#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ১৪
#লেখিকা_দিশা_মনি
দৃঢ়তা নিজের হাতে মান্যতা ও জাবিরের গায়ে হলুদ উপলক্ষে হলুদ বাটছে। আনিকা চৌধুরী কিছু কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সেসব কাজ শেষ করে এসে দৃঢ়তাকে এভাবে বসে থেকে হলুদ বাটতে দেখে তিনি ভীষণ রেগে যান। দৃঢ়তার হাত ধরে টেনে তুলে বলেন,
“এসব কি করছ তুমি দৃঢ়তা? তোমার মাথা ঠিক আছে তো?”
দৃঢ়তা জোরপূর্বক হেসে বলে,
“মাথা ঠিক থাকবে না কেন, চাচি? আজ আমার বড় বোনের বিয়ে বলে কথা। সেই উপলক্ষ্যে আমি একটু হলুদ বাটতে পারব না? শুধু হলুদ বাটা কেন? আমি তো আজ আপুকে হলুদও মাখাবো নিজের হাতে।”
আনিকা চৌধুরী ব্যাথাতুর চোখে দৃঢ়তার দিকে তাকান। অতঃপর তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“আমি আল্লাহর কাছে শুধু একটাই জিনিস চাই, আমার জীবনে আমি যেসব কষ্ট দেখেছি তার পুনরাবৃত্তি যেন তোমার জীবনে না ঘটে। তুমি যেন জীবনে সুখের দেখা পাও। আমার ভাগের সুখও আল্লাহ যেন তোমায় দেন। আর জাবিরের মতো কাপুরুষের সাথে অবশ্যই সেই কাঙ্ক্ষিত সুখ তুমি পাবে না। তোমার উপযুক্ত কারো সাথেই যেন সেই সুখের ভাগীদার হও তুমি।”
আনিকা চৌধুরী এসবই বলছিলেন এমন সময় ললিতা চৌধুরী এসে দৃঢ়তার উদ্দ্যেশ্যে বলেন,”এই মেয়ে, তোমার হলুদ বাটা হলো? মান্যতার গায়ে হলুদের সময় তো হয়ে এলো।”
“জ্বি, হয়ে এসেছে। আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
বলেই দৃঢ়তা হলুদ গুলো একটা বাটিতে নিয়ে রওনা দেয়। দৃঢ়তা যাওয়ার পরই ললিতা চৌধুরী আনিকা চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“আপা একটা কথা বলি কিছু মনে করিও না, তুমি আমার ছেলেকে খুব হিংসা করো তাইনা?”
“কি বলছিস তুই ছোট? কেন হিংসা করতে যাব আমি তোর ছেলেকে?”
“সেটা তো তোমার কথা শুনেই বোঝা যায়। আমার ছেলেকে তুমি কাপুরুষ বলো কোন সাহসে? এসব বলে তুমি কি বোঝাতে চাও যে আমি একটা কাপুরুষের জন্ম দিয়েছিলাম? আরে তর্কের খাতিরে ধরেই নিচ্ছি আমি একটা কাপুরুষের জন্ম দিয়েছিলাম কিন্তু তুমি নিজের কথা ভাবো, তুমি তো একটা মৃত বাচ্চার জন্ম দিয়েছিলে। জীবনে মা ডাক শোনার সৌভাগ্যও হয়নি৷ কতটা পাপী তুমি।”
“ছোট!”
