢোকাল। নিজের টি-শার্ট খুলে তোহার গায়ে জড়িয়ে দিতে দিতে বলল,” সবাই দেখছে তোমাকে। ”
তোহা সাথে সাথে সেটা সরিয়ে বলল,” উফ, গরম।”
আমীর জোর করে তাকে সেটা পরাতেই সে ভুরভুর করে বমি ছেড়ে দিল। আমীরের মাথার চুল, চোখের চশমা সবকিছু ভিজে একাকার। সে চশমা খুলে রাখতে না রাখতেই তোহা আরেক দফা বমি করল।
হোটেলে ঢোকার সময় প্রত্যেকের তব্দা খাওয়া দৃষ্টি আমীরকে উপেক্ষা করতে হলো। আফশান আর শাহেদ হুমড়ি খেয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমীর তখন খালি গায়ে। তার শরীরে বমির আঠালো প্রলেপ লেগে আছে৷ তার কোলে তারই টি-শার্ট পরে বেহুশের মতো ঘুমাচ্ছে তোহা। শাহেদ থতমত খাওয়া গলায় বলল,” হোয়াট হ্যাপেন্ড স্যার? আপনার এই হাল কি করে হলো?ম্যাডামের কি হয়েছে?”
আমীর কোনো জবাব না দিয়ে রুমে ঢুকল। পেছন থেকে আফশান বলল,” কিছু লাগবে স্যার? ম্যাডামের জন্য ডাক্তার?”
” কোনো দরকার নেই।”
তোহাকে বিছানায় যত্ন করে শুইয়ে দিল আমীর। গায়ে কাঁথা টেনে তার গালে হাত রাখল৷ সেই মুহূর্তে তোহা আমীরের হাতটা জড়িয়ে ধরে বলল,” খুব টায়ার্ড লাগছে। আমার মাথাটা এভাবে ঘুরছে কেন? মনে হচ্ছে এখনি ঘাড় থেকে আলাদা হয়ে উড়ে কোথাও চলে যাবে।”
তোহা কথা বলছে অস্পষ্ট স্বরে। তার চোখ দু’টি বোজা। আমীর আলতো করে তোহার মাথায় হাত বুলালো। তার পাশে বসে আদুরে গলায় বলল,” আই এম স্যরি। তোমার এ অবস্থা করতে আমি চাইনি। কিন্তু আমি নিরুপায়৷ তোমাকে আমি হারাতে পারব না মায়া। সবকিছুর বিনিময়ে হলেও আমি শুধু তোমাকে চাই। কতটা ভীষণভাবে যে চাই তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”
আমীর তোহার কপালে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার ছাড়তেই তীক্ষ্ণ অপরাধবোধ শক্ত কাঁটার মতো জাপটে ধরল তাকে। টিস্যু পেপার দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে আমীর চিন্তা করল, তার বিরাট ভুল হয়ে গেছে। তোহাকে ঘুমের ঔষধও দেওয়া যেতো। ড্রিংক করানো একদম উচিৎ হয়নি। সে আগে নিশ্চয়ই কখনও এভাবে ড্রিংক করেনি। এটা তার স্বাস্থ্যের উপর খুব খারাপ প্রভাব ফেলবে। তবে একটা ব্যাপার ভালো, তোহা যতক্ষণ এভাবে থাকবে ততক্ষণ অন্তত বাড়ি ফিরতে চাইবে না। আর এর মধ্যেই পার্সেলটার কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
চলবে
® Sidratul মুন্তায
#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৫৩.
সকালে ঘুম ভাঙার পর থেকেই তোহার মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। তার জীবনে এতো অদ্ভুত সকাল আগে কখনও হয়নি। তার গায়ে আমীরের ট্রাউজার আর টি-শার্ট কি করে এলো সে বুঝতে পারছে না। এই অবস্থায় সে বাড়ি ফিরবে কি করে? গতরাতে কি হয়েছিল কিছুই মনে পড়ছে না। আমীর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। তার হাতের লম্বা ট্রে-তে কফি আর স্যান্ডউইচ। সেগুলো পাশের টেবিলে রেখে জানালার পর্দা সরিয়ে দিল। হড়বড় করে রোদ প্রবেশ করল ঘরে। তোহা জড়সড় হয়ে বসে আছে। তার চোখেমুখে বিভ্রান্তি আর কৌতুহল। আমীর ঠিক তার বরাবর বসে কোমল কণ্ঠে বলল,” আমি আমার পুরো জীবনে এতো বেসামাল হয়ে কাউকে ঘুমাতে দেখিনি।”
তোহার ভ্রু দু’টো আপনা-আপনি কুঁচকে এলো। বিরস স্বরে বলল,” মানে? আমি কিভাবে ঘুমিয়ে গেলাম? কি হয়েছিল আমার?”
