ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-৩১

0
2

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ৩১(চমক)
#লেখিকা_দিশা_মনি

দৃঢ়তার জ্ঞান ফিরতেই সে নিজেকে হাসপাতালের বেডে শোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করল৷ অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকালো সে তবে ক্ষতস্থানে এখনো ব্যথা অনুভব করতে পারছে। দৃঢ়তার জ্ঞান ফির‍তেই সে নিজের চোখের সামনে আনিকা চৌধুরীকে দেখতে পায়। ধরে আসা স্বরে বলে,
“চাচি..”

“আমায় ক্ষমা করে দিও দৃঢ়তা। আমি তোমার কাছ থেকে সত্যটা লুকাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কি করবো বলো? আমি যে আমার স্বামীকে তার মৃত্যুর আগে কথা দিয়েছিলাম যে সত্যটা কখনো সামনে আসতে দেব না কিন্তু..শেষ অব্দি সবটা সামনে এলো।”

“আমার মা-বাবা সত্যিই আর বেঁচে নেই?”

আনিকা চৌধুরী দুদিকে মাথা নাড়ান। দৃঢ়তা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। আনিকা চৌধুরী বলেন,
“এটা নিয়ে মন খারাপ করো না। ওনারা যেখানেই আছেন সেখান থেকেই নিশ্চয়ই তোমার জন্য দোয়া করছে।”

“কিন্তু চাচি আসল সত্যটা কি? সত্যিই কি আপনার স্বামী মানে ইলিয়াস চৌধুরী আমার মা-বাবাকে খু*ন করেছিল?”

এমন সময় জলিল চৌধুরী এসে বলেন,
“না, এমন কিছু হয়নি। আমাদের বড় ভাইজান ইলিয়াস চৌধুরী আমাদের দুই ভাইকে নিজের জীবনের থেকে বেশি ভালোবাসতেন তিনি কখনো এমন কাজ করার কথা ভাবতেও পারেন না।”

আনিকা চৌধুরী নিজেও এবার হতবাক হন। কারণ তিনি আজীবন জেনে এসেছেন তার স্বামী ইলিয়াস চৌধুরীই নিজের মায়ের আদেশে নিজের ছোট ভাই দেলোয়ার চৌধুরী এবং তার স্ত্রী অনিকাকে খু*ন করেছিল। কিন্তু জলিল চৌধুরীর কথা শুনে আজ তিনিও অস্থির হয়ে উঠলেন। বললেন,
“তাহলে আসল সত্য কি?”

জলিল চৌধুরী এবার কেঁদে ফেললেন,
“ভাইজান সেদিন মায়ের আদেশ মেনে ওদের মা*রতে গেলেও যখন দেলোয়ার ভাইজানের কাছে আকুতি করে তখনই ভাইজানের মন গলে যায়৷ হ্যাঁ, তার রাগ ছিল দেলোয়ারের প্রতি কারণ সে আমাদের পরিবারের সম্মান ডুবিয়েছে কিন্তু ভাইয়ের স্নেহের কাছে সেসব ফিকে হয়ে যায়। ভাইজান সেদিন ভেবেছিল ওদের দুজনকে সাবধানে পালিয়ে যেতে সাহায্য করবে। কিন্তু ঠিক সেই সময় আম্মা সেখানে উপস্থিত হন। ভাইজানের দয়া হলেও আম্মার নিজের ছোট ছেলের জন্য দয়া হয় না। সেদিন তিনি নিজের হাতে গু*লি করে হ*-ত্যা করেন নিজের ছোট ছেলে এবং তার স্ত্রীকে!”

সমস্ত কাহিনি শুনে আনিকা চৌধুরী স্তব্ধ হয়ে যান। বলে ওঠেন,
“তার মানে কি? কিন্তু তোমার ভাইজান যে মৃত্যুর আগে আমায় বলেছিল সে নিজের ভাইকে খু*-ন করেছে এটা সে মেনে নিতে পারছিল না আর সেজন্যই তিনি বি*ষ খেয়ে নিজেকে শেষ করে দেন..”

