ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব-৩২ এবং শেষ পর্ব

0
2

#ওরা_মনের_গোপন_চেনে_না
#পর্বঃ৩২(অন্তিম)
#লেখিকা_দিশা_মনি

ডিভোর্স পেপারে সই করে যেন দৃঢ়তার বুকের উপর থেকে অনেক বড় একটা বোঝা নেমে গেল। অবশেষে জাবিরের সাথে জুড়ে থাকা সম্পর্ক থেকে সে মুক্ত। জাবির স্বেচ্ছায় দৃঢ়তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। ডিভোর্সটা কার্যকর হবার পরই জাবির মলিন হেসে বললো,
“আমি তোমাকে কখনো এক ফালি সুখের সন্ধান দিতে পারি নি দৃঢ়তা। তুমি আমায় এত ভালোবেসেছ অথচ তার বিনিনয়ে আমি কষ্ট ছাড়া তোমায় কিছুই দেইনি। তুমি একটু সুখ ডিজার্ভ করো যা হয়তো তুমি ইউভানের কাছেই পাবে। তোমার জন্য আমার দোয়া সব সময় থাকবে। এখন যখন জানতে পারলাম, তুমি আর ইউভান দুজনেই আমার কাজিন তখন তো তোমাদের সুখ আরো বেশি করে চাইব। তোমরা ভালো থেকো।”

বলেই জাবির বেরিয়ে আসে কোর্ট চত্ত্বর থেকে। এই একটা দায়িত্ব পালনের জন্যই সে এতোদিন ধরে দেশে ছিল। এখন সেই দায়িত্বের পাট চুকল। জাবির একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। তার মা-বাবা, দাদি সবাই এখন জেলে। জাবিরের কাছে এখন পুরো পরিবেশটা বিষাক্ত। নিজের মায়ের অপকর্মের জন্য সে ইউভান বা আনিকা চৌধুরী কারো কাছেই মুখ দেখাতে পারছে না। জাবির জানে তাদের মনে জাবিরের প্রতি কোন ক্লেশ নেই তবুও সে বারবার নিজেই নিজের কাজে ছোট হয়ে যেত। তাছাড়া যতোই হোক, দৃঢ়তা তার প্রাক্তন। তারই চোখের সামনে ইউভানের সাথে সংসার করতে নিশ্চয়ই কিছুটা দ্বিধা বোধ কর‍ত সে, লোকেও ব্যাপারটাকে ভালো চোখে দেখত না। এসব ভেবেই জাবির সিদ্ধান্ত নিয়েছে লন্ডনে চলে যাবার। সেখানেই একটা চাকরিরও অফার পেয়েছে সে। জাবির বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠে বসবে এমন সময় সেখানে ছুটে এলো মোহনা। এসেই হাফাতে হাফাতে বলতে লাগল,
“এই যে মিস্টার জাবির চৌধুরী, এভাবে আমায় একা রেখে কোথায় যাচ্ছেন? দৃঢতার সাথে আপনার ডিভোর্স হয়েছে কিন্তু আমি তো এখনো আপনার স্ত্রী। তাই আপনি যেখানেই যান আমাকে সাথে নিয়ে যেতে হবে।”

জাবির মলিন হাসে। তার পা জোড়া থেমে যায়। সে মোহনার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি তোমার সাথে যা কিছু করেছি তারপরেও কি তুমিআমার সাথে যেতে ইচ্ছুক মোহনা?”

মোহনা নিজের ট্রলি ব্যাগ এগিয়ে নিয়ে এসে বলে,
“প্রস্তুত মানে,,,একেবারে কোমড় বেধে প্রস্তুত দেখতে পারছেন না? যদিও আমি ওতো সতী-সাবিত্রী স্ত্রী নই যে স্বামীর হাজারো অন্যায় ক্ষমা করে তার পায়ে পড়ে থাকব কিন্তু মাঝে মাঝে একটু ক্ষমাশীল হওয়া যায়।।তবে মনে রাখবেন, এটাই আপনার শেষ সুযোগ। এরপর কোন বাড়াবাড়ি করলে আপনাকে লন্ডনের টেমস নদীর পানিতে ডুবিয়ে মারবো!”

