ওয়ান ফোর থ্রি পর্ব-৫৪+৫৫

0
479

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৫৪.
ভবনটি অনেক উঁচু। লিফটে ওঠার পর তোহা কনফিউজড হয়ে গেল। তাকে সাত তলায় যেতে হবে নাকি আটতলায়? লিফটম্যানকে জিজ্ঞেস করলেই হয়। ইউনিফর্ম পরিহিত একজন ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন। তোহা ইংরেজিতে প্রশ্ন করল,” সাইকোলজিস্ট ইরফান মির্জা কয়তলায় বসেন বলতে পারবেন?”

সম্ভবত লোকটি তার কথা বুঝতে পারছে না। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আগে তোহা জানতো বিদেশী দেখলে শুধু বাঙালিরাই এভাবে তাকিয়ে থাকে। এখন দেখা যাচ্ছে ইতালিয়ানদের মধ্যেও এই রোগ আছে। মানুষ যে দেশেরই হোক, কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য সবার মধ্যেই বিদ্যমান। তোহা আবার প্রশ্ন করল,” ইরফান মির্জার কেবিন কয়তলায়?”

লোকটি কথা না বলে লিফটের সুইচ টিপে দিল। আটতলায় উঠছে লিফট। বড় করে সাইনবোর্ডে ইংরেজিতে লেখা,”Mental Health Organisation.” সে কাঁচের দরজা পুল করে ভেতরে ঢুকল। একজন মহিলা এসিস্ট্যান্ট এসে জিজ্ঞেস করল,” আপনার কি কোনো এপয়েন্টমেন্ট আছে?”

” জ্বী। আমি ফোন করেছিলাম। আজ বিকাল পাঁচটায় ইরফান মির্জার সাথে আমার এপয়েন্টমেন্ট আছে।”

তোহা তার ফোন বের করে একটা মেসেজ দেখালো। মেয়েটি বলল,” আপনি ভেতরে যেতে পারেন।”

” আসসালামু আলাইকুম, স্যার। আমি কি আসব?”

ইরফান মির্জা মিষ্টি করে হেসে বললেন,” আসুন।”

তোহা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,”আমি কথা ভাবীর ননদ। উনি আমাকে আপনার সাথে দেখা করতে বলেছিলেন।”

” ও, হ্যাঁ। কথা আমাকে রাতে ফোন করেছিল। বসুন প্লিজ।”

তোহা বসল। বিদেশে বাঙালী সাইকোলজিস্ট খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ইরফান মির্জা নাকি কথার দূর সম্পর্কের মামা হয়। একজন মনোবিজ্ঞানীর সাথে কনসাল্ট করা তোহার জন্য অত্যন্ত জরুরী৷ গত তিনরাত ধরে সে ঘুমাতে পারছে না।

ইরফান গম্ভীর স্বরে বললেন,” আপনার সমস্যার কথা আমি শুনেছি। বিস্তারিত আপনি বলে যান। আমি নোট করছি।”

তোহা প্রথম থেকে সবকিছু বলল। ব্যক্তিগত বিষয়গুলো বলতে নিয়ে সে বার-বার আটকে যাচ্ছিল। ইরফান বললেন,” আমার কাছে সংকোচের কিছু নেই। যত দ্রুত ফ্রী হতে পারবেন ততই ভালো। ”

তোহা তার আর আমীরের সম্পর্কের বিষদ বর্ণনা দিল৷ বাবার মৃ-ত্যুর পর সে এই পর্যন্ত কয়বার বাবাকে স্বপ্ন দেখেছে তাও জানালো। সবশেষে বলল,” আমি জানি না আমার এই চিন্তা কতটুকু যৌক্তিক। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি একটু শান্ত হতে পারছি না। গত তিনদিন ধরে এই দুশ্চিন্তা আমাকে জ্বালিয়ে মা-রছে। আমি আমার বাবার খু-নিকে যেভাবেই হোক খুঁজে পেতে চাই।”

ইরফান ভ্রু কুটি করে বললেন,” আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, আপনি কাউকে সন্দেহ করেন।”

” জ্বী।”

” কে সেই ব্যক্তি?”

” আমীর।”

কিছুক্ষণের নীরবতা। হঠাৎ ইরফান অবাক হয়ে বলে উঠলেন,” আপনি নিজের বয়ফ্রেন্ডকেই বাবার খু-নি হিসেবে সন্দেহ করছেন?”

তোহা মাথা নেড়ে বলল,” জ্বী। আমি জানি আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। অযথা তাকে সন্দেহ করার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যাও নেই। কিন্তু আমার মন বলছে, বাবার মৃ-ত্যুর পেছনে কোনো না কোনোভাবে সে জড়িত। সে কিছু একটা জানে। সে আমার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত কিছু একটা লুকাতে চায়। আমি তার চোখের ভাষা বুঝতে পারি। সে সবসময় অপরাধবোধে ভুগছে এমন মনে হয় আমার।”

ইরফান কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তোহা খুব অস্থিরবোধ করছে। তার গলা শুকিয়ে আসছে। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে সে একটু পানি খেয়ে নিল। ইরফান প্রশ্ন করলেন ভাবুক স্বরে,” আপনি কতদিন ধরে তাকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছেন?”

