#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ১৫
#লেখিকা_দিশা_মনি
মান্যতাসহ উপস্থিত সবাই হতবাক চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে থাকে। মান্যতা বিয়ের আসর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে যায় আবিরের কাছে। অতঃপর বলে,
“আবির ভাই..তুমি কোথা থেকে এলে? তুমি তো আমায় ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলে। তোমায় ভরসা করে আমি বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গেছিলাম আর তুমি তার বিনিময়ে আমায় ধোকা দিলে!”
আবির বলে,
“আমি তোকে ধোকা দেই নি মান্যতা। আমি সেই দিন কাজি ডেকে তোকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলাম কিন্তু মাঝ রাস্তায়..”
আবির আর কিছু বলার আগেই আমিনা চৌধুরী বলে ওঠেন,
“সিকিউরিটি! কোথায় তোমরা? এভাবে হুট করে যে কেউ বাড়িতে ঢুকে পড়ছে। এসবের জন্য কি তোমাদের বেতন দেয়া হয়? দ্রুত এসে একে বের করে দাও। আর মান্যতা তুমি এসে বিয়ের আসরে বসো। এই প্রতারকের কথা শোনার কোন দরকার নেই।”
মান্যতা আমিনা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে,
“দাদি, প্লিজ। একটু অপেক্ষা করুন। আবির ভাইয়ের থেকে আমায় শুনতে দিন সবটা।”
“ওর কথা কি শুনবে তুমি? ও যা বলবে সব মিথ্যা। যেই ছেলে তোমায় মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে পালিয়ে গেছিল তার কথা বিশ্বাস করবে তুমি?”
আবির এবার রাগী স্বরে বলে,
“চুপ করুন আপনারা..আজ আমি আপনাদের সব অপকর্ম তুলে ধরব। জানিস মান্যতা, যেদিন আমি আমাদের বিয়ের জন্য কাজি ডাকতে গেছিলাম সেদিন হঠাৎ রাস্তার মাঝে একটা কালো গাড়িতে করে কিছু মুখোশ পড়া লোক এসে আমায় তুলে নিয়ে যায়। এরপর তারা আমায় নিয়ে গিয়ে এতদিন একটা বদ্ধ ঘরে আটকে রেখেছিল। এজন্যই আমি এতদিন তোর কাছে ফিরতে পারিনি। কিন্তু আমি রোজ ঐ লোকগুলোর কথা শুনতাম যে, ওদের ফোনে কেউ বলত, আমাকে বেধে রাখতে। এমনকি গতকাল তো ওরা আমায় মেরে ফেলারও পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আমি চালাকি করে পালিয়ে আসি। তারপর সিলেট থেকে সোজা ঢাকার৷ বাস ধরে আজ ঢাকায় আসি। প্রথমেই আমি তোদের বাসায় যাই কিন্তু সেখানে তোর খোঁজ পাই না৷ তারপর তোর কিছু প্রতিবেশীর সাথে কথা বলে সবটা জেনে এখানে ছুটে এলাম। কিন্তু এখানে এসে এমন কিছু দেখব ভাবিনি….তুই আমাকে ছেড়ে এই লোকটাকে বিয়ে করবি মান্যতা?”
মান্যতা ক্রন্দনরত স্বরে বলে,
“নাহ…আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি আবির ভাই..এই বিয়েটা তো আমি বাধ্য হয়ে করছিলাম। কারণ আমি ভেবেছিলাম তুমি আমায় ঠকিয়ে পালিয়ে গেছ।”
“আবির কখনো তার মান্যতাকে ফেলে পালাতে পারে?”
ললিতা চৌধুরী আমিনা চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বলেন,
“আম্মা..এসব কি হচ্ছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
আমিনা চৌধুরী এগিয়ে এসে মান্যতাকে বলেন,
“এই প্রতারককে তুমি বিশ্বাস করবে মান্যতা? আমরা এত কিছুর পরেও তোমাকে আমাদের বাড়ির বউয়ের স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়েছি আর তুমি..”
মান্যতা বলে,
“আমার উপর কোন দয়া করেন নি আপনারা। আপনাদের বাড়ির ছেলেই তো আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল ছিল। এজন্য তো আমার বোনটাকে ত্যাগ করতেও দুবার ভাবে নি। এখন আমি বুঝতে পারছি, এসব কিছু আপনাদেরই প্ল্যান। মিস্টার জাবির, আপনি নিশ্চয়ই আবির ভাইকে আটকে রেখেছিলেন তাইনা? যাতে করে আমায় নিজের করে পেতে পারেন।”
জাবির বলে ওঠে,
“এসব তুমি কি বলছ মান্যতা? আমি কেন এমন কিছু করতে যাব?”
