#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩৯
________________
আহিকে ওয়াশরুমে রেখে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো হ্যাভেন৷ ভেবেছিলো আহি বের হওয়ার পরই সে রুম ছাড়বে৷ কিন্তু তার পূর্বেই হ্যারির কল পেয়ে হন্যে হয়ে রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো। ড্রাইভার কে এবং দেহরক্ষী শফিককে কল করে জানালো এখনি তারা ঢাকা ব্যাক করবে। হ্যাভেন যখন গেট খুলছিলো রুবিনা দোতালার বারান্দা থেকে চিল্লিয়ে ওঠলো,
-‘ হ্যাভেন দাঁড়া কোথায় যাস এই রাত্রিবেলা? দাঁড়া বাবা যাস না ‘।
-‘ ঢাকা ব্যাক করছি চিন্তা করো না আগামিকাল ফিরবো ‘। বলেই বেরিয়ে পড়লো হ্যাভেন।
রুবিনা নিচে নামতে নামতেই ড্রাইভার তমালকে ফোন করে সিওর হয়ে নিলো সত্যি তারা ঢাকা ফিরছে। নিশ্চয়ই বড়োসড়ো কোন ঝামেলা হয়েছে। তাই উদ্বিগ্ন মনে উপরে ওঠে হ্যারিকে কল করলো। ফোন কানে দিয়ে বারান্দায় রাখা বেতের চেয়ারটাতে বসলো। ফোন রিসিভ হতেই রুবিনা কড়া স্বরে প্রশ্ন করলো,
-‘ কি হয়েছে তোরা এখনো আসিসনাই হ্যাভেনও ঢাকায় ব্যাক করছে সব ঠিক আছে তো ‘?
-‘ বড় মা চিন্তা করোনা ছোটখাটো একটা সমস্যা হয়েছে ভাই আসুক আমরা মিটিয়ে নেবো। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো ‘।
-‘ একটা দিনও শান্তি পেলো না ছেলেটা এসেছে দুপুরে এখনি ডাক পড়লো তার, তোদের কারো আর আসতে হবে না। তোরা ঝামেলাই মিটাতে থাক’।
বলেই রেগে ফোন কেটে দিলো। এদিকে আহি ফ্রেশ হয়ে এসে হ্যাভেনকে না পেয়ে তেমন গুরুত্ব দিলো না। কিন্তু যখন শ্বাশুড়ি কে উদ্বিগ্ন অবস্থায় বারান্দায় বসে থাকতে দেখলো এবং তার উদ্বিগ্নতার কারণ জানতে পারলো নিজেও কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। সেদিনের পর থেকে হ্যাভেনকে নিয়ে বেশ চিন্তা হয় তার। যতোই দূরে থাকুক না কেনো সবসময় উপরওয়ালার নিকট প্রার্থনা করে হ্যাভেন যেনো সুস্থ থাকে, ভালো থাকে। কোন বিপদ যেনো তাকে স্পর্শ করতে না পারে। কিন্তু যার পেশাটাই বিপদকে ঘিরে তাকে বিপদ স্পর্শ করবে না তাই কখনো হয়?
.
পরের দিন সকাল থেকেই বাড়ির পরিবেশ বেশ রমরমা হয়ে ওঠলো। নিচতলার ফাঁকা রুমটার মেঝেতে হিয়া এবং রিদি পাটি বিছাচ্ছিলো। আহিও তাদের সঙ্গে ছিলো। তখনি জানতে পারলো আজ হ্যাভেনের খালামুনি এবং তাদের মেয়েরা আসছে। শুধু তাই নয় হুমায়ুন তালুকদার, হ্যাভেন,হিরা,হ্যারি সকলেই আসছে। দুপুরে তারা একসঙ্গেই ভোজন পর্ব সাড়বে। পাটিতে বসে এ বাড়ির সকলের সঙ্গে তালুকদার বাড়ির ছেলেরা একসঙ্গে খাবে ? বিষয়টা বেশ মনঃপূত হলো আহির। নানুবাড়ি মানেই বিশেষ অনুভূতিগুলোতে মিশে থাকা। সেই অনুভূতি তে হ্যাভেন নামক ঐ মানুষ টাও মিশে থাকতে পারে? সত্যি অবাক হলো আহি। মন বললো এ মানুষ টা’কে পূর্ণাঙ্গভাবে চেনা, বা বুঝতে পারায় এখনো ঢের বাকি। ভাবনার গতিপথ থেকে ফিরে এলো আহি। মনোযোগ দিলো রিদি, হিয়ার কথোপকথনে। তারা দুজন পাটিতে হাঁটু মুড়িয়ে বসে ওটা সেটা গল্প করছিলো সেও বসলো তাদের পাশে। রিদি বললো,
-‘ অবশেষে আবার আমরা সকলে এভাবে একসাথে হচ্ছি ‘?
