ওহে প্রিয় পর্ব-৫০ এবং শেষ পর্ব

0
2944

#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫০
____________________
আহিকে ওভাবে পড়ে যেতে দেখে ‘ওহ শীট’ বলেই চিলেকোঠার ঘর থেকে ছুটে এলো হ্যাভেন৷ উদগ্রীব হয়ে আহিকে ধরে ওঠালো। অনুরাগের স্বরে বললো,

-‘ কিভাবে হাঁটা চলা করো তুমি? একটু সাবধানে হাঁটবে তো দেখি কোথায় লাগলো? ধ্যাত… বালের প্ল্যান আমার! ‘

একদিকে হাত এবং নাকে তীব্র ব্যাথা অপর দিকে অর্ধেক শাড়ি খুলে পড়া,আবার আচমকাই হ্যাভেনের আগমন। সব মিলিয়ে রুদ্ধশ্বাস এক মূহুর্ত। হ্যাভেন ব্যস্ত ভঙ্গিতে দাঁত কিড়মিড় করে রাগ ঝাড়ছে পাশাপাশি আহির শাড়ির আঁচল কাঁধে জরিয়ে ময়লা ঝেড়ে ফেলছে। সবশেষে আহির দিকে তাকিয়ে নাকের ডগায় আলতো আঙুল ছোঁয়ালো। আহি চোখ বুঝে ভারী শ্বাস ছাড়লো,দু’চোখ বেয়ে কয়েকফোটা অশ্রু গড়িয়েও পড়লো তার। তা দেখে হ্যাভেন কিছুটা সংযত হয়ে আহিকে জরিয়ে ধরতে উদ্যত হবে তার পূর্বেই অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো আহি। ঠাশ করে হ্যাভেনের ডান গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। শুধু থাপ্পড় দিয়েই ক্ষ্যান্ত হলো না ক্রোধান্বিত কন্ঠে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই তৎক্ষনাৎ হ্যাভেন ক্ষিপ্ত হয়ে আহির দু’কাধ শক্ত হাতে চেপে ধরে চিলেকোঠার ঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড় করালো এবং চিৎকার করে বললো,

-‘ হাউ ডেয়ার ইউ আহি!’

হ্যাভেনের এহেন রূপ দেখে আঁতকে ওঠলো আহি। সব রাগ,অভিমান নিমিষেই উধাও হয়ে চোখে, মুখে ভর করলো একরাশ আতংক। এক ঢোক গিলে তোতলাতে তোতলাতে কিছু বলতে যাবে তখনি হ্যাভেনের হুঁশ ফিরলো। আহি কি করেছে এবং সে কি করতে যাচ্ছিলো মনে করতেই চোখ বন্ধ করে ক্ষণকাল চুপ রইলো। যখন চোখ খুললো দেখলো বদ্ধ চোখে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে আহি। ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে কাঁধ ছেড়ে দু’হাতের আঁজলে আহির চোয়াল চেপে ধরলো। চোখেমুখে গম্ভীরতা ফুটিয়ে তুলে বললো,

