ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-২০

0
2

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ২০
#লেখিকা_দিশা_মনি

দৃঢ়তা ইদানীং ইউভানের সাথে অনেক ভালো সময় অতিবাহিত করছে। ইউভানও দৃঢ়তার সাথে সময় কাটিয়ে ভালো বোধ করছে৷ তাদের এই ঘনিষ্ঠতা মিষ্টি ও রাফসানও লক্ষ্য করে। মিষ্টি ভাবে,
“দৃঢ়তা যদি ইউভানের মতো একটা ছেলের সঙ্গ পায় তাহলে জীবনে এগিয়ে যেতে পারবে। ওর অতীতের কালো ছায়া থেকেও বেরিয়ে আসতে পারবে। তাই আমাকেই কিছু করতে হবে ওদের মিল করানোর জন্য।”

এমন ভাবনা থেকেই সে রাফসানকে বলে,
“ইউভান দৃঢ়তার অতীতের ব্যাপারে বেশি কিছু জানে না। ওকে আমাদের সবটা জানানো উচিৎ। যদি সব শুনেও ও দৃঢ়তার প্রতি এই একই আগ্রহ বজায় রাখে তাহলে আমরা কিছু ভাবতে পারি।”

রাফসান বলে,
“কিন্তু আমি যতদূর জানি, দৃঢ়তার সাথে ওর প্রাক্তন স্বামীর এখনো ডিভোর্স হয়নি৷ তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব?”

“ডিভোর্স হয়নি তো কি হয়েছে? সামনে হবে। এত দুশ্চিন্তা করার মতো কিছু হয়নি। তাছাড়া দৃঢ়তার স্বামী তো এখন নিশ্চয়ই ওর বোন মান্যতাকে বিয়ে করে নিয়ে অনেক খুশিতে জীবনযাপন করছে। তাহলে দৃঢ়তা কেন শুধু শুধু কষ্টে থাকবে? ও কি একটু জীবনে সুখ ডিজার্ভ করে না?”

“সেটা অবশ্য তুমি ঠিক বলেছ। আমি ইউভানকে সবটাই খুলে বলবো।”

এদিকে দৃঢ়তা ও ইউভান আজকের প্রকৃতি নিয়ে গল্প করছিল৷ হঠাৎ কথায় কথায় ইউভান বলে ওঠে,
“আচ্ছা, আপনার জীবনে কি কখনো ভালোবাসা এসেছিল?”

কথাটা শোনামাত্রই দৃঢ়তার মুখে স্থবিরতা নেমে আসে। মনে পড়ে যায়,অন্ধকারাচ্ছন্ন অতীত। তার চোখে অশ্রুবিন্দু জমে। ইউভান সেটা খেয়াল করে বিনীত স্বরে বলে,
“দুঃখিত, হয়তো আমার জন্য আপনার কোন বাজে অতীত মনে পড়ে গেল..”

দৃঢ়তা বলে,
“তেমন কিছু না। সবার জীবনে তো আর ভালোবাসা আসে না। কারো কারো জীবনে এমন কিছু আসে যা তার ভালো থাকাটাই নষ্ট করে দেয়। এমনি কিছু হয়েছিল আমার সাথেও। আমার জীবনে এমন একজন এসেছিল যে আমার ভালোবাসা নয় আমার ভালো থাকাই নষ্ট করে দিয়েছিল।”

অতঃপর দৃঢ়তা তার জীবনের সমস্ত ঘটনা, জাবিরের সাথে তার বিয়ে, তারপর জাবিরের অত্যাচার, মান্যতার ফিরে আসা,দৃঢ়তার চলে আসা সব ঘটনাই বলে। সব শুনে ইউভান হতবাক হয়ে যায়। বলে,
“তার মানে আপনি বিবাহিত?”

“হ্যাঁ। মিস্টার জাবিরের সাথে এখনো আমার ডিভোর্স হয় নি। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ৬ মাস পর ফিরে গিয়ে ওনাকে ডিভোর্স দিব৷ তারপর নিজের নতুন জীবন শুরু করব। যে জীবন হবে আমার, শুধুই আমার।”

ইউভান হঠাৎ বলে ওঠে,
‘সেই জীবনে কি আপনার কোন সঙ্গীর প্রয়োজন?’