-‘ ইয়েস ফাইনালি আমরা দাদানকে আবারও পাচ্ছি’।
হিয়ার কথাটি শুনে ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে ফেললো আহি। হাসি হাসি মুখটা বিলীন হয়ে গেলো তার। কৌতুহলোদ্দীপক হয়ে প্রশ্ন করলো,
-‘ তোমার দাদান তোমাদের সঙ্গে এভাবে কখনো সামিল হয়নি ‘?
রিদি বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো,
-‘ আরে ভাবি হয়েছে তো সেই ছোট্ট সময় থেকেই আমরা সব ভাই-বোনরা বছরে অন্তত দুবার এভাবে একসঙ্গে সময় কাটাই। খাওয়া-আড্ডা, গ্রাম জুরে ঘুরাফেরা আরো কতো কি কতো স্মৃতি ‘।
-‘ তাহলে ফাইনালি দাদানকে পাচ্ছি কথাটার মানে ‘?
থতমত খেয়ে গেলো হিয়া কিন্তু রিদি স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
-‘ গত চার-পাঁচ বছর যাবৎ দাদান তেমনভাবে একসঙ্গে হয়নি ভাবি। যাও হয়েছে আমাদের সঙ্গে আগের মতোন প্রানখুলে না মিশেছে না হেসেছে। হুট করেই দাদান কেমন একটা হয়ে গেলো। সব ঐ শাঁকচুন্নি, ডাইনীটার জন্য। জানো আগে আমরা কতো আড্ডা দিয়েছি? কতো ঘুরেছি। ধানক্ষেতের বাঁধ দিয়ে ঘুরে বেড়ানো, চারদিকে যখন থৈথৈ পানি আসে, খালে,বিলে যখন গলা অবদি পানি আমরা ভাই-বোনরা মিলে তখন দিন নেই রাত নেই যে কোন সময় নৌকায় ঘুরাঘুরি করতাম। লাল,সাদা শাপলা দিয়ে মালা গেঁথে মাথায় পড়তাম, গলায় পড়তাম,
সে সব আনন্দগুলো আজ শুধুই আবছা স্মৃতি মাত্র। ভাই-বোনদের মাঝের বন্ধনটা দিনকে দিন নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। হয়তো এখন আড্ডা চলে,ঘুরাঘুরি হয় কিন্তু আগের মতোন এক ঝাঁক পাখির ন্যায় চলাফেরা আর হয়ে ওঠে না। কারণ আমাদের জ্যোষ্ঠ ভ্রাতাই আর আগের মতোন নেই। তার কাছে আগের মতোন কোন বায়না করা যায় না। তার মুখের হাসিগুলো আজ বিষন্নতার চাদরে মুড়িয়ে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব পাল্টে গেছে সবটা। তবুও আজ যখন শুনলাম সবাই আসছে আবারও সবাই এক সঙ্গে হবো আমরা তখন মনটা সত্যি খুশিতে ভরে ওঠলো ‘।
আহির মনটাও বিষন্ন হয়ে গেলো। হিয়ার দিকে চেয়ে দেখলো তার মুখটাও ভার। দীর্ঘ একটি শ্বাস ছেড়ে ওষ্ঠ কোনে ঈষৎ হাসি ফুটিয়ে বললো,
-‘ মন খারাপ করো না তোমরা আজ যখন সবাই একসঙ্গে হচ্ছো আবারো সেই দিনগুলোতে নতুনত্ব দান করে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। তবে হ্যাঁ এই নতুনত্বে আমাকে বাতিল করো না যেনো ‘।
হিয়া, রিদি দুজনেই চেঁচিয়ে ওঠলো।
-‘ সত্যি ‘?
