ওয়েলকাম_টু_মাই_ডার্কসাইড পর্ব-৩৭+৩৮

0
5

#ওয়েলকাম_টু_মাই_ডার্কসাইড
#পর্ব_৩৭
#সারিকা_হোসাইন
——–
সারা রাতের ভারী বর্ষনের পর শেষ রাতের দিকে বৃষ্টির দমক কিছুটা কমেছে।তবে এখনো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ঝড়েই যাচ্ছে।আকাশ কিছুটা সাফ হয়ে হালকা করে সূর্যের মুখ দেখবার সুযোগ করে দিয়েছে।ভোরের আলো ফুটেছে তাও ভালোই কিছুক্ষণ আগে।কোনো জন মানবের সাড়া শব্দ পাওয়া না গেলেও থেকে থেকে দুই একটা চড়ুই পাখির কিচিরমিচির ডাক কর্ণকুহরে এসে ধাক্কা খাচ্ছে।যুবরাজের বাংলোর থাই জানালার কাঁচে ছোট ছোট মুক্ত দানার ন্যায় বৃষ্টির কনা সেটে বাইরের দৃষ্টি সীমানা ঝাপসা করে রেখেছে।তাই বাহিরের প্রাকৃতিক পরিবেশ আবছা আবছা দৃষ্টি গত হচ্ছে।

যুবরাজের পেশীবহুল বাহুডোরে পরম শান্তিতে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে রাজ্য।সারা রাতের উষ্ণ আদরে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে কখন ঘুমে তলিয়েছে সে নিজেই জানেনা।কিন্তু ঘুম নেই যুবরাজের চোখে।সারা রাত সে এক সেকেন্ডের জন্যও দুই চোখের পাতা এক করেনি।প্রচন্ড জেদ আর ক্রোধে শরীরের রক্ত টগবগিয়ে ফুটছে তার। এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করলেই সুবহান শেখের ক্রুর হাসি যুক্ত বিশ্রী চেহারা খানা চোখের সামনে ভেসে উঠছে যা যুবরাজের একদম সহ্য হচ্ছে না।ক্রোধের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে দাঁতে দাঁত চেপে ফুঁসে উঠে দুই হাতে পিষে ধরলো রাজ্যকে।ব্যাথায় ককিয়ে ঘুম ভঙ্গ হলো শীর্ন দেহের মানবীর।রাজ্যের আর্তনাদে হুঁশে ফিরলো যুবরাজ।
রাজ্য কিছু বুঝে উঠার আগেই যুবরাজ বিচলিত হৃদয়াহত হলো।কন্ঠে উদ্বিগ্নতা আর আকুলতা নিয়ে বলে উঠলো

“আম সরি, আম রিয়েলি সরি।একদম খেয়াল ছিলো না যে আমার বুকে একটা ছোট তুলতুলে হ্যামিং বার্ড শুয়ে আছে।অনেক ব্যাথা লেগেছে জান?

রাজ্য তার ছলছলে দৃষ্টিতে মাথা নাড়িয়ে নিচু স্বরে মলিন কন্ঠে বলে উঠলো
“না অতোটা লাগেনি”

কথাটি বলেই যুবরাজের বুকে মুখ লুকিয়ে ব্যাথায় বেরিয়ে আসা অশ্রুকে গোপন করার প্রয়াস চালালো।চৌকস যুবরাজ ঠিকই বুঝলো ব্যাথার মাত্রা কতো খানি।তবুও না বুঝার ভান ধরে বসে রইলো।কারন এখানে বেশি কথা বলতে গেলেই পাল্টা পাল্টি প্রশ্নের সৃষ্টি হবে।যা এই মুহূর্তে যুবরাজ একদম চাচ্ছে না।নিজেকে কোনো মতে ধাতস্থ করে যুবরাজ রাজ্যের ঘন চুলে বিলি কাটলো।