“ভুল ভাবি। এমন কিছুই না৷ এসব কিছু আম্মার শিখিয়ে দেয়া হবে। ভাইজান তো বরাবরই মা ভক্ত ছিলেন। আম্মা নিজে দেলোয়ার ও তার স্ত্রীকে খু**ন করে সেই দায় ভাইজানের উপর চাপিয়ে দেন। আর ভাইজানও সেই দায় মাথা পেতে নেন। কিন্তু আজীবন এভাবে নিজের ভাইয়ের মৃত্যুর দায় নিয়ে তার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না আর তাই..তাই ভাইজান নিজেকে শেষ করে দেন।”

আসল সত্যটা জেনে আনিকা চৌধুরী স্তব্ধ হয়ে যান। তিনি নিজের স্বামীকে আজীবন খু*নি ভেবে এসেছেন, এজন্য তার প্রতি একটা চাপা রাগও ছিল কিন্তু আজ আসল সত্যটা জানার পর তার পুরো দুনিয়া যেন থমকে গেল। দৃঢ়তাও কান্নারত স্বরে বলে,
“ঐ ডাইনি বুড়িটা এখন কোথায়? ওকে নিজের হাতে শেষ না করা পর্যন্ত আমার শান্তি হবে না। ও আমার আর আমার পুরো পরিবারকে ধ্বংস করেছে। আমি ওকে শেষ করে দেব। শুনেছিলাম কুমিরের যখন খিদা লাগে তখন সে নিজের বাচ্চাকে খেয়ে নেয় কিন্তু এই ডাইনি তো নিজের স্বার্থে নিজের সন্তানদের জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে। এমন মা যেন আল্লাহ আমার শত্রুকেও না দেন।”

“তুমি কেন শুধু শুধু ওনাকে মে*রে নিজের হাত নোংরা করতে যাবে দৃঢ়তা? ওনার শাস্তি আল্লাহই ওনাকে দেবেন। আপাতত কিছুদিন জেলের ভাত খাক। তবে তার আগে আরো একটা সত্য তোমাদের জানা উচিৎ। ”

আনিকা চৌধুরী বলেন,
” আর কি সত্য?”

জলিল চৌধুরী এবার ইশারা করে তার স্ত্রী ললিতা চৌধুরীকে সামনে আসতে বলেন। তিনি আসতেই জলিল চৌধুরী ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে বলেন,
“ভাবিকে সব সত্যটা বলো। কিভাবে তুমি আর আম্মা মিলে তার সন্তানকে তার থেকে আলাদা করেছিলে।”

ললিতা চৌধুরী কান্নারত স্বরে বলে,
“আমায় ক্ষমা করে দিবেন আপা। নিজের স্বার্থে আমি অনেক নিচে নেমেছিলাম। আম্মার সবসময় আপনার উপর একটা ক্রোধ ছিল। বিয়ের পর থেকেই আপনি যেভাবে ভাইজানের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তাতে মা ভক্ত ভাইজান অনেকটা আম্মার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল তার উপর আপনার বাচ্চা হলে ভাইজান আরো আপনাদের দিকে ঝুঁকে পড়বে এই ভয়ে আম্মা আপনার একটা ছেলে সন্তানের জন্মের পরই তাকে অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দিয়েছিল আর মিথ্যা বলেছিল যে আপনি মৃত সন্তান জন্ম দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, পরবর্তীতে উনি আপনাকে এমন মেডিসিন খাইয়েছেন যাতে করে আপনি আর মা হতে না পারেন। আর ওনার এই অপকর্মে আমিও ওনার সঙ্গী ছিলাম। শুধুমাত্র নিজের লোভের জন্য। কারণ আমি চেয়েছিলাম, একমাত্র আমার সন্তান এই চৌধুরী বংশের একমাত্র ভবিষ্যৎ হোক।”