-‘ হুম সত্যি ‘।
-‘ না হবে না দাদান কিছুতেই আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে না ‘।
আহি মাথা দুলিয়ে মেকি হেসে বললো,
-‘ দেবে দেবে আমি আছি না? এমপি সাহেবকে ঠিক বশ করে নেবো ‘।
-‘ ওয়াও ভাবি ইউ আর গ্রেট! বলেই দুজনই জাবটে ধরলো আহিকে।
_________________
দুপুরের দিকে দু’টো গাড়ি এসে থামলো দিলারা ভবনের সামনে। গেট খোলা থাকায় হ্যাভেনের খালামুনি রত্না এবং খালাতো বোন শশী ভিতরে ঢুকে বেশ হাঁস-ফাঁস করতে লাগলো। বাড়ির সকলেই খুশিতে গদগদ হয়ে তাদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করলো। রিদির মা চট জলদি দু’জন কে ফ্রিজ থেকে দু’টো ঠান্ডা শরবতের গ্লাসও এনে দিলো। কোনকরম হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধুয়ে আগেভাগে শরবত মুখে দিলো দু’জন। রুবিনা শিফার কথা জিগ্যেস করতেই শশী বললো,
-‘ আপুতো হ্যাভেন ভাইয়ার সাথে সামনের মোড়ে গিয়েছে একটু কি যেনো দরকার ‘।
-‘ কিহ দাদান আর শিফা আপু একসঙ্গে নিশ্চয়ই তুই ফান করছিস ‘?
হিয়ার কথায় মজার ছলে শশী বললো,
-‘ কেনো রে আমার বোনের প্রতি ভাইয়ার আগে ইন্টারেস্ট ছিলো না বলে এখনো আসবে না এমন কোন শর্ত কেউ তোকে দিয়েছে নাকি ‘?
ওঠানের একপাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো আহি। শশীর কথাটা শুনে তার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হতে শুরু করলো। কেমন যেনো গা জ্বলা একটা ভাব হচ্ছে। সেই সাথে মন, মানসিকতা হয়ে ওঠলো চরম বিপর্যস্ত। শশীর কথা শেষ হতেই হিয়া শশীর হাতটা চেপে ধরে আহিকে ইশারা করিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বিরবির করে বললো,
-‘ মুখ সামলে কথা বল বোন আমার ওখানে ভাবি দাঁড়িয়ে আছে চেয়ে দেখ একবার ‘।
শশী ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে ফেললো। আহির দিকে চেয়ে একশ চল্লিশ ভোল্টেজের শখড খেলো যেনো। এদিকে তার মা,মামি খালারা নিজেদের মধ্যে কথা বলায় ব্যাস্ত। শশী আহির দিকে ফ্যাল ফ্যাল চোখে কিছু সময় চেয়ে থেকে বেশ চিল্লিয়ে ওঠলো,
-‘ ও আম্মুগো দেখো দেখো হ্যাভেন ভাইয়ার বউ কি সুন্দর ওমাগো আপু তো এই মেয়েকে দেখে এবার কোমায়ই চলে যাবো। আগেরটা দেখে তো শুধু অজ্ঞান হইছিলো ‘।
তীব্র অস্বস্তি নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়েই আছে আহি। এদিকে প্রত্যেকের চোখে,মুখে প্রবল ক্রোধ ভেসে ওঠেছে। না পারে শশীকে এরা চোখ দিয়ে গিলে খাবে। শেষমেশ রত্নাই নিজের মেয়েকে ধমকে ওঠলো। শশীও চোখ, মুখ কুঁচকে গাল থেকে হাত সড়িয়ে নিলো। মেয়ের থেকে কড়া দৃষ্টি সড়িয়ে আহির দিকে হাস্যজ্জ্বল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো রত্না। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আহিকে বললো,
-‘ বাহ বউ তো বেশ মিষ্টি দেখতে। নাম কি তোমার আম্মু’?