“আসলে ঘুম ভেঙেই তোমাকে এই এবস্থায় দেখে সহ্য হচ্ছিলো না।মনে হচ্ছিলো তোমাকে দুমড়ে মুচড়ে খেয়ে ফেলি।কনট্রোল লেস হয়ে বেশি ব্যাথা দিয়ে ফেলেছি।এজন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত।আর কখনো এমন সিরিয়াস হবো না।প্রমিস।

যুবরাজের এমন আদুরে কন্ঠে রাজ্য তার মোলায়েম হাত দিয়ে যুবরাজের কোমর জড়িয়ে ধরে পরম আবেশে পুনরায় চোখ বুঝলো।কিন্তু মনন আর মস্তিষ্কে চললো সন্দেহের খেলা।

“কিছু তো একটা হয়েছেই!সেই কিছুটা কি তা আমাকে অবশ্যই জানতে হবে।গত রাতে যুবরাজের নগ্ন পিঠে অসংখ্য কাটা ছেড়া আর জখমের দাগ দেখা গিয়েছে।কিছু জখম একদম নতুন।এগুলোর রহস্য খুব দ্রুত আমাকে জানতেই হবে আর আমাকে এভাবে ফেলে সে গেছিলো ই বা কোথায়?”

বিভিন্ন ভাবনা ভাবতে ভাবতে না চাইতেও রাজ্যের হাত যুবরাজের খালি পিঠে চলে এলো।এবং উৎসুক হয়ে কাটা জখমের উপর নিজের জহুরী আঙ্গুলি চালনা করলো।ঘটনার পুরোটাই বুঝতে পারলো যুবরাজ।মুখে কিছুই না বলে স্মিত হেসে রাজ্যের ব্রেন ওয়াশে ধ্যান দিলো।

“আমাকে সিডিউস করার চেষ্টা করলে কিন্তু তোমারই লস ডিয়ার ওয়াইফ”

“আমি মোটেও আপনাকে সিডিউস করছি না ডিয়ার শেইমলেস”

“তাহলে উষ্ণ হাতের শিহরণ কেনো দিচ্ছ?জানোনা বারুদ থেকে আগুনের দূরে থাকতে হয়?

“আসলে আপনার পিঠে…….

রাজ্যকে কথা শেষ করতে না দিয়েই রাজ্যের চোয়াল চেপে ধরে জবরদস্তি তে নিজের উষ্ঠদ্বয় দিয়ে আকড়ে ধরলো রাজ্যের নরম পাতলা শুষ্ক ঠোঁট জোড়া।কিছুক্ষণ এভাবেই কেটে যাবার পর শ্বাস নিতে না পারায় হ্যাচকা টানে যুবরাজের হাত সরিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে যুবরাজের দিকে দৃষ্টি মেললো রাজ্য।

“আমার কথা এখনো শেষ হয়নি ”

মুখে ফিচেল হাসি ঝুলিয়ে রাজ্যের গলার ভাঁজে নিজের মুখ গুঁজে দিয়ে মাদকতা মিশ্রিত কন্ঠে যুবরাজ বলে উঠলো
“এতো কৌতুহল মোটেও ভালো না।সময় এলে সব জানতে পারবে।এখন আদর করতে দাও,সহ্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।ছোটা ভিম কন্ট্রোলের বাইরে”

না চাইতেও যুবরাজের সাথে তাল মেলাতে হলো রাজ্যকে।কিন্তু আনন্দ উপভোগের চাইতে নানাবিধ ভয়ঙ্কর ভাবনা ভর করলো দুজনের মস্তিষ্কেই।কিন্তু কেউ কারো মনোভাব প্রকাশ করলো না।

