#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ৯(চমক)
#লেখিকা_দিশা_মনি
দৃঢ়তা আজ ভীষণ সুন্দর করে সেজে উঠেছে। আনিকা চৌধুরীই দৃঢ়তাকে সাজিয়ে দিয়েছে৷ এই সাজার অবশ্য একটা কারণও আছে৷ জাবির সুস্থ হওয়ায় আমিনা চৌধুরী আজ বাড়িতে একটা পার্টির আয়োজন করেছেন। আর সেই পার্টিতে যাওয়ার জন্যই মূলত প্রস্তুত হচ্ছে দৃঢ়তা।
আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তাকে সাজাতে সাজাতেই আনমনে বলে ওঠেন,
“আমার মন কেন জানি বারবার অজানা আশংকায় কেপে উঠছে। আমি আম্মাকে যতদূর চিনি উনি এমনি এমনি তো কোন কিছু করার মানুষ নন। ওনার মাথায় নিশ্চয়ই কোন কিছু ঘুরছে। নিশ্চয়ই এই পার্টির পেছনে কোন কারণ আছে। তুমি একটু সাবধানে থেকো দৃঢ়তা। ”
“আপনি কোন চিন্তা করবেন না, চাচি। আমি যথেষ্ট সাবধানে থাকার চেষ্টা করব।”
আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তার মাথায় হাত বোলান৷ হালকা কন্ঠে বলেন,
“তুমি একটু সামলে থেক।”
★★
জাবির আজ খুব সুন্দর একটা নীল শেরওয়ানি পড়েছে। যেটাতে তাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। এখনও তাকে ক্রচে ভড় দিয়ে চলতে হচ্ছে। তবে দৃঢ়তার সেবায় সে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। ডাক্তার বলেছে খুব শীঘ্রই জাবির আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
দৃঢ়তা নিজের রুমেই বসে ছিল৷ এমন সময় তার রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায় সুদর্শন এক যুবক। দৃঢ়তা পিছনে ফিরে তাকিয়ে নীল শেষে পরিহিত জাবিরকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। দৃঢ়তার পরনেও একটা নীল শাড়ি। জাবির দৃঢ়তার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“বাহ, তোমাকে তো আজ খুব সুন্দর লাগছে।”
দৃঢ়তা একটা লজ্জা পেয়ে বলে,
“ধন্যবাদ। আপনাকেও অনেক সুন্দর লাগছে।”
জাবির দৃঢ়তার অনেক কাছে চলে আসে। যার ফলে দৃঢ়তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। অতঃপর জাবির নিজের হাতের পেছন থেকে একটা বক্স বের করে দৃঢ়তার সামনে এনে বলে,
“এটা তোমার জন্য।”
দৃঢ়তা অবাক হয়ে যায়। বলে,
“আমার জন্য?”
“হ্যাঁ, তুমি যে সেবা আর শ্রম দিয়ে আমায় সুস্থ করে দিয়েছ এটা তার জন্য ছোট্ট একটা উপহার। জানি এটা দিয়ে আমি তোমার ঋণ শোধ করতে পারব না। তবুও ভাবলাম,তোমার জন্য এটা ভালো হবে। এটায় তোমাকে অনেক ভালো লাগবে।”
“কি আছে এটাতে?”
“নিজেই খুলে দেখ।”
দৃঢ়তা গিফট বক্সটা খুলে দেখে ভেতরে অনেক সুন্দর একটা ডায়মন্ড নেকলেস আছে। এটা দেখে তো দৃঢ়তার চোখ কপালে উঠে যায়। সে বলে,
“এটা তো অনেক দামি হবে!”
“হুম,পছন্দ হয়েছে তো?”