বেশ ইতস্ততভাবেই উত্তর দিলো আহি,
-‘ আহিয়ানা আহি ‘।
রুবিনা এগিয়ে এসে সকলের সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাড়িতে প্রবেশ করলো হ্যারি এবং হিরা। তাদের পিছনে হুমায়ুন তালুকদারও ঢুকলো। আহি নিচের দিকে মাথা রেখেই এক পলক চেয়ে শুধু দেখে নিলো হ্যাভেন এসেছে কিনা। কিন্তু না সে আসেনি। তাই বিক্ষিপ্ত মেজাজে গুটিগুটি পায়ে ভীরের মাঝখান থেকে সড়ে গেলো। রিদির রুমে গিয়ে রাগে ফোঁসফোঁস করছিলো সে। কিন্তু বেশীক্ষণ শান্তিতে ফোঁসফোঁস করতে পারলো না। হিয়ার ডাকে আবার বেড়িয়ে যেতে হলো। খালা শ্বাশুড়ি তার মুখ দেখে কিছু দেয়নি তখন তাই এখন ডাক পড়েছে। রিদির রুমের পাশের রুমটাতেই ছিলো রত্না এবং রুবিনা। আহি যেতেই তাকে কাছে টেনে বসালো রত্না। পাশে রাখা হ্যান্ডব্যাগ থেকে একজোরা স্বর্ণের কানের দুল বের করে আহির কানে পড়া রিং জোরা খুলিয়ে তার দেওয়া দুলজোরা পড়িয়ে দিলো। ভালো লাগছে না আহির তবুও জোর পূর্বক মুখে মিথ্যা হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। আর মনে মনে হাঁসফাঁস করছে কখন এখান থেকে পালাতে পারবে।
.
হ্যাভেন আর শিফা ফিরলো প্রায় এক ঘন্টা পর। যখন সকলের জন্য খাবার বাড়া হচ্ছে তখন। হালকা গোলাপি রঙের সেলোয়ার-কামিজ পড়েছে আহি। মাথায় হালকা গোলাপি রঙের সুতি ওড়না দিয়ে ঘোমটাও দিয়ে রেখেছে। ঘোমটার ফাঁকফোঁকড়ে কানে পড়া দুলজোরা চকচক করছে একদম। নাকে একটা নাক ফুল পড়া থাকলেই এখন তাকে পারফেক্ট বউ লাগতো। খাবার রুমটায় পাটি বিছানো সেখানে একপাশে হাঁটু মুড়িয়ে চুপচাপ বসে ফোন ঘাটছে সে। তার অপজিট পাটিতে হিয়া, রিদি,শশী বসে আছে তারা সকলেই ফোনে ব্যাস্ত। ম্যাসেন্জারে গ্রূপ চ্যাট করছে তারা। আহিকেও এড দেওয়া হয়েছে তবে সে শুধু ওদের কথোপকথন দেখছে কিছু বলছে না। হ্যাভেন এসেছে কিছুক্ষণ পর খাবার রুমেও চলে আসবে। তার অপেক্ষা তেই ছিলো ভাইয়েরা। তাই একে একে সব ভাইরাই চলে এলো। হিরা ওয়ার্নিং দিতে দিতেই রুমে প্রবেশ করলো। বললো,
-‘ ফিমেল সদস্যরা একপাশে চলে যাও যাও ‘।
রিদি ওঠে চট করে আহির পাশে বসে পড়লো। হিয়াও ওঠে পড়লো শশী ঠাঁই বসেই রইলো। হিরা সুযোগ টা’কে জাষ্ট লুফে নিলো চট করে শশীর গা ঘেঁষে বসে বললো,
-‘ আহা কতোদিন পর ঢঙি দিদির সঙ্গে দেখা ‘।
