ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-০৬

0
1

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ৬
#লেখিকা_দিশা_মনি

দৃঢ়তাকে সাথে নিয়ে হাসপাতালের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন আনিকা চৌধুরী। তাদের উদ্দ্যেশ্য এখন জাবিরকে দেখতে যাওয়া। তবে দৃঢ়তার মনে এখনো ভয় ছিল যে তাকে দেখে না জানি সবাই কেমন আচরণ করে।

আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তার মনোভাব বুঝতে পেরে বলেন,
“আমি জানি, দৃঢ়তা তুমি কি ভাবছ। তোমার ভাবনা অমূলক নয়। তবে এটা মনে রেখো, এই পরিবারের সদস্যদের এত ভয় পেলে চলবে না। তুমি এদের যত ভয় পাবে এরা তোমায় ঠিক ততোই দমিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। তাই তুমি যদি এদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাও তাহলে তোমায় এদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হবে।”

“কিন্তু চাচি আমি এখন মিস্টার জাবির চৌধুরীর সাথে দেখা করতে চাই। উনি এই মুহুর্তে অসুস্থ আর…এটা একটা হাসপাতাল। তাই আমি চাই না এখানে কোন ঝামেলা হোক।”

“তোমার ভাবনা সঠিক। আমরা এভাবে গেলে ঝামেলা হতে পারে। তাই আমরা এভাবে যাব না।”

“তাহলে কিভাবে যাব?”

আনিকা চৌধুরী হাসপাতালের সামনে দাঁড়ানো কিছু নার্সদের দিকে ইশারা করে বলেন,
“এইভাবে!”

★★
ললিতা চৌধুরী ও আমিনা চৌধুরী জাবিরের কেবিনের সামনেই বসে আছেন। ললিতা চৌধুরী নিজের ছেলের সুস্থতার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন। অপরদিকে আমিনা চৌধুরী নিজের মনে কোন এক ভাবনায় লিপ্ত আছেন।

এরইমধ্যে দুজন নার্স যাদের মুখ মাস্ক দিয়ে ঢাকা তারা জাবিরের কেবিনের দিকে প্রবেশ করছিল৷ আমিনা চৌধুরী তাদের দেখে হঠাৎ করে বলে ওঠেন,
“দাঁড়ান..”

উপস্থিত দুজন নার্সের মধ্যে একজনকে ভীতু লাগছিল৷ তবে অপর একজন তাকে চোখ দিয়ে ইশারা করে সাহস দেন৷ অতঃপর আমিনা চৌধুরীর চোখে চোখ রেখে বলেন,
“জ্বি, বলুন।”

“আমাদের বাড়ির ছেলের এখন কি অবস্থা? ও ঠিক হয়ে যাবে তো?”

“সেটা তো ডাক্তাররাই ভালো বলতে পারেন। আমরা তো শুধু নিজের দায়িত্বটা পালন করতে পারি। তুমি এসো..”

বলেই আরেকটি নার্সকে ইশারা করে ভেতরে চলে যায়। আমিনা চৌধুরী ললিতা চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“নার্সটার গলার স্বর কেমন চেনা চেনা লাগল না? আর আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এদের চেহারাও কেমন চেনা চেনা লাগল।”

ললিতা চৌধুরী বললেন,
“আপনি ওনাদের কিভাবে চিনবেন আম্মা? মনে হয় কোন ভুল হচ্ছে। ওরা তো সাধারণ নার্স।”

আমিনা চৌধুরী বলেন,
“তাই হবে হয়তো..”

এদিকে জাবিরের কেবিনে প্রবেশ করে জাবিরকে অসাড় হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে কেঁদে ফেলে দৃঢ়তা। আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তার কাধে হাত রেখে বলেন,
“কেদো না, তোমায় শক্ত হতে হবে। এভাবে ভেঙে পড়লে একদম চলবে না নিজেকে শক্ত করো।”

মূলত তারা দুজনে নার্সের ছদ্মবেশেই জাবিরকে দেখতে এসেছে। এটাই ছিল আনিকা চৌধুরীর বুদ্ধি।

দৃঢ়তা কান্নারত স্বরে বলে,
“আমার ভীষণ খারাপ লাগছে ওনার জন্য..আমার উপর রাগ করেই বোধহয় ওনার আজ এই অবস্থা। ওনার বড় কোন ক্ষতি হয়ে গেলে যে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। ”

আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলেন,
“কোন চিন্তা করো না দৃঢ়তা। জাবিরের কিছু হবে না। তুমি এখানে থাকো,আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। নার্স হিসেবে তুমি জাবিরের সেবা করে যাও। নিজের স্বামীকে সুস্থ করে তোলো। যেটা আমি পারি নি সেটা তুমি করে দেখাও। নিজের স্বামীকে ধরে রাখো নিজের কাছে।”

বলতে বলতেই আনিকা চৌধুরী কেঁদে ফেলেন৷ দৃঢ়তা নিজের চোখের জল মুছে বলে,
“আমি চেষ্টা করবো। কিন্তু চাচি, যদি কিছু মনে না করেন আপনি কি আমাকে বলতে পারেন আপনার স্বামীর সাথে ঠিক কি হয়েছিল? আমি যতদূর জানি এই পরিবারে কিছু রহস্য অবশ্যই লুকিয়ে আছে। আপনি কি আমায় সেসব বলতে পারবেন?”

