ওয়েলকাম_টু_মাই_ডার্কসাইড পর্ব-১০+১১

0
4

#ওয়েলকাম_টু_মাই_ডার্কসাইড
#পর্ব_১০
#সারিকা_হোসাইন®
●●●●
ঘুটঘুটে অন্ধকার নিশুতি রাত।কিছুক্ষন আগের আলো বিলিয়ে দেয়া চাঁদটাকে কুটকুটে কালো মেঘ পুরো দমে গ্রাস করে ফেলেছে।মেঘের ঘন অন্ধকারে চাঁদটি তার চকচকে রুপালি আলো ছড়াতে ব্যার্থ হয়েছে।শহরের ল্যাম্পোস্ট আর সোডিয়াম লাইট গুলো ব্যাতিত নিভিতে শুরু করেছে শহরজুড়ে বসবাস করা মানুষের ঘর আলোকিত করার কৃত্তিম ফকফকে বাতিগুলো।রাস্তায় মানুষের আনাগোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে আরো অনেক আগেই।অদূরে মাঝে মাঝে নেড়ি কুকুর গুলো ঘেউঘেউ করে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।চারপাশ গা ছমছমে অনুভূতি দিচ্ছে।

এমন ভয়ংকর গা শিউরে উঠা পরিবেশে হাতে একটা টর্চ আর রিভলবার নিয়ে দৌড়ে চলেছে রাজ্য।উদ্দেশ্য একটাই যুবরাজের ভুত মাথা থেকে নামিয়ে বেনজির আশফীর বাড়ির ভুত টাকে কব্জা করা।কিন্তু বিপত্তি বাধলো গুলশান সোসাইটির গেইটের সামনে এসে।সে আগে কখনো কমান্ডারের বাড়িতে আসেনি।আসার প্রয়োজন ও হয়নি।বেনজির আশফী তাকে ভুত ধরার দায়িত্ব ও দেয়নি।নিজ উদ্যোগে এখানে এসেছে সে।অফিস কলিগদের কাছে সে শুনেছিল কমান্ডার এর বাসা নম্বর 236 আর বাসার ভেতর থেকে সবসময় বিদেশি কুকুরের ঘেউঘেউ শোনা যায়।কিন্তু 236 এর আগে পরে কি আছে তা সে জানেনা।

সোসাইটির লোহার গেটে হেলান দিয়ে কপালে রিভলবার এর নল ঠেকিয়ে কিছুক্ষন সে নিজে নিজেই চিন্তা করলো

“যতগুলো 236 নম্বর বাসা আছে সব গুলো ঢু মারবো।যেটাতে দেখবো বিদেশি কুকুর বাধা আছে ঐটাই খারুস কমান্ডার এর বাড়ী”

নিজেকে নিজেই শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমানের তকমা দিয়ে খুব দক্ষ ভাবে গেট টপকে ভেতরে প্রবেশ করলো।আশেপাশে চোখ বুলাতেই শ্লেষ হাসলো রাজ্য
“ব্যাটা নাইট গার্ড এখুনি এভাবে ঝিমুচ্ছিস বাকি রাত কি করবি?তাইতো বলি ভুত গুলশান সোসাইটি তে কিভাবে ঢুকলো?নিষ্কর্মার দল।

সময় ব্যায় না করে দ্রুত পদে হেটে খুঁজতে লাগলো 236 নম্বর বাসা।হঠাৎই একটি বাসার নম্বর প্লেট দেখে খুশিতে বত্রিশ পাটি দাঁত বেরিয়ে এলো তার।কিন্তু মুহূর্তেই সেই দাঁত ফিনফিনে পাতলা চিকন ঠোঁটের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেলো।কারন বাসা নম্বর 236/A তারমধ্যে গেইটে দারোয়ান পাহারত রয়েছে।

সর্ব কনিষ্ঠ আঙ্গুলি দিয়ে নিজের মাথা চুলকে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো রাজ্য।

“যতদূর জানি চিপ কমান্ডার এর বাসার সামনে কোনো দারোয়ান নেই।আর বাসাটি নাকি খুবই নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর!এটা কোনো ভাবেই বেনজির আশফীর বাসা হতে পারে না।এটা তো এপার্টমেন্ট কম ফ্যাক্টরি বেশি মনে হচ্ছে।

হঠাৎই বাসাটির দারোয়ান ভারিক্কি গলায় ডেকে উঠলো
“কেরা ঐহানে ?

