ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-১৭

0
2

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ১৭
#লেখিকা_দিশা_মনি

দৃঢ়তা ভয়ে ভয়ে রাস্তার এককোণে গিয়েছিল দাঁড়ায়। গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে সে ভীষণ আঘাত পেয়েছে৷ হাত ও পায়ের গোড়ালিতে বেশ ভালোই ক্ষত হয়েছে। ভাগ্যিস সঠিক সময় গাড়িটা থেমে গিয়েছিল নাহলে আরো বড় কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারত৷ এসব ভেবেই দৃঢ়তা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। এমন সময় গাড়ি থেকে নেমে আসা যুবকটি তার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“আপনি ঠিক আছেন তো? এত রাতে এভাবে উন্মাদের মতো দৌড়াচ্ছিলেন কেন? আমি সঠিক সময় গাড়ি না থামালে আজ কতবড় দূর্ঘটনা ঘটতে পারতো জানেন?”

রাতের আধারে অন্ধকার সড়কে কোন ল্যাম্পপোস্ট নেই। তাই দৃঢ়তা যুবকটির মুখ স্পষ্ট দেখতে পেলো না। তবে তার কথা শুনে ভীষণ নির্ভরযোগ্য মানুষ মনে হলো। তাই তো এই বিপদের দিনে আগপাছ না ভেবে বলতে লাগল,
“প্লিজ, আমাকে বাঁচান। ঐ লোকটা আমার…আমার বড় কোন ক্ষতি করে দেবে..উনি আমার গলায় ছুরি ধরেছিলেন..”

বলেই কান্না করে ওঠে দৃঢ়তা। যুবকটি দৃঢ়তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে,
“আপনি শান্ত হোন, কিচ্ছু হবে না আপনার। আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন। আমি একজন নেভি অফিসার। আপনার যদি কোন সমস্যা না থাকে তো আমার সাথে আসুন। আমি আপনাকে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দেব।”

বলেই যুবকটি দৃঢ়তার দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো।

দৃঢ়তার কেন জানি এই আগন্তুক যুবককে বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছা করলো। তাই তো সে যুবকের বাড়িয়ে দেয়া হাতটি ধরল। অতঃপর যুবকটি তাকে ধরে ধরে নিজের গাড়ির কাছে নিয়ে যেতে লাগল৷ দৃঢ়তা এবার করুণ চোখে নিজের পায়ের দিকে তাকালো। ভীষণ আঘাত পাওয়ায় ঠিকভাবে হাটতেও পারছে না সে। যুবকটি বেশ যত্ন সহকারেই তাকে নিজের গাড়িতে তুলল। অতঃপর সামন ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। গাড়ির ভেতরে লাইট জ্বালানোর পরই লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে যুবকটির মুখশ্রী স্পষ্ট দেখতে পেল দৃঢ়তা। শ্যামবর্ণের পুরুষটিকে নিঃসন্দেহে সুদর্শন বলা যায়। দেখে বোঝা যাচ্ছে তার বেশ পেটানো বলিষ্ঠ দেহ। দৃঢ়তা বেশিক্ষণ যুবকটির দিকে না তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। যুবকটি দৃঢ়তার দিকে একটা পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নিন, এটা খেয়ে নিন। ভালো লাগবে।”

দৃঢ়তা নিলো পানির বোতলটা। ঢকঢক করে পানি খেল। যুবকটি গাড়ি স্টার্ট করলো। যুবকটি গাড়ি চালাতে চালাতেই হঠাৎ করে বললো,
“আপনার নাম কি জানতে পারি? আর আপনি থাকেন কোথায় সেটা বলুন। আমি আপনাকে আপনার ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”

“আমার নাম দৃঢ়তা। আমার বাসা ঢাকায়..”

“কি বলেন ঢাকা? কিন্তু এখন তো আপনাকে ঢাকায় রেখে আসা সম্ভব নয়। আপনার কি এখানে কোন চেনাজানা কেউ আছে?”