হ্যারি মিটিমিটি হাসতে হাসতে হাঁটু মুড়িয়ে বসলো। শশী ফুঁসে ওঠে এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেলো। হিরাকে রেগে চারটে তেঁতো কথা শুনাতে যাবে তখনি চোখ পড়লো হ্যারির টকটকে লাল ওষ্ঠকোনের ক্ষীণ হাসিটার দিকে। নিমিষেই সকল রাগ উধাও হয়ে গিয়ে বুকের ভিতর উথাল-পাতাল ঢেউ শুরু হয়ে গেলো তার। বেহায়ার মতোন হ্যারির ওষ্ঠকোনেই আঁটকে রইলো তার আঁখিদ্বয়৷ হিরা বিষয়টা বুঝতেই পকেট থেকে রুমাল বের করে হ্যারির মাথা থেকে থুতনি অবদি পর্দায় ন্যায় ঢেকে ফেললো। হিয়া, রিদি খিলখিল করে হেসে ওঠলো। রিদির ভাই রিমন ফোন ঘাটাঘাটি করছে বলে এদিকটায় তেমন খেয়াল করলো না। তবে আহি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তে শশীর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়ে মানুষের এতো এডভান্স আচরণ তার মোটে পছন্দ নয়। হ্যারিও বিষয়টা আঁচ করে বিরক্তি তে চোখ,মুখ কুঁচকে রুমালটা সড়িয়ে হিরার দিকে চেয়ে বললো,
-‘ ফাইজলামি কম কর ‘। তারপর শশীর দিকে চেয়ে বললো,
-‘ তোমার পড়াশোনার কি খবর’?
শশীর হৃদপিণ্ডে যেনো কেউ চেপে ধরেছে। শ্বাসরুদ্ধ করে মিনমিনে সুরে উত্তর দিলো সে,
-‘ এখন তো লগডাউন চলছে বাসায় পড়ছি। হিয়ারও যা আমারো তাই আর কি ‘। বলেই সামনে চলে আসা কাটা চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিলো।
সকলে এবার হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। আহি আড়ালে মুখ ভেঙচি দিয়ে বিরবির করে বললো, ‘ আহ ন্যাকা ষষ্ঠী একেবারে’।
.
বারো পদের ভর্তার আয়োজন করা হয়েছে। দু’বছর সংসার করেও আহি জানতে পারেনি হ্যাভেন সহ হ্যাভেনের বাড়ির প্রতিটি সদস্যই গ্রাম্য খাবার ভীষণ পছন্দ করে। জানবে কি করে রাজনৈতিক ঝামেলা, নির্বাচন এসবের ব্যাস্ততায় তালুকদার বাড়ির কেউই গ্রামে আসার সময় পায়নি। হ্যাভেন দু’একবার এলেও ঘন্টা, খানিক সময় ব্যয় করেই চলে গেছে। তাদের আবার বিলাসিতার শেষ নেই ভর্তা আয়োজন কখনো নিজ বাড়িতে শহরে করেনা বরং নানু বাড়ি গ্রামে এলেই তারা এভাবে ভর্তা ভোজন করে। আহিকে বিয়ে করার পর কখনো এখানে নিয়েই আসেনি তাহলে সে জানবে কোথায় থেকে? আজ এতোদিন পর আবার যখন সবার দেখা হলো তখন আবারো সবার ভোজনে নানারকম ভর্তার আয়োজন করা হয়েছে। তার মধ্যে হ্যাভেনের সব চেয়ে প্রিয় হচ্ছে আলু এবং কচু ভর্তা। এছাড়াও তিল,তিসি, কাঁচা পেয়াজের ভর্তা, পাঁচ মিশালি শুঁটকি ভর্তা,চিংড়ি ভর্তা, টাকি মাছ ভর্তা,শিমের বিচি ভর্তা,ধনে পাতা ভর্তা, কালো সরিষা ভর্তা, হলুদ সরিষা ভর্তা।