লোকটির কাছে এতো জবাবদিহিতা করার সময় রাজ্যের হাতে নেই।তাই দ্রুত কেটে পড়ে অন্য গলিতে ঢুকে গেলো সে।গলিটির চারপাশে চোখ বুলাতেই অপূর্ব এক ভালোলাগায় ছেয়ে গেলো তার মন।
এই গলিটি অন্য সকল গলির থেকে আলাদা।এখানে এক সাথে অনেক গুলো এপার্টমেন্টের জড়াজড়ি নেই সেই সাথে প্রশস্ত চকচকে রাস্তা।পুরো এরিয়াটা ফাকা ফাঁকা আর বাড়ির ডিজাইন গুলোও খুব সুন্দর।মনোরম এই গলিতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই রাজ্যের চোখ যায় পনেরো তলা বিশিষ্ট একটি এপার্টমেন্টের নম্বর প্লেটের দিকে।সেখানে বড় বড় এক্রাইলিক এম্বুষড অক্ষরে মিরর শাইন লেজার কাট এপার্টমেন্ট নম্বর 236/B লেখাটি চকচকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।এপার্টমেন্ট টির সামনে বিশাল এরিয়া জুড়ে বাহারি দেশি বিদেশি ফুলের সুন্দর একটি গার্ডেন শোভা বর্ধন করেছে।না আছে পাহারাদার না আছে কোনো কোলাহল।বাড়িটির নিচ থেকে উপর পর্যন্ত চোখ বুলাতেই আট তলার দিকে নজর দিতেই ক্ষীণ আলো চোখে লাগলো।সাথে কুকুরের অল্প ঘেউঘেউ কানে এলো।
রাজ্য নিজের বুকে নিজেই চাপড় মেরে বললো
“সাব্বাস!তুমি ঠিক জায়গাতেই এসেছো।এবার তোমার পিন্ডি আমি চটকিয়ে ছাড়বো ব্যটা ভুত সাহেব”

বিশালাকার এপার্টমেন্টটির গেট ভেতর থেকে তালা দেয়া।ভেতরে কিভাবে উঠা যায় সেই চিন্তা করতেই সমানে পায়চারি করে আঙ্গুলের নখ কামড়ে ধরলো রাজ্য।
দ্বিতীয়বার এপার্টমেন্টে নজর বুলাতেই খোলা ব্যালকনি নজরে এলো।বেলকনিতে গ্রিল না থাকায় খুব যেনো সুবিধা হলো তার।
রিভলবার টি পকেটে ঢুকিয়ে স্টিলের পাইপ বেয়ে ধুপধাপ দূতলার বেলকনি তে উঠে গেলো সে।প্রতিটা বেলকনির কোমর সমান রেলিংয়ে পা ফেলে অনায়াসেই সাত তলা পর্যন্ত উঠে হাঁপিয়ে গেলো সে।

“ধুর অযথা এই রাতের বেলা কেনো মরতে এলাম এখানে?আর এনি হারামজাদী টাও এখনো এলোনা।কাল অফিসে গিয়ে চূড়ান্ত শিক্ষা দেবো শয়তান টাকে”

হঠাৎই সাত তলার ফ্ল্যাট থেকে চিকন স্বরে কেউ বলে উঠলো
“কে ওখানে?

মানুষের গলা শুনতে পেয়েই ভয়ে হুড়মুড় করে আট তলার ওয়ালের ডিজাইনের বাড়তি অংশ ধরে ঝুলে বহু কষ্টে আলো জ্বালিত বেলকনিতে উঠতে সক্ষম হলো।কিন্তু অসাবধানতাবশত তার হাত ছিলে গেলো অনেক খানি।বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নিজেকে রিল্যাক্স করে রুমের ভেতর তল্লাশি চালানোর প্রস্তুতি নিলো।
বেলকনি সাইডের দরজা সম্পূর্ণ খোলা।এতে যেনো বেশ সুবিধাই হলো তার।ধীর পায়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই লাইট বন্ধ হয়ে গেলো।
যেই লাইট কিছুক্ষণ আগেও আলো ছড়াচ্ছিলো সেটা নিমিষেই বন্ধ হওয়াতে রাজ্য ঘাবড়ে গিয়ে রিভলবার বের করে গুলি করার পজিশন নিলো।

কুকুরটার ঘেউঘেউ আওয়াজ ও আর শোনা যাচ্ছে না।

“যেহেতু স্যার ম্যাডাম কেউ বাসায় নেই তাহলে লাইট কে নেভালো?আর হঠাৎই কুকুরটা এতো শান্ত কিভাবে হয়ে গেলো?