“যে আমাকে পাবার জন্য দৃঢ়তার মতো এত ভালো একটা মেয়েকে ছেড়ে দিতে পারে তার জন্য আর এটা এমন কি। কিন্তু আপনি কান খুলে শুনে রাখুন মিস্টার জাবির, আমি আপনাকে বিয়ে করব না। আপনার ইচ্ছা কখনোই পূরণ হবে না। আপনি আমায় পাবেন না।”
মান্যতার বাবা আলমগীর খান এগিয়ে এসে মান্যতার হাত ধরে বলেন,
“এসব কি বলছিস তুই পাগলের মতো? একবার যেই বোকামি করেছিস সেটা আর দ্বিতীয় বার করিস না। জাবিরের মতো ভালো ছেলে আর পাবি না। এই আবিরকে বিশ্বাস করিস না তুই।”
“ব্যস, আব্বু। তোমার থেকে আমি আর কিছু শুনতে চাইনা। তুমি বাবা হিসেবে নয় একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আমার আর জাবির চৌধুরীর বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ, সেটা কি আমি বুঝি না? আমিও বোকা ছিলাম যে…এই জঘন্য লোকটার জীবনে ফেরার জন্য নিজের বোন..দৃঢ়তাকে কত কষ্ট দিলাম। তুমিও নিজের ভাতিজির সংসার ভাঙার আগে দুবার ভাবো নি..যদিও একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। দৃঢ়তা এই জাবির চৌধুরীর মতো জঘন্য লোককে ডিজার্ভ করে না। আমি আশা করব, ও যেখানেই গেছে ভালো কাউকে পাক, তাকে নিয়ে সুখী হোক।”
মনোয়ারা বেগম এগিয়ে এসে বলেন,
“কি বলছিস তুই? কোথায় গেছে দৃঢ়তা?”
“জানি না কিন্তু যেখানেই গেছে সেখানে সুখী হোক। এখন আমি এসব নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না। আমি এখন আবির ভাইকে বিয়ে করে নিতে চাই। বলা তো যায়না,চারপাশে যা শকুন আর ঈগলের কারবার৷ কখন কার নজর লেগে আবার আমরা আলাদা হয়ে যাই।”
আমিনা চৌধুরী ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলেন,
“এই মেয়ে এক্ষুনি বেরিয়ে যাও এই বাড়ি থেকে। কি ভেবেছ টা কি তুমি? তোমাকে বিয়ে না করলে আমার নাতি মরে যাবে? মোটেই না, এটা তো আমাদের মহানুভবতা য্ব আমরা তোমার মতো একটা থার্ডক্লাস মেয়েকে সুযোগ দিয়েছিলাম। তুমি বা তোমার বোন কেউ আমার নাতির যোগ্য না
ওর জন্য আমি আরো ভালো মেয়ে খুঁজে বের করবো।”
মান্যতা বলে,
“ভালো মেয়ে পরে খুঁজবেন। আগে পুলিশের মামলা সামলান। আপনাদের নামে আমি প্রতারণা ও অপহরণের কেইস করব আবির ভাইকে আটকে রাখার জন্য৷ আপনার নাতিকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।”
ললিতা চৌধুরী এগিয়ে এসে বলেন,
“মান্যতা..তোমার এত বড় সাহস আমার ছেলেকে জেলের ভাত খাওয়াতে চাও? তোমাকে তো আমি..”
বলেই যেই না মান্যতার গায়ে হাত তুলতে যাবে এমন সময় মান্যতা তার হাতটা ধরে বলে,
“খবরদার! আমি দৃঢ়তা নই। আপনার ভাগ্য ভালো যে আমি আপনার ছেলের বউ হয়ে আসিনি। নাহলে আমার উপর হাত তুললে না হাত ভেঙে গুড়োগুড়ো করে রেখে দিতাম।”
বলেই সে ললিতা চৌধুরীকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে আবিরের হাত ধরে বলে,
“চলো এখন এখান থেকে। আমরা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে নেই। কেউ আমাদের বিয়ে মানুক বা না মানুক তাতে কিছু যায় আসেনা।”
বলেই তারা বেরিয়ে যায়। মনোয়ারা বেগম আহাজারি করে বলেন,
“আমার দৃঢ়তা কোথায় গেল?”
এদিকে আকস্মিকতায় বিধ্বস্ত জাবিরের হঠাৎ দৃঢ়তার দেয়া চিঠিটার কথা মনে পড়ে৷ চিঠিটা সে নিজের ঘরে রেখেছিল। তাই ছুটে যায় চিঠিটা পড়তে। আনিকা চৌধুরী এতক্ষণ ঘরের ভেতরে থেকে সব দেখছিলেন। এবার তিনি বাইরে এসে আমিনা চৌধুরীর উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“আজ আরো একবার আপনার করা অন্যায়ের জন্য আরো কয়েকটা জীবন তছনছ হয়ে গেল। আমি বুঝি না, এত অন্যায় করার পরও কি আপনার পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়নি? আজরাইল কি আপনাকে চোখে দেখে না?”
“বড় বৌমা!”
★★★
দৃঢ়তা ট্রেনে করে যাচ্ছিল এক অজানা গন্তব্যের দিকে। চাদনী রাতের হালকা আলোয় বাইরের কিছু দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল। ট্রেনের শব্দ তার কানে লাগছিল। এই ট্রেনের মতো দৃঢ়তাও আজ ছুটে চলেছে এক অজানা গন্তব্যে। দৃঢ়তা এবার নিজের পার্স থেকে নিজের ফোন বের করে অতঃপর সেটা ফেলে দেয় জানালা দিয়ে। মনে মনে বলে,
“যেই দৃঢ়তাকে এতদিন সবাই চিনত সেই দৃঢ়তা আর থাকবে না। এরপর আবার যখন আমি ফিরবো এই ঢাকা শহরে তখন সবাই এক নতুন দৃঢ়তাকে দেখতে পাবে।”
বলেই সে ঢাকা-চট্টগ্রামগামী ট্রেনটির টিকিটে একবার চোখ বুলিয়ে বলে,
“চট্টগ্রাম..এই শহরেই এক নতুন দৃঢ়তার উত্থান ঘটবে।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