**********
নিজের তুলতুলে নরম বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে এলোমেলো ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে শেরহাম।কোকেইন এর নেশা এতোটাই গভীর ভাবে জেঁকে বসেছিলো তাকে যে সে আর সারা রাতের কোনো খবরই বলতে পারে না।রাত ফুরিয়ে কখন ভোর নেমেছে এটাও তার অজানা।দরজা জানালা এমন ভাবে আটকে রাখা হয়েছে যে বাইরের শব্দ তো দূর একটু আলো পর্যন্ত কক্ষে প্রবেশ করছে না।

ধীরে ধীরে হালকা হয়ে এলো শেরহামের ঘুম।অল্প পিট পিট করে তাকিয়ে কিছু সময় সে ওভাবেই বিছানায় পড়ে রইলো।নেশার ঘোর অল্প অল্প করে কেটে যাচ্ছে।শরীর খুব হালকা লাগছে।মাথাটা ব্যাথায় টনটন করছে।এই মুহূর্তে একটা হ্যাঙওভার ড্রিংক্স খুব প্রয়োজন।কিন্তু কে দেবে তাকে এই ড্রিংক্স?

হঠাৎই রাজ্যের হাসিমাখা মুখশ্রী মনে পড়তেই অনিন্দ্য ভালো লাগায় ছেয়ে গেলো শেরহামের মন।

“তুমি ই একমাত্র লাকি গার্ল যাকে শেরহাম ফাইয়াজ ভোগ নয় রানী করে রাখতে চেয়েছে তার নিজ রাজ্যে।এবং খুব শীঘ্রই তোমাকে দখল করবো আমি।

রাজ্যকে পাবার সুখে মুখের হাসি প্রশস্ত হলো শেরহামের।কিন্তু নিমিষেই যুবরাজের চেহারাখানা মস্তিষ্কে হানা দিতেই রাগে উত্তপ্ত হয়ে উঠলো পুরো শরীর।
শোয়া থেকে চট করে উঠে বসে নিজের চুল নিজেই শক্ত মুঠিতে টেনে ধরলো শেরহাম।

“তোকে আমি দেখে নেবো যুবরাজ!আমি তোকে ছাড়বো না।রাজ্যকে জড়িয়ে অনেক বড় বড় ভাষণ তুই দিয়েছিস।তোর জিভ যদি আমি কে*টে না নিয়েছি তবে আমার নাম ও শেরহাম নয়।

রাজ্যকে এক পলক দেখার বাসনায় মন ব্যাকুল হয়ে উঠলো শেরহামের।কতো বার নির্লজ্জের মতো চৌধুরী বাড়িতে গিয়েছে সে।কেনো গিয়েছে এই খবর কি কেউ রেখেছে?
রাজ্যকে কখন সে ভালোবেসে ফেলেছে সেটা তো সে নিজেই জানেনা।এক পলক মেয়েটিকে চোখের দেখা দেখার জন্য নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে সময় অসময়ে ছুটে গিয়েছে ওই বাড়িতে।কিন্তু মেয়েটি একবারের জন্য চোখ তুলে দেখেই নি তাকে।

“কিসের এতো অবহেলা আমার প্রতি তার?কি নেই আমার?যুবরাজের থেকে সবকিছুই বেশি বেশি আছে আমার।তবুও কেনো রাজ্য আমাকে ভালোবাসবে না?দরকার হলে হিরে জহরতে মুড়িয়ে রাখবো।তবুও আমাকে তার ভালোবাসতেই হবে!

আর ভাবতে পারেনা শেরহাম।এখনই একবার রেজোয়ান চৌধুরীর মুখোমুখি হওয়া চাই।

“ভালোয় ভালোয় মেয়েকে আমার হাতে তুলে না দিলে জোর করে উঠিয়ে আনবো।”

