ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-১৮

0
1

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ১৮
#লেখিকা_দিশা_মনি

দৃঢ়তা মিষ্টির পাশে বসেছিল৷ মিষ্টি তাকে নিজের জীবনের সব গল্প বলছিল৷ ফ্রান্সে নিজের কাটানো অভিজ্ঞতার বিবরণ দিচ্ছিল। দৃঢ়তাও একসময় তার জীবনের সমস্ত কষ্টের কথা বলতে থাকে। যা শুনে মিষ্টি হতবা হয়ে যায়। দৃঢ়তার মতো এত ভালো একটা মেয়েকে যে এত কিছু সহ্য করতে হয়েছে তা মিষ্টির ধারণার বাইরে ছিল৷ সব শোনার পর মিষ্টি দৃঢ়তার কাধে হাত রেখে বলে,
“তুমি একদম চিন্তা করো না। যারা তোমার সাথে অন্যায় করেছে তারা তাদের সেই অন্যায়ের শাস্তি একদিন না একদিন ঠিকই পাবে।”

এসব কথা বলতে বলতেই রাত পেরিয়ে যায়। সকাল হতেই মিষ্টি বলে ওঠে,
“ওহ, রাফার আবার স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। আমি তো বুঝতেই পারলাম না। তুমি যাও ঘুমিয়ে পড়ো।”
“আচ্ছা, আপু।”

বলেই মিষ্টি কিচেনের দিকে চলে যায়। আর দৃঢ়তা গেস্টরুমের দিকে৷ বিছানায় শুইয়ে পড়তেই তার ঘুম পেয়ে যায়। আর নিজেদের জীবনের দুঃখগুলোর স্মৃতিচারণ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। এদিকে মিষ্টি কিচেনে গিয়ে রান্না করতে করতে ভাবে,
“আমার জীবনেও তো এক সময় কত কষ্ট ছিল৷ রাফসানকে ছাড়া কত দিন থাকতে হয়েছে;নিজের মেয়ে টাকেও একা মানুষ করতে হয়েছে৷ তবে সেসব কষ্টের দিন অতিক্রম করে আজ আমি অনেকটাই সুখী হতে পেরেছি। আশা করি, দৃঢতাও এভাবে এক সময় না এক সময় সুখের দেখা পাবে। তবে তার জন্য ওর জীবনে এক জন ভালো মানুষ আসা দরকার যে নিজের সবটা দিয়ে ওকে আগলে রাখবে। জাবিরের কাছ থেকে ও যতোটা কষ্ট পেয়েছে সব কষ্ট দূর করে দেবে এমন কেউ।”

মিষ্টির ভাবনার মাঝেই তার স্বামী রাফসান হঠাৎ পেছন থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। মিষ্টি বলে ওঠে,
“তুমি আর শোধরালে না..”

“আর শোধরাতেও চাই না।”

দুজনেই হেসে ওঠে।

★★
ইউভান গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ করে দৃঢ়তার ভাবনায় হারিয়ে যায়। তার চোখের সামনে দৃঢ়তার ভীত ভীত মুখশ্রী ভেসে ওঠে। সেসব ভেবেই ইউভান বলে ওঠে,
“মেয়েটা অনেক নিষ্পাপ। ওর চোখে মুখে একটা নিষ্পাপ প্রভা রয়েছে…আজকাল কার যুগেও এত নিষ্পাপ মেয়ে হয়? আমার তা জানা ছিল না।”

ইউভান হঠাৎ নিজের জীবনের ব্যাপারে ভাবে। ছোটবেলা থেকে সে বড় হয়েছে চট্টগ্রাম শহরের এক অনাথ আশ্রমে। নিজের মা-বাবার পরিচয়ও সে জানে না। তাই জীবনে কখনো ভালোবাসার স্পর্শ পায় নি। স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি লাইফেও তার ভালোবাসার কেউ ছিল না। হাতে গোণা দুই এক জন বন্ধু ছিল। তার থেকে বেশি কিছু নয়৷ তবে কর্মজীবনে আসার পর রাফসান ও মিষ্টি তাকে ভাইয়ের মতো ভালোবেসেছে যা তার মন কেড়েছে। আর আজ এতদিন পর প্রথম কোন মেয়েকে দেখে তার মনে অন্যরকম একটা অনুভূতি হচ্ছে। ইউভান নিজের বুকের বা পাশে হাত রেখে বলে,
“কেন এমন অনুভূতি হচ্ছে আমার? এর পেছনে কি কোন কারণ আছে?”