” যেদিন থেকে আমার কাছে ওই পার্সেলটা আসে, সেদিন থেকেই।”

” পার্সেল মানে? এই ব্যাপারে আপনি আগে বললেননি।”

তোহা মাথায় হাত রেখে বিষণ্ণ গলায় বলল,” বলিনি কারণ এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। পার্সেলটা যেদিন এসেছে সেদিন আমি বাড়িতে অনুপস্থিত৷ বাংলাদেশ থেকে কেউ পার্সেলটা পাঠিয়েছিল। সে আমাকে আমার বাবার খু-নি সম্পর্কে কিছু বলতে চায়। পার্সেলটা রিসিভ করেছিল আলিফ ভাইয়া। এখন পর্যন্ত সেটা আমার হাতে আসেনি। আলিফ ভাইয়ার ভাষ্যমতে জিনিসটা হারিয়ে গেছে। এখন কথা হলো, আমি যেদিন বাড়িতে ছিলাম না সেদিনই কেন পার্সেল আসবে? আর আমি আসার আগে আগেই কেন পার্সেলটা হারিয়ে যাবে? তাছাড়া সেই রাতে আমার সাথে খুব অদ্ভুত কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমি তখন আমীরের সাথে ছিলাম৷ আর পুরো ব্ল্যাকআউট অবস্থায় ছিলাম। কিভাবে আমার এমন অবস্থা হলো তা কিছুতেই মনে পড়ছে না। সকালে উঠে দেখলাম আমি আমীরের হোটেলের বিছানায় শুয়ে আছি৷ তার জামা-কাপড় আমার গায়ে। অথচ আমার কিছুই মনে নেই। পুরো ব্যাপারটাই একটা মস্তবড় রহস্যজাল। কেউ আমার সাথে খেলছে। খুব অদ্ভুত ধরণের খেলা। লুকোচুরি খেলা। আমি বুঝতে পারছি না যে কাকে বিশ্বাস করব আর কাকে অবিশ্বাস করব!”

ইরফান অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,” তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। আমার মেয়ের বয়সী হবে তাই তুমি করেই বলছি। মা, তোমার মনটা অনেক নরম। তুমি প্রতারিত হওয়াকে সবচেয়ে ভয় পাও। তুমি তোমার কাছের মানুষদের অত্যন্ত ভালোবাসো আর ভরসা করতে চাও। কিন্তু কেউ তোমাকে ঠকালে সেটা মেনে নেওয়ার মতো মানসিক ক্ষমতা তোমার নেই।”

একটু থেমে ইরফান আবার বললেন,” যদি সত্যি আমীরই তোমার বাবার খু-নি হয় তাহলে নিশ্চয়ই তুমি অনেক বড় একটা ধাক্কা খাবে।”

তোহা আর্দ্র কণ্ঠে বলল,” আমি ম-রেই যাবো। এরকম যাতে কখনও না হয়। এমন অন্যায় সন্দেহের জন্য আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি আমার মনকে বোঝাতে পারছি না। আপনিই বলে দিন স্যার, আমি কি করব?”

তোহা কাঁদতে শুরু করল। ইরফান দুঃখিতবোধ করছেন। তিনি বললেন,” আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না যে আলিফ তোমাকে মিথ্যা বলছে? যেহেতু আগেও সে কয়েকবার মিথ্যা বলেছে।”

” কিন্তু আমার বাবার মৃ-ত্যুর ব্যাপারে মিথ্যা বলে তার কি লাভ? ”

” সেটাও কথা।” ইরফান ঘড়ি দেখে বললেন,” শোনো মা, আমি অত্যন্ত দুঃখিত যে তোমাকে বেশিক্ষণ সময় দিতে পারব না। আজকে আমার মেয়ের জন্মদিন। ব্যাপারটা মনে থাকলে আজকে তোমার সাথে শিডিউল ফিক্সড করতাম না। সকালেই জানতে পেরেছি। এখন বাড়িতে না গেলে সে খুব রাগ করবে।”

তোহা মৃদু হেসে বলল,” নিশ্চয়ই যান। আপনার মেয়ের জায়গায় আমি থাকলে আমিও রাগ করতাম।”

ইরফান শব্দ করে হেসে উঠলেন। তোহা বলল,” ওকে আমার পক্ষ থেকে উইশ করে দিবেন।”

” নিশ্চয়ই করব মা। তুমি চাইলে আমার সাথে যেতে পারো। ওর সঙ্গেও তাহলে তোমার দেখা হয়ে গেল। তারপর ফ্রী হয়ে আমরা আবার আলোচনায় বসবো।”

” দরকার নেই আঙ্কেল। আপনি আজ শুধু আপনার মেয়েকে সময় দিন। আমি না হয় আরেকদিন আসব।”

” ঠিকাছে। তোমার ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভাবব। আর তোমার যখন মন চায়, তুমি কিন্তু আমাকে ফোন করতে পারো।”

” আচ্ছা। আমি করব।”

তোহা আর ইরফান মির্জা একসঙ্গে বের হলো। ইরফান বললেন,” গাড়িতে ওঠো। তোমাকে ড্রপ করে দেই।”

তোহা প্রথমে রাজি হতে চাইল না। কিন্তু ইরফান যখন বললেন,” প্লিজ চলো। আমার মেয়ের মতো তুমি।” তখন তোহা রাজি না হয়ে পারল না। তাদের একসঙ্গে গাড়িতে উঠতে দেখে শাহেদ সাথে সাথে আমীরকে ফোন করল,” স্যার, ম্যাডাম বের হয়েছে। কিন্তু উনার সাথে একজন লোক আছে। লিফটম্যানের থেকে শুনেছিলাম সাইকোলজিস্ট ইরফান মির্জা না কি যেন… উনিই মনে হয় তিনি।”

আমীর চিন্তিত কণ্ঠে বলল,” মায়া হঠাৎ সাইকোলজিস্টের কাছে কেন যাবে? আমি ইন ডিটেলস সব জানতে চাই শাহেদ। ফলো দেম।”

” ওকে স্যার।”

শাহেদ একটা ট্যাক্সি নিয়ে তাদের অনুসরণ শুরু করল। তোহাকে গন্তব্যে নামিয়ে ইরফান গাড়ি ঘুরিয়ে ফেললেন। শাহেদ তৎক্ষণাৎ আমীরকে ইনফর্ম করল,” স্যার, ম্যাডাম নেমে গেছেন। এখন কি করব?”

” মায়া কি বাড়িতে?”