আমীর এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ টানল,” রাতে কতবার ডাকলাম। একবারও উঠলে না৷ সকালেও ডেকেছি। তোমার সাড়া নেই। অথচ তোমার চিন্তায় আমি সারারাত একদম ঘুমাতে পারিনি।”
আমীর হাই তুলল। কফির কাপ হাতে নিয়ে বলল,” এখন ব্রেকফাস্ট করে তুমি চুপচাপ এখানে বসে থাকবে। আমি একটু ঘুমাবো। তুমি আদর করে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে।”
তোহা মুখ শক্ত করে বলল,” আমার সাথে হেঁয়ালি করবেন না। রাতে কি হয়েছিল সেটা বলুন। আমার জামা-কাপড় কোথায়?”
আমীর আহত গলায় বলল,” তোমার কি কিছুই মনে নেই?”
” না।”
আমীর হাসল। তার হাসি দেখে তোহা আরও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল,” কি হয়েছে?”
” বললে তুমি বিশ্বাস করবে না৷ তার চেয়ে ভালো না বলি!”
তোহা ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে। তার রাগ উঠে যাচ্ছে। মনে চাইছে গরম কফির কাপ তুলে আমীরের মুখে ছুঁড়ে মারতে। সে এমন রহস্য করে কথা বলছে কেন? ঘটনা যেমনই হোক, সরাসরি বলে দিলেই তো হয়। আমীর তোহার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। তোহা চমকে উঠল। আমীর চোখ বুজে আয়েশ করে বলল,” তুমি কি গান জানো মায়া? একটা গান শুনাও তো। ছোটবেলায় মা আমাকে গান শুনিয়ে ঘুম পারাতো।”
” আমি আপনার মা না।”
” মা না হলেও তুমি আমার অনেক কিছু। জীবনে খুব মানুষকেই আমি নিজের কাছাকাছি থাকার সুযোগ দেই। তুমি হলে তাদের মধ্যে দ্বিতীয়জন।”
আমীরের ফোন বেজে উঠল। আজাদের নাম্বার। গতরাতে সে দূর্দান্ত কাজ করেছে। সেজন্য তাকে ধন্যবাদ দেওয়া হয়নি এখনও। আমীর শোয়া থেকে উঠে বসল। তোহাকে ব্রেকফাস্ট করতে বলে মোবাইল নিয়ে বারান্দায় এগিয়ে গেল। তোহার মেজাজ অতিরিক্ত খারাপ হয়ে আছে৷ আমীরের সাথে কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। সে বিছানা থেকে নামল। তারপর আমীরের অগোচরেই রুমের বাইরে চলে এলো। আফশান করিডোরে কাউচে বসে টিভি দেখছে। তোহাকে বের হতে দেখেই সে উঠে এলো,” ম্যাডাম, কিছু লাগবে আপনার?”
লোকটা এতো বিনয়ের সাথে কথা বলে যে তোহা প্রত্যেকবার খুব অপ্রস্তুত হয়৷ এবারও হলো। ইতস্তত করে বলল,” আফশান ভাই, আমাকে একটা ট্যাক্সি ঠিক করে দিতে পারবেন?”
” ট্যাক্সি… মানে আপনি কি চলে যাচ্ছেন? স্যার কোথায়?”