রাগে ফুঁস ফুঁস করতে করতে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে।ঝটপট ফ্রেস হয়ে পোশাক পাল্টে সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে এলো।এদিকে একের পর এক ফোনের ভাইব্রেট হয়ে যাচ্ছে শেরহামের মুঠোফোনে।।রাজ্যকে দেখার উত্তেজনায় সেই ফোন তুলতে বেমালুম ভুলে গেল সে।দ্রুত হাতে সু রেক থেকে এক জোড়া স্নিকার্স পায়ে তুলে খট করে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো।
ঘরের বাইরে দৃষ্টি মেলতেই বেশ কিছুটা অবাক হলো শেরহাম।
বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে দুটি ফুলে সজ্জিত খয়েরি রঙা কফিন সার বেঁধে রাখা হয়েছে।
“এগুলো কিসের কফিন রাখা হয়েছে এখানে?আর কে রেখেছে?শেরহাম ফাইয়াজ এর বাড়ির সামনে কফিন রাখার স্পর্ধা হয়েছে কোন কলিজা ওয়ালার?

কথা গুলো গর্জে উঠা কন্ঠে বলে দৌড়ে কফিন দুটোর নিকট এগিয়ে গেলো শেরহাম ।শকুনি দৃষ্টিতে কফিন দুটোর দিকে নজর বুলাতেই কুচকুচে কালো রঙের একটা খাম চোখে পড়লো।খয়েরি ফুলে সজ্জিত কফিনে এমন কুচকুচে কালো রঙের খাম দেখে কপাল কুঞ্চিত হলো শেরহামের।
বাজ পাখির মতো ছো মেরে সেই খাম হাতে তুলে উল্টে পাল্টে দেখতেই দুই রঙা চোখের মণি জলন্ত কয়লার খনিতে পরিণত হলো।
অত্যাধিক ক্রোধে কপালের আর ঘাড়ের শিরা গুলো নীল হয়ে ফুলে উঠলো।অস্বভাকি ভাবে ভারী শব্দে নিঃশাস পড়তে লাগলো।

কালো রঙের খামটিতে খুব যত্নের সাথে খোদাই করে লিখা হয়েছে

“গিফট ফ্রম ইউভরাজ”

নিজের থাবা যুক্ত হাতে সেই খাম দুমড়ে মুচড়ে ছুড়ে ফেললো শেরহাম।এরপর সজোড়ে পা দিয়ে লাথি মেরে কফিনের ঢাকনা খুলে ফেললো।
কফিনের ঢাকনা খুলতেই চোখে পড়লো ভেজা ফ্যাকাশে বর্ণের নিজের বিশ্বস্ত ভাড়াটে খু*নি সিরাজের মৃ*ত মুখশ্রী।
নিজের ক্রোধের লাগাম আর টেনে ধরতে পারলো না শেরহাম।ধরণী কাঁপিয়ে জলন্ত চোখে গর্জে উঠলো শেরহাম

“যুবরাজ”

#চলবে

#ওয়েলকাম_টু_মাই_ডার্কসাইড
#পর্ব_৩৮
#সারিকা_হোসাইন

**********
শরৎ কাল পেরিয়ে হেমন্তের আগমন হয়েছে আরো দুদিন আগে।সকল প্রখরতা অস্থিরতা দূর হয়ে প্রকৃতি কোমলতার ছোঁয়ায় নিজেকে উজাড় করেছে।কিছুদিন আগেও যেই সূর্যতাপ শরীরে ফোস্কার সৃষ্টি করতো তা এখন অনেকটাই মোলায়েম ।নেই কোনো ক্লান্তি নেই কোনো বিষাদ।তবুও কোথায় যেনো কি নেই!