” জ্বী স্যার। ম্যাডাম বাড়িতেই গেছেন। ”

“ঠিকাছে। তুমি তাহলে লোকটাকে ফলো করো। উনি কোথায় যাচ্ছে, কি করছে সবকিছু আমাকে জানাবে।”

” ওকে স্যার।”

আমীর শাহেদের ফোন রেখে তোহাকে ফোন করল এবার। তোহা প্রথমে ফোন ধরছিল না। অনেকবার চেষ্টা করার পর অবশেষে ধরল,” হ্যালো।”

” হায়, কি করছো?”

” কিছু না…. ঘুমাচ্ছিলাম।”

মিথ্যা শুনে আমীরের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। তোহা আজ-কাল তাকে সব বিষয়েই মিথ্যা বলছে। কেন? আমীর বলল,” ও… তাহলে মনে হয় ডিস্টার্ব করলাম।”

” না। ঠিকাছে, বলুন।”

” আজাদ তোমাকে বিকালে বাইরে যেতে দেখেছিল।”

” হ্যাঁ গিয়েছিলাম একটা কাজে। কিছুক্ষণ আগে ফিরেছি।”

” কতক্ষণ আগে?”

” আপনি এভাবে জেরা করছেন কেন? ”

” জেরা না। এমনি জানতে চাইছি৷ তোমাকে নিয়ে আমার টেনশন হয় সেটা বোঝো না কেন?”

” শুনুন আমি কোনো বাচ্চা মেয়ে না যে আমাকে নিয়ে সারাক্ষণ টেনশন করতে হবে। আমি নিজের খেয়াল রাখতে পারি।”

” তুমি কি কোনো বিষয় নিয়ে টেন্সড? তোমার মেজাজ সবসময় এতো গরম থাকে কেন?”

তোহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করল। ঠান্ডা গলায় বলল,” স্যরি।”

” ইটস ওকে। দেখা করতে পারবে?”

” কখন?”

” উমম…এখনি।”

” এখন পারব না। সন্ধ্যাবেলা ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করছে না। আগামীকাল দেখা করি?”

” এজ ইউর উইশ।”

” ওকে।বায়।”

” বায়।”

আমীর তোহার সাথে কথা শেষ করেই শাহেদকে টেক্সট লিখল। সেই টেক্সটের নির্দেশ অনুযায়ী প্রথমে ট্যাক্সি দিয়ে ইরফান মির্জার পথ আটকাতে হবে। শাহেদ তাই করল। ইরফান জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,” হোয়াটস রং? হু ইজ দেয়ার?”

শাহেদ বের হয়ে এলো। ভদ্র গলায় সালাম দিয়ে বলল,” আপনার সাথে একটু জরুরী দরকার ছিল স্যার।”

” পথ আটকিয়ে জরুরী দরকার? এটা কেমন বিহেভিয়ার? তাছাড়া আমি এখন ব্যস্ত। আপনার বেশি প্রয়োজন থাকলে আমার অফিসে আসবেন।”

” স্যার, দরকারটা অন্য বিষয়ে৷ কিছুক্ষণ আগে যে মেয়েটিকে আপনি নামিয়ে দিয়েছেন তার সম্পর্কে জানতে চাইছিলাম। সে আপনার কাছে কেন এসেছিল?”

” সেটা দিয়ে আপনার কি দরকার? আমি কোনো ক্লায়েন্টের পারসোনাল ইনফরমেশন লিক করি না। এটা আমাদের পলিসির বাইরে।”

শাহেদ তার পকেট থেকে পিস্তল বের করল। পেছনে আরও দু’জন এসে দাঁড়ালো তাদের হাতে চাকু। সবাই একসঙ্গে হেসে উঠেছে। সন্ধ্যার রাস্তা এতো নির্জন যে আশেপাশে কাউকে চোখে পড়ছে না। ইরফানের শিরদাঁড়ায় প্রবাহিত হলো শীতল স্রোত। শুকনো করে একটা ঢোক গেলার চেষ্টা করলেন তিনি। পারলেন না। শাহেদ শীতল হেসে বলল,” এখনও কি বলবেন না?পলিসি নাকি জীবন? আপনার জন্য কোনটা বেশি জরুরী স্যার?”

ইরফান রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন,” কারা তোমরা?”

” তার থেকেও বড় প্রশ্ন আমরা এখন আপনার সাথে কি করব? যদি নিজের ভালো চান, তাহলে সত্যিটা বলুন স্যার। আপনি নিজেও ভালো থাকুন আর আমাদেরও থাকতে দিন।”

” ঠিকাছে বলব। কিন্তু আমার কোনো ক্ষতি কোরো না। আজকে আমার মেয়ের জন্মদিন। মেয়েটা আমার অপেক্ষায় বসে আছে।”

” আপনি সত্যি বললে আপনার মেয়ের অপেক্ষা দ্রুত শেষ হবে। কিন্তু যদি মিথ্যা বলেন…”

ইরফান হাঁফ ধরা কণ্ঠে জানালেন,” আমি সব সত্যি বলব।”

ঠিক রাত বারোটায় তোহার কাছে ফোন এলো। আফশান অস্থিরচিত্তে বলছে,” ম্যাডাম,আপনি কি একবার হোটেলে আসতে পারবেন? স্যার হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রচন্ড জ্বর গায়ে। ”

তোহা বিছানায় শুয়ে বই পড়ছিল। হঠাৎ এমন কথা শুনে খুব ভয় পেয়ে বলল,” কি বলছেন এসব? জ্বর মানে? ডাক্তার দেখিয়েছেন?”