“ভীষণ। অনেক ধন্যবাদ আমাকে এত সুন্দর একটা উপহার দেয়ার জন্য।”
“থাক, আর ধন্যবাদ দিতে হবে না। কালকে বললাম না,আমরা এখন থেকে বন্ধু। আর বন্ধুদের মাঝে এসব ধন্যবাদ-টন্যবাদ বলে কিছু হয় না। এসো, আমি তোমায় নেকলেসটা পড়িয়ে দেই।”
দৃঢ়তা জাবিরের ব্যবহারে অবাকের উপর অবাক হচ্ছিল৷ তার কাছে যেন সবটাই স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। জাবির দৃঢ়তার হাত থেকে নেকলেসটা নিয়ে নিজেই তাকে পড়িয়ে দেয়। অতঃপর আয়নার সামনে দাড়্ করিয়ে বলে,
“বাহ, এটা সত্যিই তোমায় ভীষণ মানাচ্ছে।”
জাবিরের এতোটা কাছে থাকায় দৃঢ়তার হৃদস্পন্দন বাড়ছিল। সে আরো দূর্বল হয়ে পড়ছিল জাবিরের প্রতি। জাবিরের গরম নিঃশ্বাস পড়ছিল দৃঢ়তার কাধে৷ দৃঢ়তা চোখ বন্ধ করে বলে,
“হায় আল্লাহ! এত সুখও আমার কপালে লিখে রেখেছিলে তুমি। এখন শুধু একটু রহম করো, আর কোন বিষাদের ছায়া আমার জীবনে তুমি প্রবেশ করতে দিও না। আমি যেন জাবিরকে নিয়ে একটা সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাতে পারি। আর এই পরিবারের সবাই যেন আমায় মেনে নেয়৷ ব্যস,আর কিছু চাই না।”
দৃঢ়তাকে জাবিরের নেকলেস পড়িয়ে দেয়ার এই দৃশ্য দরজায় বাইরে থেকে দেখছিলেন আমিনা চৌধুরী। তার দুচোখ যেন জ্বলছিল। পরক্ষণেই তিনি হেসে বলেন,
“যতো খুশি হওয়ার এখনই হয়ে নাও মেয়ে। কারণ তোমার এই সুখের আয়ু যে বড্ড অল্প৷ এখন যতটা খুশি হচ্ছ, ভবিষ্যতে তোমায় ঠিক তার থেকে দ্বিগুণ দুঃখ ভোগ করতে হবে।”
★★
চৌধুরী বাড়িতে পার্টি শুরু হয়ে গেছে। আমিনা চৌধুরী আগত সকল গেস্টকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে৷ তার সাথে জলিল চৌধুরী ও ললিতা চৌধুরীও আছেন। আনিকা চৌধুরী একটু দূরে দাঁড়িয়ে খেয়াল করছিলেন যে আমিনা চৌধুরী আর ললিতা চৌধুরী এই দুজন কে আজ যেন একটু বেশিই খুশি খুশি লাগছে। অথচ কাল অব্দি এদের দুজনের মনে কতটা বিষ ছিল৷ আনিকা চৌধুরী আবারো সচেতন হয়ে ভাবেন,
“নিশ্চয়ই এরা কোন ভয়ানক পরিকল্পনা করছেন। আমাকে ব্যাপারটা দেখতে হবে। অনেক কষ্টে দৃঢ়তা একটু সুখের দেখা পেয়েছে। এই সুখকে আমি আর হারিয়ে যেতে দেব না।”
আনিকা চৌধুরী এসবই ভাবছিলেন এমন সময় ললিতা চৌধুরী তার পাশে এসে বলেন,
“কি ব্যাপার আপা? আপনি এখানে এত দুঃখী দুঃখী মুখে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আমার ছেলের সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য যে এত সুন্দর পার্টির আয়োজন করা হয়েছে সেটা কি আপনার পছন্দ হয়নি?”
“কেন পছন্দ হবে না ছোট? আমার তো আর তোর মতো নীচ মানসিকতা নেই৷”
“হ্যাঁ, তুমি তো সবসময় এভাবেই আমায় কথা শোনাও এ আর নতুন কি।”
“আচ্ছা,সত্য করে একটা কথা বল তো। তোর আর আম্মার মনে কি চলছে৷ এই পার্টির আড়ালে নিশ্চয়ই তোরা কোন ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিস তাই না?”
