ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-০২

0
1

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ২
#লেখিকা_দিশা_মনি

দৃঢ়তাকে টানতে টানতে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয় জাবির। অতঃপর ধীরে ধীরে দৃঢ়তার দিকে এগোতে থাকে৷ দৃঢ়তা পিছোতে পিছোতে একদম দেয়ালে গিয়ে ঠেকে। কান্নারত স্বরে বলে,
“আপনি এগো..চ্ছেন কেন?”

জাবির দৃঢ়তার একদম কাছে এসে দৃঢ়তার গলা চেপে ধরে বলে,
“তোমার বড় বোন কোথায়? কোথায় মৌনতা?”

দৃঢ়তার কাঁদতে কাঁদতে হেচকি উঠে যায়৷ সে বলে,
“আমি জানি না।”

“মিথ্যা কথা। তুমি সব জানো। আমি কিছু খোঁজ রাখি না ভেবেছ? আমি সবটাই জানি৷ তোমার সাথে মৌনতা অনেক ভালো সম্পর্ক। মৌনতা তো তোমাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে। ও নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছে ও এখন কোথায় আছে তাই না?”

দৃঢ়তা তবুও বলল,
“না, আমায় কিছু বলে নি আপু। আমি এই ব্যাপারে সত্যিই কিছু জানি না।”

জাবির এবার রেগে দৃঢ়তার গালে ঠা*স করে থা*প্পড় মা**রল। অতঃপর দৃঢ়তার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে বলল,
“এভাবে সত্যটা অস্বীকার করে কোন লাভ নেই৷ আমি জানি,তুমি নিজের বোনকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছ। কারণ আমি যেরকম সিকিউরিটি ঠিক করে রেখেছিলাম তাতে করে তোমার বোনের পালানো এতোটা সহজ ছিল না। কারো সাহায্য ছাড়া এটা করা ওর পক্ষে সম্ভব নয়। আর তাছাড়া একমাত্র তুমিই জানতে যে, মৌনতা আমায় বিয়ে করতে রাজি না। তাই তুমি ছাড়া এই কাজ আর কারো নয়।”

জাবিরের কথায় দৃঢ়তা এবার অতীতে ডুব দেয়। জাবির চৌধুরী মৌনতাকে দেখতে গিয়ে তাকে পছন্দ করে। কিন্তু মৌনতার জাবিরকে পছন্দ ছিল না। কারণ মৌনতার অন্য একজন প্রেমিক ছিল। মৌনতা সেই প্রেমিককেই বিয়ে কর‍তে চেয়েছিল। এজন্য তো দৃঢ়তাকে সাথে নিয়ে সে জাবিরের সাথে দেখা করতে গেছিল তাদের বিয়ে ঠিক হবার পর। আর সেখানেই সে পরিস্কার করে সবটা খুলে বলে৷ কিন্তু জাবিরের জেদ ছিল স্পষ্ট। ছোটবেলা থেকে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে জাবির। আর মৌনতাকে তার অনেক বেশিই পছন্দ হয়েছিল। তাই জাবির সব শোনার পরেও বলেছিল,
“তোমার প্রেমিককে তুমি ভুলে যাও। কারণ বিয়ে তো তোমায় আমাকেই করতে হবে। আমি কথা দিচ্ছি, আমি তোমাকে অনেক সুখে রাখব।”

সেদিন মৌনতা অনেক অনুরোধ করেছিল জাবির চৌধুরীর কাছে এমনকি তার পায়ে পর্যন্ত পড়েছিল তবুও জাবির চৌধুরী নিজের জেদে অটল থাকে।

অতীতের এসব স্মৃতি মনে করেই দৃঢ়তা বলে,
“আপনি বিশ্বাস করুন বা না-ই করুন, সত্যি আমি জানি না আপু এখন কোথায় আছে।”

“কিন্তু তোমার আপুকে তো তুমিই পালাতে সাহায্য করেছ তাইনা?”

