#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ১
#লেখিকা_দিশা_মনি
১.
নিজের বড় বোনের যায়গায় বিয়ের আসরে বসে আছে দৃঢ়তা। মাথায় দিয়ে রেখেছে একহাত ঘোমটা। তার সামনেই রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে সেই লোকটা, যাকে তার আজকের পর থেকে দুলাভাই ডাকার কথা ছিল কিন্তু ভাগ্যক্রমে এখন এই লোকটাই তার স্বামী।
এদিকে ‘কবুল’ বলে বিয়েটা সম্পন্ন করার পরই বিয়ের আসর থেকে উঠে দাঁড়ালো জাবির চৌধুরী। অতঃপর দৃঢ়তার চাচা আলমগীর খানকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে উঠল,
“কাজটা আপনারা একদম ভালো করলেন না, আমি বিয়ের জন্য আপনাদের বাড়ির বড় মেয়ে মৌনতাকে পছন্দ করেছিলাম। তাকে নিয়েই এতগুলো দিন স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু মৌনতা এভাবে বিয়ের দিন পালিয়ে গিয়ে শুধু আমায় প্রত্যাখ্যানই করে নি, চৌধুরী বাড়ির সম্মানে আঘাত হেনেছে। এর ফল মোটেই ভালো হবে না। আপনারা শেষ মুহুর্তে ব্যাপারটা ঢাকা দেয়ার জন্য নিজেদের ছোট মেয়েকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে ভাববেন না সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আপনাদের, মৌনতার সবার করা অন্যায়ের ফল এখন ভোগ করতে হবে দৃঢ়তাকে। এই কথাটা সব সময় মাথায় রাখবেন।”
বলেই জাবির দৃঢ়তার হাতটা শক্ত করে ধরে নিজের সাথে টানতে টানতে নিয়ে যেতে থাকে দৃঢ়তাকে৷ দৃঢ়তা হাতে ব্যথা অনুভব করলেও কিচ্ছুটি বলল না৷ আলমগীর খানও মাথা নিচু করে রইলেন। নিজের মেয়ের কাজে যে তিনি আজ ভীষণ লজ্জিত। তাই আর কিছু বলার মতো মুখ তার নেই।
জাবির দৃঢ়তাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগেই দৃঢ়তার চাচি মনোয়ারা বেগম এসে দাঁড়ান জাবিরের সামনে। জাবির এতে কিছুটা বিরক্ত হয়। মনোয়ারা বেগম হঠাৎ করেই দৃঢ়তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠেন। অতঃপর কান্নারত স্বরে জাবিরের দিকে তাকিয়ে আকুতিভরা চোখে বলে ওঠেন,
“দৃঢ়তা আমার বড্ড আদরের বাবা। ওর মা-বাবার মৃত্যুর পর আমিই ওকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। কোনদিনও ওকে পর ভাবিনি বরং নিজের মেয়ে মান্যতার থেকেও বেশি ভালোবেসেছি দৃঢ়তাকে। দৃঢ়তা যে আমার নয়নের মনি। আমি জানি, মান্যতা এই বিয়ে থেকে পালিয়ে গিয়ে তোমার আর তোমার পরিবারের সবার সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছে। মা হিসেবে নিজের মেয়ের এই কাজের জন্য আমি ভীষণ লজ্জিত। হয়তো আমিই ওকে ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারিনি। কিন্তু একটা কথা আমি হরফ করে বলতে পারি বাবা,যার সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে সে কিন্তু খাটি সোনা। তাই তোমার কাছে একটাই অনুরোধ থাকবে, আমার মেয়ের করা ভুলের শাস্তি তুমি ওকে দিও না। দৃঢ়তা শুধু নিজের চাচার কথামতো তার ঋণ শোধ করতেই এই বিয়েটা করেছে কিন্তু…”
জাবির মাঝপথেই মনোয়ারা বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,
“দৃঢ়তাকে যখন আমি বিয়ে করেছি তাহলে ওর সাথে কি করব আর কি করব না সেটা আমাকেই ঠিক করতে দিন। আর আপনাদের এসব ন্যাকাকান্না কাঁদতে হলে অন্য কোথাও গিয়ে কাঁদবেন। জাবির চৌধুরীর মন এসবে গলবে না।”
বলেই জাবির দৃঢ়তাকে জোরপূর্বক টেনে নিয়ে যেতে থাকে। মনোয়ারা বেগম কেবল অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকেন। অতঃপর রেগে আলমগীর খানের সামনে এসে বলেন,
“এবার শান্তি পেয়েছ না তুমি? নিজের মেয়েত ভুল ঢাকতে তুমি দৃঢ়তাকে নরকে ঠেলে দিলে! কি করে পারলে এটা তুমি?”
“এছাড়া আমার কাছে আর কোন উপায় ছিল না মনোয়ারা। এই বিয়েটা যদি না হতো তাহলে চৌধুরী পরিবার আমাদের ধ্বংস করে দিত।”
“বাহ,তোমার বিয়ে ছেড়ে পালালো, তোমার পরিবার ধ্বংস হবে আর এর দায় নেবে দৃঢ়তা। আচ্ছা, দৃঢ়তা যদি তোমার ভাইয়ের মেয়ে না হয়ে তোমার নিজের মেয়ে হতো তাহলে কি তুমি পারতে ওর সাথে এমনটা করতে?”
