ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-০৪

0
1

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ৪
#লেখিকা_দিশা_মনি

দৃঢ়তা কে নিয়ে রান্নাঘরে আসেন আনিকা চৌধুরী। অতঃপর তারা দুজন একসাথে মিলে নানারকম রান্নাবান্না করতে থাকেন। দৃঢ়তা রান্নায় তেমন পটু নয়৷ আনিকা খানই তাকে সবকিছু শিখিয়ে দিচ্ছিলেন।

একসময় আনিকা চৌধুরী বলেন,
“আচ্ছা, রান্না তো প্রায় সব শেষ। বাকি যেটুকু আছে তুমি করে নাও। আমি একটু বাগানের গাছগুলোয় পানি দিয়ে আসছি। তুমি তো বাকিটা সামলাতে পারবে নিশ্চয়ই।”

“হ্যাঁ, চাচি। আপনি যান, বাকিটা আমি সামলে নেব।”

দৃঢ়তার কথায় নিশ্চিত হয়ে আনিকা চৌধুরী চলে যান বাগানের দিকে। এদিকে দৃঢ়তা রান্নায় মনযোগ দেয়। সে এভাবে একাই সবকিছু সামলানোর চেষ্টা করছিল এমন সময় হঠাৎ করে ললিতা চৌধুরী সেখানে চলে আসে। তাকে দেখে দৃঢ়তা কিছুটা অবাক হয়। ললিতা চৌধুরী এসেই দৃঢ়তার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“এই মেয়ে, আম্মা চা চাচ্ছেন। ওনার জন্য একটু চা করে নিয়ে যাও। সকাল থেকে তো রান্নাঘর দখল করে আছ। যেই না বিয়ে তার আবার বৌভাত।”

ললিতা চৌধুরীর এমন কথায় দৃঢ়তা কষ্ট পেলেও হাসিমুখে বলে,
“ঠিক আছে, আপনি একটু অপেক্ষা করুন৷ আমি এখনই চা করে দাদিমাকে দিয়ে আসছি।”

বলেই সে গ্যাসের উপর চা বসিয়ে দেয়। ললিতা চৌধুরী একটু সরে আসেন। চা তৈরি করা হয়ে যেতেই দৃঢ়তা সেটা নিয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে যেতে থাকে।

ড্রয়িংরুমে গিয়ে দৃঢ়তা দেখে আমিনা চৌধুরী সোফায় বসে আছেন আর খবরের কাগজ পড়ছেন। দৃঢ়তা তার কাছে গিয়ে চা বাড়িয়ে দিতেই আমিনা চৌধুরী দৃঢ়তার দিকে তাকিয়ে রাগী ভাব নিয়ে চায়ের কাপটা ছুড়ে মারেন। এতে কিছু চা এসে দৃঢ়তার হাতে পড়ে। দৃঢ়তা যন্ত্রণায় আহ করে ওঠে। আমিনা চৌধুরী দাঁত কটমট করে বলেন,
“এই মেয়ে, তোমার সাহস কি করে হয় আমার জন্য চা আনার? কি ভেবেছ টা কি? বড় বৌমাকে পাশে পেয়ে কি নিজেকে হনু ভাবতে শুরু করেছ? আমরা কেউই তোমাকে এই বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নেইনি। তাই যতই তোমার বৌভাত হোক, আমরা কেউ তোমার হাতের হাত গ্লাস পানিও স্পর্শ করব না।”

দৃঢ়তা অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বলল,
“আমাকে মা বললেন আপনার জন্য চা করে নিয়ে আসতে আর তাই তো আমি..”