ইউভানের কথা শুনে দৃঢ়তা অবাক চোখে তার দিকে তাকাতেই ইউভান হেসে বলে,
“যদি সঙ্গীর প্রয়োজন হয় আমাকে বলতে পারেন। আমি আপনার বন্ধু হয়ে আপনার পাশে থাকব।”

দৃঢ়তা কিছুই বলে না৷ তার কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হয়৷ তাই সে স্থানত্যাগ করে। দৃঢ়তা যাওয়ার পরই রাফসান এসে ইউভানের কাধে হাত রাখে। জিজ্ঞেস করে,
“সবই তো শুনলে দৃঢ়তার মুখে। ওর জীবনের দুঃখের অতীতও জানলে৷ আমি আর তোমার ভাবি কিন্তু ওর প্র‍তি তোমার আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। তুমি যে ওকে পছন্দ করতে শুরু করেছ তা তোমাকে দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায়৷ এখন বলো, সবটা জানার পরও কি তুমি একইভাবে ওকে পছন্দ করো যেমনটা আগে করতে?”

ইউভান একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“না।”

রাফসান ইউভানের উত্তর শুনে অবাক হয়৷ ইউভান বলে,
“আমি এখন দৃঢ়তাকে আগের থেকেও বেশি ভালোবাসি৷ যতদূর বুঝলাম, ওনার জীবনে সুখের বড়ই অভাব। এত সংগ্রাম করেও উনি নিজের না, অন্যের কথা ভেবেছেন। যেই বোন তাকে ঠকিয়েছেন সেই বোনের জন্য এত দূরে এসে বিপদে পড়লেন। এমন মেয়ে লাখে একটা থাকে৷ যেই লোকটা এত ভালো একটা মেয়ের মূল্য দিতে পারেনি তিনি নিঃসন্দেহে এই পৃথিবীর সবথেকে বড় অভাগা। কিন্তু আমি সেই ভুল করব না। উনি জীবনে যতো দুঃখ পেয়েছেন সেই দুঃখ ভুলে আমি ওনার জীবনে একটু সুখের পরশ আনার চেষ্টা করব।”

ইউভানের উত্তর শুনে রাফসান প্রসন্ন হয়।

★★
মোহনা নিজের রুমে বসে আছে। তার আর জাবিরের বিয়ের এক সপ্তাহেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এই এক সপ্তাহে জাবির এক মুহুর্তের জন্যেও তার দিকে ফিরেও তাকায় নি। তাকে সবসময় অবহেলা করেছে। প্রথমদিকে ধৈর্য ধরে থাকলেও মোহনা আর ধৈর্য ধরতে পারে না। সে এবার ঠিক করে নিয়েছে জাবিরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। জানতে চাইবে এতো অবহেলার কারণ কি। সেই উপলক্ষেই সে ঘরে বসে আছে।

মোহনা বসে বসে জাবিরের কথাই ভাবছিল এমন সময় জাবির চলে আসে। জাবির আসতেই মোহনা বলে ওঠে,
“আপনি এসেছেন। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। আপনার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।”

জাবির মোহনার কথায় কোন পাত্তা না দিয়েই নিজের ব্লেজার খুলে রেখে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে। মোহনা ভীষণ অপমানিত বোধ করে। তার চোখে জল জমে। এমন সময় সে জাবিরের ব্লেজারটা হাতে নেয়। ব্লেজারের পকেটে একটা ছবি দেখেই সে হতবাক হয়। পকেট থেকে ছবিটা বের করেই দেখতে পায় একটা মেয়ে(দৃঢ়তার) ছবি। যা দেখেই মোহনা বলে ওঠে,
“এই তাহলে সেই কারণ যার জন্য উনি আমায় এভাবে ইগ্নোর করছেন। ওনার অন্য একটা মেয়ের সাথে এফেয়ার চলছে..”