” আমি জানি না উনি কোথায়। আমি এখন বাড়ি যাবো। আপনি ট্যাক্সি ঠিক করে না দিলে আমি নিজেই ঠিক করে নিবো।”
তোহার জবাব শুনে আফশান হকচকিয়ে গেল। তোহা হনহন করে বেরিয়ে যাচ্ছে। আফশান কি করবে বুঝতে না পেরে পেছন পেছন গেল। বারান্দা থেকে আমীর তাদের দু’জনকেই সড়কে দেখতে পেল। আফশান ইশারায় আমীরের কাছে জানতে চাইল যে সে এখন কি করবে? আমীর ইশারায় বলল তোহাকে ছেড়ে দিতে। তখন আফশান বলল,” ম্যাডাম দাঁড়ান, আমি এখনি আপনার জন্য ট্যাক্সি নিয়ে আসছি।”
” থ্যাঙ্কিউ। ”
সে ট্যাক্সি এনে অগ্রীম ভাড়াও দিয়ে দিল। তোহা ট্যাক্সিতে ওঠার সময় হঠাৎ কি মনে করে যেন উপরে তাকাল একবার৷ আমীর বারান্দা দিয়ে তাকেই দেখছে। সে তাকানো মাত্রই হাত নেড়ে বিদায় জানালো আমীর। তোহা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল।আমীরকে না জানিয়েই সে হোটেল থেকে বের হয়ে গেছে। কাজটা কি ঠিক হয়েছে? এমনও তো হতে পারে, সে যা ভাবছে সেরকম কিছুই হয়নি। অযথাই উল্টা-পাল্টা ভেবে রাগ দেখানো উচিৎ না। কিন্তু তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। গতরাতের ব্যাপারটা ঠিকভাবে মনে না করা পর্যন্ত সে আমীরের সামনে দাঁড়াতে পারবে না৷
__________________
সারারাত ধরে তোহার জন্য অপেক্ষা করেছে আলিফ। তার ঘুম হয়নি৷ শেষরাতে একটু ঘুমিয়েছিল। ভোরে আবার ঘুম ছুটে গেছে। পরে আর একবারও ঘুম আসেনি। এর মধ্যেই একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে গেছে। আলিফ ঠিক করে রেখেছে এইবার তোহা বাড়ি ফিরলে সে এমন ব্যবস্থা করবে যেন তোহা আর ঘরের বাইরেই বের হতে না পারে।
এই কথা শুনে কথা বলল,” কি করবে? দরজার বাইরে তালা দিয়ে রাখবে?”
আলিফ তেজ নিয়ে বলল,” প্রয়োজন হলে সেটাই করব। মেয়েটা সারারাত ধরে বাড়ি ফিরেনি। তুমি কি বুঝতে পারছো পরিস্থিতি কত ভয়াবহ?”
কথা মুখ মলিন করে বসে রইল। আলিফ সারাদিন তোহাকে নিয়ে যে পরিমাণ চিন্তা করে তার সিকিভাগও যদি নিজের স্ত্রীকে নিয়ে করতো তাহলে কথার স্ত্রী জীবন ধন্য হতো! কথা চায় খুব দ্রুত আমীরের সাথে তোহার বিয়েটা হয়ে যাক। ওই মেয়ে যত জলদি এই বাড়ি থেকে বিদায় হবে ততই শান্তি। তার স্বামীর মাথাটা পুরো খারাপ করে রেখে দিয়েছে ওই মেয়ে। আচ্ছা, সেই কবে থেকে তো তোহার বিয়ের কথা চলছে। এখনও সব ঠিকঠাক হচ্ছে না কেন? কথা এই ব্যাপারে শাশুড়ীর সাথে আলাপ করার জন্য বের হলো। তখনি সে দেখল সদর দরজা দিয়ে তোহা ঢুকছে। সে একবার নিজের রুমে উঁকি দিল৷ আলিফ এতোক্ষণ পায়চারী করছিল। এবার বিছানায় ঝিম মেরে বসে আছে। সে এখনও তোহাকে দেখেনি। কথা এই ফাঁকে দরজা ভিড়িয়ে তোহার কাছে গেল।
” গুড মর্ণিং ননদী। অবশেষে বাড়ির কথা মনে পড়ল? সারারাত কি করেছো? শুনলাম নাকি আমীর সাহেবের হোটেলে ছিলে? ”
তোহা আড়ষ্ট গলায় বলল,” আমি আসলে একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম৷ তাই রাতে ফিরতে পারিনি৷ ফুপু কি আমার ব্যাপারে কিছু বলেছে?”
” কি জানি? আমার মায়ের সাথে এ ব্যাপারে কথা হয়নি৷ তা তোমরা বিয়ে করছো কবে? শুধু কি প্রেম করে বেড়ালেই চলবে? বিয়ে-শাদী নিয়েও তো কিছু ভাবতে হবে নাকি?”
তোহা খুব উশখুশ করতে করতে অবশেষে বলল,” তোমাকে একটা প্রশ্ন করি ভাবি? কিছু মনে করবে না তো?”
” আমি আবার কি মনে করব? আমার মনে করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। বলো, কি প্রশ্ন?”
