#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ১০
#লেখিকা_দিশা_মনি
দৃঢ়তা মান্যতার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল। সে মোটেই আশা করে নি যে মান্যতা আবার ফিরে আসবে তাও এভাবে। মান্যতার মুখশ্রী ভীষণ মলিন লাগছে। কাধে হাত রেখে তাকে জিজ্ঞেস করে,
“আপু, তুমি কোথায় ছিলে এতদিন? তুমি তো আবির ভাইয়ার সাথে গিয়েছিলে তাহলে আজ হঠাৎ…”
মান্যতা বলে ওঠে,
“ঐ প্রতারকটার নাম নিস না বোন আমার সামনে৷ দোষটা আমারই…আমি আমার সত্যিকারের ভালোবাসাকে চিনতে পারি নি। আমাকে যে সত্যি ভালোবেসেছিল তার ভালোবাসা আমি ফিরিয়ে দিয়েছি আর তারই ফল আমায় ভোগ করতে হলো।”
বলেই মান্যতা জাবিরের দিকে তাকায়। জাবিরও অশ্রুসিক্ত চোখে মান্যতার দিকে তাকিয়ে ছিল। আনিকা চৌধুরী এবারে এগিয়ে এসে দৃঢ়তার পাশে দাঁড়িয়ে বলেন,
“মানে? তুমি কি বলছ এসব? স্পষ্ট করে বলো। তুমি তো জাবিরের সাথে তোমার বিয়ের দিন নিজের প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছিলে। যার ফলে দৃঢ়তার সাথে জাবিরের বিয়ে হয়৷ তাহলে আজ তোমার হঠাৎ করে এখানে ফিরে আসার কারণ কি?”
মান্যতা বলে,
“ভুল করেছিলাম আমি। আর সেই ভুলের ফলই এখন পাচ্ছি।”
আমিনা চৌধুরী এবার এগিয়ে এসে বলেন,
“মান্যতার মানসিক অবস্থা এখন বেশি ভালো না। তাই যা বলার আমি বলছি। গতকাল মান্যতাই আমাকে নিজে থেকে ফোন করে যোগাযোগ করেছিল। আমি তো রেগে ওকে অনেক কথা শুনিয়ে দেই কারণ ও আমাদের পরিবারের সম্মানে আঘাত হেনেছে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন ওর অসহায়ত্বের কথা শুনলাম তখন না গলে পারলাম না৷ ওর প্রেমিক আবির ওকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ের দিন পালিয়ে ঢাকা থেকে সিলেটে নিয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে ওকে আর বিয়ে করে না। এই অবস্থায় রেখেই কাজি ডাকার কথা বলে বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। তারপর থেকে মেয়েটা সিলেটে একা একা ঘুরছিল৷ লজ্জায় বাড়িতে আর যোগাযোগও করতে পারছিল না। ওখানে নিজের এক পরিচিত বান্ধবীর বাসায় ছিল এতদিন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে? আর তাই উপায়ন্তর না দেখে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। যদিও আমি ওর উপর রেগে ছিলাম কিন্তু ওর এই অসহায়ত্বের কথা শুনে খুব মায়া হয় আমার। আর তাই তো ওকে ফিরে আসতে বলি। তারপর নিজেই বন্দোবস্ত করে ওকে ফিরিয়ে আনলাম।”
আনিকা চৌধুরী আমিনা চৌধুরীর দিকে ঘৃণাভরে তাকিয়ে মনে মনে বলেন,
“আপনি যে মায়া দেখিয়ে নয় বরং দৃঢ়তা আর জাবিরের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টির জন্যই মান্যতাকে ফিরিয়ে এনেছেন সেটা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। এরকম নোংরা খেলা আপনি আগেও খেলেছেন। কিন্তু এখন আমি কি করবো? দৃঢ়তাকে কিভাবে সামলাবো?”