“গলা নামিয়ে। তোমার মতো বন্ধ্যা মানুষের এত উঁচু গলা মানায় না।”
ললিতা চৌধুরীর কথা শুনে আনিকা চৌধুরীর চোখে জল চলে আসে। তার পুরানো ক্ষত যেন আবার তাজা হয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায় সন্তান হারানোর বেদনা।
★★
দৃঢ়তা হলুদ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে গায়ে হলুদের স্থানে। অতঃপর সবাই মিলে ভীষণ আনন্দ করে গায়ে হলুদের আয়োজন শুরু হবে৷ মান্যতার কিছু বান্ধবী ও জাবিরদের কিছু আত্মীয় স্বজন উপস্থিত আছে এখানে। মান্যতারই এক বান্ধবী দৃঢ়তার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“তোমাকে দেখে আমি সত্যিই ভীষণ অবাক হচ্ছি দৃঢ়তা। তুমি কিভাবে এত সহজে নিজের স্বামীর ভাগ কাউকে ছেড়ে দিলে? আমি হলে তো কখনোই পারতাম না।”
দৃঢ়তা কিছু বলার আগেই মান্যতা বলে ওঠে,”সবাইকে কি তোরা নিজেদের মতো হিংসুটে আর স্বার্থপর ভাবিস? আমার বোন মোটেই ওমন নয়। ও বুঝদার। ও জানে জাবির শুধু আমাকে ভালোবাসে আর ওর মনে অনুভূতি শুধু আমার জন্য। সেজন্যই আর আমাদের মাঝে বাধা হয়ে দাড়ায়নি। কারণ ও চায় আমি আর জাবির সুখী হই। তাছাড়া আমার বোনের কি কোনদিক দিয়ে কম আছে নাকি? দেখবি ও জীবনে আরো ভালো জীবনসঙ্গী পাবে। যে ওকে সুখী রাখবে।”
এবার মান্যতার সেই বান্ধবী মান্যতার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“সে তো চাইলে তুইও অন্য একটা জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পারতি। এভাবে নিজের বোনের সংসার ভাঙছিস কেন?”
দৃঢ়তা বলে ওঠে,
“আপু আমার সংসার ভাঙছে না। এই সংসারটা কখনো আমি গড়িই নি। এই পরিবারে কেউ আমায় মেনে নেয়নি আর হয়তো কখনো মানতোও না। তাই এই নিয়ে আপুর উপর আমার কোন রাগ নেই।”
মান্যতা হেসে বলে,
“দেখলি এই হলো আমাদের দৃঢ়তা। ওকে দেখে কিছু শেখ।”
তত্মধ্যে আমিনা চৌধুরী সেখানে উপস্থিত হন। তাকে দেখেই মান্যতা সালাম দিয়ে বলে ওঠে,
“আসসালামু আলাইকুম, দাদি।”
“ওয়ালাইকুম সালাম। তা তোমরা সবাই এখনো হাত গুটিয়ে বসে আছ কেন? গায়ে হলুদের আচার শুরু করো।”
“জ্বি। দৃঢ়তা, তুই প্রথম আমার গায়ে হলুদ লাগা।”
“আমি?”
“হ্যাঁ, তুই। আমি চাই আমার গায়ে প্রথম তোর হাতের ছোয়া হলুদের স্পর্শ লাগুক।”
“আচ্ছা।”
বলেই দৃঢ়তা হলুদ নিয়ে এগিয়ে যায় মান্যতার দিকে। মান্যতার গায়ে হলুদ মাখিয়ে দেয়। মান্যতা আশেপাশে তাকিয়ে সুযোগ বুঝে দৃঢ়তার কানে কানে বলে,
“কালকে কি বলেছিলাম মনে আছে তো? আজ আমার বিয়েটা হওয়ার আগেই তুই দূরে কোথাও চলে যা প্লিজ।”
দৃঢ়তা বলে,
“আমার সব মনে আপু। তুমি কিছু চিন্তা করো না, আমি চলে যাব অনেক দূরে। তারপর একেবারে ৬ মাস পর ফেরত আসব।”
আমিনা চৌধুরী দূরে দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবেন,
“এই বিয়েটাতে যাতে কোন বাঁধা না আসে সেটা আমায় দেখতে হবে। অনেক কষ্টে এই দৃঢ়তাকে দূর করতে পেরেছি এবার বড় বৌমাকে বের করার পালা।”
★★