জাবির ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসতেই মোহনা গিয়ে জাবিরের শার্টের কলার চেপে ধরে বলে,
“আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে বিয়ে করে পরকীয়া করার? আমি এতদিন চুপ ছিলাম জন্য কি ভেবেছেন? আমি সব মুখ বুঝে মেনে নেবো? আমি লন্ডনে বড় হয়েছি। আমি কি করতে পারি, সেই সম্পর্কে আপনার কোন আন্দাজ নেই। এতদিন আমার ভালো রূপ দেখেছেন, এবার খারাপ রূপ দেখবেন।”

“এসব কি বলছেন আপনি? আমার কলার ছাড়ুন।”

“ছাড়বোনা! আগে বলুন এই মেয়েটা কে?”

জাবির মোহনার হাত থেকে ছবিটা কেড়ে নিয়ে বলে,
“আপনার ম্যানার্স নেই? এভাবে অন্যের জিনিস চেইক করেন।”

“ভাগ্যিস চেইক করেছিলাম। নাহলে তো কোন কিছুই জানতে পারতাম না।”

এরমধ্যেই এত সব চিৎকার চেচামেচি শুনে আনিকা চৌধুরী, আমিনা চৌধুরী, ললিতা চৌধুরী সবাই ছুটে আসেন। ললিতা চৌধুরী এসেই বলে ওঠেন,
“কি হয়েছে? এভাবে চেচাচ্ছ কেন তোমরা?”

মোহনা বলে ওঠে,
“কি হওয়া বাকি রেখেছে আপনার ছেলে? বিয়ের পর থেকেই আমাকে ইগ্নোর করে চলেছে। আর আজ আমি জানলাম উনি আমাকে ঠকাচ্ছেন। আমাকে বিয়ে করে বাইরের একটা মেয়ের সাথে..”

জাবির রাগী কন্ঠে বলে ওঠে,
“চুপ করুন আপনি। দৃঢ়তা কোন বাইরের মেয়ে নয়। ও আমার স্ত্রী!”

জাবিরের কথাটা শুনে সবাই হতবাক হয়ে যায়। আমিনা চৌধুরী ঘামতে শুরু করেন। আনিকা চৌধুরী মনে মনে ভাবেন,
“এটা তো হওয়ারই ছিল। এবার দেখব, আমিনা চৌধুরী কি করেন।”

মোহনা বলে,
“স্ত্রী মানে? তাহলে আমি কে?”

“আপনি একটা বোঝা। যাকে আমার দাদি আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে।”

আমিনা চৌধুরী এগিয়ে এসে বলেন,
“দাদুভাই! এসব কি বলছ তুমি? চুপ করো। মোহনা তোমার স্ত্রী, ওকে তুমি বিয়ে করেছ। আগের কথা ভুলে যাও।”

“কেন ভুলে যাব দাদি? আমি কিছু ভুলব না। তুমি তো সেই সময় অভিনয় করে আমাকে মোহনাকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলে৷ আজ সেটা আমার কাছে পানির মতো পরিস্কার। কিন্তু এই বিয়েটা আমি মন থেকে করিনি। আমি এখন শুধু দৃঢ়তাকেই ভালোবাসি আর ওনাকেই নিজের স্ত্রী হিসেবে মানি। অন্য কাউকে নয়।”

বলেই জাবির মোহনার সামনে গিয়ে হাতজোড় করে বলে,
“আপনার সাথে যা হয়েছে তার জন্য দুঃখিত কিন্তু আপনাকে স্ত্রীর মর্যাদা দেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। ৬ মাস পর, দৃঢ়তা আবার ফিরে আসবে। তারপর আমি ওকে আবার আপন করে নেবো। আপনার যত টাকা লাগবে বলবেন, প্রয়োজনে আমার সব সম্পত্তি আপনার নামে করে দেবো তবুও এই সম্পর্ক থেকে আমায় মুক্তি দিয়েন প্লিজ।”

বলেই জাবির চলে যায়। এদিকে মোহনা সত্য জেনে ভীষণ আঘাত পায়৷ নিজের প্রতি হওয়া প্রতারণার কথা ভেবে ফ্লোরে বসে কাঁদতে থাকে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