-‘ কাঁদছো কেন? ‘

উত্তর দিলো না আহি। দু’হাতে হ্যাভেনের বুক বরাবর মৃদু ধাক্কা দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার জন্য দু’পা এগিয়েছে মাত্র। অমনি শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো হ্যাভেন৷ আহি কাঁধে আঁচল চেপে ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। হ্যাভেন বারতি আঁচলটুকু হাতে প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে এগিয়ে গিয়ে আহির পিঠ একদম নিজের বুকে ঠেকালো। চোখ বন্ধ করে হ্যাভেনের ধরে রাখা আঁচলটুকুতে হাত রাখলো আহি। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর তীব্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অবিরত সে। হ্যাভেন ঘাড় বাঁকিয়ে তার ক্লেশবোধ পরখ করে নিয়ে বাঁকা হাসি দিলো। এবং সঙ্গে সঙ্গেই গভীরভাবে ওষ্ঠজোড়া ছুঁইয়িয়ে দিলো আহির কাঁধে। দু’হাতে নিজের শাড়ি খামচে ধরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো আহি। হ্যাভেন তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালে চুমু খেতেই সে অশ্রুসিক্ত নয়ন দু’টো মেলে ধরলো। সে দৃষ্টিতে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকার সাহস হলোনা হ্যাভেনের। দৃষ্টি নত করে আহির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো। হাতের পিঠে ওষ্ঠ ছুঁইয়িয়ে একবার তাকালো আহির পানে। আহির অভিমানী দৃষ্টি, অভিমানী মুখশ্রী অতি সন্তর্পণে হজম করে নিয়ে পা বাড়ালো চিলেকোঠার রুমের দিকে। সেখানে গিয়ে আহি দেখতে পেলো ল্যাপটপে তাদের বেডরুমের যাবতীয় চিত্র ফুটে ওঠেছে। রাগে শরীর কাঁপতে শুরু করলো এবার আহির। ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে হ্যাভেনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। হ্যাভেন ভ্রু নাচিয়ে আহির ধরে রাখা হাতটি আরো শক্ত করে চেপে ধরলো৷ আহি কিছু বলতে উদ্যত হতেই এক আঙুলে আহির ওষ্ঠজোড়া চেপে মৃদু স্বরে বললো,

-‘ চুপপ কোন কথা নয়। বিয়ের পূর্বে প্রথম দেখার দিন গায়ে হাত তুলেছিলে পরিণামে কি পেয়েছিলে ভুলে গেছো সুন্দরী? বিয়ের পর আজ আবারও এমন দুঃসাহসিকতা দেখিয়েছো এর পরিণাম কতোটা ভয়াবহ হয় এবার দেখো। ‘

ভয়ে পুরো শরীর অসাড় হয়ে আসার উপক্রম আহির৷ তার ভয়’টাকে অনুভব করতে পেরে রহস্যময় এক হাসি দিলো হ্যাভেন। আহির কানের কাছে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে মৃদুস্বরে বললো,

-‘ ডোন্ট ওয়ারি জান প্রথম বারের শাস্তিটা ছিলো ভালোবাসা বিহীন, দ্বিতীয় বারের শাস্তিটা হবে ভালোবাসা মিশ্রিত। ‘

চলবে…

#ওহে_প্রিয়
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫০ (বর্ধিতাংশ) অন্তিম পর্ব
.
.
চিলেকোঠার ঘর থেকে বেরিয়ে আহিকে নিয়ে ছাদের বামপাশে চলে গেলো হ্যাভেন৷ সেখানে গিয়ে আহির হাতটি ছেড়ে দিয়ে পাশেই চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো। জ্যোৎস্নার কোমল কাব্যিক রূপে বারতি কোন আলোর প্রয়োজন হলো না আহির। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ছাদের মেঝেতে একটি গোলাকার চারপায়া বিশিষ্ট উঁচু আসবাববিশেষ। যেটি পায়া অবদি সাদা পর্দায় ঢাকা রয়েছে। এবং মুখোমুখি দু’টো চেয়ার। তার থেকে কয়েক কদম দূরে চার কোণায় চারটি ভিন্ন ভিন্ন গাছ। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি’তে পরোখ করে চারটি গাছ’কেই শনাক্ত করতে পারলো সে৷ লালগোলাপ এবং সবুজ পাতায় পরিপূর্ণ একটি গোলাপ ফুল গাছ। মাঝখানে রয়েছে সাদা আস্তরণে ঢাকা গোলাকার টেবিল। তারপরেই লালগোলাপ গাছটির সম্মুখীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি গাছ। যেটিতে রয়েছে কদমফুলে ভরপুর। চমকে লালগোলাপ গাছটির দিকে আবারো তাকালো আহি। এমনও হয়! এমন গাছ তো আগে কখনো দেখেনি সে। এতো বড় গোলাপ গাছ কস্মিনকালেও দেখেনি সে এমনটি হয় তাও শুনেনি কারো কাছে। ছাদে এই অদ্ভুত গাছগুলোর স্থান হলো কি করে? ভ্রু যুগল কুঁচকে গোলাপ গাছের বামপাশে তাকালো সেখানে যে গাছটিকে দেখতে পেলো সেটি হচ্ছে আগা থেকে গোড়া অব্দি কাশফুলে ভরপুর। আশ্চর্যান্বিত হয়ে চেয়েই রইলো সে। কাশফুলের এমন গাছ! কাশফুল গাছের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে শিউলি ফুল গাছ। আশ্চর্যান্বিত হয়েই এবার হ্যাভেনের দিকে তাকালো আহি। হ্যাভেন ট্রাউজারের পকেটে দু’হাতে গুঁজে ওষ্ঠকোণে দুর্বৃত্ত হাসি ফুটিয়ে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আহির পানে। আহির আশ্চর্যান্বিত মুখশ্রী, উদ্ভাসিত দৃষ্টিজোড়া অতি সন্তর্পণে দেখে যাচ্ছে। আহি অবনত কন্ঠে বললো,