দৃঢ়তা এবার আর কিছু বলে না। কারণ সে-ই সাহায্য করেছিল মৌনতাকে। করবে না-ই বা কেন? চাচাতো বোন হলেও দৃঢ়তা ও মৌনতার সম্পর্ক আপন বোনের থেকেও বেশি সুন্দর। তারা একে অপরের জন্য জীবনও দিতে প্রস্তুত। সেখানে দৃঢ়তা কিভাবে পারত মৌনতার কষ্ট মেনে নিতে? মৌনতা যে তার মামাতো ভাই আবিরকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু মনোয়ারা বেগমের ভাইয়ের সাথে মৌনতার বাবার পূর্বের দ্বন্দের জন্য তাদের সম্পর্ক পারিবারিক স্বীকৃতি পাচ্ছিল না। আর তাই তো মৌনতার বাবা জাবিরের সাথে নিজের মেয়ের দিতে চাইলেন। যদিও এর পেছনে ব্যবসায়িক স্বার্থও ছিল।

দৃঢ়তাকে চুপ দেখে জাবির বলে,
“এখন এই সাহায্য করার ফল তোমায় ভোগ করতে হবে। তোমার আপুকে তো আমি নিজের করে নেবোই। সেটা যেকোন ভাবেই হোক না কেন। কিন্তু তার আগে, আমায় তোমাকে তোমার করা অন্যায়ের শাস্তি দিতে হবে।”

বলেই জাবির ওয়াল হুক থেকে একটা ব্লেট হাতে নিলো। দৃঢ়তা চোখের ইশারায় জাবিরকে অনুরোধ করল এমনটা না করতে। কিন্তু জাবির দৃঢ়তার সেই অনুরোধ গ্রাহ্য করল না। সে নির্দয়ের মতো বেল্ট দিয়ে পে*টাতে লাগল দৃঢ়তাকে। অবস্থা এমন হয়ে গেল যে দৃঢ়তার চিৎকারে পুরো বাড়ি মাথায় উঠল।

একটু পর দৃঢ়তার জ্ঞান হারানোর দশা হলো। তার হাত, পিঠ, গলা সব যায়গায় আঘাতের দাগ। এমন সময় দরজায় কারো কড়া নাড়ার শব্দ পাওয়া গেল৷ জাবির বিরক্ত হয়ে থেমে গেল। অতঃপর গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো৷ দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকে এলেন একজন মধ্যবয়সী নারী৷ পরনে তার একটা সাদা শাড়ি। তিনি এসেই দৃঢ়তার কাছে এসে তাকে আগলে নিয়ে বললেন,
“এসব কি হচ্ছে জাবির? এতোটা অমানুষ হয়ে গেছ তুমি। মেয়েটাকে এভাবে মারছ কেন? ও স্ত্রী হয় তোমার।”

জাবির নিজের রাগকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে বলে,
“তুমি এসবের মধ্যে এসো না চাচি। এই মেয়েটা মৌনতাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। ওর জন্য আমি মৌনতাকে নিজের করে পাই নি। ওকে আমি শেষ করে দেবো আজ..”

আনিকা চৌধুরী এবার ভীষণ রেগে বলেন,
“ছি! আমি ভেবেছিলাম তোমার শরীরে চৌধুরী বাড়ির রক্ত বইলেও তুমি অন্যদের মতো নও। কিন্তু এখন তো দেখতে পাচ্ছি এই বাড়ির অন্য সদস্যসের সাথে তোমার কোন পার্থক্য নেই। জানো, আমার খুব আফসোস হতো কেন আল্লাহ আমায় মা হবার সৌভাগ্য দিলেন না,কেন আমার স্বামীকে আমার থেকে কেড়ে নিলেন অল্পবয়সে। কিন্তু আজ তোমার এই রূপ দেখার পর আমার মনে হচ্ছে, ভালোই হয়েছে যে আল্লাহ আমায় তোমার মতো কোন নরপশুর মা বানায় নি। যদি বানাতেন তাহলে আমি নিজের হাতে নিজের সন্তানকে শেষ করে দিতাম।”

এমন সময় ললিতা চৌধুরী এসে বলেন,
“আপা! এসব কি বলছেন আপনি? আমার ছেলেকে এসব কথা বলার সাহস আপনি পান কোথায়?”