” দেখানো হয়েছে। কিন্তু স্যারের কন্ডিশন খুবই বাজে৷ তিনি কথাই বলতে পারছেন না। শুধু আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন।”

“আচ্ছা, আমি এখনি আসছি।”

” থ্যাঙ্কস ম্যাডাম।”

তোহা ঝটপট তৈরী হয়ে নিল। বাড়ির সবাই তখন ঘুমে। তাই কাউকে কিছু না জানিয়েই বের হতে হলো। নিচে আজাদ ট্যাক্সি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল৷ তোহা নামতেই সে বলল,” আসুন ম্যাডাম, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

তোহা ট্যাক্সিতে উঠে বসল। বিচলিত গলায় বলল,” আজাদ ভাই, কেউ যদি আমার খোঁজ করে তাহলে জানিয়ে দিবেন আমি হোটেলে যাচ্ছি।”

” সেটা নিয়ে আপনি টেনশন করবেন না ম্যাডাম। নিশ্চিন্তে যান।”

আজাদ ট্যাক্সি ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে ইংরেজিতে বলল,” সাবধানে পৌঁছে দিবে। ম্যামের কোনো ক্ষতি হলে তোমার খবর আছে। গাড়ির নাম্বার কিন্তু নোট করে রেখেছি।”

তোহা হোটেলে পৌঁছে দেখল আমীর বিছানায় অচেতনের মতো শুয়ে আছে। তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে৷ তোহা প্রচন্ড ঘাবড়ে গেল, “জ্বর কি খুব বেশি?”

সে আমীরের মাথায় হাত রাখল। সত্যিই গা পুড়ে যাচ্ছে। মাথা গরম হলেও হাত-পা অস্বাভাবিক ঠান্ডা। সে বলল,” পানি ঢালার দরকার নেই। আমাকে একটা ভেজা টাউয়েল এনে দিন।”

” এখনি দিচ্ছি ম্যাডাম।”

আফশান তোয়ালে আনতে গেল। তোহা আমীরের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকল,” এইযে শুনছেন, আমীর!”

আমীর চোখ খুলে বলল,” তুমি কখন আসলে?”

” মাত্র। আপনি এতো অসুস্থ কিভাবে হলেন বলুন তো? কিভাবে এই জ্বরটা বাঁধালেন?”

আমীর হেসে বলল,”আমি একটা মারাত্মক ক্লু পেয়েছি।এইবার বাংলাদেশে ফিরলে তোমার বাবার খু-নিকে খুঁজে পেতে বেশি অসুবিধা হবে না। ”

” মানে? এখন এসব চিন্তা করার সময় না। আগে আপনি সুস্থ হোন।”

” ওই ড্রয়ারে একটা জিনিস আছে। খুললেই দেখবে। জিনিসটার কথা আমি প্রায় ভুলেই গেছিলাম। আজকেই মনে পড়ল। আমার লাগেজের ভেতরেই ছিল।”

” কি জিনিস?”

তোহা ড্রয়ার খুলতেই দেখতে পেল একটা চিঠি। খামে প্রেরকের নাম হিসেবে লেখা,” জাবিদ আলম।” বাবার নাম দেখে তোহা চমকে উঠল। হাত-পা কাঁপতে লাগল।

” এটা, কি এটা?”

” তোমার বাবা মৃ-ত্যুর আগে আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন। উনি তখন মিশনে ছিলেন। সেখানে নেটওয়ার্কের খুব অসুবিধা। কারো সাথে যোগাযোগ করার মতো ব্যবস্থাই ছিল না৷ অথচ আমাকে একটা খবর জানানো খুব জরুরী ছিল। তখন তিনি চিঠিটা লিখেছিলেন।”

তোহার চোখ অশ্রুতে ভরে আসছে। সে চিঠি খুলে দেখল মুক্তোর মতো ঝকঝকে লেখা। তার বাবার লেখা তো এমনই ছিল! সে লেখাগুলোয় চুমু দিল। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। সত্যিই কি তার বাবার চিঠি এটা? সে বার-বার আঙুল দিয়ে লেখাগুলো ছুঁয়ে দিতে লাগল। আমীর দূর্বল গলায় বলল,” চিঠিটা পড়ো মায়া। তাহলে তুমিও বুঝতে পারবে কেন হঠাৎ করে এটার কথা আমার মনে এসেছে।”

তোহা চিঠি পড়তে শুরু করল। অথচ এই চিঠির কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। হ্যান্ডরাইটিং স্পেশালিস্ট দিয়ে হাতের লেখা নকল করিয়ে চিঠিটা লেখানো হয়েছে। এই চিঠিতে জাবিদ সাহেব আমীরের কাছে সাহায্য চেয়েছেন। গোপন শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি যাদের সন্দেহ করেন তাদের একটা তালিকা তৈরী করে পাঠিয়েছেন। এদের কাউকেই অবশ্য তোহা চেনে না। চিঠি পড়ে মনে হচ্ছে, তিনি নিজের মৃ-ত্যুর কথা জানতেন। সেজন্যই তোহার দায়িত্ব আমীরের উপর হস্তান্তর করে গেছেন। এই চিঠি যেদিন লেখা হয়েছে তার তিনদিন পরেই তাঁর মৃ-ত্যু হয়েছিল। অতএব নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, তাঁর মৃ-ত্যুর পেছনে আমীরের কোনো হাত নেই। যদি তাই হতো তাহলে উনি আমীরের কাছে চিঠি লিখে সাহায্য চাইতেন না। তোহা চিঠিটা শেষ করে একদম ঝিম ধরে বসে রইল।

আমীর ডাকল,” মায়া, কি হয়েছে? তুমি কি চিঠিটা পড়েছো?”

তোহা অপরাধী কণ্ঠে বলল,” আমাকে মাফ করে দিন।”

” কেন?”

তোহা নিজের অন্যায় সন্দেহের কথা জানালো না। শুধু অনুতাপ নিয়ে বলল,” এমনি। আমাকে আপনি মাফ করে দিন, প্লিজ।”

আফশান তোয়ালে নিয়ে উপস্থিত হলো। তোহা সেই ভেজা তোয়ালে আমীরের মাথায় জ্বর পট্টি হিসেবে ব্যবহার করল। আফশান নিচু গলায় বলল,” ম্যাডাম, স্যার সারাদিন কিছু খায়নি।”

” বলেন কি? কেন খাননি আপনি?”