-‘ এসব কি হ্যাভেন! ‘

-‘ এখানে আপনি যা দেখছেন পরবর্তী’তে যা দেখতে পাবেন এবং আপনার সাথে যা কিছু ঘটবে সবই আপনার কল্পনা জগতের ঊর্ধ্বে ম্যাম। তবে হ্যাঁ আপনার কল্পনা জগতের রহস্য উদঘাটন করেই ছোট্ট পরিসরে এই আয়োজন আমার। আপনি খুশিতো মাই জান?’

হ্যাভেনের মুখে ঢংগি সুরে আপনি শুনে কপট রাগ দেখিয়ে আহি বললো,

-‘ এসব আয়োজন কি রিয়েলি আমার জন্য হ্যাভেন তালুকদার? নাকি নতুন কোন রমণীর আগমন ঘটেছে আপনার জীবনে? আমার জন্যই যদি হবে তো এই লুকোচুরি খেলা কেন, আমায়ই বা এ বাড়ি ছাড়া করানোর জন্য সকলে ওঠে পড়ে লেগেছেন কেনো? হুয়াই! ‘

হকচকিয়ে গেলো হ্যাভেন। সেই সাথে মজাও পেলো খুব৷ হাত দু’টো পকেটে গুঁজে রাখা অবস্থায়ই মাথা উঁচিয়ে বুক ফুলিয়ে দারুণ এক ভাব নিয়ে আহির আশেপাশে ধীর পায়ে ঘুরপাক দিতে শুরু করলো। আহি চোখ ঘুরিয়ে হ্যাভেনের ভাব ভঙ্গি দেখে প্রচন্ড ক্ষেপে গেলো। আঙুল উচিঁয়ে বললো,

-‘ আপনার মতো খারাপ মানুষ আর দু’টো দেখিনি আমি। আপনার মধ্যে আমার জন্য বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসা নেই। আপনার মতো মানুষের সঙ্গে এক মূহুর্ত থাকাও ইম্পসিবল। ‘

কথাগুলো বলেই চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো আহি। ঠোঁট কামড়ে হাসলো হ্যাভেন। আহির হাত আঁটকে যেতে বাঁধা দিলো আহি থেমে গিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলো৷ রাগ তার আকাশ ছুঁয়েছে বুঝতে পারলো হ্যাভেন তাই আর বেশী ঘাটলো না৷ একটানে টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজে হাঁটু গেড়ে বসলো। আহির হাতজোড়া নিজ হাতে মুঠোবন্দি করে নিয়ে হাতের পিঠে চুমু খেলো৷ বললো,

-‘ সুন্দরী মেয়েদের রাগতে নেই। এতে তারা ভয়ংকর সুন্দরী হয়ে ওঠে। তখন তাদের সে সৌন্দর্যের আগুনে আমার মতো কৃষ্ণমানব’রা ঝলসে যেতে বাধ্য হয়। ‘