শেরহামের ভুতুড়ে বিশাল ফ্ল্যাটে একটা কাউচে পায়ের উপর পা তুলে সমানে কপাল স্লাইড করে চলেছেন সুবহান শেখ।চোখে মুখে তার গভীর ক্রোধের ছাপ স্পষ্ট।নিজের ক্রোধ আয়ত্তে আনতে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে আছেন প্রবীণ এই লোকটি।শেরহামের বলা প্রতিটি কথা যেনো তার শরীরে সুচের মতো ফুটেছে।বার বার অগ্নি স্ফুলিং যুক্ত পলক ঝাপটে নিজের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছেন তিনি।

“পপ্স যুবরাজকে বাঁচিয়ে রাখলে আমাদের পুরোটাই লস।এই কয় বছরে আমাদের আশেপাশের সকল মানুষকে টার্গেট করে মে*রে ফেলেছে ও।শেষ পর্যন্ত সিরাজকেও ছাড়েনি।কোনো ভাবেই আর ওর নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না।আমি কিন্তু পাবলিক প্লেসে ওকে ঠুকে দেবো বলে দিলাম।

শেরহামের কথায় সুবহান শেখের ক্রোধ যেনো তরতর করে আরো হাজার গুণ বেড়ে গেলো।চট করে বসা থেকে উঠে ঠাস করে স্বশব্দে এক চ*ড় বসিয়ে দিলেন ছেলের ফর্সা গালে।সাথে সাথেই গালটা র*ক্ত*বর্ণ আকার ধারণ করলো।বা হাতের চারটা আঙুলের দাগ সেখানে সুস্পষ্ট।নিজের গাল চেপে ধরে মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো শেরহাম।

ছেলের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন সুবহান শেখ।

“খুব মাস্তান সেজেছো তাই না?যাকে ছোট থাকতেই কিছু করতে পারো নি তাকে তাকত ওয়ালা হবার সুযোগ দিয়েছো।এখন বলছো পাবলিক প্লেসে ঠুকে দেবে!ওই ছেলে কতো ধুরন্দর জানো না?নিজের প্রাণ খোয়াতে চাও নাকি?গ*র্দ*ভ কোথাকার।এহ এসেছে আমার লায়েক”!

নিজের বাবার থেকে এমন জঘন্য ভাবে অপমানিত হয়ে রাগে দুঃখে দুচোখ ফেটে জল এলো তার।ছোট থেকে এমন তুচ্ছ তচ্ছিল্য করে শেরহামকে কথা বলেন সুবহান শেখ।দিনে দিনে বিশ্রী আচরণের মাত্রা বেড়েই যাচ্ছে শুধু।অশ্রুসজল চোখে আহত দৃষ্টিতে নিজের জন্মদাতা পিতার দিকে চোখ তুলে তাকায় শেরহাম

“আমি কি সত্যিই তোমার ছেলে পপ্স?

“কেনো বিশ্বাস হচ্ছে না?বিশ্বাস না হলে নিজের ম*রা মাকে জিজ্ঞেস করো।

কথাটি বলেই ফিক করে হেসে ফেললেন সুবহান শেখ।সেই হাসির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো শেরহাম।এরপর দাঁতে দাঁত পিষে সুবহান শেখ বলে উঠলেন

“জিজ্ঞেসটা করবে কি করে?নিজের মাকেও তো রা*ন্না করে খে*য়ে ফেলেছো।মানুষ খেকো কোথাকার”

কোথাও না কোথাও আজকে শেরহামের বড্ড অনুশোচনা হচ্ছে।কোনো সন্তানের সাথে বাবা হয়ে এমন আচরণ কেউ করতে পারে না।যুবরাজের যখন কোনো খুজ ছিলো না শেরহাম নিজের চোখে দেখেছে একমাত্র ছেলের অকুলতায় কতোটা কষ্ট পেয়েছিলেন সাদাফ শাহীর।ছেলেকে একবার বুকে টেনে নিতে পুরো দুনিয়া এক করতে চেয়েছিলেন।রেহানের বাবা মার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা সে নিজে চোখে দেখেছে।তাহলে তার বাবা এমন কেনো?
কই এতো দিন পর দেশে ফিরেও তো সে শেরহাম কে একটি বারের জন্য বুকে টানলো না।কিন্তু শেরহাম তো চায় তার বাবা তাকে শক্ত হাতে বুকে চেপে ধরুক।মাথায় মমতার হাত বুলাক।
যুবরাজ নিজের মনের স্বাধীনতা মতো সমস্ত জায়গায় বিচরণ করতে পারে।আর সে?
সে তো সুবহান শেখের হুকুম ছাড়া খাবার পর্যন্ত খেতে পারেনা।
তবে কি দিনে দিনে সে তার বাবার কলের পুতুলে পরিণত হয়েছে?
আর ভাবতে পারেনা শেরহাম।
নিজের দুঃখ কষ্ট লুকিয়ে অনুরোধের স্বরে বলে উঠে