মান্যতা জাবিরের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার বোনটা ভীষণ ভালো মনের মেয়ে। আমি আপনার দাদির কাছে শুনেছি কিভাবে আমার পালিয়ে যাওয়ার রাগ মেটাতে আপনি জোর করে ওকে বিয়ে করে ওর উপর অত্যাচার করেছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন,ওর কোন দোষ নেই। আমি ওকে ভয় দেখিয়েছিলাম যে যদি ও আমাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য না করে তাহলে আমি নিজেকে শেষ করে দেব আর সেই ভয়েই ও আমাকে পালাতে সাহায্য করে।”
জাবির নিশ্চুপ ছিল৷ মান্যতা জাবিরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,
“দোষটা আমারই..আমি ঐ প্রতারক আবিরের ভালোবাসায় এতটা অন্ধ ছিলাম যে আপনার সত্যিকারের ভালোবাসা আমি দেখতে পাই নি। আমার ভুলের জন্যই আজ এত গুলো জীবন নষ্ট হয়ে গেল।”
আমিনা চৌধুরী বলে ওঠেন,
“কোন কিছু এখনো নষ্ট হয়নি। এখনো সুযোগ আছে, সব ভুল শুধরে নেয়ার।”
“মানে?”
“জাবির আর দৃঢ়তার বিয়েটা তো কোন বিয়েই নয়৷ জাবির তো জেদের বশে একপ্রকার প্রতিশোধ নিতেই বিয়েটা করে। কিন্তু আসলে তো ও এখনো মান্যতাকেই ভালোবাসে। আমি জানি সেটা। জাবিরের পক্ষে কখনো দৃঢ়তাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নেওয়া সম্ভবও না। আর তাই, আমি ঠিক করেছি যেহেতু মান্যতা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে এসেছে আর জাবিরের সত্যিকারের ভালোবাসা বুঝতেও পেরেছে তখন ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করবো।”
কথাটা শোনামাত্রই দৃঢ়তার পায়ের তলার মাটি যেন সরে যায়। সে পড়ে যেতে নিতেই আনিকা চৌধুরী তাকে আগলে নিয়ে বলে ওঠেন,
“এসব আপনি কি বলছেন আম্মা? জাবিরের সাথে দৃঢ়তার বিয়ে হয়েছে এক মাসও হয়নি..আর আপনি এরমধ্যেই জাবিরের অন্য কারো সাথে বিয়ে দিতে চাইছেন। বিয়েটা কোন ছেলেখেলা নয় আর জাবির ঈ দৃঢ়তার তো তাদের সম্পর্ককে একটা সুযোগ দেয়া উচিৎ।”
আমিনা চৌধুরী বলে ওঠেন,
“কিসের সুযোগ বড় বৌমা? জাবির মান্যতাকে ভালোবাসে। ওর মনজুড়ে কেবল মান্যতা আছে। দৃঢ়তার প্রতি ওর কোন অনুভূতিই নেই আর না দৃঢ়তাত আছে। আর এখন তো মান্যতাও জাবিরের ভালোবাসা বুঝতে পেরেছে তাহলে কেন একটা জোরপূর্বক সম্পর্ক টেনে নিয়ে যেতে হবে? আমি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাতেই সবাই খুশি হবে। কি হলো জাবির, দৃঢ়তা তোমরা কিছু বলো।”
দৃঢ়তা জাবিরের দিকে তাকায়। তার মুখ থেকে এটা শোনার অপেক্ষায় থাকে যে সে এখনই বলবে, সে মান্যতাকে বিয়ে করতে চায় না, দৃঢ়তার সাথে তার সম্পর্ককে একটা সুযোগ দিতে চায়। কিন্তু দৃঢ়তাকে হতাশ করে দিয়ে জাবির বলে ওঠে,
“দাদি একদম ঠিক বলেছে। আমি মান্যতাকে ভালোবাসি। ওকে প্রথম দেখার পর থেকে আমার মনজুড়ে শুধু ঐ আছে। হ্যাঁ, দৃঢ়তার প্রতি প্রথম আমার রাগ ছিল এখন যদিও সেটা নেই এবং আমাদের মধ্যে একটা সুন্দর বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে কিন্তু একসাথে সংসার করার জন্য সেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক যথেষ্ট নয়। আমি দৃঢ়তাকে কখনো সেই নজরে দেখতে পারব না যেই নজরে আমি মান্যতাকে দেখেছি। আর তাই এই সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাওয়াই সবদিক দিয়ে সেরা হবে। আর মান্যতার জন্য তো আমার মনের জায়গা সবসময় খোলা ছিল। ও যখন ফিরে এসেছে তখন..আমি ওর সাথেই সবকিছু নতুন করে শুরু করতে চাই।”
বলেই সে মান্যতার দিকে গভীর আবেগ নিয়ে তাকায়। মান্যতাও জাবিরের কথা শুনে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে।
দৃঢ়তা যেন ভেতর থেকে একদম দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যায়। আনিকা চৌধুরী বলেন,
“কিন্তু এসবের মাঝে দৃঢ়তার সাথে যে অন্যায় হচ্ছে তার কি হবে?”
