#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ৮
#লেখিকা_দিশা_মনি
দৃঢ়তা জাবিরের রুম থেকে বের হয়ে সামনের দিকে হাঁটছিল৷ এমন সময় সে খেয়াল করে কেউ তার পিছু নিচ্ছে। দৃঢ়তা পিছু ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় আমিনা চৌধুরীকে৷ আমিনা চৌধুরী দৃঢ়তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে আসেন দৃঢ়তার দিকে৷ অতঃপর খানিক হেসে বলেন,
“তোমার গানের গলাটা শুনলাম। ভীষণই সুন্দর..”
ললিতা চৌধুরীও আমিনা চৌধুরীর পাশেই ছিল। জাবিরও ততক্ষণে নিজের রুম থেকে বাইরে আসে। আমিনা চৌধুরী জাবিরের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“তুমিও তো মেয়েটার গলায় গান শুনেছ। এখন নিশ্চয়ই আর ওকে চিনতে তোমার ভুল হয়নি? নিশ্চয়ই জেনে গেছ এই মেয়েটার আসল পরিচয়।”
জাবির নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। এদিকে আমিনা চৌধুরী এগিয়ে এসে দৃঢ়তার মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে দিতে বলেন,
“বেশ ভালোই খেলা খেললে মেয়ে৷ কিন্তু দিনশেষে তোমার আসল পরিচয় আমরা জেনে গেলাম। কোন লাভ হলো না এসব কিছু করে।”
দৃঢ়তা চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল৷ হঠাৎ করে আমিনা চৌধুরী দৃঢ়তার হাত শক্ত করে ধরে বললেন,
“অনেক নাটক করেছ মেয়ে এখন এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও…”
বলেই দৃঢ়তাকে একটা ধাক্কা দেন। দৃঢ়তা পড়ে যেতে নেয় এমন সময় আনিকা চৌধুরী এসে দৃঢ়তাকে সামলে নেন। আনিকা চৌধুরীকে দেখেই দৃঢ়তা তাকে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে। আমিনা চৌধুরী আনিকাকে দেখেই বলা শুরু করেন,
“বাপের বাড়ির ভাত তাহলে বেশিদিন নিজের পেটে সহ্য হলো না। শেষমেষ তোমায় এখানে আসতেই হলো। কিন্তু এবাড়িতে তোমার আর এই মেয়ের আর কোন যায়গা হবে না৷ তাই ভালো হয় যদি তুমি এই মেয়েকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।”
আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তার হাত শক্ত করে ধরে বলেন,
“এখান থেকে আমার বা দৃঢ়তা কাউকে আপনি বের করে দিতে পারেন না। কারণ আমাদের দুজনেরই এখানে সমান অধিকার আছে।”
“কোন অধিকার চলবে না৷ এই চৌধুরী বাড়িতে শুধু আমার কথা চলবে, বুঝলে তুমি?”
বলেই আমিনা চৌধুরী সিকিউরিটি গার্ডকে ডাকলেন তাদের দুজনকে বের করে দিতে। এরমধ্যে আনিকা চৌধুরী নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা জাবিরের উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“তুমি চুপ করে আছ কেন জাবির? তোমার সামনে এত বড় একটা অন্যায় হচ্ছে তাও তুমি কিছু বলবে না? দৃঢ়তা এই এক সপ্তাহ কিভাবে নিঃস্বার্থ ভাবে তোমার সেবা করেছে সেটা তো তুমি দেখেছ। তার এই প্রতিদান দিচ্ছ তুমি মেয়েটাকে? তুমি মেয়েটার সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছ, ওকে কত মেরেছ অথচ এতকিছুর পরেও মেয়েটা তোমার খারাপ সময়ে তোমার পাশে ছিল৷ আর আজ যখন ওকে সবাই বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইছে তখন তোমার মুখ বন্ধ। একটু তো নিজের বিবেককে কাজে লাগাও জাবির।”
দৃঢ়তার চোখে জল গড়িয়ে পড়ছিল। ললিতা চৌধুরী এগিয়ে এসে দৃঢ়তার হাত শক্ত করে ধরে বলে,
“এসব নাটক করে তুই আমার ছেলের মন পাবি না। তাই ভালোয় ভালোয় বের হ এখান থেকে।”
বলেই দৃঢ়তার হাত শক্ত করে ধরে তিনি বাইরে বের করে দিতে যাবেন এমন সময় জাবির এগিয়ে এসে নিজের মায়ের হাত ধরে ফেলে। ললিতা চৌধুরী অবাক স্বরে বলেন,
“এটা কি করছ তুমি জাবির? আমাকে আটকাচ্ছ কেন?”
“দৃঢ়তা এই বাড়ি থেকে কোথাও যাবে না।”
“মানে? এসব কি বলছ তুমি? তুমি কি এই মেয়ের নাটকে গলে গেলে নাকি? এই মেয়ে হলো একটা কালনাগিনী এর নাটকে গলে যেও না৷ ওকে এই বাড়িতে থাকতে দিলে তোমার জীবনে না জানি আর কত বিপদ আসবে। ওর জন্যই তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছিল আমি আর কোন রিস্ক নেব না।”
“আম্মু, আমি আমার কথা জানিয়ে দিয়েছি। দৃঢ়তা এই বাড়িতেই থাকবে। কারণ ওকে আমি বিয়ে করেছি তাই ওর দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে। তাছাড়া সেসব বাদ দিলেও,ও এ’কদিন যেভাবে আমার সেবা করেছে তার প্রতিদানেও ও এখানে থাকতে পারে। বুঝতে পেরেছ?”
