ওহে প্রিয় পর্ব-৪৬

0
1682

#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৪৬
__________________
সত্য কখনো চাপা থাকেনা প্রকাশ পায় একদিন।
তখন কারোর আসে সুদিন কারো আসে দুর্দিন। সুদিনের আয়োজন করতে গিয়ে বোধ হয় দুর্দিনের সম্মুখীন হলো হ্যাভেন। চিলেকোঠার ঘর টাতে দরজা বরাবর ঢোকার পর ডান পাশে একটি সিঙ্গেল বিছানা তার পাশে রয়েছে একটি কাঠের চেয়ার। বাম পাশে রয়েছে কিছু ভাঙা আসবাবপত্র। ভাঙা আসবাবপত্রগুলোর একটিতেই আচমকা আঘাত পায় আহি৷ ভেবেছিলো এক আর হয়ে গেলো আরেক। আর যাইহোক আহিকে আঘাত করে নিজের কাছে আটকে রাখার পরিকল্পনা তার ছিলো না৷ তাই যখন আহির ফোঁস ফোঁস নিঃশ্বাসের শব্দের সঙ্গে ক্রন্দনধ্বনিও কানে বাজলো তখন আর চুপ থাকতে পারলো না। একহাতে আহিকে জড়িয়ে ধরে অপর হাতে পকেট থেকে ফোন বের করে অন করলো। চিলেকোঠার ঘরের ছাদটি টিনের বিধায় অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে বৃষ্টির ঝুম-ঝুম শব্দে গা ছমছমে এক ভাব সৃষ্টি হয়েছে। তীব্র বাতাসে দরজাটাও কড় কড় শব্দ করছে। বৃষ্টির পানি গুলো ছিটকে এসে ভিজিয়েও দিচ্ছে দু’জনকে। ফোন অন হতেই আহিকে ছেড়ে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো হ্যাভেন৷ তখনি ফুঁসে ওঠলো আহি ভাঙা আওয়াজে বললো,

-‘ আপনার ফোনে চার্জ নেই অফ হয়ে গেছে তাহলে এখন চার্জ কোথায় পেলেন অনই বা হলো কি করে’?

হ্যাভেন শান্ত ভণিতায় আহির পাশে বসে ফ্লাশ অন করে জিগ্যেস করলো,

-‘ কোথায় ব্যাথা লেগেছে দেখি ‘।

-‘ কোথাও লাগেনি মিথ্যাবাদি, চিটিংবাজ কোথাকার দূরে সরুন ‘।

-‘ ওকে বাট কোথায় ব্যাথা পেয়েছো সেটা না দেখে এক চুল পরিমাণও নড়বো না ‘।

-‘ মনে হয় এখনি ব্যাথা ভালো করে দেবেন এমন ঢং করছেন’?

মন্থর চোখে তাকালো হ্যাভেন। বললো,

-‘ প্রয়োজনে তাই করবো ‘।

কথাটি বলেই আহিকে আরেকটু কাছে টেনে নিলো। বাতাসের তীব্রতায় পুরো শরীর যখন উষ্ণতাহীন হয়ে এসেছে তখনি একে অপরের থেকে কিছুটা উষ্ণতা পেয়ে কেমন যেনো নিবৃত্ত হয়ে গেলো। দুজনের মাঝে যখন এক চুল পরিমাণ ফাঁকও নেই৷ বৃষ্টির ক্রুদ্ধতায় কান যখন ফেটে পড়ার উপক্রম। তখনি হ্যাভেন কানের কাছে উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে প্রশ্ন করলো,

-‘ ব্যাথাটা কোথায় পেয়েছো আহি…বলো ‘?

