ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-১৯

0
2

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ১৯
#লেখিকা_দিশা_মনি

দৃঢ়তা রাফাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মেয়েটা অনেক মিষ্টি আর দৃঢ়তার সাথে বেশ ভাব জমে গেছে। মিষ্টি দৃঢ়তাকে রাফসানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলে,
“এই দেখো দৃঢ়তা, যার কথা তোমাকে বলেছিলাম একদিন। কাল তো ও ঘুমাচ্ছিল তাই তোমার সাথে আর দেখা হয়নি। জানো, মেয়েটার জীবনে না অনেক কষ্ট।”

রাফসান দৃঢ়তার উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“তোমার ব্যাপারে তোমার মিষ্টি আপুর কাছে অনেক কিছুই শুনেছি। শোনো, তোমায় কিন্তু নিজের নামের মতো দৃঢ় হতে হবে৷ নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করো। আর চাইলে মিষ্টির কাছে ট্রেনিং নিতে পারো। ও তোমায় একদম শক্ত হতে শিখিয়ে দেবে। ফ্রান্সে থাকতে ও যা ফাইট করেছে না..আর ভীষণ জেদী, তেজিও ছিল।”

“হয়েছে, হয়েছে এসব আর বলতে হবে না। দৃঢ়তা, তুমি তো এখনো কিছু খাওনি, যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি তোমার জন্য কিছু বানিয়ে আনছি।”

দৃঢ়তা মাথা নাড়ায়। অতঃপর মিষ্টি রাফাকে নিজের কোলে নিয়ে বলে,
“আন্টিকে যেতে দাও। আন্টি এখন ব্রেকফাস্ট করবে।”

রাফাও ভদ্রমেয়ের মতো বলে,
“ওকেই।”

দৃঢ়তা উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর ফ্রেশ হয়ে যায়। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে রাফাকে নিয়ে মিষ্টি ও রাফসান কতোটা আনন্দ করছে। একে অপরের সাথে কতোটা খুশি। তাদের দেখে মিষ্টি একইসাথে আনন্দ পায় আবার তার বুক চিরে দীর্ঘ শ্বাসও বের হয়। দৃঢ়তা আনমনে বলে,
“আমিও তো এভাবেই সুখী হতে পারতাম! যদি মিস্টার জাবির…নাহ, এসব কেন ভাবছি আমি। উনি নিশ্চয়ই এখন মান্যতা আপুর সাথে অনেক সুখী আছেন। ওনার সুখে আমার নজর না লাগুক। আমি একাই ভালো আছি, এভাবেই নিজেকে গড়ে নিতে হবে আমায়।”

বলেই দৃঢ়তা সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

★★
জাবির মন ভাড় করে বসে আছে বিয়ের আসরে। বেশ ছিমছাম ভাবেই বিয়ের আয়োজন করেছেন আমিনা চৌধুরী। কারণ তিনি আর লোক হাসাতে চান নি। মোহনার বাবাকে সামলানোর জন্য বলেছেন, তিনি অনাড়ম্বর ভাবেই বিয়েটা দিতে চান। মোহনার বাবাও এতে নারাজ হন নি।

আমিনা চৌধুরীর খুশি আজ আর ধরে না। সমস্ত অসুস্থতার নাটক যেন আজ শেষ। ললিতা চৌধুরীও আজ ভীষণ খুশি। তিনি আমিনা চৌধুরীর পাশে দাঁড়িয়ে বলেন,
“দেখছেন আম্মা,এতদিনে আমার ছেলেটা একজন যোগ্য জীবনসঙ্গী পেতে চলেছে। ঐ দৃঢ়তা বা মান্যতা কেউই আমার ছেলের যোগ্য ছিল না৷ মোহনাই আমার যোগ্য বৌমা হবে।”

আমিনা চৌধুরীও মাথা উঁচু করে বলেন,
“ঠিক বলেছ তুমি। আমার পছন্দের মেয়েই এই বাড়ির সেরা বৌমা হয়। যেমন তুমি। আর যাদের আমি পছন্দ করি না তারা..”