জাবির হেসে ফেলে। অতঃপর গাড়িতে উঠে বসে মোহনাকে তার পাশের সিটে বসার ইশারা করে। মোহনাও উঠে বসে। জাবির মোহনার হাত আলতো করে বলে,
“এক ভুল মানুষ জীবনে দুই বার করে না। আগেরবার আমি যাই করি এবার তোমাকে আর হারাবো না। তোমাকে আপন করে নিব।”

★★
“কবুল” শব্দটা প্রথমবার যতোটা ভয় ও উদ্বিগ্নতা নিয়ে বলেছিল দৃঢ়তা এবার ঠিক ততোটাই আনন্দ নিয়ে বললো। ইউভানের গায়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল দৃঢ়তার কন্ঠে বহুল আকাঙ্ক্ষিত শব্দটি শুনে। অতঃপর সে নিজেও কবুল বলল। ব্যস, দুজনেই বাধা পড়লো এক পবিত্র বন্ধনে।

মিষ্টি, রাফসান তাদের মেয়ে রাফা, মনোয়ারা বেগম, আনিকা চৌধুরী সবার উপস্থিতিতে বেশ জাকজমকভাবে তাদের বিয়েটা হয়ে যায়। জাবির ও মোহনাও লন্ডন থেকে তাদের বিয়ে উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠায়।

আনিকা চৌধুরী তো ইউভান ও দৃঢ়তাকে পুরো বুকে টেনে নিয়ে বলে,
“আমার জীবনে যে আবারো কখনো এই সুখের মুহুর্ত আসবে সেটা আমি ভাবতেও পারিনি।”

দৃঢ়তা আড়চোখে ইউভানের দিকে তাকায়। বিগত কিছুদিন ধরে এই লোকটার শতশত পাগলামীর কারণেই তো সে দ্বিতীয় বার বিয়ে করতে রাজি হলো। নাহলে তো সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিল জীবনে আর বিয়ের আসরে বসবে না। কিন্তু এই পাগল পুরুষের পাগলামীতে তাকে হার মানতেই হলো।

বিয়েটা সম্পন্ন হতেই মিষ্টিও এগিয়ে এসে বললো,
“তোমাদের এক হতে দেখে খুব ভালো লাগছে। এখন সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা, তোমাদের ভবিষ্যত জীবন অনেক সুখের হোক। আর দৃঢ়তা, তুমি একদম নয়নার মতো সুখী হও নিজের জীবনে।”

দৃঢ়তা অবাক স্বরে জানতে চায়,
“এই নয়না আবার কে?”

“আরে মনে নেই, আমাদের স্কুলে তোমার এক ক্লাস জুনিয়র ছিল। ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে।”

“ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। মেয়েটা সত্যিই অনেক ভালো ছিল।”

“ও নিজের জীবনে অনেক সুখী জানো। কারণ অনেক ভালো একটা বর পেয়েছে। তাই নিজের জীবনের দুঃসময়েও ভালো থাকতে পেরেছে।”

“মানে? নয়নার আবার কি কষ্ট হলো? মেয়েটা তো অনেক সুখীই ছিল।”

“সে অনেক কথা। এখন বলে শেষ করা যাবে না৷ তুমি আপাতত তোমার জীবনে মন দাও। একদিন সময় করে আমি নয়নার জীবনের কাহিনি তোমায় বলব।”

“আচ্ছা।”

★★
বাসর ঘরে বসে আছে দৃঢ়তা। মাথায় তার এক হাত ঘোমটা। হঠাৎ করে ইউভান এগিয়ে এসে দৃঢ়তার ঘোমটাটা তুলে বললো,
“থাক আর এত লজ্জা পেতে হবে না। এখন আমায় একটু আদর কর‍তে দাও..”