তোহা বুঝতে পারছে না কি করে বলবে? ফিসফিসিয়ে উচ্চারণ করল,” আচ্ছা, কোনো মেয়ে যদি প্রেগন্যান্ট হয় তাহলে সেটা কয়মাসে বোঝা যায়?”
কথা চোখ বড় করে তাকাল। হতভম্ব হয়ে আওড়াল,” তুমি কি প্রেগন্যান্ট?”
” না।”
” তাহলে এই প্রশ্ন করছো কেন?”
দু’জন-দু’জনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। কেউই কোনো কথা বলছে না। তোহার মনে হচ্ছে সে বিরাট বোকা। এই প্রশ্নটা কথাকে জিজ্ঞেস করার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। গুগলে অনুসন্ধান করলেই হতো।
আলিফ আচমকা ছুটে এলো। তোহাকে দেখেই হড়বড় করে বলল,” কোথায় ছিলে তুমি? জানো সারারাত টেনশনে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। আজাদকে দিয়ে খবর পাঠানোর পরেও কেন এলে না?”
তোহা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল। আজাদকে দিয়ে খবর পাঠানো হয়েছে মানে? সে কোনো খবর পায়নি। তবে এই মুহূর্তে আলিফের সাথে তর্ক করতে একদম ইচ্ছে করছে না। তোহা কথার দিকে চেয়ে ক্লান্ত গলায় প্রশ্ন করল,” ফুপু কোথায় ভাবি?”
” ঘরেই আছে। ”
” আমি তাহলে দেখা করে আসি।”
আলিফকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তোহা চলে যেতে নিচ্ছিল। আলিফ তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,” এই মেয়ে, আমার কথা কি তোমার কানে যাচ্ছে না? আমি কি জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দাও আগে।”
তোহা থামছে না দেখে আলিফ তার হাত চেপে ধরল। কথা অপ্রসন্ন মুখে বলল,” কি শুরু করলে? মেয়েটা মাত্র এসেছে। আগে ওকে রেস্ট নিতে দাও।”
” আমার এখুণি ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে। তোহা আমার দিকে তাকাও। কতকিছু যে ঘটে গেছে সেই ব্যাপারে তোমার কোনো আইডিয়া নেই।”
তোহা রুক্ষ গলায় বলল,” আমার হাত ছাড়ো। এই মুহূর্তে তোমার সাথে কথা বলতে চাই না৷ যেকোনো সময় বেয়াদবি করে ফেলতে পারি। সেটা নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগবে না।”
আলিফ বিস্মিত গলায় বলল,” তুমি আমার সাথে এই টোনে কথা বলছো কেন? তোমার কি হয়েছে?”
তোহা ঘুরে দাঁড়িয়ে কটমট করে বলল,” তোমার মতো মিথ্যাবাদীর সঙ্গে কি তাহলে মধুর স্বরে কথা বলতে হবে? এখনও যে আমি তোমার কথার জবাব দিচ্ছি সেটাই বেশি।”
আলিফের মুখ ছাইবর্ণ ধারণ করল। সে বুঝতে পারছে আমীর তাকে সব বলে দিয়েছে। আস্তে করে তোহার হাতটা ছেড়ে গম্ভীর হয়ে গেল সে। তোহা তীব্র ক্রোধ নিয়ে বলল,” খবরদার আমার সামনে আসবে না তুমি।”
হনহন করে হেঁটে চলে গেল তোহা। আলিফ দাঁড়িয়ে রইল শক্ত হয়ে। কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। সে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,” ও এমন ব্যবহার কেন করল তোমার সাথে?”
আলিফ কোনো উত্তর দিল না। সোজা হেঁটে ঘরে ঢুকে গেল।
জাবিদা বিছানার চাদর ভাঁজ করছিল। তোহা গিয়ে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। জড়ানো গলায় বলল,” ফুপু।”
জাবিদা আশ্চর্য হয়ে বলল,” তুই কখন এলি? সারারাত কই ছিলি? বাড়ি ফিরিসনি কেন?”
” স্যরি। আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তারপর হোটেলেই ঘুমিয়ে গেছি। তুমি রাগ করোনি তো?”
” রাগ করব কেন? রাতে যে ফিরবি না সেই কথা আমাকে জানাবি না?”