এমন সময় ললিতা চৌধুরী সেখানে এসে বলেন,
“এই মেয়ে, খবরদার আমায় মা বলবে না। আমি তোমাকে ছেলের বউ হিসেবে স্বীকার করি না। আর তাই আমাকে মা ডাকার অধিকার তোমার নেই। আর তুমি তো বেশ ধুরন্ধর। নিজে অন্যায় করে এখন আমার ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছ? জানেন আম্মা, আমি আপনার জন্য চা করে আনতে গেছিলাম রান্নাঘরে কিন্তু এই মেয়ে আমায় রান্নাঘরে ঢুকতেই দিল না। বরং আমায় বলল, ও নিজেই চা করবে আপনার জন্য। আমি কত করে বললাম যে, আপনি ওর হাতে বানানো চা খাবেন না তবুও ও কোন কথাই মানল না।”

ললিতা চৌধুরীর এমন জঘন্য মিথ্যাচারে দৃঢ়তা হতবাক হলো৷ কিন্তু কিছু বলল না৷

আমিনা চৌধুরী রেগে বললেন,
“এখনো সং এর মতো এখানে দাঁড়িয়ে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছ কেন? তোমার এসব ন্যাকামি দেখার সময় আমাদের নেই। দূর হও বলছি এখান থেকে। তোমার মুখও দেখতে চাই না আমি।”

চোখের জল মুছে চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে গেল দৃঢ়তা। কষ্টকে বুকে চাপা দিয়ে রান্নায় মন দিলো৷ কিছু সময় পর আনিকা চৌধুরী বাগান থেকে এসে বললেন,
“রান্না শেষ হলো?”

“হ্যাঁ, চাচি। প্রায় শেষ। এখন শুধু পরিবেশন করা বাকি।”

“তোমার গলা এমন লাগছে কেন দৃঢ়তা? তুমি কি কাঁদছিলে? আমি যাওয়ার পর কি আবার কেউ তোমাকে কিছু বলেছে।”

“না, আসলে বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছিল।”

আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“তুমি না বললেও আমি ঠিকই বুঝতে পারছি নিশ্চয়ই এই অমানুষগুলো আবার তোমার সাথে কোন জুলুম করেছে। তোমার যায়গায় তো একদিন আমিও ছিলাম তাই আমার থেকে কিছু লুকাতে পারবে না তুমি। তবে একটা কথা কি জানো? আমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য কেউ না থাকলেও তোমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য কিন্তু আমি আছি। তাই আমার থেকে কিছু লুকাবে না। বুঝলে?”

দৃঢ়তা মাথা নাড়ায়।

★★
বৌভাতের সময় হয়ে এসেছে। অনেক আত্মীয় স্বজন আসছে। এত অচেনা মানুষের ভীড়ে দৃঢ়তা ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছে। তাছাড়া চৌধুরী পরিবারের কেউই নিচে নামে নি৷ শুধুমাত্র আনিকা চৌধুরীই একা সব আত্নীয়কে স্বাগত জানাচ্ছে আর সবার সাথে দৃঢ়তার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে৷

জলিল চৌধুরী যদিওবা থাকতে চেয়েছিল কিন্তু আমিনা চৌধুরীর কড়া ভাষায় নিষেধ করার পর তিনিও আর আসেন নি।

এদিকে আগত অতিথিদের অনেকেই ত্যাড়া চোখে দৃঢ়তাকে দেখছে। যা দৃঢ়তার অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এরইমধ্যে একজন মহিলা এগিয়ে এসে আনিকা চৌধুরীকে বললাম,
“শুনলাম, এই মেয়ের বড় বোনের সাথে নাকি আপনাদের বাড়ির ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তারপর সেই মেয়ে পালিয়ে যাওয়ায় নাকি একে আপনাদের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে। তাই কি আপনি ছাড়া আর কেউ এখানে নেই? ”

আনিকা চৌধুরী জবাব দেন,
“মোটেই এমন না। বরং আমাদের বাড়ির ছেলে জাবির নিজেই জেদ করে দৃঢ়তাকে বিয়ে করেছে। ওর পরিবার থেকে ঝুলিয়ে দেয়া হয়নি।”

এরমধ্যেই হঠাৎ করে জাবির সেখানে চলে আসে। জাবিরকে দেখামাত্রই আনিকা চৌধুরী বলে ওঠেন,
“এই তো এসে গেছে জাবির। এবার আপনারা সবাই ওর মুখ থেকেই সত্যটা শুনুন।”