না কোন উচ্চবাক্য না কোন বিরোধিতা মূলক শব্দ, অনুগ্রভাবে ব্যাথাটা কোথায় পেয়েছে বলে হাত দিয়ে দেখিয়েও দিলো৷ খোঁপা করে রাখা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কখন খুলে পড়েছিলো খেয়ালই নেই আহির। পিঠে ব্যাথা পাওয়াতে হ্যাভেন আহিকে পিছন ঘুরিয়ে বসিয়ে চুলগুলো এক সাইট করে দেখলো লম্বাটে একটি ফাঁক গেছে কিছুটা রক্তও বের হচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে নিচের ওষ্ঠে কামড়ে ধরে ফ্লাশটা আসবাবপত্রের দিকে তাক করলো এবং দেখতে পেলো ভাঙা একটি ড্রেসিংটেবিলের কাচ চৌকা ভাবে রয়েছে। ধারণা করে নিলো আঘাতটা ওখানেই লেগেছে। মেজাজ’টাই বিগড়ে গেলো তার। এভাবে কেউ ভাঙাচোরা জিনিস রাখে। আল্লাহ না করুক পিঠের পরিবর্তে চোখ হলে কি হতো! ব্যাকুলতার ঘোরে থেকেই কেটে যাওয়া অংশে আলতো আঙুল ছোঁয়ালো হ্যাভেন৷ আহি ‘ইশ’ বলেই চোখ মুখ খিঁচে রইলো। সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নিলো হ্যাভেন। -‘ ব্লাডটুকু মুছে দিচ্ছি অল্প ফাঁক গেছে ঠিক হয়ে যাবে ‘ বলেই আঙুল দিয়ে চেপে ধরে ব্লাড টুকু মুছে দিলো। দাঁতে দাঁত কেটে রইলো আহি। হ্যাভেনের হাত সরিয়ে দিয়ে অনুরোধ করে বললো,

-‘ দেখুন আমার লাগছে আপনি ইচ্ছে করে ব্যাথা দেবেন না। মানুষ কে আঘাত করার চিন্তা বাদ দিয়ে আঘাত সারিয়ে তোলার চিন্তা করা উচিত ‘।

কিছু বললো না হ্যাভেন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাটা স্থানে গভীরভাবে ওষ্ঠাধর দিয়ে স্পর্শ করলো। পুরো শরীর জুরে সাজোরে আন্দোলন তৈরি হয়ে গেলো আহির। একহাতে শাড়ি খামচে ধরে অপরহাতে হ্যাভেনের চুল খামচে সরিয়ে দিলো। হ্যাভেনও খানিকটা দূরে সরে গেলো। কিন্তু ফ্লাশ আহির দিকেই ধরে রইলো৷ নিঃশ্বাসে অস্থিরতা স্পষ্টতর হয়ে ওঠেছে আহির৷ হ্যাভেন শীতল দৃষ্টি’তে চেয়ে মোহপ্রাপ্ত কন্ঠে বললো,

-‘ বৃষ্টি হচ্ছে। আজ নিচে বেশ গাদাগাদি করে ঘুমাতে হতো। তাই ভাবলাম এ ঘরটা যেহেতু খালি আছে কষ্ট না করে এখানেই শোয়া যাবে ঘুমেও ডিস্টার্ব হবে না’।

আহি নিশ্চুপ একটি বাক্যও উচ্চারণ করলো না সে। হ্যাভেন তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করে ব্যার্থ হলো৷ শেষে নিরুপায় হয়ে বললো,

-‘আমি হ্যারি’কে ফোন করছি ‘।

-‘ থাক এখন সাধু সাজতে হবে না। আর না কাউকে বিরক্ত করতে হবে একটা রাতেরই তো ব্যাপার কাটিয়ে দেবো ‘।

বলেই সোজা হয়ে বসে দুহাতে হাঁটু জরিয়ে হাঁটুর ওপর মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো। হ্যাভেনও চুপচাপ ফোনটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেতে রেখে এক পা লম্বা করে বিছিয়ে আরেক পা ভাঁজ করে হাঁটুতে এক হাত রেখে আহির দিকে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। বৃষ্টিস্নাত রাতে অন্ধকারাচ্ছন্ন বদ্ধ ঘরে হিমযুক্ত পরিবেশে দু’জন নর-নারী বসে রয়েছে। তাদের মাঝে দূরত্ব কেবল দু’হাত পরিমাণ। স্মার্ট ফোনের স্বল্প আলোতে পুরুষ ব্যক্তিটি নারী ব্যক্তিকে দৃষ্টিপাত করছে যত্নসহকারে। বুকের ভিতর বৃষ্টির শ’শ শব্দ গুলো যেনো তুমুল ঝড়ের সৃষ্টি করছে। ঠান্ডায় হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। একটু খেয়াল করতেই বুঝলো আহিরও ঠান্ডা লাগছে। শাড়ির আঁচল গায়ে বেশ ভালো মতোন জড়িয়ে বসে আছে এখন৷ কিছু সময় পর পর আড় চোখে তাকেও দেখছে।