হ্যাভেনের কথা শুনে আহির অনুরাগী মুখখানা এবার রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। চোখেমুখে ভর করলো একরাশ লাজুকলতা। সেই লাজুকলতা’কে হ্যাভেন থেকে লুকানোর উদ্যেগ নিয়ে মাথা নিচু করলো আহি। চিবুক ছুঁয়ে রইলো বুকে। হ্যাভেন পরিস্থিতি বুঝতেই ওঠে দাঁড়ালো। সঙ্গে সঙ্গে আহিও দাঁড়িয়ে গেলো। চোখেমুখে আবারো ক্রোধ ফুটিয়ে কিছু বলতে যাবে তৎক্ষনাৎ হ্যাভেন তার ওষ্ঠে আঙুল চেপে ধরলো৷ দৃষ্টিতে প্রগাঢ়তা মিশিয়ে কন্ঠে দৃঢ়তা বজায় রেখে বললো,

-‘ উহুম কোন কথা নয়। আমি যখন বলবো তখন তোমার বলার কোন সুযোগ নেই৷ ঠিক যেমনটা আমি যখন তোমায় আদর দিতাম তোমায় বিন্দু সুযোগটুকুও দিতাম না। ‘ বলেই বাঁকা হাসি দিলো।

পুরো শরীর শিরশির করে ওঠলো আহির৷ কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছে যেনো। ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকাও কষ্টকর হয়ে ওঠলো৷ না পেরে হ্যাভেনের আঙুল চেপে রাখা হাতটি এক ঝটকায় ছাড়িয়ে পিছন ঘুরে ঘনঘন নিঃশ্বাস ছাড়লো। আহির অবস্থা যতোটা না করুণ হ্যাভেনের অবস্থা তার চেয়েও দ্বিগুন শোচনীয়। তাই খুব বেশী সময় নিলো না হ্যাভেন প্রথমত আহিকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার জন্য বললো,

-‘ পরিবেশ টা সুন্দর না? ‘

ক্ষণকাল চুপ থেকে আহি বললো,

-‘ খুবই বাজে। ‘

-‘ তাই। ‘ বলেই আহির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো হ্যাভেন। বললো,

-‘ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে গাছ গুলো লাগিয়েছি। মাটি বিহীন এমন সুন্দর পুষ্পে সজ্জিত গাছ উপহার দিলাম আর তুমি বলছো খুবই বাজে! এসবই তোমার জন্য নিজ বুদ্ধি খাটিয়ে তৈরী করিয়েছি কিছুটা প্রশংসা কিন্তু পেতেই পারি। ‘

ঘাড় বাঁকিয়ে আহির দিকে তাকালো হ্যাভেন৷ চাঁদের মৃদু আলোতে আহির লাজুক মুখাখানি দেখতে পেয়ে স্মিত হাসলো সে৷ আহি তার পাশ থেকে সরে গিয়ে একে একে গাছগুলো ছুঁয়ে দেখলো। গাছের পাতা থেকে শুরু করে ফুল এবং আগাগোড়া, ডালপালা সমস্তই প্লাস্টিকের তৈরী৷ যা আহি ছুঁয়ে বুঝলো নয়তো বোঝার উপায় নেই। হ্যাভেনের বুদ্ধিমত্তা সত্যি প্রশংসনীয় লাগলো তার কাছে সেই সাথে খাঁটি প্রেমিক পুরুষও। মনের অজান্তেই ওষ্ঠকোণে হাসি ফুটলো তার। সে হাসিটা হ্যাভেন দেখতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে আহিকে টেনে আবারো দাঁড় করালো সাদা আস্তরণে ঢাকা টেবিলের সামনে। নির্বোধের মতোন তাকিয়ে রইলো আহি। হ্যাভেন ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসিটি বজায় রেখে বললো,

-‘ এখন যা হবে সেসবের প্ল্যান আগে থেকেই করা ছিলো শুধু ভিন্নভাবে। সাবা ম্যামের মৃত্যু না ঘটলে হয়তো সব কিছুই অন্যভাবে হতো। সে যাই হোক না কেন আমি আমার প্ল্যানে সাকসেসফুল হলেই চলবে৷ আর কিছু চাই না। ‘

হ্যাভেনের থেকে হাত ছাড়িয়ে আহি বললো,

-‘ আমি কিছু শুনতে চাই না আর না কিছু বুঝতে চাই। শুধু এটুকু বলুন আপনি কি আমার সঙ্গে থাকতে চাইছেন না? আমায় কেন বাড়ি ফিরিয়ে দিতে চাইছেন?’