এই প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পায় না ইউভান৷ তার খুব ভালো লাগছিল এভাবে দৃঢ়তা র কথা ভাবতে। তাকে নিয়ে চিন্তা করে যেন ইউভান এক আনন্দের জগতে হারিয়ে যাচ্ছিল৷ এভাবে গাড়ি চালাতে চালাতে সে এক সময় নিয়ন্ত্রণ হারাতে চলেছিল এমন সময় হঠাৎ করে সে নিজেকে সামলে নেয় আর বলে,
“উফ এই যাত্রায় বেচে গেলাম। নাহলে মেয়েটা নিয়ে স্বপ্ন দেখেই সাধ মেটাতে হতো। নিজের করে আর পাওয়া হতো না।”

বলেই নিজের মাথা চুলকায়। তারপর নিজের ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হয়। এভাবে অল্প পরিচয়ে কোন মেয়ের ব্যাপারে এভাবে কি ভাবা যায় নাকি?

★★
জাবির সকাল সকাল ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে বাড়িতে ফিরল। তার মুখশ্রী একেবারে মলিন। সে এসেই চুপচাপ সোফায় বসে পড়লো। আনিকা চৌধুরী জাবিরকে দেখেই এগিয়ে এসে বললেন,
“কি হলো তোমার? পেলে ওকে খুঁজে?”

“না। পাইনি।”

“আমি আগেই জানতাম। যে নিজের ইচ্ছায় হারায় তাকে খোঁজ করা বৃথা। দৃঢ়তা মনে যতটা কষ্ট নিয়ে এই বাড়ি থেকে গেছে ও নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথাও নেই৷ অনেক দূরেই কোথাও গেছে। আর ও ফেরার জন্য তো যায়নি। চলে যাওয়ার জন্যই গেছে। আর আসবে না ও। হয়তো কোন এক সময় আসবে তবে এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে নয়, ভাঙতে। আর আমিও সেটাই চাই।”

“চাচি! এমন কথা বলো না দয়া করে। দৃঢতাকে ফিরতেই হবে আমার কাছে। আমি নিজের সব অপরাধ স্বীকার করছি কিন্তু এখন তো আর তা শোধরানোর সময় নেই। ওকে শুধু একবার ফিরতে দাও তারপর আমি আগে ওকে যত কষ্ট দিয়েছি এখন ওকে ঠিক ততোটাই ভালোবাসা দিয়ে ওর মন জয় করব।”

“সে সুযোগ আর ও তোমায় দেবে না জাবির। আর না ভাগ্য তোমায় দেবে। আমার কেন জানি মনে হয়, দৃঢ়তার মতো এত ভালো একটা মেয়ের জীবনে আল্লাহ নিশ্চয়ই অনেক ভালো কিছু লিখে রেখেছে। তোমার মতো কেউ ওকে ডিজার্ভ করে না। ও ভালো কাউকেই পাবে।”

” নাহ, দৃঢ়তা শুধু আমারই হবে। ও এই পৃথিবীর যে প্রান্তে ই লুকি এ থাকুক না কেন ওকে আমি ফেরত আনবোই। গোটা পৃথিবীর বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও ওকে নিজের করে নেবো।”