“পপ্স আমি একবার রাজ্যকে দেখতে চাই।আমাকে বাড়ির বাইরে যাবার একটু অনুমতি দাও প্লিজ।আজ ষোল দিন ধরে আমি এই বাড়ির চার দেয়ালে বন্দি।আমার প্রাণ টা যে ছটফট করছে পপ্স”

ছেলের দিকে ক্রোধিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন সুবহান শেখ

“পরের বউয়ের জন্য কিসের এতো উতলা তোমার?

সুবহান শেখের মুখ থেকে পরের বউ শব্দটি শেরহামের মস্তিষ্ক নাড়িয়ে দিলো।সমস্ত কিছু ভুলে বোকা মানবের ন্যায় কিঞ্চিৎ মুখ ফাঁকা করে অবুঝের ন্যায় শুধালো

“পরের বউ মানে?

হুইস্কির বোতলের সিল খুলতে খুলতে সুবহান শেখ বলে উঠলো
“যুবরাজ ওই মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে,কিন্তু বিয়ে করে বউ নিয়ে কোথায় গেছে এটা কেউ জানেনা”

এবার আর শেরহাম তার উপচে উঠা অশ্রু বিন্দুকে ধরে রাখতে পারল না।দুই কদম সুবহান শেখের দিকে এগিয়ে হুইস্কির বোতল কেড়ে নিয়ে আহত কন্ঠে শুধালো

“বিয়ের কথা তুমি জানতে?

সুবহান শেখ বাজখাই গলায় বলে উঠলেন
“হ্যা জানতাম তো”

“তাহলে আমাকে একটা বার জানানোর প্রয়োজন ও মনে করলে না তুমি?

“তোমাকে জানিয়ে কি হবে?যুবরাজের সামনে যেতে যেচে ম*রা*র জন্য?”

“তুমি চাইলেই তো বিয়েটা আটকাতে পারতে পপ্স!

“কেনো আটকাবো?তোমাকে কি এখানে প্রেম আর বিয়ে করতে পাঠিয়েছি?কান খুলে ভালো করে শুনে রাখো।এসব প্রেম ভালোবাসা আর বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে সাদাফ শাহীরের পুরো পরিবার শেষ করে দাও।তোমার মত পাগল ছাগলের আবার বিয়ে কিসের?ভুলে যেওনা তুমি একজন ন*র*খাদক।তোমার কাছে কোনো মানুষ সেফ না”

“আমি রাজ্যকে মনের গভীর থেকে ফিল করি পপ্স”

“ওসব ফিল টিল কিছুই না।ওগুলো আবেগ।এসব আবেগ বাদ দিয়ে যুবরাজ কোথায় আছে সেটা খুঁজে বের করো যাও।

*********
বড় বড় শাল আর হরতকি গাছের সমারোহে ঘেরা যুবরাজের অভিজাত্যে ভরা সাদা রঙের বাংলোটি।বাংলোর সামনের দিকটায় বিশাল এক গার্ডেন এরিয়া।সেখানে দেশি বিদেশি নাম না জানা হরেক রকমের ফুল।যেমন তার সৌন্দর্য তেমন তার সুবাস।গার্ডেন এরিয়ার কাঠের বেঞ্চিতে বসলে সুবাসিত সমীরণ আর পাখির মিষ্টি ডাকে মনে এক অনিন্দ্য প্রশান্তি মিলে।

