ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-০৫

0
2

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ৫
#লেখিকা_দিশা_মনি

দৃঢ়তা জাবিরের এক্সিডেন্টের কথা শুনে ভীষণ হতবাক হয়৷ তার মনে কেমন জানি অনুভূত হয়৷ এদিকে ললিতা চৌধুরীও আহাজারি শুরু করে বলেন,
“আমার ছেলেটার কি হয়ে গেল? ওর যদি বড় কোন ক্ষতি হয়ে যায় তাহলে কিন্তু আমি তোমার বড় ভাবি আর ঐ মেয়েটাকে ছাড়ব না। ওদের জন্যই আমার ছেলে সকাল সকাল এত রেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল আর এখন..নাহ, আমি আর ভাবতে পারছি না। ওগো, তুমি আমায় জলদি হাসপাতালে নিয়ে চলো। আমার ছেলেকে না দেখা পর্যন্ত আমি শান্তি পাবো না।”

জলিল চৌধুরী কিছু বলতে যাবেন এমন সময় আমিনা চৌধুরী এসে বলেন,
“কি হয়েছে? নিচ থেকে আওয়াজ শুনে ছুটে এলাম রুম থেকে।”

ললিতা চৌধুরী কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“কি আর হওয়া বাকি আছে আম্মা? আপনার নাতির এক্সিডেন্ট হয়েছে। জানি না আমার ছেলেটার এখন কি অবস্থা।”

‘কি এক্সিডেন্ট? কখন কিভাবে?’

জলিল চৌধুরী বলে উঠেলন,
“এসব পরে আলোচনা করা যাবে আম্মা। আগে আমাদের জলদি করে হাসপাতালে পৌঁছে যাওয়া প্রয়োজন। ওখানে গিয়ে দেখা লাগবে আমার ছেলেটার কি অবস্থা এখন।”

“হ্যাঁ, চলো চলো।”

দৃঢতা এসে বলে,
“আমিও যাব আপনাদের সাথে। দয়া করে আমায় নিয়ে চলুন।”

ললিতা চৌধুরী দৃঢ়তা কে দেখেই ক্ষেপে উঠে বলেন,
“এই ডাইনিটার জন্যই আমার ছেলের আজ এই অবস্থা। এই তুই কোন অমঙ্গলকে সাথে নিয়ে এই বাড়িতে এসেছিস রে? আসার পরেই আমার ছেলেকে জীবন মৃত্যুর টানাটানিতে ফেলে দিলি। এখন আবার ঢং করে আমাদের সাথে যেতে চাচ্ছিস কেন? আমার ছেলেকে না খেয়ে কি তোর শান্তি হবে না।”

এমন সময় আনিকা চৌধুরী ছুটে এসে বলেন,
“ছোট! এসব কি বলছিস? নিজেদের ভাষা সামলা। এভাবে কথা বলা ঠিক না। তোর মানসিক অবস্থা আমি বুঝতে পারছি কিন্তু তাই বলে এভাবে কথা বলা কোনভাবেই জাস্টিফাই করা যায় না। তুই দৃঢ়তাকে এভাবে দোষ দিতে পারিস না।”

“তুমি কোন আর কথা বলো না আপা। তোমার দোষও কম না। একবার শুধু আমার ছেলেটা সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরুক তারপর তোমার আর এই মেয়ের ব্যবস্থা আমি করছি।”

আমিনা চৌধুরীও বলেন,
“এই মেয়েকে আমি আর এক মুহুর্ত এই বাড়িতে যায়গা দেব না।”

বলেই তিনি দৃঢ়তার হাত ধরে টানতে টানতে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বলে,
“এই মেয়ে বেরিয়ে যা এই বাড়ি থেকে। লজ্জা থাকলে আর এখানে আসিস না।”

আনিকা চৌধুরী বলেন,
“আম্মা, এসব আপনি ঠিক করছেন না। ও এই বাড়ির বউ আর..”

আমিনা চৌধুরী এবার আনিকা চৌধুরীর গালে ঠাস করে একটা থা*প্পড় মারেন। আনিকা চৌধুরী স্তব্ধ হয়ে যান৷ আমিনা চৌধুরী বলেন,
“তোমার অনেক বাড়াবাড়ি আমি সহ্য করেছি বড় বৌমা আর না। এবার একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো, এই মেয়ে এই বাড়িতে থাকবে না আর এটাই আমার শেষ কথা। ভুলে যেও না এই বাড়ির মালকিন আমি। তাই এই বাড়িতে কে থাকবে আর কে থাকবে না সেই সিদ্ধান্তও আমি নেব। আর তোমার যদি এই মেয়ের জন্য দয়া এত উতলে ওঠে তাহলে তুমিও এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। আমি তোমায় আটকাবো না।”

আনিকা চৌধুরী বলেন,
“আপনি আমায় মারলেন আম্মা? এই হাত দিয়ে আর কত অন্যায় করবেন? এই হাত দিয়েই একদিন আপনি নিজের ছেলেকে..”

“বড় বৌমা..আর একটা কথাও না।”

“আমার মুখ আপনি বন্ধ করতে পারবেন আম্মা কিন্তু সত্য সব সময় সত্যই থাকবে৷ আপনার সব অন্যায়ের ফল আপনাকে পেতে হবে৷ শুধু আপনাকে না এই পুরো পরিবারকে। জাবিরের এই অবস্থার জন্য আপনারা দৃঢ়তা কে দায়ী করছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, ওর এই অবস্থার জন্য আপনাদের অতীতে করা পাপ গুলো দায়ী। তারই শাস্তি পাচ্ছে ও।”

ললিতা চৌধুরী বলেন,
“আমার ছেলের এই অবস্থা আর আপনি এসব বলছেন আপা!”