আনিকা চৌধুরী বলেন,
“আমাকে এই প্রশ্ন করার আগে নিজের ছেলের কাজকর্ম দেখ ছোট। মেয়েটাকে কিভাবে পশুর মতো মেরেছে। এসব কিছু দেখার পরেও তুই নিজের ছেলের হয়ে কথা বলবি?”

ললিতা চৌধুরী বলেন,
“হ্যাঁ, বলব। আমার ছেলে যা করেছে একদম ঠিক করেছে। এই মেয়ে এসবই প্রাপ্য।”

“আজ যদি এই মেয়েটা তোমার নিজের মেয়ে হতো তাহলে এভাবে বলতে পারতে?”

ললিতা চৌধুরী আর কিছু বলতে যাবেন এমন সময় আমিনা চৌধুরী সেখানে চলে আসেন। তাকে দেখেই সবাই চুপ হয়ে যায়। আমিনা চৌধুরী এসেই ললিতা চৌধুরীকে আদেশ করেন,
“তোমার ছেলেকে নিয়ে বাইরে যাও ছোট বৌমা। ওকে একটু নিজের মাথাটা ঠান্ডা করতে বলো। এদিকটা আমি সামলাচ্ছি।”

ললিতা চৌধুরী জাবিরকে নিয়ে চলে যান। তারা চলে যেতেই আমিনা চৌধুরী এগিয়ে এসে আনিকা চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“এই মেয়েটার প্রতি তোমার দরদ একটু বেশিই মনে হচ্ছে। ভালো, তবে একটা কথা মনে রেখো, এই মেয়েটার কারণে আজ আমাদের পরিবারের সম্মানে আঘাত এসেছে। ও নিজের বোন পালাতে সাহায্য করে একদম ভালো করে নি। তাই এর ফল ওকে ভোগ করতেই হবে।”

আনিকা চৌধুরী বরাবরই সাহসী ব্যক্তিত্ব। অন্যের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহস তিনি রাখেন। তাই তো আজও আমিনা চৌধুরীর চোখে চোখ রেখে বললেন,
“এভাবে আর কত প্রতিশোধের আগুন নিয়ে আপনি খেলবেন আম্মা? তিনকাল গিয়ে তো এককালে ঠেকেছে, এই বয়সে এসে কোথায় একটু আল্লাহর নাম স্মরণ করবেন তা না এখনো সেই হিংসা, অহংকার, বিদ্বেষ বজায় রেখেছেন। কিসের জন্য আম্মা? কি পেলেন আপনি আজীবন এসব করে? আপনার এই অহংকারের জন্য আমি নিজের স্বামীকে হারিয়েছি, আপনি নিজের দুই ছেলেকে হারিয়েছেন তবুও কি আপনার শিক্ষা হয়নি? এখন নিজের নাতির জীবনও ধ্বংস করতে চান আপনি?”

“বড় বৌমা!”

“আমার সাথে চিৎকার করে কোন লাভ নেই আম্মা। আমি সবসময় নির্ভীকতার সাথেই সত্যটা তুলে ধরি, তাই তো আপনার আমাকে পিছন না। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখবেন, জীবনে যা যা অন্যায় করেছেন তার জন্য একদিন আপনাকে ভীষণ পস্তাতে হবে। যেই চৌধুরী সাম্রাজ্য নিয়ে আপনার এত অহংকার সেই সাম্রাজ্যও একদিন আপনার চোখের সামনে ধ্বংস হবে অথচ আপনি কিছুই করতে পারবেন না। আল্লাহ হয়তো সেই দিন দেখানোর জন্যই আপনাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