তোহা মাথা নিচু করল। জাবিদা তার হাতের রিং লক্ষ্য করে বলল,” এটা কোথায় পেলি? দেখে তো মনে হচ্ছে খুব দামী। ডায়মন্ড নাকি?”
তোহা এতোক্ষণ লক্ষ্য করেনি। সে তো রিংটা ফেরত দিয়েছিল। আমীর আবার তাকে পরিয়েছে। তোহা লজ্জিত গলায় বলল,” হয়তো।”
” তোদের তাহলে এংগেজমেন্টও হয়ে গেছে? অথচ আমরা কিছুই জানি না?”
” এরকম কোনো ব্যাপার না ফুপু। তোমাদের না জানিয়ে আমি কিছু করব না। ও আমাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করেছে। আমি এখনও হ্যাঁ বলিনি।”
” হ্যাঁ না বললে আংটি নিয়েছিস কেন? এটা নেওয়া মানেই তো তুই রাজি। বোকা মেয়ে।”
তোহা মুখ গোমরা করে জাবিদার গলা জড়িয়ে ধরল। কাঁধে মাথা রেখে উদাস গলায় বলল,” আমি না কিছু বুঝতে পারছি না ফুপু। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে বাবা যদি থাকতো! আমি তার কাছে একটা সাজেশন চাইতাম। আমার সব প্রবলেম সোলভ হয়ে যেতো।”
” কি সাজেশন চাইতি? আমাকে বল। দেখি আমি তোকে সাহায্য করতে পারি কি-না।”
তোহা চোখ মুছতে মুছতে বলল,” কিছু না৷ আমি গেলাম।”
” আরে শোন, এংগেজমেন্ট যখন করেই ফেলেছিস তখন বিয়েটাও করে ফেল না! একটা আকদের অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়? সকালে হবে এংগেজমেন্ট পার্টি। সন্ধ্যায় আকদ। আইডিয়াটা কেমন?”
তোহা কোনো উত্তর না দিয়ে ঘরে চলে এলো। দরজা আটকে গোসলে ঢুকল। লম্বা সময় নিয়ে সে গোসল করল। শাওয়ারে দাঁড়িয়ে থাকার সময় তার দুই চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছিল।
দীর্ঘসময়ের গোসল শেষ করে তোহা যখন বের হলো, তখন আলিফ তার বিছানায় বসে আছে৷ তোহা প্রায় আৎকে উঠল। দরজার দিকে একপলক তাকিয়ে বলল,” তুমি কিভাবে ঘরে ঢুকলে? দরজা তো লক ছিল।”
” এক্সট্রা চাবি দিয়ে খুলেছি। তোমার সাথে আমার খুব জরুরী কথা আছে।”
তোহার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। গোসল করে মাথা অনেক কষ্টে ঠান্ডা হয়েছিল। এখন আবার গরম হচ্ছে। সে রূঢ় স্বরে বলল,” তুমি একটা মেয়ের ঘরে এভাবে ঢুকে যেতে পারো না৷ এটা কোনো ভদ্রতার কাতারেই পড়ে না। অবশ্য তোমাকে আমি ভদ্রতা কি শিখাবো? ন্যূনতম সুশিক্ষাও তোমার মাঝে নেই। তাহলে ওসব নোংরা কাজ করতে না।”
” তুমি অনেক বেশি বলে ফেলছো তোহা৷ আমি তোমার ভালোর জন্য সব করেছি।”
তোহা মুখ বিকৃত করে বলল,” আমার ভালোর জন্য তুমি আমার ফিয়্যান্সের কাছে আমার নামে নোংরা কথা বলেছো? সিরিয়াসলি?”
আলিফ চোয়াল শক্ত করে বলল,” যাকে তুমি ফিয়্যান্সে বলছো সে একটা ধূর্ত কালসাপ। ওই ছেলেকে বিয়ে করা তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল সিদ্ধান্ত হবে আমি বলে রাখলাম।”
তোহা ক্রোধে আঙুল উঠিয়ে বলল,” আমীরের নামে আর একটাও বাজে কথা শুনতে চাই না৷ জাস্ট গেট লস্ট।”
আলিফ গেল না। কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ধীরে ধীরে তোহার কাছে এলো। খুব ঠান্ডা গলায় উচ্চারণ করল,” ছোটমামা যে খু-ন হয়েছে এই কথা কি তুমি জানো?”
হঠাৎ এমন প্রসঙ্গ শুনে তোহা মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল,” মানে?”