-‘ উফফ আহি বড্ড অধৈর্য তুমি। যে প্রশ্ন গুলো করছো সব উত্তর পেয়ে যাবে। তার জন্য মুখটা বন্ধ রাখতে হবে এবং আমার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনতে হবে। ‘

-‘ ওকে বলুন শুনতে চাই আমি। ‘

মুচকি হেসে আহির হাতটি নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে টেনে চেয়ারে বসিয়ে নিজেও চেয়ার টেনে তার পাশে বসলো৷ হ্যাভেনের নম্র স্বভাব দেখে কিছুটা অস্বস্তি ঘিরে ধরলো আহিকে। জড়োসড়ো হয়ে চুপ করে বসে রইলো। তার অবস্থা দেখে হালকা কেশে ওঠলো হ্যাভেন এবং বলতে শুরু করলো,

-‘ তুমি আমায় শর্ত দিয়েছিলে আহি। আমি তোমার শর্ত পূরণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। তবে একটা কথা বলে রাখি শুনো শর্ত সাপেক্ষে কখনো কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মায় না। আর না সম্পর্কের ভিত শক্ত হয়৷ তোমার আমার সম্পর্ক শুরুটা যেভাবেই হোক না কেন একটা সময় আমার দিক থেকে ভালোবাসা জন্মেছে। আর সেই ভালোবাসা থেকেই আমি তোমার শর্তগুলো হয়তো পুরোপুরি পালন করতে সক্ষম হইনি৷ একটা মানুষ যখন তোমার মনের চাওয়া,পাওয়া গুলো বুঝতে পারে,পড়তে পারে তোমার চোখের ভাষাগুলো। তখন সেই মানুষটা আর কি শর্ত পালন করবে বলতে পারো? ‘

অবাক দৃষ্টিতে হ্যাভেনের দিকে তাকালো আহি। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হ্যাভেনও। যতোটুকু মুখে বলছে হ্যাভেন, যতোটুকু কানে শুনছে আহি এর চেয়েও দ্বিগুন কথোপকথন হচ্ছে তাদের চোখে চোখ রেখে। যেনো শুধু হাতে হাত রাখাই বাকি। হ্যাভেন হালকা কেশে ওঠে আবারো বললো,

-‘ তুমি আমায় শর্ত দিয়েছিলে তোমার থেকে দূরে থাকতে হবে আমায়। দূর থেকে তোমার পক্ষ থেকে কোন প্রকার সাপোর্ট না পেয়ে তোমার মন জয় করতে হবে৷ বুঝতে হবে তোমার চোখের ভাষাগুলো। বিশ্বাস করো আমি দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। কোনভাবেই তোমাকে ফেরাতে পারছিলাম না৷ আর না বুঝতে পারছিলাম তোমার শর্তের আসল মানেগুলো। কিন্তু তোমাকে ছাড়া এক মূহুর্তও বাড়িতে টিকতে পারছিলাম না। আবার তোমার শর্তগুলো কিভাবে পূরণ করবো তাও বুঝতে পারছিলাম না৷ একদিকে আমার শূন্য ঘর শূন্য বুক অন্যদিকে নির্ঘুম রাত। রাতের পর রাত চলে যাচ্ছিলো অথচ ঘুম নেই আমার চোখে। যখনি চোখ লাগতো তখনি নব্যজাত শিশুর কান্নার আওয়াজে চমকে ওঠতাম৷ বুক টা খাঁ খাঁ করতো৷ কানের কাছে স্পষ্ট ভেসে ওঠতো শিশু বাচ্চার গলা ফাটানো চিৎকার। কখনো কখনো দূর আকাশে মেঘেদের ভেসে বেড়ানোর দৃশ্যতে ভেসে ওঠতে তুমি তোমার কোলে সদ্যাজাত শিশুর ঘুমন্ত মুখ দেখতে পেতাম৷ তোমরা দু’জন স্বপ্নে এসেও আমাকে একা করে চলে যেতে৷ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে তোমাদের ডাকতাম তোমরা দুজন ফিরেও তাকাতে না৷ আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে পাষাণ হৃদয়ের অধিকারীনি হয়ে আমার বাচ্চা’কেও পাষাণ বানিয়ে চলে যেতে তুমি। তখনি আচমকাই ঘুম ভেঙে যেতো আমার। আশেপাশে তাকিয়ে দেখতাম আমি বিছানায় পড়ে আছি। এসি, ফ্যান চলা সত্ত্বেও পুরো শরীর ঘেমে চুপচুপে হয়ে গেছে। গলা থেকে বুক অবদি শুকনো কাঠের ন্যায় অনুভব হচ্ছে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসতো আমার৷ পাগল পাগল লাগতো। কখনো ইচ্ছে হতো নিজেকে শেষ করে দেই। কখনো বা ভাবতাম আবারো তুলে নিয়ে আসি তোমায়৷ হাত,পা বেঁধে রেখে দেই আমার ঘরের কোণে। যেন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় তোমার মুখখানি দেখতে পারি,আমার সকালটা শুরু হয় তোমার নিষ্পাপ মুখশ্রী দেখে, প্রতিবার খাওয়ার সময় তোমার যত্নগুলো যেন আমি পাই, আমার বামপাশে গত দু’বছরের স্বভাবসুলভ যেন তোমাকে পাই, বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় তোমার ছোট্ট এই কপালে আমার ঠোঁটের প্রাগাঢ় স্পর্শটুকু দিতে পারি,প্রচন্ড ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন বাড়ি ফিরবো সদর দরজায় তোমার স্নিগ্ধ মুখশ্রী দেখে দূর করতে পারি আমার সকল ক্লান্তি। সব শেষে তোমার ঠোঁটে চুমু খেয়ে শান্ত করি আমার তৃষ্ণার্ত বক্ষঃস্থল’কে। ‘