মনে মনে হাজারখানেক ভাবনা ভেবে ভয়ে শিউরে উঠলো রাজ্য।

“একা একা এখানে চলে আসা মোটেও উচিত হয়নি।যদি খারাপ কিছু হয় তখন আমার লাশের অস্তিত্ব থাকবে তো?যদি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকি তখন?যদি চিপ জিজ্ঞেস করে তার বাসায় আমি কি করছিলাম অতো রাতে তখন কি উত্তর দেবো?

হঠাৎই কারো পায়ের হাঁটার শব্দে ধ্যান ভেঙে চমকে উঠলো রাজ্য।
“তার মানে এখানে কেউ আছে”!

ভয়ে বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গিয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো।নিজের রিভলবার টি শব্দের দিকে তাক করতেই আবছা ছায়ার মতো কিছু একটা সরে গেলো।সেই ছায়া অনুসরণ করতেই কেউ একজন পেছন থেকে গলা পেঁচিয়ে হাত মুড়িয়ে ধরে কব্জা করে ফেললো রাজ্যকে।মস্তিস্ক সজাগ হতেই ছিলে যাওয়া জায়গাটার ব্যাথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো রাজ্য।তবুও পেছনের ব্যাক্তির মনে কোনো দরদের উদ্রেক হলো না।
রাজ্যকে টেনে হিচড়ে একটি অন্ধকার কক্ষের ভেতর নিয়ে কিছু একটা দিয়ে হাত দুটো বেঁধে ছুড়ে মারলো শক্ত টাইলসের মেঝেতে।
ব্যাথায় রাজ্যের বড় বড় পাপড়ি যুক্ত বাঁকানো চোখ দুটি জলে থৈ থৈ করে উঠলো।

নির্জন অন্ধকার কক্ষটি মুহূর্তেই গমগমে গর্জনে উত্তাল হয়ে উঠলো
“কে তুই?

লোকটির ভরাট কন্ঠের ধমকে কেঁপে উঠলো রাজ্য।
জবাব দেবার আগেই অন্ধকার কক্ষটি আলোতে পরিপূর্ণ হলো।পিছ মুড়ো করে হাত বাধার কারণে হাঁটুতে সর্ব শক্তি সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো সে।তার আগেই ঝড়ের গতিতে লোকটি এসে গলা চেপে রাজ্যের ঝুকে যাওয়া মুখ উঁচু করে ধরলো।
রাজ্য চোখ তুলে সামনে দাঁড়ানো হিংস্র যুবক কে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো।মন থেকে ভয় কেটে গেলো ঠিকই কিন্তু হাতের ব্যাথায় চোখ থেকে টুপটুপ করে জল গড়িয়ে যুবকটির হাতের থাবায় গিয়ে জমা হলো।
রাজ্যের কান্নারত মুখশ্রী যুবকের মনে কঠিন পীড়ার সৃষ্টি করলো।টাইফুনের উত্তাল ঝাপটা আর বাতাসের বেগ যেমন সবকিছু লনভন্ড করে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে যুবকের হৃদয় ও ঠিক সেভাবে দুমড়ে মুচড়ে বিষিয়ে উঠলো।

ঝট করে রাজ্যের গলা থেকে হাত সরিয়ে নিজের বুকের সাথে সর্ব শক্তি দিয়ে চেপে ধরে আহত কন্ঠে বলে উঠলো
“আম সরি”

যুবকের বুকের হৃদ যন্ত্রের হাতুড়ি পেটানো শব্দ খুব করে উপলব্ধি করতে পারছে রাজ্য।কেমন অদ্ভুত ছন্দ তুলে ক্রমাগত হার্ট বিটিং হয়ে চলেছে।নিজের হাতের ব্যাথা ভুলে যুবকের বুকে মাথা রেখে চোখ বুঝে ফেললো রাজ্য।
হঠাৎই যুবক রাজ্যকে বুক থেকে সরিয়ে অপরাধী চোখে রাজ্যকে দুই হাতের বাহু ধরে দাঁড় করালো।ঝটপট বেঁধে রাখা হাত দুটো বাধন মুক্ত করে সরে দাঁড়িয়ে পাশেই সাজিয়ে রাখা হুইস্কির তাকে সজোড়ে এক ঘুষি বসিয়ে দিলো।
যুবকের এমন ভয়াবহ কাণ্ডে নিজের দুই কান চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে বসে পড়লো রাজ্য।
মুহূর্তেই যুবকের হাত কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে গেলো।নিজের কাঁটা হাতের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলো যুবক।