এবার ললিতা চৌধুরী বলে ওঠেন,
“তুমি চুপ করো তো আপা। আমার ছেলের সুখ তো তোমার সহ্য হয়না তাই এসব বাজে বকছ। দৃঢ়তার সাথে কোন অন্যায় হবে না। আমরা ওর সব দেনমোহরের টাকা মিটিয়ে দেব। আমার ছেলে মান্যতার সাথেই সুখী হবে দৃঢ়তার সাথে নয়।”
“কিন্তু তাই বলে এভাবে তো কিছু হয়না। সবকিছুর তো একটা নিয়ম নীতি বলে কিছু আসে। জাবির আর দৃঢ়তার বিয়ের এখনো ৬ মাসই হয়নি এরমধ্যে কিভাবে ওদের ডিভোর্স হবে? আইনত তো এটা সম্ভব না আর তার আগে জাবির মান্যতাকে বিয়েই বা করবে কিভাবে?”
এমন সময় দৃঢ়তা বলে ওঠে,
“কেন সম্ভব নয় চাচি? অবশ্যই সম্ভব।”
আনিকা চৌধুরী হতবাক স্বরে বলেন,
“দৃঢ়তা!”
দৃঢ়তা নিজের চোখের জল মুছে যথাসম্ভব হাসার চেষ্টা করে বলে,
“একজন পুরুষের একাধিক বিয়ে করা তো জায়েজ আইনত বৈধ..যতোই এখন ডিভোর্স সম্ভব না হোক কিন্তু মিস্টার জাবির তো চাইলেই এখন মান্যতা আপুকে বিয়ে করতে পারেন। তারপর নাহয় ৬ মাস পর আমি ডিভোর্স দিয়ে ওনাদের মধ্যে থেকে সরে গেলাম।”
“এসব কি বলছ তুমি দৃঢ়তা? তোমার মাথা ঠিক আছে তো? নিজের অধিকার তুমি এভাবে ছেড়ে দেবে?”
দৃঢ়তার হাসি চওড়া হয়। সে বলে,
“অধিকার? কিসের অধিকার? যা আমার কখনো ছিলই না সেখানে আমি কিভাবে অধিকার ফলাবো? মিস্টার জাবির মান্যতা আপুকে ভালোবাসে, মান্যতা আপু মিস্টার জাবিরকে..তাহলে আমি কেন তাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি হবো। আমি শুধু চাই, আমার আপু খুশি হোক..আর মিস্টার জাবিরও…”
মান্যতা দৃঢ়তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমি জানতাম তুই আমার ব্যাপারটা ঠিক বুঝবি..যতই আমরা চাচাতো বোন হই..আমার কাছে তো তুই নিজের বোনের থেকেও বেশি..ধন্যবাদ রে…”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