“না, এখানে আমার চেনাজানা কেউ নেই।”

“তাহলে কি ঢাকাতেই ফিরতে চান?”

“না, আমি ঢাকায় ফিরতে চাই না। আপনি আমায় হালিশহরের কাছে নামিয়ে দিয়ে আসুন প্লিজ। আমি নিজের কোন একটা ব্যবস্থা করে নেবো।”

“আপনার চেনাজানা কেউ নেই এখানে,আবার আপনি নিজের বাড়িতেও ফিরতে চান না। তাহলে এখানে একা কি করবেন আপনি? আবার যদি কোন বিপদে পড়েন?”

“আমার কথা এত ভাবতে হবে না আপনাকে। আমি যা বলছি তাই করুন..”

কথাটা বেশ বিরক্ত হয়ে বলে দৃঢ়তা। যুবকটি উত্তরে বলে,
“আপনাকে যখন আমি উদ্ধার করেছি তখন আপনার দায়িত্ব আমার। আমি জানি না, আপনি কেন এমন সব অদ্ভুত কথাবার্তা বলছেন৷ কিন্তু আপনাকে এভাবে একা ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার উপর একটু ভরসা রাখুন, আমি আপনাকে নিরাপদ একটা স্থানেই নিয়ে যাব।”

বলেই যুবকটি নিজের মতো গাড়ি চালাতে শুরু করল৷ দৃঢ়তা বুঝল না তার কি এই যুবকটির উপর ভরসা করা উচিৎ নাকি নয়? কিন্তু কোন প্রতিবাদও জানালো না। কয়েক ঘন্টা পর যুবকটি গাড়ি এনে থামালো একটি ফ্ল্যাটের সামনে৷ অতঃপর দৃঢ়তাকে গাড়ি থেকে নামতে বললো। দৃঢ়তা এবার কিছুট ভয় পেয়ে বললো,
“এ আপনি আমায় কোথায় নিয়ে এসেছেন?”

“ভয় পাবেন না। এটা একটা নিরাপদ স্থান। এখানে আমার খুব ভরসাযোগ্য একজন মানুষ থাকে। তার ভরসাতেই আপনাকে নিয়ে এসেছি।”

বলেই যুবকটি দৃঢ়তাকে আস্তে করে গাড়ি থেকে নামায়। অতঃপর দৃঢ়তাকে নিয়ে ফ্ল্যাটের ভেতরে প্রবেশ করে লিফটে উঠে। কিছু সময় পর লিফটের দরজা খুলে যায় ৮ম ফ্লোরে গিয়ে। যুবকটি দৃঢ়তাকে নিয়ে লিফট থেকে নামে। অতঃপর একটু এগিয়ে গিয়ে একটা দরজার সামনে গিয়ে কলিং বেল বাজায়৷ কিছু সময় পর একজন মহিলা এসে দরজা খুলে দেয়। যুবকটি মহিলাটিকে দেখেই স্মিত হাসে। অতঃপর বলে,
“আসসালামু আলাইকুম ভাবি, এত রাতে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। আসলে খুব বিপদে পড়েই আপনার কাছে আসা। বুঝতে পারছিলাম না কি করব..”

মিষ্টি যুবকটির কথার প্রতিত্তোরে বলে,
“কি হয়েছে? সবটা আমায় নির্ভয়ে বলো?”

“আসলে আমি আজ রাতে একটা মিশন শেষ করে ফিরছিলাম এমন সময় রাস্তায় এই মেয়েটি আমার গাড়ির সামনে চলে আসে আর তারপর..”

যুবকটি মিষ্টিকে সব ঘটনা খুলে বলে। মিষ্টি সব শুনে অবাক হয়ে বলে,
“কোথায় মেয়েটি? মেয়েটিকে নিয়ে এসো।”

যুবকটি এবার নিজের পেছনে থাকা দৃঢ়তাকে সামনে নিয়ে আসে। দৃঢ়তাকে দেখামাত্রই মিষ্টি অবাক স্বরে বলে ওঠে,
“দৃঢ়তা তুমি!”