“এই যুবরাজ শাহীর জীবনে প্রথম আজ এই মুহূর্তে কঠিন এক অন্যায় করে ফেলেছে।সে তার নিজের জীবনকেই আঘাত করে বসেছে।”

কাঁটা রক্তাক্ত হাত নিয়ে রাজ্যের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আহত নিচু কন্ঠে বলে উঠলো
“তোমাকে যতোটা আঘাত করেছি তার চেয়ে বেশি ব্যাথা আমি নিজেকে দিয়েছি।না জেনে তোমাকে ব্যাথা দেবার জন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত।”

যুবরাজের এমন মায়াবী বেদনার্ত কন্ঠে মুখ তুলে যুবরাজের কষ্ট জড়িত মুখশ্রী তে দৃষ্টি দিলো রাজ্য।যুবরাজের অসহায় মায়াবী মুখটা রাজ্যের মনের কোথায় যেনো সূক্ষ ব্যাথার সৃষ্টি করলো।
ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে খপ করে যুবরাজের হাতের কব্জি চেপে ধরে উদ্বিগ্নের স্বরে বলে উঠলো
“আপনার হাতে কাঁচ ঢুকে আছে।এখনই হসপিটাল চুলুন আমার সাথে না হলে রক্ত বন্ধ করতে ঝামেলা হবে।

রাজ্যের এমন উদ্বিগ্নতা দেখে স্মিত হেসে রাজ্যের মাথায় মমতার হাত বুলালো যুবরাজ।লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে ঠোঁট কামড়ে ধরে অনিমেষ রাজ্যের পানে তাকিয়ে রইলো।

“দুনিয়াতে আমার কষ্টে উদ্বিগ্ন হবার মতো আমার মা ছাড়া আর কেউ নেই।সেই তালিকায় আজকে তুমিও যুক্ত হলে।তুমি নিজেও জানোনা আমার কষ্টে তোমার এই চিন্তিত মুখশ্রী আমাকে ব্যাথা উপশমে কতোটা হেল্প করেছে।

কথাটি বলেই হন হন করে হেটে আলমারি খুলে মেডিকিট বক্স নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো যুবরাজ।
যুবরাজের পিছন পিছন রাজ্য ধীরপায়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করতে দেখতে পেলো কোনো এনেস্থেসিয়া ছাড়াই একের পর এক ভাঙা কাঁচের ছোট ছোট টুকরো গুলো একটা ফোর্সেপ্স এর সহায়তায় টেনে টেনে বের করছে যুবরাজ।এই বিষয়টাতে তাকে খুবই প্রফেশনাল মনে হচ্ছে।
ভাঙা কাঁচের টুকরো বের করা শেষ হলেই একটা লিকুইড পোভিসেপ এর বোতল পুরোটাই গলগল করে ঢেলে দিলো নিজের হাতে।
এই দৃশ্য দেখে রাজ্যের পুরো শরীর শিউরে উঠলো।মুহূর্তেই যুবরাজকে তার কাছে ভয়ংকর ঠেকতে লাগলো।রাজ্য শরীরের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেললো যখন দেখতে পেলো এক হাত আর মুখের সাহায্যে যুবরাজ নিজের কাটা জায়গা গুলো ঘেচ ঘেচ করে নিজেই সেলাই করে চলেছে।রাজ্যকে ভয় আর অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে দিয়ে যুবরাজ নিজেই নিজের হাতে সুনিপুণ ব্যান্ডেজ করে রাজ্যের পানে দৃষ্টি দিলো।

যুবরাজের বাদামি গভীর চোখে দৃষ্টি মিলতেই ঠকঠক করে কেঁপে উঠলো রাজ্য।যুবরাজকে তার দিকে এগোতে দেখে তার কমলার কোয়ার ন্যায় ঠোঁট দুটো শৈত প্রবাহের শীতের ন্যায় থরথর করে কাঁপতে লাগলো।

“তোমার হাতে চোট লেগেছে।চলো ড্রেসিং করে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দেই”!