আলিফ মাথা নেড়ে বলল,” আমার কাছে ইনফরমেশন এসেছে। তার মৃ-ত্যু কোনো দূর্ঘটনায় হয়নি। তুমি হয়তো ভাবছো তোমার বাবা কোনো মিশনে গিয়েছিলেন। সেখানে কারো থেকে গুলি লেগে তিনি আহত হয়েছেন তারপর তার মৃ-ত্যু হয়েছে। কিন্তু ঘটনা আসলে সেরকম ঘটেনি। তাকে খুব ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা মাফিক তুলে এনে হত্যা করা হয়েছে। অথচ কেউ এই ব্যাপারটা জানে না। তুমিও নিশ্চয়ই জানতে না।”
তোহার চোখ ভিজে আসছে। সে কাঁপা গলায় বলল,” তুমি এসব কিভাবে জানো?”
” আমার কাছে কাল সন্ধ্যায় একটা পার্সেল এসেছিল। উড়ো পার্সেল। প্রেরকের নাম নেই। পার্সেলটা মূলত তোমার জন্য এসেছিল। তুমি বাড়িতে ছিলে না সেজন্য আমিই খুলে দেখেছি।”
” কোথায় সেই পার্সেল? আমার কাছে দাও।”
আলিফ চুপসে যাওয়া কণ্ঠে বলল,” এটাই তো সমস্যা তোহা। সকাল থেকে পার্সেলটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
তোহা রেগে উচ্চারণ করল,” তুমি আমার সাথে ফাজলামি করছো নাকি?”
” আমার কথা বিশ্বাস না হলে আজাদকে প্রশ্ন করে দেখতে পারো। সে নিজের চোখে দেখেছিল ডেলিভারিম্যান পার্সেল নিয়ে এসেছে।”
তোহা অবিলম্বে বাগানে ছুটে গেল। আলিফও তার পেছনে গেল। তোহা আজাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,” পার্সেল কখন এসেছিল আজাদ ভাই?”
আজাদ দারুণ বিস্ময় নিয়ে বলল,” স্যরি ম্যাম… বুঝলাম না। পার্সেল মানে?”
তোহা রুক্ষ দৃষ্টিতে আলিফের দিকে তাকাল। আলিফ রাগী স্বরে বলল,” গতকাল একটা পার্সেল এসেছিল না? তোমার সামনেই তো রিসিভ করলাম আমি।”
আজাদ হেসে বলল,” ও স্যার বুঝেছি। আপনার অফিসের পার্সেলটা?”
আলিফ হকচকিয়ে বলল,” আমার অফিসের পার্সেল হবে কেন? ওইটা বাংলাদেশ থেকে এসেছিল তোহার কাছে। তোহার বাবার ব্যাপারে। এই কথা তোমাকে বলিনি?”
আজাদ হৃষ্টচিত্তে বলল,” কি জানি স্যার! আপনি তো আমাকে পার্সেল দেখতেও দেননি। ভেতরের খবর আমি কি করে জানবো?”
আলিফ তেড়ে এসে আজাদের শার্টের কলার চেপে ধরল। বিশ্রী গালি দিয়ে বলল,” ওভারস্মার্ট সাজার চেষ্টা করবি না।” সে ঘুঁষি মা-রতে উদ্যত হলেই তোহা থামাল,” আরে কি করছো? পাগল নাকি তুমি? খবরদার গায়ে হাত তুলবে না।”
” তোহা, এই বেটা মিথ্যা বলছে। তুমি এই বেটার কথা বিশ্বাস করলে বিপদে পড়বে।”
তোহা হাত ভাঁজ করে বলল,” কে যে কতটা মিথ্যা বলতে পারে তা আমার বোঝা হয়ে গেছে।”
কথা শেষ করে সে ভেতরে চলে গেল। আলিফ উত্তপ্ত দৃষ্টিতে বলল,” এটা তুমি কি করলে? তোহার সামনে মিথ্যা কথা কেন বললে?”
আমীর গাড়ি নিয়ে পার্কিং লটে ঢুকল। তাকে দেখে আলিফ আর আজাদ দু’জনেই স্থির হয়ে গেল। গাড়ি থেকে বের হতে হতে আমীর হাস্যমুখে বলল,” আলিফ সাহেব, কি খবর?”
