#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ৩
#লেখিকা_দিশা_মনি
দৃঢ়তা রুমে চুপচাপ বসেছিল। তার গায়ের সমস্ত ক্ষত থেকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত করেও সে চুপ আছে। আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তার ক্ষতে মলম লাগাতে লাগাতে বলেন,
“তোমায় এত নরম হলে চলবে না। তোমায় নিজের নামের মতোই দৃঢ় হতে হবে মেয়ে। নাহলে এই পরিবারে তুমি টিকতে পারবে না।”
কথাটা শুনেই অবাক চোখে আনিকা চৌধুরীর দিকে তাকায় দৃঢ়তা। আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তার চোখে চোখ রেখে বলেন,
“জানো, তোমার মধ্যে আমি নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। আমি যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলাম তখনও আমি ঠিক তোমার মতোই ছিলাম। কিন্তু এই বাড়ির মানুষের সাথে থাকতে থাকতে আমাকে নিজেকে বদলে নিতে হয়েছে। অভিযোজিত হতে হয়েছে এদের মতো করে। তাই তো আজ এদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারি। তবে যদি আরো আগে এমনটা করতে পারতাম তাহলে হয়তো আমার জীবনটা এমন এলোমেলো হতো না।”
দৃঢ়তা অনেক আগ্রহ নিয়ে বলে,
“কি হয়েছিল আপনার জীবনে?”
“সেসব নাহয় অন্য একদিন শুনো। তবে আমার ওপর একটু ভরসা রাখতে পারো। আমার সাথে এই বাড়ির লোকেরা যেসব অন্যায় করেছে তোমার উপর আমি সেইসব অন্যায় হতে দেব না। সবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব আমি তোমার হয়ে।”
আনিকা চৌধুরীর মুখে এমন কথা শুনে দৃঢ়তা আচমকা তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন,
“জীবনে কখনো মায়ের ভালোবাসা পাই নি আমি, নিজের মায়ের মুখটাও মনে নেই৷ কিন্তু চাচির কারণে কখনো মায়ের ভালোবাসার অভাব বোধ করি নি। আজ আবারো আপনাকে পেয়ে এত কষ্টের মাঝেও মনে হচ্ছে আমার মাথার উপর মায়ের ছায়া পেয়েছি।”
আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“একবার যখন মা বলে ডেকেছ তখন এই মায়ের উপর ভরসা রাখো। আমি সব ঠিক করে দেব।”
★★
চৌধুরী বাড়ির সব সদস্যরা বাড়ির ড্রয়িংরুমে জট পাকিয়ে বসে আছেন। সবার মধ্যমনি হয়ে বসে আছেন আমিনা চৌধুরী। তার ডান পাশের সোফায় বসে আছেন তার মেঝ ছেলে জলিল চৌধুরী ও তার স্ত্রী ললিতা চৌধুরী। ডানদিকে বসে আছে জাবির। আমিনা চৌধুরীর বড় এবং ছোট দুই ছেলেই মারা গেছেন। এখন শুধুমাত্র তার মেঝ ছেলেই জীবিত।
আমিনা চৌধুরী জলিল চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
“কি যেন বলছিলে তুমি?”
জলিল চৌধুরী ভয়ে ভয়ে বলে,
“আসলে আম্মা, আমি বলছিলাম যে সবাইকে কে তো আগে থেকেই বৌভাতের দাওয়াত দেয়া হয়েছে আর তাই…”
আমিনা চৌধুরী গর্জে উঠে বলেন,
“বৌভাত! কিসের বৌভাত। হবে না কোন বৌভাত। এটা কোন বিয়েই না। আমাদের সাথে প্রতারণা হয়েছে। এমনিতেই আমাদের বাড়ির সম্মানে অনেক আঘাত এসেছে। আমি আর লোক হাসাতে চাই না।”
জলিল চৌধুরী অসহায় সুরে বলেন,
“কিন্তু আম্মা সবাইকে তো দাওয়াত করা হয়ে গেছে এখন হঠাৎ কিভাবে..”
“আমি কিচ্ছু জানি না। প্রয়োজনে সবাইকে জানিয়ে দাও যে, কোন বৌভাত হবে না।”
এমন সময় আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তাকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে বলেন,
“কেন হবে না বৌভাত? বিয়ে যখন হয়েছে তখন বৌভাতও হবে। জলিল তুমি বৌভাতের সব আয়োজন শুরু করো।”
আমিনা চৌধুরী চরম রেগে বলেন,
“বড় বৌমা! নিজের সীমা পার করো না। তোমার সাহস কি করে হলো আমার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলার।”
“আমার সাহস সম্পর্কে আপনার যথেষ্ট ধারণা আছে আম্মা। তাই এসব বলা বোকামি। আপনি খুব ভালো করেই জানেন,আমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি বৌভাত হবে তখন বৌভাত হবেই।”
ললিতা চৌধুরী বলেন,
“আপনি এবার বেশি বাড়াবাড়ি করছেন আপা। জোর করে কিছু হয় না। আমার ছেলেটাকে এভাবে ঠকিয়ে বিয়ে করে নিয়েছে এই চালবাজ মেয়েটা এখন আবার বৌভাত!”