আনিকা চৌধুরী বলেন,
“সেসব বলার সঠিক সময় এখনো আসেনি। সময় হলে আমি ঠিকই বলবো। আপাতত তুমি থাকো এখানে আমি আসছি। আমাকে এখন সবটা ম্যানেজ কর‍তে হবে।”

বলে আনিকা চৌধুরী বের হতে যাবে এমন সময় দৃঢ়তা তাকে আটকে বলে,
“আমাকে বিশ্বাস করে সব বলতে পারেন চাচি..আমি আপনার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবো না।”

আনিকা চৌধুরী একটু নরম হন। দৃঢ়তাকে কিছু বলতে যাবেন এমন সময় হঠাৎ তার দৃশ্যপটে কিছু স্মৃতি ভেসে ওঠে…

তার স্বামীর রক্তমাখা হাত এবং তার বলা শেষ কথা…..
“আমাকে তুমি কথা দাও আনিকা..তুমি কখনো কাউকে এই ব্যাপারে কিছু বলবে না। আম্মার করা অন্যায়গুলো কখনো কারো সামনে প্রকাশিত করবে না। এটাই আমার শেষ চাওয় তোমার কাছে…”

বলেই লোকটার মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়া।

এসব কিছু মনে পড়তেই আনিকা চৌধুরী কোন কিছু না বলেই বেরিয়ে যান। এদিকে দৃঢ়তা ভাবতে থাকে,
“চাচি হয়তো আমায় কিছু বলতে চাইছেন না। তবে আমাকে সবকিছু জানতেই হবে৷ কারণ এরসাথে যে আমার জীবনও ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত।”

কথাটা বলার পরই দৃঢ়তা নিজের গলায় থাকা একটি হারে স্পর্শ করে। যেখানে একজন মহিলার ছবি ছিলো। দৃঢ়তা বিড়বিড় করে বলে,
“আমায় সব রহস্য উদঘাটন করতেই হবে মা।”

★★
আনিকা চৌধুরী হাসপাতাল থেকে সোজা বের হয়ে একটি কবরস্থানের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। দূর থেকেই কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকেন তার চোখ খুঁজছে একটি নির্দিষ্ট কবরকে। কিছু সময় এদিক ওদিক তাকিয়ে খোঁজার পর তার চোখ যায় একটি নির্দিষ্ট কবরস্থানে। রজনগন্ধা ফুলের গাছের নিচে থাকা সেই কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে আনিকা চৌধুরী ক্রন্দনরত স্বরে বলেন,
“কেন মৃত্যুর আগে তুমি আমায় এমন জঘন্য একটা শর্ত দিয়ে গেলে? শুধু তোমার দেয়া শর্তের কারণে আমি তোমার মাকে তার কৃতকর্মের শাস্তি দিতে পারি নি। এতে যে আমি শুধু তোমার কাছে না আরো ২ জন ব্যক্তির কারণে সারাজীবনের মতো দোষী রয়ে গেছি..”

বলেই আনিকা চৌধুরী কান্নায় ভেঙে পড়েন।

★★
২ দিন পর,
জাবির নিজের বেডে উঠে বসে তার তত্ত্বাবধানে থাকা নার্সের সাহায্যে। গতকালকেই সে নিজের জ্ঞান ফিরে পেয়েছে৷ তারপর থেকে এই নার্সটাই তার খেয়াল রাখছে সবসময়। জাবিরকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে, রাতে তার গরম লাগায় হালকা পাখার বাতাস থেকে শুরু করে সব ছোট বড় সুবিধা-অসুবিধার খেয়াল রাখছে এই নার্সটি। জাবিরেরও ভীষণ ভালো লাগছে এই নার্সটির সান্নিধ্য। নার্সটি নিজের মুখ ঢেকে রেখেছে মাস্ক দিয়ে। তাই তার মুখ দেখে নি জাবির৷

এরইমধ্যে একজন ডাক্তার জাবিরের কেবিনে প্রবেশ করে বলে,
“গুড মর্নিং মিস্টার জাবির চৌধুরী। এখন আপনি কেমন অনুভব করছেন?”

জাবির হালকা হেসে বলে,
“আগের থেকে যথেষ্ট ভালো অনুভব করছি। যাইহোক আপনাদের এখানকার নার্সরা কিন্তু বেশ কার্যকরী। নিজের আপন জনেরও বোধহয় কেউ এভাবে সেবা করে না যেভাবে আপনাদের হাসপাতালে নার্সরা করে।”

কথাটা শুনেই নার্সরূপী দৃঢ়তার চোখে জল চলে আসে। দৃঢ়তা বলে,
“আপনি কি কখনো বুঝবেন না, আমি আপনার কতটা আপন!”

এরইমধ্যে ললিতা চৌধুরী কেবিনে প্রবেশ করেন। জাবিরকে আগের থেকে অনেকটা সুস্থ দেখে তিনি ক্রন্দনরত স্বরে বলেন,
“জাবির, আমার বাচ্চা,তুমি ঠিক আছ তো? তোমার কিছু হয়নি তো?”

“আম্মু, আমি একদম ঠিক আছি। তুমি চিন্তা করো না।”

“চিন্তা না করে আর কি উপায় আছে? আমি দুদিন থেকে কি দুশ্চিন্তার মাঝে আছি বলে বোঝাতে পারব না। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া যে তুমি সুস্থ হয় গেছ। এখন জলদি বাসায় ফিরে চলো৷ তোমার এই অবস্থা ঐ দৃঢ়তা মেয়েটার জন্যই হয়েছিল৷ ওকে আর আমি তোমার কাছে ঘেষতে দেব না।”

এমন সময় জাবির বলে ওঠে,
“কোথায় দৃঢতা এখন?”

“জানি না, যেখানেই থাকুক জাহান্নামে যাক কিছু যায় আসে না। তুমি সুস্থ হয়েছ এটাই আমার জন্য যথেষ্ট।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