দৃঢ়তাও অবাক স্বরে বলে,
“মিষ্টি আপু!”

যুবকটি এবার অবাক হয়ে বলে,
“আপনারা একে অপরকে আগে থেকেই চেনেন?”

“চিনবো না মানে? দৃঢ়তা তো ভার্সিটিতে আমার জুনিয়র ছিল। কত ভালো ছিল পড়াশোনায় আর ওর গানের গলাও তো ভীষণ সুন্দর। আমার সাথে ওর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আমি ফ্রান্সে চলে যাবার পর থেকে ওর সাথে কোন যোগাযোগই ছিল না। আজ এতদিন পর ওকে দেখলাম, তাও এই অবস্থায়।”

দৃঢ়তা আবেগপ্রবণ হয়ে হঠাৎ মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে। মিষ্টি দৃঢ়তাকে নিজের বুকে আগলে নিয়ে বলে,
“কোন চিন্তা করো না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে৷ আমি আছি তো।”

“উনি বোধহয় খুব ভয়ে পেয়েছেন ভাবি৷ আপনি ওনাকে ভেতরে নিয়ে যান।”

“তুমিও ভেতরে এসো ইউভান!”

মিষ্টির কথা শুনে দৃঢ়তা প্রথমবারের মতো জানতে পারলো দেবদূত হয়ে যে ব্যক্তিটি আজ তাকে উদ্ধার করলো তার নাম ইউভান! নামটা বেশ অদ্ভুত ঠেকলো দৃঢ়তার কাছে। কারণ বাঙালি যুবকদের সাধারণত এমন নাম হয় না। এদিকে ইউভান আবারো একটা স্মিত হাসি দিয়ে বললো,
“আজ না অন্য একদিন, তাছাড়া এখন থেকে তো আমার এখানে আসা যাওয়া চলতেই থাকবে। কারণ আপনার কাছে যে আমার এক দায়িত্ব রেখে যাচ্ছি। যদিও জানি, আপনি ওনার যথেষ্ট খেয়াল রাখবেন তবুও অনুরোধ করছি..ওর খেয়াল রাখবেন।”

“এ নিয়ে তোমায় একদম চিন্তা করতে হবে না। দৃঢ়তাকে আমি নিজের বোনের মতো আগলে রাখব।”

“বেশ, নিশ্চিন্ত হলাম। এবার তাহলে আমি আসি ভাবি।”

বলেই সে এবার দৃঢ়তার দিকে তাকিয়ে বললো,”আসি মিস দৃঢ়তা..”

বলে আবারো সেই স্মিত হাসি দিলো। দৃঢ়তা চোখভরে সেই হাসিটা দেখল। এই শ্যামপুরুষের হাসিতে যেন এক অদ্ভুত মায়া লুকিয়ে আছে। ইউভান আর দাঁড়ালো না। যেভাবে মুহুর্তের মধ্যে এসেছিল দৃঢ়তার সামনে ঠিক সেভাবেই হাওয়া হয়ে গেল। মিষ্টি দৃঢ়তাকে বললো,
“জানো, ইউভান আমার স্বামী রাফসানের সাথে নেভিতে একসাথে জব করে। আমার স্বামীর জুনিয়র ও। তবে ওদের সম্পর্ক দুই ভাইয়ের মতো। আমাকেও তো ও ভাবির মতোই দেখে৷ আমরা ফ্রান্স থেকে ফেরার পর মাত্র ২ বছর হলো আমাদের পরিচয় অথচ এত জলদি কিভাবে আপন করে নিয়েছে! ভীষণ ভালো ছেলে ও।”

দৃঢ়তাও ইউভানের করা সাহায্যের কথা ভেবে বলে,
“আসলেই তাই..”

মনে মনে(জাবিরের মতো পুরুষ মানুষের যুগেও এমন স্নিগ্ধ পুরুষ তাহলে আছে পৃথিবীতে!)

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