” খেতে ইচ্ছে করছিল না।”

” বুঝেছি। সব আমার জন্য তাই না? আমার জন্যই আপনার এই অবস্থা হয়েছে। আল্লাহ, আফশান ভাই। প্লিজ আপনি কিছু একটা নিয়ে আসুন। উনি এখনি বসবেন।”

” আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না মায়া। খেলেই হয়তো বমি করে ফেলব। আফশান তুমি যাও। কিছু লাগবে না।”

” ওকে স্যার।”

তোহা মুখে হাত রেখে কাঁদতে লাগল। সে চিঠিটা বুকে জড়িয়ে ধরে আছে। আমীর অবাক হয়ে বলল,” কেন কাঁদছো এভাবে?”

” জানি না। শুধু কান্না পাচ্ছে। আমি গত কয়েকদিন আপনার সাথে খুব রুড বিহেভ করেছি। সেজন্য কি আপনি আমার উপর রেগে আছেন?”

” একদমই না। আমি তোমার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারছি। চিন্তা কোরো না। খুব শীঘ্রই তোমার বাবার খু-নিকে তোমার সামনে হাজির করব। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।”

তোহার কান্নার বেগ আরও বাড়ল। কত খারাপ সে! আমীর এখানে তাকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলছে আর সে কি-না আমীরকেই সন্দেহ করে দিনের পর দিন দূরে সরিয়ে রাখছে! বড্ড অন্যায় হয়ে গেছে। তোহা কেন যে সন্দেহ করল! নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে এবার। সে বেশ কিছুক্ষণ আমীরের মাথার কাছে বসে নিঃশব্দে কাঁদল। একটু পর আমীর বলল,” এখন তোমার বাড়ি ফেরা উচিৎ মায়া। অনেক রাত হয়ে গেছে। ”

” উহুম। আমি যাবো না। এখানেই থাকব। আপনার অসুবিধা আছে?”

” কি বলছো এসব? এখানে কেন থাকবে?”

” কেন, থাকতে পারি না?”

” তোমার বাড়ির সবাই তো টেনশন করবে।”

” করতে দিন। একদিন টেনশন করলে কিছু হয় না।”

তোহা উঠে গিয়ে দরজা আটকে এলো। আমীরের পাশে শুয়ে তার গায়ের উপর হাত রেখে কোমল গলায় বলল,” যতক্ষণ আপনি সুস্থ না হচ্ছেন, আমি কিন্তু এখান থেকে নড়বো না।”

আমীর বলল,” তাহলে আমি কখনোই সুস্থ হতে চাই না।”

তোহা হেসে আমীরকে জড়িয়ে ধরল। শীতল, শুভ্র, নরম একগুচ্ছ অনুভূতি ঘিরে ধরল তাদের চারপাশ থেকে। আমীর পুনরায় একগাদা মিথ্যার মাধ্যমে তোহাকে পেয়ে গেল। সত্যিটাই তাদের সম্পর্কের একমাত্র অন্তরায়। তাই আমীর কখনও সেই সত্যি প্রকাশ হতে দিবে না। যতই তোহা সন্দেহ করুক আর যতই বিপদ আসুক। সে সবকিছু এভাবেই কাটিয়ে দিবে। প্রয়োজনে সারাজীবন তোহাকে শুধু মিথ্যাই বলে যাবে। কারণ, এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লভ এন্ড ওয়ার।

চলবে

®Sidratul মুন্তায

#ওয়ান_ফোর_থ্রি
৫৫.
সম্পূর্ণ বাড়িটি নীরব। মেইন গেইটে আজাদ ছাড়া বাড়ির ভেতরে আর কেউ নেই। তোহা একা। মাত্র গোসল শেষ করে গায়ে বাথরোব জড়িয়ে বের হয়েছে। আজ তার জীবনের একটা বিশেষ দিন। রেস্টুরেন্টে ছোট্ট করে এংগেজমেন্ট পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। সন্ধ্যায় আকদ হবে। এর দুইদিন পর তারা বাংলাদেশে চলে যাবে। সেখানে হবে কোর্ট ম্যারেজ। তোহার ভাবতেই অবাক লাগছে। সে কোনোদিন কল্পনা করেনি এভাবে একদিন আমীরকে সে পেয়ে যাবে। ভাগ্যে কতকিছুই না হয়৷ তোহা নিজের সৌভাগ্যে নিজেই ঈর্ষান্বিতবোধ করছে। গতকাল সারারাত তার আনন্দে ঘুম হয়নি৷ আবার দুশ্চিন্তাও হয়েছে। সকাল হলেই যদি সবকিছু বদলে যায়? অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণে চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পরে যায়নি তো? তোহা আয়নায় নিজের চোখ দেখে নিল। না, সব ঠিকাছে। তোহার কিছুটা নর্ভাস লাগছে। একটু পরেই তাকে পার্লারে যেতে হবে। গাড়ি আসবে তাকে নিতে। ফুপু আর কথা পার্লারেই আছে। মাহমুদ সাহেব আর আলিফ সকাল থেকে রেস্টুরেন্টে। এই বিয়েতে আলিফ ছাড়া সবাই খুব উৎসাহ দেখাচ্ছে। গত রাতেও আলিফ এসে তোহাকে বলছিল,” আরেক বার ভেবে দেখো তোহা, সত্যিই কি এই বিয়েটা তুমি করবে?”