এই কয়েকটা দিন বাংলোর সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতেই কেটে গিয়েছে রাজ্যের।কিন্তু অত্যন্ত অবাকের বিষয় এতো বড় বিশাল বাড়িতে না আছে কাজের লোক না আছে রাঁধুনি।তবুও সময় মতো সব কিছু গুছানো থাকে পরিপাটি করে।টেবিল ভর্তি থরে থরে সাজানো থাকে বাহারি সুগন্ধি যুক্ত মজাদার খাবার।এগুলো কখন রান্না হয় ,কে রান্না করে তার কিছুই জানে না রাজ্য।
ডাইন ইন টেবিলে যুবরাজকে বহু বার জিজ্ঞেস করলেও খুব কৌশলে সব কিছু এড়িয়ে গিয়েছে সে।
বাড়িটির গার্ডেন এরিয়া পর্যন্তই রাজ্যের চলাফেরা করার শেষ সীমানা।অদূরে বিশাল লোহার গেট টার কাছে যাওয়া খুব কঠিন করে নিষেধ দিয়েছে যুবরাজ।
এদিকে রাজ্যের ছুটিও শেষ।আগামি কাল থেকে তাকে ডিউটি জয়েন করতে হবে।এই বাড়ির রহস্য আর যুবরাজের রহস্য দুই ই রাজ্যের মস্তিষ্কে খুব করে গেঁথে গেলো।

“বেইব,একটু পরে সন্ধ্যা নামবে।এখনো ঘরে যাচ্ছ না কেনো?

আকস্মিক যুবরাজের কন্ঠ পেয়ে কিছুটা হকচকিয়ে উঠে রাজ্য।আজকাল সবকিছুতেই সে একটু বেশি ই সন্দেহ করছে।এটা কি মনের ভুল নাকি নাকি কোনো রোগ তা সে জানে না ।কিন্তু তার মনে প্রানে চাওয়া যুবরাজ আর তার মধ্যে কখনো কোনো সন্দেহের কাটা যুক্ত গাছের যেনো জন্ম না হয়।

যুবরাজ রাজ্যকে পেছন থেকে শক্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে কাঁধে থুতনি রেখে আবেশ মেশানো কন্ঠে শুধালো

“আজকের রাত ই শেষ রাত আমার রাজত্বে তোমার”

কথাটি শুনেই ধক করে উঠলো রাজ্যের বুক।না চাইতেও মন ভার হয়ে দুই চোখ ছল ছল করে উঠলো।মুখে অনেক কিছুই বলতে চাইলো কিন্তু বোবা কান্না শক্ত হাতে তার গলা চেপে সেই কান্না রোধ করে ফেললো।

নিজের দিকে রাজ্যকে ঘুরিয়ে যুবরাজ আহত কন্ঠে শুধালো

“আমাকে ছাড়া থাকতে তোমার কি অনেক কষ্ট হবে?

টলটলে চোখে যুবরাজের গোলকধাঁধার ন্যায় বাদামি চোখের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে রইলো রাজ্য।

“একটা মানুষ এতোটা কঠিন হৃদয়ের কি করে হতে পারে?

রাজ্যকে আর কোনো চোখের ভাষা পড়তে না দিয়ে নিজের বলিষ্ঠ কাঁধে তুলো নিলো যুবরাজ।
এরপর বাংলোর দিকে হাঁটা দিলো।

“বাইরে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে,তোমার যে ঠান্ডার প্রবলেম আছে সেটা ভুলে গেছো?