জাবির দৃঢ়তার দিকে রাগী চোখে তাকাল। দৃঢ়তা চোখ নামিয়ে নিল।

আনিকা চৌধুরী জাবিরকে ধরে নিয়ে এসে দৃঢ়তার পাশে দাঁড় করিয়ে বলল,
“আজকে বর বউয়ের এভাবে একসাথে পাশাপাশি থাকার নিয়ম। তুমি দৃঢ়তার পাশে থাকো। সবার সাথে নিজের স্ত্রীর পরিচয় করিয়ে দাও। নিজেদের দাম্পত্য জীবনের জন্য দোয়া চাও।”

জাবির হঠাৎ ভীষণ রেগে দৃঢ়তাকে ধাক্কা দেয়। যাতে দৃঢ়তা ফ্লোরে পড়ে যায়। আনিকা চৌধুরী এসে দৃঢ়তাকে টেনে তুলে বলেন,
“এসবের মানে কি জাবির? কেন ধাক্কা মারলে ওকে?”

জাবির ক্ষ্যাপা কন্ঠে বলে,
“এই বিয়ের কোন মানে নেই..আমি শুধু প্রতিশোধ নিতেই দৃঢ়তাকে বিয়ে করেছি। কারণ ও নিজের বোনকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে আমাদের পরিবারের সম্মানে আঘাত করেছে, এই প্রথম ওর জন্য আমি নিজের পছন্দের কিছু পাই নি। সেই জেদ থেকেই বিয়েটা করা। তার মানে এই নয় যে, ওকে আমি স্ত্রীর স্বীকৃতি দেব। এই বিয়েটা শুধু নামের বিয়ে। আমি তো ওকে আজ অব্দি টাচ করেও দেখিনি আর করবোও না। আমি তো শুধু অপেক্ষায় আছি মৌনতার ফিরে আসার। মৌনতা ফিরে এলেই আমি ওকে নিজের করে নেব। কারণ যে জিনিস আমার পছন্দ তাকে আমি নিজের করে তবেই দম নেই।”

আনিকা চৌধুরী বলেন,
“তুমি কি নিজের সব বিবেক হারিয়ে ফেলেছ? নিজের স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে আরেক মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছ।”

এরমধ্যে দৃঢ়তাও বলে ওঠে,
“আপনি মৌনতা আপুকে কখনোই পাবেন না। কারণ এতক্ষণে ওনার অন্য কারো সাথে বিয়ে হয়ে গেছে।”

কথাটা শুনেই জাবির রেগে দৃঢ়তার দিকে আসতে লাগল তখন আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তাকে আগলে ধরল। জাবিরের চোখ রাগে লাল হয়ে গেছে। এই অবস্থাতেই জাবির বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। অতঃপর নিজের গাড়িতে উঠে জোরে ড্রাইভ করতে থাকে।

এদিকে বৌভাতের অনুষ্ঠান যেন পন্ডুল হয়ে যায়। সবাই নানাকিছু বলাবলি করছিল। দৃঢ়তা কেঁদেই চলেছে। আনিকা চৌধুরী তাকে সামলায়।

রাতে,
জাবির এখনো বাড়ি ফেরেনি। তাই বাড়ির সবাই দুশ্চিন্তা করছে। ললিতা চৌধুরী কান্নাকাটি করে বলছেন,
“সব হয়েছে ঐ কুফা মেয়েটার জন্য। ঐ মেয়ের জন্যই আমার ছেলে এখনো বাড়ি ফিরছে না।”

জলিল চৌধুরী বিরক্ত স্বরে বলেন,
“এখন এসব দোষারোপ বাদ দিয়ে নিজের ছেলের জন্য চিন্তা করো। ওকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। ওর কোন বন্ধুও ওর খোঁজ দিতে পারছে না। উফ কি যে করি।”

এমন সময় হঠাৎ জলিল চৌধুরীর ফোন বেজে ওঠে। তিনি ফোনটা রিসিভ করতেই বিপরীত দিক থেকে কিছু শুনে আর্তনাদ করে বলেন,
“কি আমার ছেলে এক্সিডেন্ট করেছে!”

দৃঢ়তা আনিকা চৌধুরীর জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝপথে কথাটা শুনেই দাঁড়িয়ে পড়ে। জাবিরের এক্সিডেন্টের কথা শুনেই তার হাত থেকে খাবারের থালা পড়ে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