যুবরাজের রক্ত হিম করা এমন কথায় রাজ্য নিজের দুই হাত পিছনে লুকিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাথা দুলিয়ে কঠিন কন্ঠে বলে উঠলো
“আমার কাছে আর এক পা ও এগুলো আমি কিন্তু জ্ঞান হারাবো মিস্টার যুবরাজ “!

রাজ্যের মুখের এমন হুমকিতে প্রশস্ত হাসলো যুবরাজ।
“আচ্ছা জ্ঞান হারালে আমি আবার হুশ ফেরাবো।মানুষকে অজ্ঞান করে হুশ ফেরানোই আমার কাজ।”

“আমি একদম মজা করছি না আমি সত্যি আমার সেন্স হারাচ্ছি”
জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে কোনোমতে কথাটি বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো রাজ্য।

ত্যাড়ামি করে রাজ্যের দিকে হাত বাড়িয়ে রাজ্যের হাত স্পর্শ করার আগেই যুবরাজের বুকে লুটিয়ে পড়লো রাজ্য।জ্ঞান হারানোর আগে অস্ফুট স্বরে যুবরাজের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
“হুঁশে ফিরলে আপনাকে আমি দেখে নেবো যুবরাজ শাহীর”

#চলবে

#ওয়েলকাম_টু_মাই_ডার্কসাইড
#পর্ব_১১
#সারিকা_হোসাইন
———
যেই মেঘ গুলো একটু আগেও পুরো আকাশ কে থমথমে করে রেখেছিলো সেই মেঘ গুলো এখন গলে গলে হালকা বর্ষণে রূপ নিয়েছে।গুমোট নিস্তব্ধ রাত মুহূর্তের ব্যাবধানেই বৃষ্টির টুপটাপ ছন্দে মূর্ছনা তুলেছে।যুবরাজের গোল্ডেন ডুডল পোষা কুকুরটিও বোধ হয় এতক্ষনে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে আছে।এমন শীতল রোমাঞ্চকর পরিবেশে ঘুম উধাও হয়েছে যুবরাজের।আজকাল এলকোহল ও তাকে কাবু করতে ব্যার্থ হচ্ছে।

রাজ্যের নিষ্পাপ মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে যুবরাজ।

“এটা কি হলো?সামান্য এই টুকুন দেখেই মেয়েটা জ্ঞান হারালো?এরকম পিঁপড়ের আত্মা নিয়ে এই মেয়ে পুলিশের স্পেশাল ফোর্স এ কিভাবে নিয়োগ পেয়েছে?

রাজ্যের হাত ভালো করে পরখ করে নিলো যুবরাজ।ধবধবে ফর্সা হাতটি একদম কব্জি থেকে কুনুই পর্যন্ত লম্বা মোটা হয়ে ছিলে দগদগে হয়ে আছে।পুরোটা হাত গরম হয়ে গোলাপি বর্ন ধারণ করেছে।মেয়েটির পুরো গলা জুড়ে যুবরাজের হাতের আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট।কপালেও সামান্য লালচে ফোলা দেখা যাচ্ছে।
ফুঁস করে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চট করে রাজ্যকে কোলে তুলে নিজের বেডরুমের দিকে অগ্রসর হলো যুবরাজ।

“না চাইতেও মেয়েটা বারবার সামনে এসে মুসিবত খাড়া করছে।এই মেয়ে কি জানে আমি তার জন্য কতোটা খতরনাক?

নিজের ধবধবে সাদা তুলতুলে নরম বিছানায় আলতো করে পরম মমতায় ভালোভাবে রাজ্যকে শুইয়ে দিলো যুবরাজ ।বালিশ টা একটু নিচু করে মাথায় হাত বুলিয়ে পায়ের কাছের পাতলা কাঁথা টা কোমর পর্যন্ত টেনে এসির পাওয়ার কমিয়ে দিলো।

রাজ্যের ঘুমন্ত মুখশ্রী যুবরাজকে বার বার খুব করে টানছে।গোলাপি খসখসে ঠোঁট জোড়া যুবরাজের মনকে অশান্ত করে তুলেছে থেকে থেকে। অস্থির মনকে শান্ত করতে না পেরে টুপ করে নিজের উষ্ণ মসৃন অধর জোড়া ছুঁইয়ে দিলো রাজ্যের শীতল খসখসে ওষ্ঠে।
এরপর দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে উঠে দাঁড়ালো

