ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-২৩

0
2

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ২৩
#লেখিকা_দিশা_মনি

দৃঢ়তা চুপচাপ বসে সমুদ্রের পানে চেয়ে আছে। তার ঠিক একটু পাশেই চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে ইউভান। চোখে তার রোদ চশমা। দৃঢ়তাকে এত স্তিমিত দেখে ইউভান বলে ওঠে,
“এভাবে থাকলে তো আপনি সমুদ্রের সৌন্দর্যটাকে কাছ থেকে উপভোগ করতে পারবেন না। যদি মজা করতে চান তাহলে কাছে যান। দেখুন রাফা, মিষ্টি আপু,রাফসান ভাই কতোটা এনজয় করছে।”

দৃঢ়তা একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“আজকাল কেন জানি আনন্দ পালন করতেও ভীষণ ভয় লাগে! না জানি কখন কোন দিক থেকে বিপদ এসে হাজির হয়।”

“এত বিপদের ভয় পেলে জীবনে সুখ আর পাবেন কই? আসুন আমার সাথে। সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করি একসাথে।”

দৃঢ়তা কেন জানি চেয়েও মানা করতে পারল না। ইউভান যখন তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো তখন সে না চাইতেও হাতটা ধরে ফেলল। এই হাতটা ধরে যেন ভীষণ ভরসা পাচ্ছে সে। অতঃপর ইউভানের হাতটা ধরেই এগোতে লাগল সামনের দিকে।

কিছুটা দূরে গিয়েই ইউভান দৃঢ়তাকে সমুদ্রের মাঝখানে দাড় করিয়ে বলল,
“এবার নিজের সব দুঃখ এই সমুদ্রের অফুরন্ত পানির মাঝে বিসর্জন করে দিন তো। তাহলে দেখবেন, আর কষ্ট লাগবে না।”

দৃঢ়তা চোখ বন্ধ করে তাই করার চেষ্টা করে। এই গভীর সমুদ্রেই ভাসিয়ে দিতে চায় তার দুঃখ গুলো। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব?

★★
থমথমে মুখে হোটেলে বসে আছে জাবির। না চাইতেও আজ তাকে কক্সবাজারে আসতে হয়েছে ঐ মোহনার সাথে। মেয়েটাকে তার একদমই সহ্য হয় না। জাবির বারবার ঘড়িতে সময় দেখছে। মোহনা এসে থেকে যে সেই ওয়াশরুমে গেছে এখনো বের হবার সময় নেই। এরমধ্যে হঠাৎ করে ওয়াশরুম থেকে বেশ সেজেগুজে বের হলো মোহনা। মোহনাকে দেখে জাবির অবাক স্বরে বলল,
“আপনি এত সেজেছেন কেন?”

মোহনা বলে,
“বা রে! এত দূর ঘুরতে এসেছি আর একটু সাজবো না। একটু ঘুরে সমুদ্র থেকে। এই প্রথম আমি বাংলাদেশের কোন টুরিস্ট স্পটে এসেছি। যদিও এর আগে ইউরোপের অনেক সি বিচে আমি গেছি তবে নিজের দেশের সি বিচে প্রথমবার। তাই একটু অন্যরকম ফিল হচ্ছে।”

“তো যান গিয়ে ঘুরে আসুন।”

“কেন? আপনি যাবেন না?”

“না।”

স্পষ্ট জানিয়ে দিলো জাবির। মোহনা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“না গেলে না যাবেন৷ আপনাকে তো আমি জোর করব না। আপনি এখানেই বসে থাকুন তাহলে আমি গেলাম।”

বলেই মোহনা বেরিয়ে যায়। জাবির চুপচাপ বসে থাকে। কিছু সময় পর তার নিজেরও আর ভালো লাগে না এভাবে বসে থাকতে। তাই সে ভাবে,
“ঐ মোহনা তো নিজের মতো বেরিয়ে গেল, এখন আমিও যাই। এভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। একটু ঘুরে আসি, তাহলে মনটা ফ্রেশ হবে ”

এমন ভাবনা থেকেই জাবির বেরিয়ে পড়লো একা।

মোহনা সমুদ্রে ঘুরতে এসে ভীষণ আনন্দ বোধ করছিল। সমুদ্রের বিশাল জলরাশি তার ভীষণ ভালো লাগছিল৷ যদিও এখানকার পানি, তার দেখা সমুদ্র গুলোর মতো ওতোটা পরিস্কার নয় তবুও নিজ দেশের উপর দিয়ে বয়ে চলা এই সমুদ্রবন্দর তার কাছে বড্ড প্রিয় ঠেকল। ইচ্ছা করল একটা ডুব দিয়ে আসার। এমন সময় সে লক্ষ্য করে দূরে দাঁড়িয়ে এক ছেলে আর এক মেয়ে(ইউভান ও দৃঢ়তা)। দুজন একসাথে এই সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কিসব যেন কথা বলছে। তাদের একসাথে কতই না সুন্দর লাগছে। এটা দেখে মোহনার ভীষণ ভালো লাগে। মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে তার ভীষণ সুপুরুষ মনে হয়। কি সুন্দর নিজের সঙ্গীনীর যত্ন নিচ্ছে সে। রোদ যাতে তাকে স্পর্শ করতে না পারে সেজন্য হাত তার মাথার উপর রেখেছে। নিজের জন্যেও তো এমনই একজনকে চেয়েছিল মোহনা। সে তাকে সব বিপদ আপদ থেকে আগলে রাখবে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আজ এমন একজন সঙ্গীকে তার বরণ করে নিতে হয়েছে যে কিনা…