আনিকা চৌধুরী এগিয়ে এসে ঠাস করে থাপ্পড় মারেন ললিতা চৌধুরীর গালে। প্রবল ঘৃণা নিয়ে বলেন,
“তোমার মুখ দেখতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। কিভাবে পারলে তুমি এটা? নিজে একটা মা হয়ে আমার সন্তানকে আমার থেকে আলাদা করে দিলে।”

জলিল চৌধুরী বলেন,
“আমি ভাইজানের ব্যাপারে সবটা জানলেও এই ব্যাপারে কিছু জানতাম না। একটু আগে ললিতাই আমায় সবটা বলল। আমাদের ভুলের জন্য আপনাদের সবার জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। এজন্য যতোবারই ক্ষমা চাই তা কম হয়ে যাবে। আমি আর ললিতা খুব শীঘ্রই পুলিশের কাছে নিজে থেকেই ধরা দেব। এখন থেকে তো আমাদের নিজেদের জবাবদিহির জন্য প্রস্তুত হতে হবে কারণ মৃত্যুর পর তো মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে গিয়েও জবাব দিতে হবে। তবে তার আগে, আমি চাই এমন কিছু করতে যাতে আমাদের পাপের বোঝা কিছুটা হলেও হালকা হয়৷ এই নিন ভাবি, এটা সেই অনাথ আশ্রমের ঠিকানা যেখানে আপনার ছেলেকে পাঠানো হয়েছে। এখানে গিয়ে খোঁজ নিন, আশা করি আপনি নিজের ছেলেকে ফিরে পাবেন।”

আনিকা চৌধুরী কাপা কাপা হাতে ঠিকানাটা তুলে নেয়। দূর থেকে জাবির ও ইউভানও দৃশ্যটা দেখে। জাবিরের নিজের পরিবারের এসব অতীত জেনে ভীষণ খারাপ লাগছে এদিকে ইউভানও কেন জানি ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। হয়তো দৃঢ়তার জন্যই তার খারাপ লাগছে এটা বলেই সে নিজের মনকে বুঝ দিলো।

★★
আনিকা চৌধুরী অনাথ আশ্রমে এসে উপস্থিত। অনাথ আশ্রমের এক পুরাতন কর্মীর সাথে কথা বলে অবশেষে তিনি নিজের সন্তানের ব্যাপারে জানতে পারলেন৷ মহিলাটি জানালেন তার সন্তান এখন একজন নেভি অফিসার। যে জেনে আনিকা চৌধুরী আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন। তিনি কাগজে মোড়ানো একটা ছবিও দিলেন তার ছেলের। কিন্তু আনিকা চৌধুরীর সাহস হলো না সেই ছবি দেখার। তিনি ঐ অবস্থাতেই আবার দৃঢ়তার কাছে হাসপাতালে ফিরে এলেন। ইউভান তখন দৃঢ়তার শিয়রে বসে তার খেয়াল রাখছিল। আনিকা চৌধুরীর আগমন টের পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আন্টি ভেতরে আসুন।”

আনিকা চৌধুরী ভেতরে প্রবেশ করতে লাগল। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় তার হাত থেকে তার ছেলের ছবিটা উড়ে গেল আর একদম ইউভানের পায়ের কাছে গিয়ে পড়লো। ইউভান ছবিটা তুলে নিয়ে দেখে পুরোই হতবাক হয়ে গেলো। চমকে উঠে বললো,
“এটা তো আমার স্কুল জীবনের ছবি। অনাথ আশ্রম থেকে বিদায় নেয়ার অনুষ্ঠানে তুলেছিলাম। এটা আপনি কোথায় পেলেন?”

ইউভানের কথা শুনে আনিকা চৌধুরী ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এসে তার মুখে হাত বোলাতে লাগলেন। তারপর একসময় হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নারত স্বরে বললেন,
“আমার ছেলে..আমার নাড়িছেঁড়া ধন..”

ইউভান পুরো জমে গেল আনিকা চৌধুরীর কথা শুনে।
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