” হ্যাঁ করব।”

” পরে যদি পস্তাতে হয় তখন আমার কথা স্মরণে রেখো। আমি নিষেধ করেছিলাম কিন্তু তুমি শোনোনি।”

তোহা কটাক্ষ করে বলেছে,” ঠিকাছে ভাইয়া, স্মরণে রাখব। এমনিতেও তুমি যেসব কাজ করেছো…. তোমাকে আমার আজীবন মনে থাকবে।”

ঘড়িতে নয়টা পয়তাল্লিশ বাজে। দশটার মধ্যে গাড়ি চলে আসার কথা। দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোহা বাথরোব খুলতে নিয়ে আয়নায় দেখল পেছনে আমীর দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারটা কি তার কল্পনায় ঘটছে নাকি সত্যি? তোহা পেছনে তাকাল, আসলেই আমীর! তার গায়ে কালো ব্লেজার, ফরমাল প্যান্ট, চোখে চশমা। একদম জেন্টালম্যান ধরণের একটা লুক। তোহা বলল,” পারফেক্ট। কিন্তু আপনি সকাল সকাল এখানে কি করছেন? আমাদের তো সেন্টারে দেখা হওয়ার কথা।”

আমীর বলল,” শুনলাম বাড়িতে তুমি একা। তাই তোমাকে নিতে এসেছি।”

” কিন্তু আমি তো এখনও রেডি হইনি। আর আমি এখান থেকে পার্লারে যাবো।”

” সমস্যা নেই। আমি তোমাকে পার্লারে নামিয়ে একটা কাজে যাবো।”

” ও। তাহলে আপনি বাইরে ওয়েট করুন। আমি চেঞ্জটা করেই আসছি।”

” বাইরে ওয়েট করার কি দরকার? এখানেই ওয়েট করি!”

তোহা চোখ বড় করে বলল,” অসভ্যতা করবেন না। যান এখান থেকে। ”

” অসভ্যতা কোথায় করলাম? চেঞ্জ করতে কি আমি তোমাকে প্রথম দেখবো? এর আগেও দুইবার…”

তোহা উচ্চস্বরে বলল,” উফ, আমি কিন্তু ঘুঁষি মেরে আপনার নাক ফাটিয়ে দিবো।”

” চলো একটা গেইম খেলি। যদি তুমি জিতে যাও তাহলে আমার নাক ফাটাবে আর যদি আমি জিতি…”

তোহা হতভম্ব গলায় বলল,” আপনি আমার নাক ফাটাবেন?”

” না, তোমার ঠোঁট।”

তোহা আমীরের পেটে ঘুঁষি মেরে বলল,” ফাজিল।”

তখনি তোহার ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে আছে ইরফান মির্জার নাম। আমীর প্রশ্ন করল,” কে এটা?”

তোহা একটু উশখুশ করে বলল,” কথা ভাবীর দূর সম্পর্কের মামা। আমারও পরিচিত, আঙ্কেল বলে ডাকি। আমি একটু কথা বলে আসছি, ঠিকাছে?”

তোহা মোবাইল নিয়ে বারান্দায় গেল। আমীর দেয়ালের ওপাশ থেকে কান পেতে রাখল। লোকটাকে থ্রেট করা হয়েছিল তোহার সাথে যেন কখনও যোগাযোগ না করে। তবুও তিনি ফোন দিচ্ছেন কেন?

” হ্যালো আঙ্কেল, আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়া আলাইকুম আসসালাম মা, কেমন আছো? ”

” এইতো আঙ্কেল ভালো। আপনি কেমন আছেন?”

” ভালো মা। তুমি ফ্রী থাকলে কি একটু দেখা করতে পারবে আমার সাথে?”

” নিশ্চয়ই পারব। কখন আসতে হবে আঙ্কেল?”

” ভালো হয় যদি এখনি চলে আসো। আমি চেম্বারেই আছি।”

তোহা বিপাকে পড়ে গেল৷ এখন তো যাওয়া যাবে না। আমীর বাড়িতে আছে। সে আমীরকে কি এক্সকিউজ দিয়ে বিদায় করবে? তোহা বলল,” ঠিকাছে আঙ্কেল আমি দেখছি। আপনাকে জানাবো।”

” বিষয়টা খুবই জরুরী তোহা৷ তুমি যে এখানে আসছো সেটা যাতে কেউ জানতে না পারে।”

” আচ্ছা, আমি দেখছি।” তোহা ফোন রাখল আর খুব চিন্তায় পড়ে গেল। আমীর বারান্দা থেকে দূরে এসে দাঁড়ালো। তোহা ঘরে ঢুকল চিন্তিত মুখে। আমীর জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে? এনি প্রবলেম?”

তোহা ফরফর করে মিথ্যা বলল,” কথা ভাবী ইরফান আঙ্কেলের মোবাইল থেকে ফোন করেছে। ফুপু আর সে চেম্বারেই আছে। আমাকেও যেতে বলছে। আপনি কি আমাকে ওখানে ড্রপ করে দিতে পারবেন?”

” ওখানে তোমাদের কি কাজ?”

” খুব জরুরী দরকার…” এতটুকু বলেই তোহা থেমে গেল। ভুল হয়েছে। ইরফান আঙ্কেল তো বলেছিলেন বিষয়টা কাউকে না জানাতে। সে আমীরকে জানিয়ে ফেলেছে। অবশ্য এটা ছাড়া তার কোনো উপায় নেই। এখন আমীর যদি প্রশ্ন করে কি জরুরী দরকার? তখন সে কি উত্তর দিবে? আমীর অবশ্য সেই প্রশ্ন করল না। তোহা ইতস্তত করে বলল,” আমাকে ওখানে ড্রপ করে আপনি না হয় আপনার জরুরী কাজে চলে যেয়েন। তারপর ভাবী আর ফুপুর সাথে আমি পার্লারে পৌঁছে যাবো।”

আমীর মাথা নেড়ে বলল,” ওকে।”

সে এতো সহজে মেনে যাওয়ায় তোহার মনের মেঘ কেটে গেল,” থ্যাঙ্কিউ। ”

খুশি হয়ে আমীরের গালে একটা চুমু দিল সে। আমীর তার কোমর চেপে ধরে বলল,” শুধু একটা?”

তোহা অন্যগালেও আরেকটা দিল। আমীর গাঢ় স্বরে বলল,” শুধু দুইটা?”

তোহা হেসে কপালেও আরেকটা দিল। আমীর তোহার কপালে কপাল ঠেঁকিয়ে ফিসফিস করে বলল,” আমার ঠোঁট কি দোষ করল? ও কেন বঞ্চিত হবে?”