পুরো বাড়ি আলোকসজ্জা ও বাদ্যযন্ত্রের শব্দে ম ম করছে। বিয়ের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে চৌধুরী বাড়িময়। এই আয়োজনের মধ্যেই দৃঢ়তাও অনেক সুন্দরভাবে সেজেছে। তার পরণে একটা হলুদ শাড়ি। এই সাজ নিয়েই সে প্রথমে মনোয়ারা বেগমের সাথে দেখা করল। মনোয়ারা বেগম দৃঢ়তাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্না করে বললেন,”মান্যতা অনেক বড় অন্যায় করল তোর সাথে দেখবি ও কখনো সুখী হবে না।”
দৃঢ়তা বলল,”ধুর, নিজের মেয়েকে কেউ এমন অভিশাপ দেয়। তুমি দোয়া করো যে, আপু যেন সুখী হয়।”
“তুই সত্যিই অনন্য দৃঢ়তা। তোর মতো খাটি সোনার মূল্য যারা দিতে পারেনি তারা একদিন ঠিকই পস্তাবে দেখিস।”
অতঃপর দৃঢ়তা মনোয়ারা বেগমের রুম থেকে বের হয় জাবিরের রুমের দিকে যায়। জাবির তখন বরবেশে বিয়ের আসরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। দৃঢ়তাকে দেখেই সে দাঁড়িয়ে যায়। দৃঢ়তা হেসে বলে,
“আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে৷ তবে পাগড়ীটা একটু ঠিক করে নিন।”
দৃঢ়তার কন্ঠে চাপা কষ্ট ছিল। যা জাবির বুঝতে পারে। আজ কেন জানি তারও ভীষণ কষ্ট অনুভূত হচ্ছে। জাবির বুঝতে পারছে না এর কারণ কি। সে তো মান্যতাকেই বিয়ে করতে চেয়েছিল। তাহলে এখন কেন কষ্ট হচ্ছে। এরমধ্যে দৃঢ়তা একটা চিঠি বের করে জাবিরের হাতে দিয়ে বলে,
“এটা রাখুন। এই চিঠিটা আজ আপনার বিয়ের পরই খুলবেন, কেমন? আর হ্যাঁ, কাউকে বলবেন না এটার ব্যাপারে।”
“কি আছে এই চিঠিতে?”
“সেটা পড়লেই বুঝতে পারবেন।”
বলেই দৃঢ়তা পিছন ফিরে চলতে শুরু করে। কারণ আর একটু সময় সেখানে থাকলে যে সে নিজের চোখের জলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। দৃঢ়তা জাবিরের কথা ভেবে বলে,
“আজ আপনাকে আমি চিরদিনের জন্য মুক্তি দিলাম। এরপর আপনি হাজার চাইলেও আমি আর ফিরবো না আপনার জীবনে। এখন আমি রওনা দেব এক অজানা গন্তব্যে। আনিকা চাচি, আমায় ক্ষমা করবেন। আপনার থেকে বিদায় নেয়া হলো না৷ কি করবো, বলুন? আপনার সামনে গেলেই যে আমি দূর্বল হয়ে পড়তাম। আমায় দেখলেই আমার মনের কথা বুঝে যেতেন আপনি৷ তবে আমি কথা দিচ্ছি ৬ মাস বা ১ বছর পর ফিরে এসে সবার আগে আমি আপনার সাথেই দেখা করব।”
★★
জাবির ও মান্যতাকে সামনাসামনি বসানো হয়েছে বিয়ের আসরে। কাজি সাহেব বিয়ে পড়াতে শুরু করেছেন। সবকিছু ঠিকভাবে হতে দেখে আমিনা চৌধুরী ও ললিতা চৌধুরী ভীষণ খুশি। মান্যতাও ভীষণ খুশি কিন্তু জাবির কেন জানি খুব একটা খুশি হতে পারছে না। তার বুকে সূক্ষ ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। বারবার দৃঢ়তার কথাই মনে পড়ছে। এরমধ্যে কাজি সাহেব মান্যতাকে বলেন,
“মা, এবার কবুল বলো..”
মান্যতা হাসিমুখে কবুল বলতেই যাবে এমন সময় হঠাৎ করে দৌড়ে বিয়ের আসরে এসে উপস্থিত হয় এক যুবক। এসেই বলে,
“মান্যতা, তুমি কবুল বলো না…তুমি এভাবে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারো না।”
মান্যতা কন্ঠটা শুনেই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। যুবকটির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আবির ভাই..তুমি?”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