“নিজের এহেন সর্বনাশের জন্য তুমি নিজেই দায়ী মেয়ে।পরে আমাকে দোষ দিলে সেটা আমি মানবো কেনো?ভালোবাসার ব্যাপারে যুবরাজ একশো তে একশো।

নিজেকে নিজেই ভুজুং ভাজুং বুঝ দিয়ে মেডিকিট বক্স টা নিয়ে রাজ্যের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলো যুবরাজ।
রাজ্যের চিকন সরু হাতটি টেনে নিয়ে একটা কটন প্যাডে হ্যাক্সিসল লাগিয়ে সামান্য ফু দিয়ে দিয়ে ক্ষত টা পরিস্কার করে নিলো।হ্যাক্সিসল লাগানোর সাথে সাথেই হুশ হীন মানবীর শরীর কিঞ্চিত ঝাকুনি দিয়ে কপাল টা কুঁচকে উঠলো।
যুবরাজ বুঝতে পারলো হাতে জ্বলুনি হচ্ছে।
রাজ্যকে এই মুহূর্তে যুবরাজের কাছে অসহায় ছোট একটা বাচ্চা মনে হচ্ছে।যেই বাচ্চা একটু ব্যাথা পেলেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদে।

যুবরাজ একটা অয়েন্টমেন্ট নিয়ে ছিলে যাওয়া জায়গা টায় এমন আলতো হাতে লাগিয়ে দিলো যেনো শরীর টের ই পেলো না এখানে কারো আধিপত্য বিস্তার হচ্ছে।
এরপর সাদা রিবন গজ নিয়ে কব্জি থেকে কুনুই পর্যন্ত ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিজের কাজ শেষ করলো।
এরপর মেডিকিট বক্স রেখে স্টেথোস্কোপ আর প্রেসার মাপার মেশিন নিয়ে অভিজ্ঞ ডাক্তারের ন্যায় কার্যক্রম চালালো।
প্রেসার একদম লো,পালস খুব ধীর গতিতে চলছে।মনে হচ্ছে কয়েকদিনের স্ট্রেচে শরীর দুর্বল হয়ে গিয়েছে।

“মেয়েটা ঠিক ঠাক খায়না নাকি?আমি এই মেয়ের বস হলে প্রথম দিনেই চাকরি থেকে আউট করে বউ বানিয়ে খাঁচায় বন্দি করে রাখতাম আর সারাদিন তুলে তুলে খাবার খাওয়াতাম।এত্তো কেয়ারলেস কোনো মেয়ে হয়?

যুবরাজ নিজে নিজেই বকবক করতে করতে একটা ইলেক্ট্রোলাইট স্যালাইন এনে রাজ্যের হাতে লাগিয়ে দিলো।

“এই মেয়েকে বিয়ে করলো তো বাসাতেই একটা ডাক্তার খানা খুলতে হবে দেখা যাচ্ছে।কি সাংঘাতিক মুসিবত!নিজের জন্য আনা মেডিসিন তো এখন দেখছি আমার আগে আমার বউয়েরই লাগবে।ধ্যত খেলবো না!

***********
এদিকে এনি বেনজির আশফীর বাসার নিচে দুই ঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাজ্যকে ফোনের উপরে ফোন দিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু বেচারি রাজ্য ফোন তো রিসিভ করছেই না মেসেজ দিয়েও কোনো ফিডব্যাক জানাচ্ছে না।

“আমাকে মেসেজ পাঠিয়ে এই মেয়ে কোথায় গেলো?গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে অলরেডি।এতো রাতে একা একা বাড়ি ফিরবো কিভাবে?

একা একা বিড়বিড় করতে করতে চতুর এনি চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর বুলালো।এরিয়াটা একদম ফাঁকা।কেমন একটা গা ছমছমে ভাব।নিজের ফোনের স্ক্রিন অন করে সময় দেখে নিলো এনি।রাত প্রায় দেড়টার কাছাকাছি।ফোন পকেটে পুড়ে টর্চ জ্বালিয়ে এপার্টমেন্ট এর ব্যাক সাইডে চলে গেলো সে।এপার্টমেন্ট এর পিছনে বড় একটা আম গাছ রয়েছে সেটা দিয়ে ইজিলি বেনজির আশফির বেলকনিতে যাওয়া যায়।
“ভুত যেহেতু ধরতেই এসেছি তাহলে একদম গাছের গুঁড়ি থেকেই শুরু করা যাক”!