উপর থেকে আমিনা চৌধুরী ও ললিতা চৌধুরী তার সমস্ত কথা শুনতে থাকে। ললিতা চৌধুরী কান্নারত স্বরে বলেন,
“দেখছেন তো আম্মা? কিভাবে আমার ছেলেটার মগজধোলাই করতে চাইছে। আমার যেই ছেলেকে ঐ দৃঢ়তা কে সহ্য করতে পারছে না সে এখন ঐ মেয়েটাকেই বিয়ে কর‍তে চাইছে। এর একটা বিহিত করুন আপনি।”

মান্যতাকে আমি আর কিছুতেই এই বাড়িতে ফিরতে দেবো না ছোট বৌমা। আর সে জন্য কি করতে হবে তা আমার আগে থেকেই চিন্তা ভাবনা করা আছে। তুমি শুধু আমার কথা মতো কাজ করো।”

“বলুন আমায় কি কর‍তে হবে।”

“তুমি তোমার ছেলেকে গিয়ে বলো আমি অনেক অসুস্থ বাকিটা আমি সামলে নেবো।”

“আচ্ছা।”

★★
জাবির বসে আছে আমিনা চৌধুরীর মাথার কাছে। আমিনা চৌধুরী গোঙাতে গোঙাতে বলেন,
“আমি বোধহয় আর বাঁচব না দাদুভাই..”

জলিল চৌধুরীও ছিলেন সেখানে৷ তিনি বলেন,
“এমন কথা বলবেন না আম্মা। আপনার কিছু হবে না।”

ললিতা চৌধুরীও বলেন,
“হ্যাঁ, আম্মা। আপনি একদম ঠিক হয়ে যাবেন।”

আনিকা চৌধুরী দূরে দাঁড়িয়ে আমিনা চৌধুরীর এসব কাণ্ড দেখে মনে মনে বলেন,
“ইনি যে ধরনের মানুষ এত সহজে তো মরবে বলে মনে হয় না। মরার হলে অনেক আগেই মর তো তখন অনেকের জীবন বেচে যেত। জানি না এ নতুন কোন নাটক।”

আমিনা চৌধুরী বলে ওঠেন,
“আমি মরে গেলেও আমার কোন আক্ষেপ থাকবে না যদি আমার একটা শেষ ইচ্ছা পূরণ হয়। আমার অনেক দিনের পুরাতন বান্ধবী গুলশেনারা, গুলশেনারার একমাত্র ছেলে আবিরের একমাত্র মেয়ে মোহনা। মেয়েটা অনেক ভালো। লন্ডনে পড়াশোনা করে। কিছু দিন আগেই লন্ডন থেকে ফিরেছে৷ ভীষণ ভালো মেয়ে। আমার আর আমার বান্ধবীর আগে থেকেই ইচ্ছা ছিল আমাদের নাতি-নাতনীর বিয়ে দেব। কিন্তু জাবিরের মান্যতাকে পছন্দ ছিল তাই..কিন্তু এখন যখন বিয়েটা হয়নি তখন আমি চাই মোহনার সাথেই জাবিরের বিয়ে হোক। নাহলে যে আমি নিজের বান্ধবীকে দেয়া কথা রাখতে পারবো না।”

জাবির বলে ওঠে,
“এটা সম্ভব না।”

“এটা আমার শেষ ইচ্ছা জাবির। তুমি যদি আমার কথা না রাখো তো আমি খাওয়া দাওয়া সব বন্ধ করে দেব আর দুদিন পর এমনিই মরব।”

“দাদি! তুমি আমায় ব্ল্যাকমেইল করছ।”

ললিতা চৌধুরী বলেন,
“চুপচাপ রাজি হ। নাহলে তোর দাদির মৃত্যুর জন্য তুই দায়ী হবি।”

জলিল চৌধুরীও জাবিরকে ফোর্স করতে থাকেন। জাবির তাই এক সময় রাজি হয়ে বলে,
“বেশ, আমি তোমার পছন্দের মেয়ে মোহনাকেই বিয়ে করব দাদি। তুমি সুস্থ হও শধু।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