আর ভাবতে পারল না মোহনা। সবসময় শক্ত থাকা মেয়েটার মনও এবার নরম হয়ে গেল। নিজের বাবার একটা ভুল সিদ্ধান্ত তার জীবনটা যেন তছনছ করে দিয়েছে। এসব ভেবে তার কান্না পেয়ে গেল। এখানে তার চেনাজানা কেউ নেই তাই এত দিনের জমিয়ে রাখা কান্নাগুলো সব একসাথে প্রকাশ পেল।

এদিকে, সমুদ্রের পানিতে দৃঢতাকে মজা করতে দেখে ইউভানের ভীষণ ভালো লাগছিল। সে বলে ওঠে,
“আপনাকে সবসময় এভাবেই সুখী দেখতে চাই দৃঢ়তা। এই সুখটুকু আপনি ডিজার্ভ করেন।”

এমন সময় হঠাৎ করে দৃঢ়তা পড়ে যেতে নিতেই ইউভান তাকে ধরে নিয়ে বলে,
“সাবধান! সামলান নিজেকে।”

দৃঢ়তা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“ধন্যবাদ। আপনি না থাকলে যে কি হতো.?”

“কোন ব্যাপার না। আপনার যেকোন বিপদে আমি ঢাল হয়ে দাঁড়াবো, কথা দিলাম।”

দৃঢ়তা আর কিছু বলতে যাবে এমন সময় রাফা সেখানে চলে এসে দৃঢ়তার হাত করে ধরে বলে,
“আন্টি এদিকে এসো..দেখবে কি সুন্দর একটা কচ্ছপ।”

দৃঢ়তা রাফার সাথে যায়। ইউভান তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।

★★
মোহনা একা একাই কিছু সময় সমুদ্রসৈকতে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করেই একটা ফাঁকা স্থানে চলে আসে। মোহনা এতোটাই বেখেয়ালি ছিল যে লক্ষ্যই করেনি এত সময় ধরে কিছু লোক তাকে অনুসরণ করছিলো গোপনে। এই সুযোগটাকেই তারা কাজে লাগালো। মোহনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার সামনে এসে দাঁড়ালো। মোহনা হঠাৎ এভাবে কিছু অচেনা মানুষকে দেখে হতবাক স্বরে বলল,
“এ কি! কারা আপনারা?”

তারা মোহনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হঠাৎ করে তার মুখে চেপে ধরল। আরেকজন একটা ধারালো ছুরি বের করলো। সামনে কি হতে পারে সেটা বুঝতে পেরেই মোহনার বুক কেপে উঠল। সে চোখ বন্ধ করে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালাকে স্বরণ করতে লাগল। বলল,
“হে আল্লাহ! আমাকে রক্ষা করুন। আজ কি তাহলে এখানেই সবটা শেষ হয়ে যাবে!”

★★
দৃঢ়তা রাফাকে নিয়ে সামুদ্রিক মাছের আড়তের কাছাকাছি চলে যায়। এই স্থানে বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রজাতির মাছ বিক্রি করা হচ্ছিল। রাফা এসব দেখে খুশি হয়ে যায়। দৃঢ়তারও ভালো লাগছিল। রাফা তো বিভিন্ন মাছের নাম জানতে চাইছিল, দৃঢতা ফোন ঘেটে তাকে সব মাছের নাম বলছিল। এভাবেই মাছের আড়তে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে দৃঢ়তা থমকে যায়। তার সামনে দাঁড়ানো পুরুষটিরও অবস্থা কিছুটা একই!

দীর্ঘ ৩ মাস! ৩ মাস পর এভাবে যে কক্সবাজারে এসে দৃঢ়তার মুখোমুখি হবে তা কল্পনাও করেনি জাবির। যাকে সে এতো খুঁজে বেড়াচ্ছিল তাকে কিনা এভাবে দেখতে হলো। জাবির কোন অনুভূতিই প্রকাশ করতে পারলো না। সে একাধারে খুশি ও অবাক। এদিকে দৃঢ়তা ভীষণ অস্বস্তিকর এক পরিবেশে পড়লো। জাবিরকে দেখেই সে চোখ নামিয়ে রাফাকে নিয়ে অন্যদিকে যাইতে চাইল৷ এমন সময় জাবির দৌড়ে এসে দৃঢ়তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“দৃঢ়তা তুমি এখানে! তুমি জানো না আমি তোমায় এতদিন কত খুঁজেছি। অবশেষে তোমার দেখা পেলাম। আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি দৃঢ়তা, তোমার মতো হিরার মূল্য বুঝতে পারিনি। যার ফল আমায় পেতে হয়েছে। তবে এবার আর সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না। তোমাকে আমি নিজের করে নেবোই।”

জাবিরের বলা কথা গুলো শুনে দৃঢ়তা একটা স্থবির হয়ে যায়৷ কি বলছে এসব জাবির? দৃঢ়তা বুঝে উঠতে পারে না। সে নিজেকে জাবিরের থেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই জাবিরের শক্ত বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে না।

কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় ইউভান। সে এসেছিল রাফা ও দৃঢ়তার খোঁজে। কিন্তু এসেই যে এমন কিছু দেখবে ভাবে নি। তার বুকের এককোণে সূক্ষ ব্যথা অনুভব হলো দৃঢ়তাকে এভাবে অন্য একজনের সাথে দেখে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