আলিফ কোনো জবাব দিল না। কেমন ঝিম ধরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার হাত তখনও আজাদের কলারে। আমীর ধীরে-সুস্থে তাদের কাছে এসে দাঁড়ালো। আলিফের হাতটা আজাদের কলার থেকে সরাতে সরাতে স্পষ্ট গলায় বলল,” এতো মাথা গরম করা শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য ঠিক না আলিফ সাহেব। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। আপনি কেন বোঝেন না?”
আলিফ কোনো কথা বলল না। আজাদের চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। দেখে মনে হচ্ছে সে আনন্দই পাচ্ছে। আলিফ নিশ্চিত আজাদের সাথে আমীরের যোগসূত্র আছে। হয়তো আমীর নিজেই আজাদকে এই বাড়িতে পাঠিয়েছে। জহুরী চোখে তাদের দু’জনকে দেখতে দেখতে আলিফ ভেতরে চলে গেল।
তোহা মাত্র এসে বিছানায় বসেছে। হেয়ার ড্রায়ার হাতে নিয়েছে চুল শুকানোর জন্য। ঠিক তখনি আমীর ঘরে ঢুকল। তাকে দেখে বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল তোহা,” আপনি?”
আমীর হাসল। তোহা রাগী গলায় বলল,” আপনি আবার আমার বাড়িতে এসেছেন? এভাবে যখন তখন এলে সবাই কি ভাববে?”
” কে কি ভাবল তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার একমাত্র মাথাব্যথা হলো তুমি কি ভাবছো সেটা নিয়ে।”
” মানে?”
আমীর কাছে এসে তোহার হাত থেকে হেয়ার ড্রায়ার কেঁড়ে নিল। নিজেই চুল শুকিয়ে দিতে দিতে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল,” তখন ওভাবে চলে এসেছিলে কেন?”
” জানি না।” তোহার কণ্ঠে অভিমান। আমীর বলল,” গতরাতের ঘটনা মনে করতে পারছো না বলে কি অস্বস্তি লাগছে? এতো আনইজি ফীল করার কিছু নেই। বি ইজি। কালরাতে তেমন কিছুই হয়নি৷ তুমি মরার মতো ঘুমিয়েছো আর আমি পাহারা দিয়েছি। বমি করার কারণে তোমার ড্রেস নষ্ট হয়ে গেছিল।”
তোহা মাথায় হাত রেখে বলল,” আমার কিছু মনে পড়ছে না।”
” সম্ভবত ড্রিংক্সে অ্যালকোহল ছিল।”
” আমারও এই সন্দেহ হচ্ছে। কিন্তু তারা অনুমতি ছাড়া ড্রিংকে নেশাদ্রব্য মেশাবে কেন? ওই রেস্টুরেন্টের নামে তো মামলা দেওয়া উচিৎ। ”
” রিল্যাক্স। তুমি কি ভেবেছো সত্যি করে বলো। তোমার ইনসেন্সিবল অবস্থার সুযোগ নিয়ে আমি কিছু উল্টা-পাল্টা করেছি? ”
তোহা অপরাধী কণ্ঠে বলল,” একদম না। আমি এসব কেন ভাববো?”
” তাহলে আমার চোখের দিকে তাকাতে পারছো না কেন?”
তোহা আমীরের চোখের দিকে চেয়ে বলল,” আই এম স্যরি।”
” স্যরি বলতে হবে না৷ তোমার আমাকে সন্দেহ করার একশো পার্সেন্ট রাইট আছে। কিন্তু একটা রিকোয়েস্ট প্লিজ। সন্দেহ কখনও নিজের মধ্যে পুষে রাখবে না। সরাসরি আমাকে প্রশ্ন করবে। যেন আমি সাথে সাথে সব ক্লিয়ার করে দিতে পারি।”
তোহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
” কি সিদ্ধান্ত?”
” আমি আমার বাবার খু-নিকে খুঁজে বের করব।”
আমীরের হাত থেমে গেল। সে হায়ার ড্রায়ার চালানো বন্ধ রেখে তোহার সামনে এসে বসল। সিরিয়াস গলায় বলল,” খুবই ভালো কথা। কিন্তু সেজন্য তো আমাদের বাংলাদেশে যেতে হবে। বিয়ের পর আমরা…”
আমীরকে কথা শেষ করতে না দিয়েই তোহা বলল,” বাবার খু-নিকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আমরা বিয়ে করব না। এটাই আমার ডিসিশন।”
আমীর কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অস্বাভাবিক গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” ভালো।”
চলবে
® Sidratul Muntaz