-‘ উপরে গিয়ে শুয়ে পড়ো বিছানাটা ঠিকঠাকই আছে প্রবলেম নেই ‘।

কথাটি বলেই হ্যাভন ওঠে দাঁড়িয়ে ফোনটি বিছানার দিকে ধরে আহিকে দেখালো। আহি কিছু না বলে চুপচাপ ওঠে গিয়ে শুয়ে পড়লো। জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,

-‘ পাশে শুয়ে পড়ুন অনেক রাত হয়েছে ঘুমানো উচিত এবার ‘।

আকাশের চাঁদটি হাতে পাওয়ার মতো অনুভূতি হলো হ্যাভেনের। বিনাবাক্যে গায়ে গা ঘেঁষে সেও শুয়ে পড়লো। বেশ অনেকটা সময় হ্যাভেনের মন উশখুশ করলেও আহিকে স্পর্শ করতে পারেনি। একটা সময় আহিই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গুটিশুটি হয়ে তার বুকে মুখ গুঁজে ভারি শ্বাস ছাড়তে শুরু করলো। মুচকি হেসে গভীরভাবে বুকে জড়িয়ে একে অপরের উষ্ণতায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে রইলো দু’জনই।
.
রোজকার মতো যেনো আজকের সকালটি নয়৷ এলোমেলো শাড়িতে হ্যাভেনের বুকে মুখ গুঁজে ঘুমাচ্ছিলো আহি। ঘুম ভাঙতেই এসব কাণ্ড দেখে তব্দা খেলো সে। এক মন বললো হ্যাভেনের শান্তির ঘুম নষ্ট করে দিতে আরেক মন বললো না থাক বেচারি একটু ঘুমাক। পরোক্ষণেই কি ভেবে যেনো দুহাতে হ্যাভেনের মুখটা নিজের গলা থেকে সরানোর চেষ্টা করলো। বিনিময়ে হ্যাভেন ঘুমের তালেই মাথা তুলে আহির ওষ্ঠজোড়ায় নিজের ওষ্ঠজোড়া মিলিয়ে দিলো৷ বহুদিনের তৃষ্ণার্ত কাক যেনো একফোঁটা পানির নাগাল পলো এমনভাবে তৃষ্ণা মেটালো হ্যাভেন৷ এখন কথা হচ্ছে কাজটা ঘুমের তালে করলো নাকি সজাগ থেকে ইচ্ছে করে ঘুমের ভান করে করলো? শুধু মাত্র চুমু খাওয়ার জন্য এমন নিখুঁত অভিনয়! হ্যাভেন তালুকদার… তুমি যে বড়ো সেয়ান। মনে মনে কথা গুলো ভেবেই বুক বরাবর ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে ধাতুপাত করে ওঠে বিছানা ছাড়লো আহি।
__________________
দুপুর বারোটা। সকালের পর আর হ্যাভেনের মুখোমুখি হয়নি আহি৷ এদিকে টেনশনে হ্যাভেনের অবস্থা বেশ নাজেহাল। বউ ভাতের অনুষ্ঠানের জন্য রেডি হচ্ছে সকলেই। আহিকেও রেডি হতে দেখে এসেছে৷ এতো বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন। সেখানে হরেক রকমের মানুষ জন থাকবে। সুন্দরী বউ থাকলে একটু ভয় ডর হওয়াটাই স্বাভাবিক। তার বউয়ের কাছে ঘেঁষার সাহস কারো হবে না৷ কিন্তু সে চায় বউ’টা সর্বক্ষণ তার পাশে থাকুক৷ এতো মানুষের মাঝে কার সাথে না কার সাথে কোন গাড়িতে না কোন গাড়িতে যাবে কে জানে? ভাবতেই কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়তে শুরু করলো৷ কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতে নানুমনির কথা মাথায় এলো। এবং দ্রুত চলে গেলো নানমনির ঘরে৷ সেখানে তাদের কি কথোপকথন হলো শুধু তারাই জানে। কিন্তু পাঁচ মিনিট বাদেই আহি’কে হিয়া জানালো নানুমনির জরুরী তলব করেছে।
.
নানুমনির ঘরে ঢুকতেই হ্যাভেনের মুখোমুখি হলো আহি। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো দু’জনই। একে অপরের দিকে আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কয়েক পল। সর্বো প্রথম সম্বিত ফিরে পেলো আহি। চোখ পিটপিট করে আগাগোড়া হ্যাভেনকে দেখলো। সাদা কোর্টের ভিতর কালো শার্ট, সাদা প্যান্ট, কালো জুতা,পুরো লুকটাই চেঞ্জ। গায়ের চামড়া সাদা মানেই সুদর্শন কে বলে? এইতো তার সামনে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুদর্শন পুরুষ টি দাঁড়িয়ে আছে। কৃষ্ণবর্ণ এই পুরুষটিই তার গৌর বর্ণের সঙ্গে একমাত্র মানান সই। তার গৌর বর্ণের সর্বাঙ্গে মিশে রয়েছে কৃষ্ণবর্ণের এই সুদর্শন পুরুষটি…