টর্চ জ্বালিয়ে গাছের দৃশ্যমান সকল অংশ পরখ করে নিলো এনি।সন্দেহ জনক কিছুই পাওয়া গেলো না এখানে।
“দুনিয়াতে ভুত প্রেত বলতে কিছুই নেই।আমি ড্যাম সিউর এটা কোনো মানুষের কাজ।কিন্তু কাজটা করলো কোন ব্যাটা?

মাঝারি সাইজের আম গাছটাতে উঠতে বেশ বেগ পোহাতে হলো এনিকে কারন বৃষ্টির ছিটায় গাছ পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছে অনেক।দুই মিনিটের কাজ দশ মিনিটে করে হাঁপিয়ে উঠলো এনি।
কোনো মতে তিন তলার বেলকনিতে পৌঁছে হাঁটুতে ভর দিয়ে বড় বড় দম ফেললো সে।এরপর রুমে ঢুকে বেলকনির দরজা লাগিয়ে পুরো বাসা আলোকিত করলো লাইটস জ্বালিয়ে।

বিশাল বড় ফ্ল্যাট,বেনজির আশফী আর তার স্ত্রী একাই থাকেন এখানে।দুটো ছেলেমেয়ে আছে উনাদের তারা বিদেশ পড়াশোনা করেন রুমানার বোনের কাছে।বেনজির আশফির ধারণা
বাংলাদেশের পড়াশোনার কোনো মূল্য নেই।সার্টিফিকেট অর্জন করে চাকরি পাবার চাইতে শিক্ষিত মানুষ হওয়া আগে জরুরি।

এনি মনে মনে ভাবে
“ভদ্রলোকের নীতি ঠিক আছে।এতো এতো লেখাপড়া করে যদি মানুষ ই না হওয়া গেলো তবে কিসের দাম রইলো বড় বড় ডিগ্রির?

বেনজির আশফির কক্ষ তল্লাশি চালাতে চালাতে এনি অদ্ভুত সুন্দর একটি রুমাল দেখতে পেলো বেড সাইড টেবিলের উপর।ঝটপট হাতে গ্লাভস পরে সেই রুমালটি একটা জিপার ব্যাগে ভরে নিলো।মস্তিষ্ক সজাগ হতেই এনির মনে পড়লো
“চিপ বারবার একটা সুগন্ধি রুমালের কথা বলছিলেন।এই রুমালের ভেতরই লুকিয়ে আছে আসল রহস্য।এখন এই রুমাল ই আমাকে ভুত পর্যন্ত নিয়ে যেতে হেল্প করবে।”

_________
আজকে কোনো ভাবেই যুবরাজের অক্ষিপটে নিদ্রা ধরা দিচ্ছে না।চোখ বুঝলেই রাজ্যের জ্ঞান হারানোর সময়টার কথা বার বার মনে পড়ছে।
“আচ্ছা মেয়েটা কি জাদুকরী?সে আমার পুরোটাই কিভাবে কব্জা করেছে?যদি মেয়েটাকে আমি না পাই তাহলে আমি বাঁচবো কি করে?

হঠাৎই রেস্টুরেন্টের কথা মাথা চাড়া দিতেই পায়ের রক্ত ছলকে মাথায় উঠে গেলো যুবরাজের।শোয়া থেকে দুম করে উঠে বসে রাজ্যের কক্ষের দিকে পা বাড়ালো।
“এই মুহুর্তেই আমাকে জানতে হবে শেরহামের সাথে তার কিসের সম্পর্ক?কেনো সে ওই নরখাদকের সাথে দেখা করতে গিয়েছে রেস্টুরেন্টে?