সকলেই চুপচাপ বসে বেশ আয়েশ করে খাচ্ছে। খাওয়ার সময় বেশি কথোপকথন পছন্দ করেনা হুমায়ুন তালুকদার। তবুও টুকটাক কথা বলছে রিদির বড় ভাই রিজভীর সঙ্গে। এই ছেলেটা কে অত্যন্ত স্নেহ করেন তিনি। বলতে গেলে রিজভীর ব্যাক্তিত্বই তাকে মুগ্ধ করেছে। আর সবার মতোন সে নয় হ্যাভেনের মতোন রগচটাও নয় বরং অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির ছেলেটি। সচরাচর সবার মাঝে তাকে দেখাও যায় না৷ এই খাওয়ার সময়ই নজরে পড়ে তাকে। বলা যায় বেশ গম্ভীর প্রকৃতিরও। সকলেই যখন নিজেদের মতো খাওয়া এবং টুকটাক কথায় ব্যাস্ত হ্যাভেন তখন আহিতে মত্ত। একধ্যানে চেয়ে মুখ বদ্ধ অবস্থায় খাবার চিবাচ্ছে সে। আহি প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে বসে আছে গলা দিয়ে খাবার নামছে না তার। একেতো কেমন রাগ লাগছে তারওপর কিভাবে যেনো চেয়ে আছে হ্যাভেন। যদিও বহুবার এ দৃষ্টির স্বীকার হয়েছে তবুও আজ কেমন জানি লাগছে। মন বলছে আজ এ দৃষ্টিতে অন্য কিছু রয়েছে নাহ অন্য নয় বরং গভীর কিছু। যা তার অনুভূতিকে কঠোর করতে পারছে না। অস্বস্তির সঙ্গে অস্বাভাবিক লজ্জা বোধ করছে সে। দুগাল রক্তিম আভায় ভরে ওঠেছে। যা খুবই সুক্ষ্ম নজরে পরোখ করছে হ্যাভেন। হ্যাভেনের অমন দৃষ্টিতে গা জ্বলে ওঠলো শিফার। একেতো আহিকে দেখেই তার মাথা ভনভন করছিলো তারওপর হ্যাভেনের এমন মুগ্ধ চাহনী তার সামনে বসে এমন দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে তবু অন্যকারো জন্যে মানতে কষ্ট হচ্ছে, রাগ হচ্ছে অন্তর জ্বলে, পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে তবুও হজম করতে হবে। কপালটাই তার খারাপ কিনা? রূপসা চলে যাওয়ার পর মানসিক রোগ বাসা বাঁধলো সে রোগ ছাড়ার পথে আবার এই মেয়ের রোগে জর্জরিত হলো উফফ কপালটাই ফাটা তার। মন চায় দেয়ালে ঠুকে মরে যাই। ভাবতেই গলায় খাবার আঁটকে কেশে ওঠলো শিফা। মূহুর্তেই সকলে চমকে তার দিকে তাকালো।
________________
রান্নাঘরে গিয়ে এক বাটি পায়েস নিয়ে বসার ঘরে এলো শিফা। হ্যাভেন সকল ভাই-বোনদের সঙ্গে বসে টুকটাক কথা বলছিলো। আহির এসব ভাল্লাগছিলো না বলে উপরে ওঠে গিয়েছে। কিন্তু মনটা ভীষণ খচখচ করছিলো কারণ হ্যাভেন পায়েস খায়নি। তাই ভাবলো বিষয়টা রুবিনাকে সেই মনে করিয়ে দেবে। তাই দোতলা থেকে নিচে নেমে এলো। কিন্তু তার আর প্রয়োজন পড়লো না শিফা হ্যাভেনের সামনে পায়েস ধরতেই হ্যাভেন মৃদু হেসে পায়েসটা গ্রহণ করলো। সঙ্গে সঙ্গে এক গাল হেসে হ্যাভেনের গা ঘেষে বসে পড়লো শিফা। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে এসে এ দৃশ্য দেখে দাঁতে দাঁত চেপে আবারো ওপরে ওঠে গেলো আহি। অসহ্য লাগছে তার। প্রতিটি মেয়েরই কাজিন জাতির মধ্যে একটা করে শকুন থাকে জানতো। কিন্তু কোন ছেলের জন্যও যে কাজিন জাতিতে একটা করে শকুনি রয়েছে তা জানতো না। মেজাজ টাই চটে গেলো তার। রিদির রুমে গিয়ে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে বসে পড়লো। ফোঁসফোঁস করতে করতে বললো,