গতকাল সকালে যার লুক দেখে সভ্যতার কাতারে ফেলতে মন চাচ্ছিলোনা আজ তাকে পুরো দমে সভ্য, ভদ্রর কাতারে ফেলা যাচ্ছে। আহা চোখ যেনো জুরিয়ে যাচ্ছে। কে বলবে আটাশের ঘরে পা ফেলা এই পুরুষ’টির আচরণ বেশ কিছু মাস আগেও ষোল,সতেরো বছর বয়সী কিশোরদের মতোন ছিলো? তবে তা শুধু নিজ বউয়ের বেলায়ই। নানারকম ভাবনা চিন্তা থেকে বেরিয়ে মনে মনে বললো ‘মাশাআল্লাহ এমপি সাহেব মাশাআল্লাহ ‘। প্রকাশ্যে মুখশ্রী তে নমনীয়তা বজায় রেখে বললো,

-‘ সরুন নানুমনির কাছে যাবো ‘।

হুঁশে এলো হ্যাভেন। গাঢ় সবুজ রঙের জরজেট শাড়ি পরেছে আহি৷ হাতে,কানে,গলায়, নাকে সর্বোত্রই স্বর্ণের অলংকারে সজ্জিত রয়েছে সে। চুলগুলো খোঁপা করে খোঁপায় তাজা রজনীগন্ধার গাজরা লাগিয়েছে। সে গাজরার ঘ্রাণে মাথা ঘুরে যাচ্ছে কেমন। সিঁথি বরাবর ছোট্ট একটি টিকলি তার খানিকটা নিচেই গাঢ় সবুজ রঙের একটি টিপ। হার্ট শেপড লাল টকটকে ওষ্ঠকোণে খানিকটা ফুলে ওঠেছে। তা দেখে শরীর জুরে বয়ে গেলো শীতল স্রোত। অস্ফুটস্বরে হ্যাভেন বলে ফেললো,

-‘ আই লাইক ইট সুন্দরী ‘।

সে সময়ই ফোন বেজে ওঠলো তার৷ ফোন বের করতেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো। আহির দিকে এক পলক চেয়ে মাথা দুলিয়ে বললো,

-‘ উফফ সুন্দরী আপনার প্রাণ প্রিয় ম্যাম আমাদের জাতির ক্রাশের দেবর ফোন করেছে। কথা বলে আসি ‘৷ বলেই চোখ মেরে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো ৷

আহি রুদ্ধশ্বাস ছেড়ে দরজার দিকে ক্ষণকাল তাকিয়ে রইলো।

চলবে..