আনিকা চৌধুরী প্রতিত্তোরে বলেন,
“তুই ভুল বলছিস ছোট। আমি কিন্তু সব জানি। দৃঢ়তা চালবাজি করে তোর ছেলেকে বিয়ে করে নি বরং তোর ছেলেই সজ্ঞানে ওকে বিয়ে করেছে। এখানে তুই দৃঢ়তার দোষ দিতে পারিস না।”
“আর ঐ মেয়ে যে ওর বোনকে পালাতে সাহায্য করে আমাদের পরিবারের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে তার বেলা?”
“আমার মুখ খুলতে বাধ্য করিস না ছোট। তোর ছেলে কিভাবে মৌনতা নামের মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে করতে চাইছিল সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি। তাই নিজের ছেলের হয়ে সাফাই গাওয়ার আগে দশবার ভাববি।”
ললিতা চৌধুরী এবার চুপ করে যান। কারণ আনিকা চৌধুরীর সাথে কথায় তিনি পেরে উঠবেন না। এদিকে জাবির হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“তোমাদের যা করার তোমরা করো কিন্তু আমায় এসবে ইনভলভ করার চেষ্টা করো না।”
আনিকা চৌধুরী বলেন,
“এসব দৃঢ়তাকে বিয়ে করার আগেই তোমার ভাবা দরকার ছিল জাবির। এখন বিয়ে করার পর তুমি নিজের দায়িত্ব থেকে পালিয়ে যেতে পারো না। এমনিতেই তুমি যা করেছ তাতে তোমার নামে দৃঢ়তা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের কেইস করতে পারে।”
“চাচি!”
“চুপ করো। তোমার অনেক বাড়বাড়ন্ত সহ্য করেছি আর নয়। দৃঢ়তাকে যখন বিয়ে করেছ তখন ওকে প্রাপ্য বউয়ের মর্যাদা দাও।”
আমিনা চৌধুরী এগিয়ে এসে বলেন,
“কাকে কি মর্যাদা দেয়া হবে সেটা আমি ঠিক করবো তুমি নও।”
“আপনার সময় তো ফুরিয়ে এসেছে আম্মা। আপনার পর আমিই তো এই বাড়ির সবথেকে সিনিয়র সদস্য, তাই আমাকে আমার দায়িত্বটা বুঝে নিতে দিন। এতগুলো বছর তো আপনিই এই সংসারটা সামলেছেন তাতে লাভ কি হয়েছে? আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি, দেবরকে হারিয়েছে, দেবরের বউকে..”
“বড় বৌমা! ওখানেই থেমে যাও। আর একটা শব্দ উচ্চারণ করবে না।”
“আমাকে চুপ করাতে পারলেও সত্যটাকে আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। একবার ভেবে দেখেছেন, মৃত্যুর পর আল্লাহকে কি জবাব দেবেন? তাই বলছি, অনেক হয়েছে। এই বয়সে এসে এসব কূটকাচালি না করে যান মক্কায় গিয়ে হজ-ওমরাহ করে আসুন। তারপর তসবিহ জবতে থাকুন।”
আমিনা চৌধুরী বড় বড় চোখ করে তাকান। আনিকা চৌধুরী জলিল চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“আর জলিল, তুমি আর দাঁড়িয়ে থেক না। এই বাড়ির একমাত্র কর্মক্ষম আর বিবেকবান মানুষ তো তুমিই আছ। তাই একটা কাজ করো, মা-বউ আর ছেলের কুপরামর্শ না শুনে এখন গিয়ে বৌভাতের আয়োজন শুরু করো। বাইরের যা যা করতে হয় করো। বাড়ির রান্নাবান্না থেকে সবকিছু আমি সামলে নেব।”
জলিল চৌধুরী একবার নিজের মা ও একবার নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
“আচ্ছা ভাবি।”
বলেই তিনি বেরিয়ে যান। তিনি বেরোতেই জাবিরও রাগে হন্তদন্ত করে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তার কাঁধে হাত রেখে বলেন,
“চলো, রান্নাঘরে চলো। সবার জন্য রান্না করতে হবে তো। রাত তো প্রায় পেরিয়েই গেছে, ভোর ৪ টা বাজে। অনেক রান্নাবান্না করতে হবে। এখন থেকেই আমরা গিয়ে হাতে হাতে আগাই। আর কেউ তো সাহায্য করবে না।”
বলেই তিনি দৃঢ়তাকে নিয়ে রান্নাঘরে চলে যান। তিনি যেতেই ললিতা চৌধুরী এগিয়ে এসে নিজের শাশুড়ীকে বলেন,
“আপনার বড় বৌমা কি কি বললেন শুনলেন তো? এর একটা বিহিত করুন আম্মা। উনি কিন্তু খুব বাড় বেড়েছেন। আপনার কথাকেও দাম দিচ্ছে না!”
আমিনা চৌধুরী বলেন,
“বড় বৌমার একটু বেশিই পাখা গজিয়েছে। এবার সেই পাখা ছেটে দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে।”
বলেই ক্রোধিত চোখে তাকান তিনি।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