বলেই তিনি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা আনিকা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
“তারা জীবনে কখনো সুখ পায় না। আর কারো কারো তো সুখ পাওয়ার জন্য জীবনটাও অবশিষ্ট থাকে না।”

মোহনা বিয়ের আসরে বসে জাবিরের দিকেই তাকিয়ে আছে। ছেলেটাকে ভীষণ অন্যমনস্ক লাগছে। অবশ্য মোহনার নিজেরও ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। এভাবে হঠাৎ করে যে অচেনা একজনকে বিয়ে করতে হবে সেটা তার কল্পনাতেও আসে নি। সবটাই মূলত তার বাবার জন্য। মোহনার বড় বোন লন্ডনের একজন স্থানীয় খ্রিস্টান ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। যার ফলে মোহনার বাবা ভীষণ রাগ করেন। মোহনা যখন অনেক ছোট ছিল তখন তার মা মারা যায়৷ তারপর বাবাই তাদের দুই বোনকে মানুষ করেছে। মোহনার বড় বোন আর মোহনা দুজনেই লন্ডনে বাবার অনেক ভালোবাসায় আধুনিক ও স্বাধীনচেতা ভাবে বড় হয়েছে। কিন্তু সেই অতিরিক্ত স্বাধীনতাই যেন তাদের জীবনে কাল হলো। মোহনার বোন যেদিন ঐ খ্রিস্টান ছেলেটিকে বিয়ে করে সেদিনই মোহনার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়। তিনি ভীষণ আফসোস করতে থাকেন মেয়েদের এতোটা স্বাধীনতা দেয়ার জন্য। যার ফলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তিনি এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর হতে দেবেন না। আর সেজন্যই তড়িঘড়ি করে মোহনাকে নিয়ে দেশে চলে আসেন আর মোহনার বিয়ে ঠিক করেন। মোহনাও নিজের বাবার শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে আর না করে নি। খুব তাড়াহুড়ো করেই তার আর জাবিরের বিয়ে ঠিক হলো এবং দিনকয়েকের মাঝেই বিয়েও ঠিক হয়ে গেলো। মোহনা বা জাবির কেউই একে অপরকে চেনার বা জানার কোন সুযোগ পেল না। যদিও মোহনার বাবা তাকে বলেছেন, তাদের সময় নাকি এভাবেই বিয়ে হতো। মোহনার তখন খুব বলতে ইচ্ছা করছিল যে এখন তো যুগ পাল্টেছে। কিন্তু মোহনা জানত সে এমনটা বললেই তার বাবা তার বোনের ঘটনাটা নিয়ে খোটা দিত। তাই মোহনাও আর কিছু বলে নি৷ মোহনার বাবার মনেও একটা দুশ্চিন্তা ছিল যে তার বোনের ব্যাপারটা জানাজানি হলে হয়তো চৌধুরী পরিবারের মতো এত ভালো পরিবারে মোহনার আর বিয়ে হবে না। কিন্তু তিনি তো আর জানতেন না যে,চৌধুরী পরিবারের ছেলে জাবিরের জীবনে আরো কত বড় কেচ্ছা আছে।

“কবুল”

এই তিন বর্ণের শব্দটা উচ্চারণ করেই মোহনা ও জাবিরের বিয়ে সম্পন্ন হলো। মোহনা লক্ষ্য করল জাবির বেশ অন্যমনস্ক হয়ে কবুল বলল। যেন এই বিয়েটায় সে মন থেকে খুশি নয়। বিয়েটা হওয়ার পর যখন বড়দের সাথে কুশলাদি বিনিময় করা হলো তখনও পুরো সময়টা জাবির নির্জীব ছিল। এসব দেখে মোহনার বুকচিরে দীর্ঘ শ্বাস বের হলো। তাহলে কি বোনের করা ভুলের শাস্তি দিতে গিয়ে মোহনার বাবা তাকে কোন এক নরকের দিকে ঠেলে দিল।

★★
দৃঢ়তা খাবার খেয়ে সবেমাত্র বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছিল৷ এমন সময় কারো উপস্থিতি উপলব্ধি করে পেছন ফিরে তাকায়। ইউভানকে দেখে খানিকটা অবাক হয়ে বলে,
“আপনি?”