দু’হাতে শাড়ি খামচে ধরে নিচের ওষ্ঠ কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে আহি। হ্যাভেন সেই স্বপ্নগুলোই দেখে যা সে নিজেও দেখে আসছে গত ক’মাস ধরে। তার প্রতিটা সকালে তন্দ্রা কাটে নব্যজাত শিশুর ক্রন্দনধ্বনি শুনেই। প্রথম দিকে সে তার মা’কে এ বিষয় জানিয়েছিলো, প্রশ্ন করেছিলো বারে বার৷ তার মা উত্তর দিয়েছিলো ‘তুই তো মা… বাচ্চার প্রতি তোর টান বেশী। হয়তো বেশী চিন্তা করিস বাচ্চা নিয়ে ভাবিস তাই স্বপ্নে আসে ‘ মায়ের কথা মনে করে আহি ভাবলো ‘তাহলে কি হ্যাভেনও এ বিষয়ে ভীষণ উইক? ‘

আহির চোখে অশ্রু দেখে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো হ্যাভেন৷ এবং দৃষ্টি স্থির রাখলো আকাশ পানে। সেভাবেই বলতে শুরু করলো,

-‘ এতো যন্ত্রণার মাঝেও আমি তোমার দেওয়া শর্ত, তোমার চোখের গভীরতা, তোমায় ঘেরা রহস্য এসব কিছুর হিসাব মেলাতে চেষ্টা করি৷ নারী চরিত্র যে ভীষণ রহস্যপূর্ণ হয় তা তোমার দ্বারাই বার বার প্রমাণিত হয়েছে। তোমার এই রহস্য কেবল মাত্র একটি পুরুষ দ্বারাই উদঘাটন করা সম্ভব। আর সে পুরুষ’টি হলাম আমি৷ রহস্য কিভাবে উদঘাটন করেছি জানতে চাও? রিদির বিয়ে উপলক্ষে নানুবাড়ি যাওয়ার পর থেকেই প্রতিটা দিন,প্রতিটা সেকেন্ড রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করেছি। তুমি বলেছিলে তোমার থেকে দূরে থাকতে কিন্তু এতো বেশী দূরত্ব আমার সহ্য হয়নি তাই নানুমনিকে দিয়ে প্ল্যান করে তোমায় নানু বাড়ি নিয়ে যাই। অন্তত পক্ষে রোজ এক বার হলেও চোখের দেখা তো দেখতে পারবো এটুকুতেই শান্তি। তবে সে শান্তি খুঁজতে গিয়েও পেয়ে গেছি অনেক বড় প্রাপ্তি আর সে প্রাপ্তির ফল সরূপ আজকের এই দিনটি। ভেবেছিলাম রিদির বিয়ের ঝামেলা মিটে গেলে আমাদের জীবনটা নতুন করে শুরু করবো। সে ভাবনাতেই সব প্ল্যান আগাচ্ছিলো। কিন্তু প্ল্যান ফ্লপ খেলো সাবা ম্যামের মৃত্যু’তে। তাই সব কিছু আবার ভিন্ন ভাবে শুরু করলাম। কিন্তু সেখানেও বাঁধা দিলে তুমি। ভুলে গেলে নিজের দেওয়া শর্তগুলো সাথে স্বপ্নগুলোও। কিন্তু আমিতো ভুলিনি। যে কোন মূল্যে আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছি আহি। তবে হ্যাঁ বড্ড শান্তি পেয়েছি দুদিন আগে। কথায় আছে তুমি যদি ইট ছুড়ো পাটকেল ফেরত পাবে। এ কথাটি যেমন আমার ক্ষেত্রে মিলেছে তেমন তোমারও৷ ‘