কোনো কথা না বলে রাজ্য যুবরাজের পিঠে মাথা রেখে চোখ বুঝে ফেললো।সেই সাথে খসে পড়লো দু ফোটা উষ্ণ জল।কঠিন হৃদয়ের যুবরাজ সেটা বুঝেও বুঝলো না।

কিছুক্ষন বাদে নিজেদের বেড রুমে এসে বিছানার উপর পরম যত্নে রাজ্যকে বসিয়ে দিল যুবরাজ।এরপর রাজ্যের তুলতুলে ফোলা ফোলা গালে নিজের বৃহৎ উষ্ণ হাতের স্পর্শ দিয়ে বলে উঠলো

“যদি কখনো আমি হারিয়ে যাই তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে বউ?

যুবরাজের আজকের কথা গুলো বেশ ধুয়াশা লাগছে রাজ্যের কাছে।খুবই রহস্য মানব ঠেকছে যুবরাজকে।এ’কদিন যুবরাজের উষ্ণ ভালোবাসায় সব ভুলে বসেছিলো রাজ্য।তবে আজ যুবরাজ বার বার এসব কি বলছে তাকে?

“সে কেনো হারাবে?আর কোথায় হারাবে?

আর ভাবতে পারে না রাজ্য।সে যুবরাজের হাতের থাবায় নিজের কাঁপা কাঁপা দুই হাত মিলিয়ে বলে উঠে

“আপনাকে বড্ড অচেনা লাগছে মিস্টার শেইমলেস।আমার যে অনেক ভয় করছে!

রাজ্যের আহত দৃষ্টির পানে তাকিয়ে খানিক মেপে হাসে যুবরাজ।এরপর মেঝেতে হাটু মুড়ে বসে রাজ্যের পা জড়িয়ে ধরে কোলে মাথা রেখে আবেশে চোখ বুঝে ফেলে।

“আমি মানুষ হিসেবে খুবই খারাপ ,পুলিশে ধরলে আমার ফাঁ*সি হবে আর ধরা না পড়লে অন্য কারো হাতে একদিন না একদিন ঠিক আমার মৃত্যু হবে।”

“আপনি কি এমন করেছেন যে আপনাকে পুলিশ ধরবে?

অবাক সিক্ত নয়নে কথাটি নিভু নিভু কন্ঠে যুবরাজকে জিজ্ঞেস করে রাজ্য।

“আমি মানুষ খু*ন করেছি!তাও দুই একজন কে নয় পুরো তিনশত সাতন্ন জন মানুষকে”

শক্ত কন্ঠে কথা গুলো বলে মাথা তুলে রাজ্যের মুখোমুখি বসে যুবরাজ।
যুবরাজের এহেন কথায় রাজ্য যেনো নিজের শ্বাস টাও নিতে ভুলে গেছে।এসব কি শুনছে সে?নিজের কানকেও বিশ্বাস করা দুষ্কর হয়ে উঠলো নিমিষেই।

নির্বাক রাজ্যের ফাঁকা দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলো যুবরাজ।।এরপর ঠোঁটে প্রশস্ত হাসি এনে পুনরায় বলে উঠলো

“কিন্তু আমি আত্মসমর্পণ করবো না।না আমি ধরা দেবো না তুমি আমাকে ধরতে পারবে”

কথাটি বলেই হাতে থাকা স্কচটেপ দিয়ে রাজ্যের হাত পিছ মোড়া করে বেঁধে ফেললো যুবরাজ।
এরপর একটা কালো কাপড়ে চোখ বাঁধতে বাঁধতে বলে উঠলো

“আম রিয়েলি সরি জান।এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।আমার রাজ্যে তোমাকে বেশিদিন রানী করে রাখতে পারলাম না।
তুমি আমাকে যা খুশি তাই ভাবতে পারো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না।”

যুবরাজের কাজে কোনো প্রকার বাধা প্রদান করলো না রাজ্য।শুধু আহত কন্ঠে বলে উঠলো

“আপনাকে আমি ভালোবাসি যুবরাজ।আপনি মার্ডারার ,টেরোরিস্ট যাই হোন তাতে আমার কিছুই আসে যায় না।সবচেয়ে বড় কথা আপনি আমার হাজব্যান্ড”

#চলবে