জলিল চৌধুরী রেগে বলেন,
“এসব নাটক বন্ধ করো তোমরা। আমার ছেলে ওখানে একা কষ্ট পাচ্ছে হাসপাতালে, জানি না ওর কি অবস্থা আর এই অবস্থাতেও তোমাদের এত ঝগড়া করতে মন চাচ্ছে। তোমাদের যদি এভাবে ঝগড়া করার ইচ্ছা হয় তো ঝগড়া করতে থাকো। আমি আমার ছেলের কাছে গেলাম।”

বলেই জলিল চৌধুরী রওনা দেন। ললিতা চৌধুরীও তার পিছু পিছু যান। আর আমিনা চৌধুরী আনিকা চৌধুরীকে বলেন,
“আমার অন্যায় নিয়ে জ্ঞান দেয়ার আগে এটাও ভেবে দেখো তোমার অবস্থান কি। আমার দয়ায় বেচে আছ তুমি।”

“এমন দয়া আমার চাই না আম্মা। আর দয়া তো আমি করেছি আপনাকে। এত কিছুর পরেও আপনার সব অন্যায় লুকিয়ে রেখেছি। আপনিও খুব ভালো করে জানেন যে, আমি মুখ খুললে আপনার অবস্থা কি হবে।”

আমিনা চৌধুরী রাগী চোখে তাকিয়ে সামনের দিকে যান।

এদিকে দৃঢ়তা কাদতে থাকে তখন আনিকা চৌধুরী তাকে আগলে নিয়ে বলে,
“হুশ, কাঁদবে না।”

“আমার খুব খারাপ লাগছে। সত্যিই কি আমার জন্য জাবির চৌধুরীর এক্সিডেন্ট হয়েছে?”

“না, তুমি নিজেকে দোষী ভেব না৷ তোমার কোন দোষ নেই। এসব যারা বলে তাদের কথায় পাত্তা দিও না৷ তুমি নিষ্পাপ। আর শোনো, মাথা ঠান্ডা রাখো৷ সব ঠিক হয়ে যাবে। চলো এখন হাসপাতালে।”

“কিন্তু ওনারা যে বারণ করলেন?”

“এই বাড়িটা ওদের হতে পারে কিন্তু হাসপাতাল নয়। তুমি হাসপাতালে যাবে। সেখানে যেতে কেউ তোমায় বাধা দিতে পারবে না। কারণ তুমি ওর স্ত্রী। আমিও যাব তোমার সাথে চলো।”

★★
হাসপাতালের বাতাসটা কেমন যেন নিস্তব্ধ, অস্বস্তিকর।
সাদা দেয়ালের মধ্যে কাঁচের জানালা দিয়ে রোদের রেখা ভিতরে ঢুকে পড়েছে, অথচ কেমন যেন উজ্জ্বলতা নেই তাতে। বাতাসে ভেসে আসছে স্যাভলনের গন্ধ, যেন এই গন্ধের মধ্যেই মিশে আছে কিছু কান্না, কিছু অনুশোচনা আর না বলা হাজার কথা।

জলিল চৌধুরী ডাক্তারকে ধরেই বসেন,
“ডাক্তার সাহেব, আমার ছেলের অবস্থা কেমন? কিছু বলুন।”

ডাক্তারের মুখে গাম্ভীর্য। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে তিনি বললেন,
“উনি এখনো অজ্ঞান। মাথায় চোট লেগেছে। তবে চিন্তার কিছু নেই এখনই। আমরা সবরকম চেষ্টা করছি। একটা রাত ভালোভাবে পার করুক, তারপর বুঝা যাবে ও কতটা সাড়া দিচ্ছে।”

ললিতা চৌধুরী চেয়ার ধরে বসে পড়লেন,
“রাত? একটা রাত… যদি সে না জাগে আর?”

তিনি মুখে আঁচল চেপে হু হু করে কেঁদে উঠলেন।

জলিল চৌধুরী চুপ। এত বছর সংসার করেও স্ত্রীর কান্নার শব্দ তার মনে এমন হাহাকার জাগায়নি।

এই সময় বাইরে এক নার্স এসে বলে,
“পেশেন্টের আত্মীয়রা কেউ কি দেখা করতে চান? পাঁচ মিনিটের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে।”

ললিতা উঠে দাঁড়াতেই জলিল চৌধুরী বললেন,
“তুমি বসো, আমি আগে যাই। তুমি দুর্বল, কিছু হলে সামলাতে পারবে না।”

ভিতরে ঢুকতেই জলিল চৌধুরীর পা হোঁচট খেলো মেঝেতে পড়ে থাকা স্ট্রেচারের এক কোনায়। একটু কেঁপে গেলেন তিনি।
ছেলের মুখে অক্সিজেন মাস্ক, মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ।
চোখ দুটো বন্ধ। এত শান্ত মুখ!
জীবনের এমন একটা ভয়াবহ সময়েও ছেলেটা যেন ঘুমিয়ে আছে—ক্লান্ত, অথচ নিরীহ।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