যুবরাজ রাজ্যের কক্ষে এসে রুমের লাইটস জ্বালিয়ে হনহন করে রাজ্যের বিছানার কাছে এসে দাড়ালো।রাগে তার চোখ দুটি জলন্ত অগ্নি শিখার মতো হয়ে আছে।আপনা আপনি দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে মেয়েটি পরম সুখের নিদ্রা গিয়েছে।বড় বড় পাপড়ি যুক্ত বন্ধ চোখ দুটো যেনো শিল্পীর আঁকা ছবি।ভরাট গোলাপি গাল দুটো পাকা আপেলের মতো লাগছে যুবরাজের কাছে।বেঘোরে মেয়েটি দুই ঠোঁট নাড়িয়ে চুকচুক শব্দ করছে।এই দৃশ্য দেখে ফিক করে হেসে দিলো যুবরাজ।

যেই পরিমাণ রাগ নিয়ে যুবরাজ এই কক্ষে প্রবেশ করেছিলো মেয়েটির এমন কোমল তুলতুলে আদুরে মুখশ্রী দেখে নিমিষেই সেই রাগ পানিতে পরিণত হলো।
দ্রুত রুমের লাইট নিভিয়ে ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে রাজ্যের পাশে চুপ মেরে শুয়ে গেলো সে।
নিজের হাতের উপর রাজ্যের মাথা রেখে আরেক হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে চোখ বুঝলো
“এবার ঘুম পাচ্ছে আমার,খুব ঘুম পাচ্ছে।তোমার উষ্ণতা বিহীন আমার ঘুম ও পালিয়েছে জান।আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি দিনে দিনে।আমি উন্মাদ বদ্ধ উন্মাদ।

———-
ঘুটঘুটে অন্ধকার একটি কক্ষে পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছর বয়সের এক তরুণের গলা টিপে ধরে আছে লম্বা চওড়া শক্তপোক্ত এক লোক।সারা শরীর তার কালো কাপড়ে আবৃত যার কারনে অজ্ঞাত ব্যাক্তির সঠিক বয়স অনুমান করা দুষ্কর।এই অন্ধকার কক্ষের মাঝেও লোকটির অদ্ভুত চোখ হিংস্রতা ছড়াচ্ছে।সাধারণ মানুষের চাইতে এই লোকের চোখের মণি ভীষন আলাদা।দুই পাশে দুই রঙের মনি।
কক্ষের সকল নিস্তবতা ভেদ করে হুংকার দিয়ে উঠলো লোকটি
‘”বল তোতলা মামুন কোথায় আছে?যদি কোনো কিছু গোপন করার চেষ্টা করেছিস তাহলে এই ঘরের মেঝেতেই দাফন করে দেবো তোকে।মানুষ তো দূরে থাক কাকপক্ষী ও জানবে না তোর সমাধির খবর।

শক্ত হাতে গলা চেপে ধরায় যুবকের কথা বলার সকল শক্তি ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে আসছে।মনে হচ্ছে গলার শ্বাস নালি এখনই ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে।আদৌ কি তার মুক্তি মিলবে এই কঠিন হৃদয়ের দস্যুর থেকে?যার কাজই মানুষকে চূড়ান্ত কষ্ট দিয়ে মেরে পৈচাশিক আনন্দ নেওয়া তার সামনে সত্য মিথ্যা কি আসে যায়?

তবুও মানুষ নিঃশ্বাসের শেষ বিন্দু দিয়ে বাঁচার জন্য লড়ে যায়।এই তরুণের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।তাকে বাঁচতে হবে।সে অবশ্যই বাঁচবে।চোখের সামনে এই শয়তানের কঠিন পরিণতি না দেখা পর্যন্ত সে মরতে পারেনা।

কঠিন মনোবলে যুবক নিজের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে রাক্ষস তুল্য ব্যাক্তির থেকে সামান্য আলগা করতে পারে নিজের গলা।তাতেই যেনো তার মনে হলো কানের কাছে দিয়ে মৃত্যু তাকে ছুঁয়ে গেলো।
অজ্ঞাত ব্যাক্তি রাগে ফুঁস ফুঁস করতে করতে দুই হাতে ধরে ছুড়ে মারলো যুবকটিকে।
ছিটকে পড়ে অদূরে ভাঙা একটি টেবিলের সাথে লেগে মাথা ফেটে গলগল করে রক্তধারা ছুটে গেলো যুবকটির চিবুক বেয়ে।
হাত দিয়ে মাথার ফাটা অংশ চেপে ধরে জড়িয়ে যাওয়া কন্ঠে সর্বোচ্চ তেজ ঢেলে ছেলেটি বলে উঠলো
“যুবরাজ ভাই তোতলা মামুনকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে ”

#চলবে