তোহা লাজুক কণ্ঠে বলল,” উফ, এখন সময় নেই। এমনিতেই দেরি হচ্ছে।”

” হোক দেরি। আই নীড মাই রাইট।”

” ঠিকাছে। কিন্তু দ্রুত।”

তোহা চোখ বন্ধ করল। এর মধ্যে আরেকবার ফোন বেজে উঠল। আমীর বিরক্ত গলায় বলল,” শিট, আবার কে?”

তোহা মোবাইল হাতে নিয়ে বলল,” ভাবী৷ দ্রুত যাওয়ার জন্য হয়তো তাড়া দিচ্ছে। এ্যাঁই আপনি বের হোন তো৷ ইশ, দশটা বেজে গেল।”

তোহা আমীরকে ঠেলে বাইরে বের করে দরজা আটকে দিল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আমীর। একটা সমস্যা নিয়ে সে সকাল থেকেই চিন্তিত। হাসান যে ইতালী এসেছে সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, সে বডিগার্ডের মতো তোহাকে ফলো করছে। আমীর তাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য লোক লাগিয়েছে। কিন্তু তাকে কোনোভাবেই ধরা যাচ্ছে না। এখন আবার নতুন বিপদ নিয়ে উদয় হয়েছে ইরফান মির্জা। লোকটা তোহাকে জরুরী তলব করল কেন? সব কি বলে দিবে নাকি? তাছাড়া আমীর ধারণা করছে হাসান এবার তোহাকে সত্যি জানাতে ইরফান মির্জার সাহায্য নিবে। সেরকম হলে তো বিরাট সমস্যা। চিন্তায় আমীরের মাথা কাজ করছে না। উফ, এরা কি কেউই আমীরকে শান্তিতে বিয়ে করতে দিবে না?

উঁচুতলা ভবনের সামনে এসে গাড়ি থামল। তোহা বলল,” আসছি, বায়। সেন্টারে দেখা হবে।”

” বায়।”

তোহা নেমে যাওয়ার পর আমীর শাহেদকে ফোন করল,” শাহেদ।”

” জ্বী স্যার।”

” ইরফান মির্জার মেয়ে যেন কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে?”

” ইউনিভার্সিটি অফ মিলান। কেন স্যার? কি করতে হবে বলুন।”

” তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমিই করব। তুমি শুধু মেয়েটার ছবিসহ ডিটেলস আমাকে সেন্ড করো।”

“ওকে স্যার। এখনি করছি। আর কিছু?”

” হ্যাঁ। ওই লিফটম্যানকে বলে দাও মায়া যেন একঘণ্টার আগে কোনোভাবেই ইরফান মির্জার সাথে দেখা করতে না পারে।”

” এখনি বলছি স্যার।”

আমীর ফোন রেখে রওনা হলো। তার গন্তব্য ইউনিভার্সিটি অফ মিলান। ইরফান মির্জার একমাত্র মেয়ের নাম তমালিকা মির্জা। তাকে খুঁজে পাওয়া গেল ক্যান্টিনে। বন্ধুদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। সরাসরি তার কাছে গিয়ে আমীর বলল,” হায় তমালিকা, কেমন আছো?”

তমালিকা বিব্রত হয়ে বলল,” ভালো। আপনি কে?”

” আমি তোমার বাবার ফ্রেন্ড। একটু এদিকে এসো, তোমার সাথে জরুরী কথা আছে।”

” রিয়েলি? আপনি পাপার ফ্রেন্ড?”

” হুম।”

তমালিকার বন্ধুরা অবাক হয়ে আমীরকে দেখছে। আমীর দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। একজন দুষ্টমি করে বলল,” হি ইজ সো হ্যান্ডসাম!”

আরেকজন বলল,” মেইবি হি উইল আস্ক ইউ ফোর আ ডেইট।”

সবাই এই কথা শুনে চিয়ার আপ করল,” উউউ!”

অনামিকা লজ্জিত গলায় বলল,” শাট আপ গাইজ। আই ডন্ট ইভেন নো হিম।”

সে খুব অস্বস্তি নিয়ে আমীরের সামনে গেল। আমীর খুব সিরিয়াস কণ্ঠে বলল,” তোমার বাবা ইমারজেন্সীতে আছেন। আমি তোমাকে হসপিটালে নিতে এসেছি তমা।”

” হোয়াট?” মুহূর্তেই অস্থির হয়ে উঠল তমালিকা। এমন জেন্টালম্যান টাইপ ভদ্রলোক যে মিথ্যা বলতে পারে সেই ব্যাপারটা তার মাথাতেই এলো না। খুব সহজেই আমীরকে বিশ্বাস করে সে গাড়িতে উঠে পড়ল।

তোহা লিফটে উঠেছে অঅনেকক্ষণ হলো। লিফট আটকে গেছে একটা নির্দিষ্ট জায়গায়। চারদিকে ঘন অন্ধকার। আবদ্ধ পরিবেশে তোহার কেমন দম আটকে আসছে। সে লিফটম্যানের উদ্দেশ্যে বলল,” ভাইয়া, কিছু একটা করুন। আমি এভাবে থাকতে পারছি না।”

” একটু ধৈর্য্য ধরুন।”

” উফ, আর কতক্ষণ ধৈর্য্য ধরে থাকব?”

ইরফান সাহেব তোহার জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছেন। তাকে ফোন করেও পাওয়া যাচ্ছে না৷ তিনি ভাবলেন একবার নিচে গিয়ে দেখবেন তোহার আসতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা! তখনি তিনি জানতে পারলেন লিফট কাজ করছে না। অনেকক্ষণ ধরে চারতলায় আটকে আছে। তিনি দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে চারতলায় নামলেন। লিফটের দরজা দুইহাতের শক্তি দিয়ে আলাদা করতেই তোহাকে দেখা গেল। তোহা হাঁফ ছেড়ে বলল,” আঙ্কেল আপনি এসেছেন! আরেকটু হলে আমি সাফোকেশনে মরেই যাচ্ছিলাম। থ্যাংক গড!”