ইউভান দৃঢ়তার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“আপনার খোঁজ নিতে এলাম। আপনি ঠিক আছেন তো?”

“জ্বি।”

মৃদুস্বরে বলে দৃঢ়তা আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ইউভান দৃঢ়তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“আপনার চোখের দিকে তাকালেই কেন জানি মনে হয় আপনি এই দুচোখে হাজারো কষ্ট লুকিয়ে রেখেছেন।”

দৃঢ়তা বলে,
“সকল মানুষেরই জীবনে কষ্ট আছে। এ আর নতুন কি৷ সবার জীবনেই অপূর্ণতা আছে।”

“ঠিক বলেছেন। জানেন, আমি নিজেও একটা অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। নিজের জীবনে কখনো পরিবারের ভালোবাসা পাইনি, তাই অপূর্ণতার যন্ত্রণা আমার থেকে ভালো আর কে বুঝবে।”

“দুঃখিত, আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাই নি।”

“ব্যাপার না।”

“জানেন,আমি যখন ৪/৫ বছরের ছিলাম আমার মা-বাবাও তখন এক দূর্ঘটনায় আমায় একা ফেলে রেখে চলে যায়। তবে আমার ভাগ্য একটু ভালো ছিল, আমার এক চাচি ছিল যিনি কখনো আমায় মায়ের অভাব বোধ করতে দেন নি।”

তারা দুজন এভাবেই একসময় একে অপরের দুঃখবিলাস করতে করতে কখন যে একে অপরের মাঝে হারিয়ে যায় টেরই পায়নি। এরমধ্যে গগণজুড়ে হাহাকার শুরু হয়। বৃষ্টি পড়তে শুরু করে দেয়। ইউভান বলে,
“কি করছেন? ভিতরে চলুন। এভাবে অকাল বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হতে পারে।”

“একটু ভিজতে দিন। এই বৃষ্টিতে ভিজলে না মন অনেক হালকা হয়। দুঃখগুলো লোপ পায়।”

“তাহলে তো আমারও এই বৃষ্টিতে ভেজা উচিৎ।”

“হুম, ভিজুন..”

দুজনে একসাথে সেই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে। দূর থেকে তাদের দেখে মিষ্টি আর হালকা হেসে বলে,
“এই দুই অভাগার জীবন যদি একসূত্রে গাঁথা পড়ে তাহলে বোধহয় দুজনেই জীবনে সুখের দেখা পাবে।”

★★
মোহনা একহাত ঘোমটা দিয়ে বাসর ঘরে বসে আছে৷ আমিনা চৌধুরী তাকে এখানে বসিয়ে দিয়ে গেছেন। মোহনা এখন চুপচাপ অপেক্ষা করে চলেছে তার সদ্য বিবাহিত স্বামী জাবিরের জন্য। এক, দুই, তিন..এভাবে ধীরে ধীরে সময় অতিবাহিত হয় কিন্তু জাবিরের আসার কোন নাম নেই। মোহনা যে কখন এভাবে ঘুমিয়ে পড়ে টেরই পায়না। সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন লক্ষ্য করে জাবির সারারাত আসেনি তখন তার বুকচিরে দীর্ঘ শ্বাস বের হয়। মলিন মুখে সে বাসর ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই এক বিধ্বস্ত জাবিরকে দেখতে পায়। যে গতকাল সারাটা রাত একটি বারে কাটিয়ে এসেছে। মোহনা তাকে দেখেই বলে,
“এ কি অবস্থা আপনার…”

জাবির বলে ওঠে,
“আমাকে একটু স্পেস দিন প্লিজ।”

বলেই সে রুমে প্রবেশ করে। মোহনা করুণ চোখে জাবিরের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