আলমগীর খান চুপ করে থাকেন। মনোয়ারা বেগম বলেন,”আমি জানি, এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই তোমার কাছে। যাইহোক, এটা মনে রেখো, আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। তোমার করা অন্যায়ের শাস্তি তুমি একদিন পাবেই। কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে আমার দৃঢ়তার জন্য। ভালোই আমি ওকে জন্ম দেই নি কিন্তু যখন ওকে তো আমিই কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি। আমি জানি তো,মেয়েটা কত নাজুক। ওর প্রতি করা এই অন্যায়ের জন্য আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করবো না, কখনো না।”
বলেই মনোয়ারা বেগম কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে চলে যান।
★★
দৃঢ়তা একদম চুপচাপ মাইক্রোতে বসে নীরবে অশ্রু ফেলছিল। এটাও যেন সহ্য হলো না জাবিরের। তাই তো সে দৃঢ়তাকে ধমকি দিয়ে বলল,
“তোমার এসব চোখের জল ফেলার নাটক বন্ধ করো। আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”
বলেই একটু থেমে বলে,
“আর এমনিতেও আজকের পর থেকে তোমাকে আরো অনেক কাঁদতে হবে। তাই এখনই সব চোখের জল শেষ করে দিও না,সামনের জন্য কিছু বাঁচিয়ে রাখো।”
দৃঢ়তা জাবিরের এমন প্রচ্ছন্ন হুমকিতে ভয় পেল না। বরং কিছুটা সাহস দেখিয়ে বলল,
“আল্লাহ আমার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন সেটা তো আমায় বরণ করতেই হবে। তবে আপনিও একটা কথা মনে রাখবেন,আপনি একটা মানুষকে যতোটা কষ্ট দেবেন তার থেকে দ্বিগুণ কষ্ট আপনি নিজে একদিন ফিরে পাবেন।”
কথাটা শুনেই জাবিরের মেজাজ একদম গরম হয়ে যায়। ইতিমধ্যে তারা জাবিরের বাড়ির সামনে পৌঁছে যায়। জাবির গাড়ির দরজা খুলে ধাক্কা দিয়ে দৃঢ়তাকে গাড়ি থেকে ফেলে দেয়। দৃঢ়তা পড়ে গিয়ে ভীষণ ব্যথা পায়। তার হাতের কিছু যায়গা ছিড়ে রক্তও বের হয়৷ তবুও সে প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আর মনে করে, আজ কিভাবে সে নিজেই তার এই ভাগ্যকে বেছে নিয়েছিল৷ মান্যতার পালিয়ে যাওয়ার কথা শুনে যখন আলমগীর খান অসহায়ের মতো দৃঢ়তাকে অনুরোধ করেছিল এই বিয়েটা করে নিতে তখন দৃঢ়তার একদম ইচ্ছা ছিল না এভাবে বিয়েটা করার। কিন্তু কি আর করার? দৃঢ়তার যখন মাত্র ৪ বছর বয়স তখনই তার মা-বাবা, দাদা-দাদি সবাই একটি সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায়। সেদিন তাদের পরিবারের সবাই এক আত্মীয়ের বাসা থেকে দাওয়াত খেয়ে ফিরছিল। দৃঢ়তা আবার ছোটবেলা থেকেই নিজের মায়ের থেকে নিজের চাচি মনোয়ারা বেগমের কাছেই বেশি থাকত। তাই মনোয়ারা বেগমের সাথে অন্য গাড়িতে থাকায় দৃঢ়তা বেঁচে গেছিল৷ এরপর থেকে আলমগীর খান ও মনোয়ারা বেগমই নিজেদের মেয়ে মান্যতার পাশাপাশি দৃঢ়তাকেও মেয়ের মতোই বড় করেন। আর সেই ঋণের প্রতিদান দিতে গিয়েই দৃঢ়তাকে আজ নিজের সব সুখ বিসর্জন দিতে হলো।
দৃঢ়তার এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কেউ একজন কাঠিতে ভড় দিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। দৃঢ়তা চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পায় আমিনা চৌধুরীকে। জাবির চৌধুরীর দাদি এই আমিনা চৌধুরীই পুরো চৌধুরী পরিবারের মাথা।
আমিনা চৌধুরী এসেই দৃঢ়তার দিকে লাঠি তাক করে হুংকার দিয়ে বলে ওঠেন,
“এই মেয়েটা এই বাড়িতে কেন? আমি তো বলেছিলাম, বিয়েটা করার দরকার নেই। এটাকে কি ছেলেখেলা পেয়েছে ওরা? নিজেদের এক মেয়ে পালালো আর আরেক মেয়েকে আমাদের ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিল।”
জাবিরের বাবা জলিল চৌধুরী বলে ওঠেন,
“সবই তো আপনার নাতির জেদের কারণে হয়েছে আম্মা। নাহলে আমরা তো চলেই আসতে নিচ্ছিলাম।”
এমন সময় জাবিরের মা ললিতা চৌধুরী সেখানে এসে বলে ওঠেন,
“ওমনি সব দোষ আমার ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছ। ও নাহয় ছেলেমানুষ তাই বুঝতে পারে নি কিন্তু তুমি তো পারতে ওকে বারণ করতে।”
জাবির এবার রাগী কন্ঠে বলে,
“বন্ধ করো এসব কথা। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। আমি ভেতরে যাচ্ছি।”
বলেই জাবির যেতে নেবে এমন সময় আমিনা চৌধুরী বলে ওঠেন,
“আমি এই মেয়েকে কিছুতেই চৌধুরী বাড়িতে প্রবেশ করতে দেব না। একে এর বাড়িতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করো।”
জাবির কিছুটা পিছিয়ে এসে দৃঢ়তার হাত শক্ত করে ধরে বলে,
“ওকে আমি এমনি এমনি বিয়ে করি নি। বিয়ে করেছি কিছু উদ্দ্যেশ্যে। আর সেই উদ্দ্যেশ্য আমি পূরণ করেই ছাড়ব। ততদিন পর্যন্ত ওকে এই বাড়িতেই থাকতে।”
বলেই জাবির সবার সামনে দিয়ে দৃঢ়তাকে টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