-‘ মি.হ্যাভেন তালুকদার আপনি বোধ হয় ভুলে গেছেন আমাদের মধ্যে ঠিক কি ডিল হয়েছিলো ‘।
মূহুর্তেই কি ভেবে যেনো ফোনটা হাতে নিয়ে হ্যাভেনকে কল করে বসলো। কলটি খুব দ্রুতই রিসিভ করলো হ্যাভেন। আহিও ক্ষিপ্ত মেজাজে বললো,
-‘ ডিয়ার হাজব্যান্ড, আপনি বোধ হয় ভুলে গেছেন আমাদের মধ্যে ঠিক কি ডিল হয়েছিলো। তাই আমিও ভুলতে বাঁধ্য হবো যে আমি আপনাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেছিলাম ‘।
কথাটি শোনামাত্রই ফোন কেটে দিলো হ্যাভেন। এবং দ্রুতই উপরে চলে এলো। রিদির রুমে ঢুকতেই দেখতো পেলো আহির চোখ,মুখে অস্বাভাবিক ক্রোধ ফুটে ওঠেছে। নাকের ডগা লালচে হয়ে আছে। হালকা কেশে আহির পাশে গিয়ে বসলো হ্যাভেন। উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলো,
-‘ কি হয়েছে ‘?
-‘ শিফার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ছিলো ‘?
কলার চেপে ধরে ক্রোধান্বিত স্বরে প্রশ্নটি করলো আহি। হকচকিয়ে গেলো হ্যাভেন আহির হাতে ধরে দৃষ্টি তে দৃষ্টি মিলিয়ে উত্তর দিলো,
-‘ আমি বোধ হয় তোমাকে বলেছিলাম রূপসার আগে আমার জীবনে কেউ ছিলো না তবে পরে কে আছে আর থাকবে বুঝে নাও ‘।
-‘ বুঝতে পারবো না এ বাড়িতে সবাই কেনো আপনাকে আর ওকে নিয়ে কানাঘুষা করছে? কেনো রিদি, হিয়ারা মুখ ফস্কে ওটা সেটা বলে তা আবার লুকানোর চেষ্টা করছে? ও কেনো আপনাকে ওভাবে দেখে? কেনো ও আপনার জন্য পায়েস নিয়ে গেলো আর আপনি নির্লজ্জের মতো হেসে হেসে সেটা গ্রহণ করলেন? পুরো দের ঘন্টা,দেড় ঘন্টা সময় ওকে নিয়ে কথায় হাওয়া খেতে গিয়েছিলেন বলুন ‘?
কৈফিয়ত জিনিসটাকে প্রচন্ড অপছন্দ করে হ্যাভেন। তার ওপর চিৎকার করা তাকে ধমকানো, তাকে চোখ রাঙানো এসবের সাহস আজ অবদি কারো হয়নি। বিষয়টা সে স্বাভাবিক ভাবে পছন্দনীয় ভাবে নেয়ও না। তবে আজ বুকটা প্রশান্তি তে ভরে ওঠছে। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় পুরো শরীর শিউরে ওঠছে। তার বউ যে তার পাশে অন্য মেয়ে দেখে জেলাস ফিল করছে। প্রচন্ড জেলাসি থেকে একদম সাইকোর ন্যায় আচরণ করছে। কে বলে শুধু একা সে সাইকো এই যে তার সুন্দরী বধুওতো সাইকোর চেয়ে কম কিছু নয়। মুচকি হেসে ফেললো হ্যাভেন। আহির হাতের ওপর থেকে হাত সড়িয়ে দুহাতে কোমড় জড়িয়ে কোলে বসিয়ে নিলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাকে নাক ছুঁয়িয়ে ওষ্ঠ ছুঁই ছুঁই করে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করলো,
-‘ ইউ নো হোয়াট সুন্দরী ? জেলাসি ইজ দ্যা বেষ্ট ফিলিংস ‘।
চলবে….