“ওহ আপা। তুমি এত চালাক কেন? যাইহোক, এটুকু যখন ধরতে পেরেছ তখন আরেকটু ধৈর্য ধরো। তোমার নিজের চোখেই সব দেখতে পাবে।”
ললিতা চৌধুরীর এমন কথায় আনিকা চৌধুরী ভ্রু কুচকান।
এদিকে জাবির ও দৃঢ়তা একসাথে নিচে নেমে আসে৷ দৃঢ়তা জাবিরের হাত ধরে ছিল৷ দৃঢ়তার এসব কিছু অনেক ভালো লাগছিল। তার মনে হচ্ছিল,খুব শীঘ্রই হয়তো তার আর জাবিরের মধ্যে সবকিছু ঠিক হতে চলেছে।
আমিনা চৌধুরী জাবিরকে দেখেই তাকে সামনে নিয়ে গিয়ে সবার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আপনারা জানেন,আমার নাতির উপর দিয়ে কিছুদিন আগে কি ঝড় গেছে৷ আর সেই ঝড়ের প্রকোপ কমায় আজ আমি এই পার্টির আয়োজন করেছি। আপনারা সবাই একটু আমার নাতির জন্য দোয়া করবেন যেন ওর জীবন থেকে ঝড় সম্পূর্ণরূপে দূর হয়ে যায়৷ অবশ্য সেই এরেঞ্জমেন্ট আমি নিজেই করেছি। আমার নাতি আমার দুচোখের তারা৷ ছোটবেলা থেকে ও আমার কাছে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। ওর সব ইচ্ছা আমি পূরণ করেছি আর এখনও তার অন্যথা হবে না। ওর সবথেকে বড় ইচ্ছাও খুব শীঘ্রই পূরণ হবে।”
জাবির অবাক স্বরে বলে,
“মানে?”
এমন সময় হঠাৎ চৌধুরী বাড়ির গেইট দিয়ে একটা লাল শাড়ি পরিহিত মেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে প্রবেশ করে আকুল কন্ঠে বলে ওঠে,
“দৃঢ়তা!”
দৃঢ়তা গলার স্বরটা শুনেই হতবাক হয়ে যায়৷ পিছন ফিরে তাকিয়ে আরো বেশি হতবাক হয়ে বলে,
“মান্যতা আপু…!”
জাবিরও অবাক হয়ে তাকায় মান্যতার দিকে। সাথে উপস্থিত সবাই। মান্যতা দৌড়ে এসে দৃঢ়তাকে জড়িয়ে ধরে। দৃঢতাও নিজের বড় বোন সুলভ এই নারীটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। মান্যতা বলতে থাকে,
“তুই ঠিক আছিস তো দৃঢ়তা? আমার ভুলের জন্য তোকে নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। তুই আর একদম চিন্তা করিস না৷ আমি এবার এসে গেছি, আমি সব ঠিক করে দেব।”
জাবির চোখে প্রবল প্রশ্ন নিয়ে মান্যতার দিকে তাকিয়ে ছিল৷ মান্যতা দৃঢ়তাকে ছেড়ে দিয়ে জাবিরের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার জন্য আমার বোনকে আর কষ্ট দেবেন না। আমার ভুলের শাস্তি আপনি আমায় দিন ওকে নয়। ওকে আপনি মুক্তি দিন এবার।”
আনিকা চৌধুরী বিচক্ষণ চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারলেন এটাই তাহলে ছিল আমিনা চৌধুরীর প্ল্যান। নিশ্চয়ই এবার খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে। মান্যতাকে এখানে নিয়ে আসার পেছনে তার নিশ্চয়ই বড় কোন উদ্দ্যেশ্য আছে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