ইরফান লিফটম্যানকে ধমক দিয়ে বললেন,” তুমি এতোক্ষণ ধরে ওকে আটকে রেখেছো কেন? বেল বাজালেই তো হতো।”

” স্যরি স্যার। আমি বেল বাজিয়েছিলাম।”

” আবার মিথ্যা কথা? তুমি বেল বাজালে কেউ টের পাবে না কেন?”

লোকটি কেমন অসহায়ের মতো মাথা নিচু করে আছে। তোহার মায়া লাগল৷ সে বলল,” আচ্ছা বাদ দিন আঙ্কেল। সব ঠিক হয়ে গেছে। চলুন আমরা যাই।”

” তুমি যে এখানে এসেছো সেটা কেউ জানতে পারেনি তো?”

তোহা আমীরের কথা বলতে নিয়েও চেপে গেল। হেসে বলল,” না। কেউ জানেনি।”

” দ্যাটস গুড। ভেরি গুড। চলো উপরে যাই।”

সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ইরফান চিন্তিত মুখে বললেন,” তুমি যে পার্সেলের কথা বলেছিলে সেরকম একটা পার্সেল আজ আমার…. বাকি কথা বলার আগেই তার ফোন বেজে উঠল। তমালিকার নাম্বার দেখে তিনি সাথে সাথে রিসিভ করলেন,” হ্যাঁ মা, বলো।”

ওইপাশ থেকে ভেসে এলো তমালিকার আর্তনাদ,” পাপা, সেইফ মি। লোকটা আমাকে মে-রে ফেলবে। প্লিজ সেইফ মি!”

ইরফান খুব হকচকিয়ে গেলেন। উতলা কণ্ঠে আওড়ালেন,” মা তমা, কি হয়েছে তোমার?”

আমীর থমথমে কণ্ঠে বলল,” আপনার মেয়েকে সেইফ করতে চাইলে মুখ বন্ধ রাখুন মিস্টার ইরফান। নাহলে…”

ইরফান ব্যাকুলচিত্তে বললেন,” প্লিজ, ওর কোনো ক্ষতি কোরো না। আমি তোমাদের সব কথা মানব। কিন্তু আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও।”

ফোন কেটে গেল। ইরফান অস্থির হয়ে পুনরায় ডায়াল করতে লাগলেন। কিন্তু নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। তিনি আতঙ্কে এলোমেলো পায়ে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলেন।বুকে প্রচন্ড চাপ অনুভব করছেন। এক পর্যায় তিনি বুকে হাত রেখে সিঁড়িতেই বসে গেলেন। তোহা এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেল,” আঙ্কেল কি হয়েছে?”

ইরফান ক্লান্ত গলায় বললেন,” তুমি বাড়ি যাও মা।”

” আঙ্কেল আজকে আমার বিয়ে। আমি সবকিছু ছেড়ে আপনার সাথে দেখা করতে ছুটে এসেছি। আপনি আমাকে জরুরী কথাটা বলবেন না?”

” কোনো জরুরী কথা নেই। তুমি বাড়ি যাও তোহা।”

” মিথ্যা কথা। আপনি কিছু গোপন করছেন আমি জানি। কার ফোন ছিল?”

” আমার মেয়ে, তমা।”

” ওর কি হয়েছে?”

” কিছু হয়নি।”

” তাহলে আপনাকে এতো অস্থির দেখাচ্ছে কেন?”

” আমি তোমাকে এখন এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। তুমি তোমার কাজে যাও মা। আজ না তোমার বিয়ে!”

” আপনাকে ছেড়ে আমি যাবো না। আপনাকে আমি পার্টিতে ইনভাইট করতে এসেছিলাম। গেলে আপনাকে আর আপুকে সাথে নিয়ে যাবো।”

” আমরা সময়মতো আসবো। তুমি এখন শুধু একটা সাহায্য করো। আমাকে গাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসতে পারবে?”

“নিশ্চয়ই পারব। আপনি আমার কাঁধের উপর হাত রাখুন আঙ্কেল।”

__________________
তমালিকা খুব ছটফট করছে৷ তার হাত, পা আর চোখ দু’টো কালো কাপড়ে বাঁধা। মাথায় পিস্তল ঠেঁকিয়ে রাখার কারণে সে চিৎকার করতে পারছে না। কেবল অনুরোধ করে বলছে,” প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনার কোনো ক্ষতি করিনি। তাহলে আপনি আমার ক্ষতি কেন করছেন? প্লিজ, আমাকে যেতে দিন।”

আমীর কোনো কথা বলল না। তমালিকা নিরবচ্ছিন্নভাবে কেঁদে চলেছে। এক পর্যায় অধৈর্য্য হয়ে আমীর বলল,” চুপ, আর একটা সাউন্ড করলেও আমি কিন্তু শ্যুট করব।”

মেয়েটা একদম নিশ্চুপ হয়ে গেল। তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। নিশ্বাস আটকে আসছে। বেশ কিছুক্ষণ পর আমীর তমালিকাকে তার বাড়ি পৌঁছে দিল। হঠাৎ নিজের বাড়ির পথ দেখে তমালিকা বিস্মিত হলো। আমীর তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে বলল,” তোমার বাবাকে সাবধান করে দিও। আর কখনও যেন আমার পারসোনাল বিষয়ে ইন্টারাপ্ট না করে। তাহলে তুমি আবার বিপদে পড়তে পারো।”

আমীরের শীতল দৃষ্টি তমালিকার শরীরে একটা ছমছমে অনুভূতি জাগাল। সে কোনো জবাব না দিয়ে নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। আমীর মুহূর্তের মধ্যে গাড়ি নিয়ে গায়েব হয়ে গেল। তমালিকা বেশ কিছুক্ষণ স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল সেই একই জায়গায়।

চলবে