বলেই ইউভান দৃঢ়তাকে কাছে টেনে নিয়ে অসংখ্য চুমুতে তার গাল ভড়িয়ে দিতে থাকে। দৃঢ়তা তো লজ্জা পেয়ে যায়। এই প্রথম কোন পুরুষের এত গভীর স্পর্শ সে অনুভব করতে পারছে। জাবিরের সাথে তার বিয়ে হলেও শারীরিক বা মানসিক ভাবে কখনো তারা কাছাকাছি আসে নি। জাবিরের সাথে তার স্মৃতি মানেই শুধু দুঃসহ যন্ত্রণা।

এসব ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে দৃঢ়তা। অতঃপর ইউভানের পবিত্র স্পর্শে সায় দিতে থাকে। এদিকে ইউভানের আজ নিজেকে সব দিক থেকে পরিপূর্ণ মনে হয়।

এক সময় তার নিজের বলতে কিছুই ছিল না। একটা অনাথ আশ্রমে কত কষ্টে মানুষ হয়েছে সে। অথচ আজ সে তার মাকে ফিরে পেয়েছে সাথে নিজেকে ভালোবাসার মতো একজন নারীসঙ্গীও পেয়েছে।

★★
ইউভান ও দৃঢ়তার বিবাহিত দিন গুলো সুখে কাটতে থাকে। দৃঢ়তা নিজের প্রথম বিবাহিত জীবনে যতোটা কষ্টে ছিল দ্বিতীয় জীবনে যেন সেই সব কষ্টের লাঘব টানা হয়। ইউভান তাকে পুরো ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখে। তাদের এই ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে এক বছরের মাঝেই তাদের এক ছেলে সন্তান জন্ম নেয় এই ধরিত্রীর মাঝে। যাকে পেয়ে ইউভান ও দৃঢ়তার জীবন যেন একেবারে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।

নিজের ছেলেকে কোলে নিয়ে দোল খেতে থাকে দৃঢ়তা। ইউভান হঠাৎ পিছন থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমার ছেলে তো দেখি একদম নিজের মায়ের মতো হয়েছে..”

“তাই?”

“অবশ্যই। জানো, দৃঢতা যতোবারই আমি আমাদের ছেলেকে দেখি ততবারই ওর মাঝে যে তোমার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই।”

“কিন্তু আমার কেন জানি মনে হয় ও একদম আপনার মতো।”

“কি জানি।”

দুজনেই এবার একে অপরের দিকে তাকায়। গল্পটা শুরুই হয়েছিল একে অপরের মনকে না চেনার গল্প দিয়ে। অথচ শেষ হলো এক অন্যরকম পর্যায় এসে। জাবির দৃঢ়তার মনের গোপন কথাগুলো বুঝতে না পারলেও, ইউভান দৃঢ়তার দিকে তাকাতেই তার সব মনের কথা বুঝতে পারে। দৃঢ়তাকে যেন মুখ ফুটে কিছু বলতেই হয় না। ইউভান আচমকা দৃঢ়তার কপালে প্রেমের পরশ একে দেয়। দৃঢ়তার শরীর জুড়ে আবারো বয়ে যায় প্রেমের শীতল স্রোত!

পরিশিষ্ট
জেলের অন্ধকারে বন্দি আমিনা চৌধুরী। তার সব দম্ভ আজ এই চার দেয়ালে চূর্ণ হয়ে গেছে। আজকাল মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি। মাঝে মাঝেই অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে বিভিন্ন অশরীরী উপস্থিতি টের পান। মাঝে মাঝেই স্বপ্নে নিজেকে জ্যান্ত তেলে ভাজতে দেখেন, কখনো আবার স্বপ্নের মাঝেই উপলব্ধি করেন তাকে আগুনে পোড়ানো হচ্ছে। এভাবে বেঁচে থাকতেই নরক যন্ত্রণা ভোগ করে চলেন তিনি। মৃত্যুর পর না জানি আরো ভয়াবহ যন্ত্রণা বাকি আছে। আমিনা চৌধুরীর আজকাল বড্ড আফসোস হয়ে নিজের কৃতকর্মের কথা ভেবে। কিন্তু এখন আর ভেবে কি হবে। পাপ তাকে চারিদিক থেকে গ্রাস করে নিয়েছে। এখন যে আর মুক্তির কোন পথ নেই!
সমাপ্ত ✨