আমিনা চৌধুরী রাগী স্বরে বলেন,
“নাহ, এই মেয়েকে আমি এই বাড়িতে থাকতে দেব না।”
জাবির বলে,
“দাদি আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, দৃঢ়তাকে এখানে থাকতে দাও।”
“জাবির!”
“ওর কাছে আমি ঋণী। সেই ঋণ আমাকে শোধ করতেই হবে।”
বলেই জাবির দৃঢ়তার দিকে তাকায়। অতঃপর তাকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
“তুমি যাও ভেতরে যাও। এই বাড়িতে তোমার জন্য যেই রুম বরাদ্দ করা হয়েছিল মানে নার্স হিসেবে যেই রুমে ছিলে সেখানেই যাও। তোমার সাথে আমি পরে কথা বলছি।”
দৃঢ়তা মাথা নাড়িয়ে চলে যায়৷ আনিকা চৌধুরী জাবিরকে বলে,
“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ জাবির। ন্যায়ের সঙ্গ দেয়ার জন্য।”
এদিকে ললিতা চৌধুরী আমিনা চৌধুরীর কানে কানে ফিসফিস করে বলেন,
“দেখলেন আম্মা, এরা দুজন মিলে কিভাবে আমার ছেলেটার ব্রেইনওয়াশ করে এখানে থাকা নিশ্চিত করল। এদের তাড়ানোর কি আর কোন উপায় নেই?”
“তুমি চিন্তা করো না ছোট বৌমা৷ এই চৌধুরী বাড়িতে আমার বিরাগভাজন হয়ে কেউ টিকতে পারবে না৷ বড় বৌমা আর ঐ মেয়েটার এই বাড়িতে আয়ু অনেক সীমিত। বড় বৌমার ব্যবস্থা তো আমি পরে করছি তবে এই মেয়েটাকে আগে তাড়াতে হবে।”
“কিন্তু কিভাবে?”
এমন সময় আমিনা চৌধুরীর ফোন বেজে ওঠে। আমিনা চৌধুরী ফোনে কথা বলেন। কথা বলা শেষ করে খুশি হয়ে ললিতা চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করো ছোট বৌমা। তোমার সমস্যার সমাধান হলো বলে।”
“মানে? আপনার কথার কিছুই আমি বুঝতে পারছি না আম্মা।”
“বুঝবে, বুঝবে সব বুঝবে। শুধু কালকের সকালটা হতে দাও। কাল অনেক বড় একটা চমক অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।”
★★★
দৃঢ়তা চুপচাপ নিজের রুমে বসেছিল। একটু সময় পর জাবির এলো দৃঢ়তার রুমে। এসেই দৃঢ়তার একদম পাশে এসে বসে বললো,
“তোমাকে জোর করে বিয়ে করে এই বাড়িতে এনে আমি তোমার সাথে কত খারাপ ব্যবহার করেছি, তোমাকে চাবুক দিয়ে মেরেওছি৷ তবুও কেন তুমি আমার খারাপ সময়ে আমার পাশে থাকলে দৃঢ়তা?”
দৃঢ়তা বলে,
“আপনাকে সুস্থ হতে না দেখলে যে আমি নিজেই অনুশোচনায় মরে যেতাম। আমার বারবার এটাই মনে হয় জানেন,যে আপনার এই এক্সিডেন্টের জন্য আমিই দায়ী আর তাই তো..”
“তুমি ভুল ভাবছ দৃঢ়তা। আমার এক্সিডেন্টের জন্য তুমি কোনমতেই দায়ী নও। আমার সাথে যা হয়েছে তা সম্পূর্ণ আমার দোষ। আমিই রেগে গাড়ি চালাতে গিয়ে…খামোখা রাগ দেখাতে গিয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনি। এই ক’দিনেই আমি নিজের ভুলের উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমি এটাও বুঝতে পারছি যে, তুমি মনের দিক থেকে কতোটা নরম মেয়ে। আর তাই হয়তো মান্যতা তোমার এই ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে তোমায় ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে তাকে পালাতে সাহায্য করতে বাধ্য করে তাইনা?”
দৃঢ়তা চুপ করে থাকে। জাবির দৃঢ়তার কাধে হাত রাখে৷ দৃঢ়তার শরীর জুড়ে যেন এক অদ্ভুত উন্মাদনা বয়ে যায়। জাবির বলে,
“সত্যি বলতে এখন তোমার প্রতি আমার মনে আর বিন্দুমাত্র রাগ,ক্ষোভ কিছু নেই। বরং এই কদিনে তুমি যেভাবে আমার পাশে থেকেছ তার জন্য আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ। তুমিও আমার প্রতি আর কোন রাগ, ক্ষোভ কিছু রেখো না।”
দৃঢ়তা বলে,
“ছি ছি! কি যে বলেন। আমি আপনার প্রতি রাগ করতে যাব কেন? আমার কোন রাগ নেই।”
“জেনে অনেক ভালো লাগল৷ আমরা কিন্তু চাইলেই আমাদের মধ্যে একটা স্বাভাবিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক হতে পারে। তুমি কি আমার বন্ধু হবে দৃঢ়তা?”
বলেই জাবির দৃঢ়তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়৷ দৃঢ়তা জাবিরের বাড়িয়ে দেয়া হাত স্পর্শ করে বলে,
“অবশ্যই!”
অতঃপর দুজনের ঠোঁটেই সুক্ষ হাসির রেখা ফুটে ওঠে। যেন দুজনের মধ্যে সকল তিক্ততা ভুলে এক নতুন মিষ্টি সম্পর্কের সূচনা ঘটলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