বেশ অনেক আগেই নিঃশব্দে হ্যাভেনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে আহি। তাই হ্যাভেনের বলা শেষ কথাটি শুনতেই সে বললো,

-‘মানে।’

ঘুরে দাঁড়ালো হ্যাভেন। আহির কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচুস্বরে বললো,

-‘ আশা করি সে রাতে বুঝেছো পার্টনার থেকে রেসপন্স না পেলে কতোখানি কষ্ট হয়। ‘

বড় বড় করে তাকালো আহি। ভীষণ লজ্জাও পেলো। চোখ, মুখের আকার পরিবর্তন হতে থাকলো ক্রমশ। হ্যাভেন মুচকি হেসে আহির হাতটি ধরে আবারো টেবিলের সামনে দাঁড় করালো। তারপর নিজে হাঁটু গেড়ে বসে আহির বাম হাত’টি নিজের ডানহাতে তুলে নিলো। আচমকাই এমনটা করায় চমকে ওঠলো আহি। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো হ্যাভেনের দিকে। হ্যাভেন বাঁকা হেসে বাম হাতটি বাড়িয়ে টেবিলের ওপর থাকা সাদা আস্তরণ’টি এক টানে সরিয়ে নিচে ফেলে দিলো। এবার আরো একটু চমকালো আহি। হ্যাভেন তার কুটিল হাসিটি বজায় রেখেই প্রগাঢ় দৃষ্টিতে আহির পানে তাকিয়ে বাম হাতের সাহায্যে টেবিলের মাঝ বরাবর থাকা লাল রঙের রিং বক্স’টি হাতে নিয়ে কৌশলে একহাতের সাহায্যে বক্সটি খুলেই রিং নিয়ে বক্স নিচে ফেলে দিলো। এক ঢোক গিললো আহি তীব্র উত্তেজনায় বুক ধড়ফড় করছে তার। হ্যাভেন অতি সন্তর্পণে আহির অনামিকায় রিংটি পরিয়ে দিয়ে গাঢ় একটি চুমু খেলে আঙুলের পিঠে। তারপর আবারো টেবিলে হাত বাড়িয়ে লাল গোলাপ ফুলের তোরা নিয়ে আহির দিকে উঁচিয়ে ধরে বললো,

-‘ উইল ইউ ম্যারি মি এ্যা সেকেন্ড টাইম? ‘

পুরো শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো আহির৷ শরীরের প্রতিটি লোমকূপে যেনো মিশে গেলো হ্যাভেনের বলা কথাটি ‘উইল ইউ ম্যারি মি এ্যা সেকেন্ড টাইম?’ হায় কপাল! এও হওয়ার ছিলো? বিয়ের দু’বছর পর বর বউ’কে এভাবে প্রপোজ করছে? বিয়ের প্রপোজাল এও সম্ভব? হয়তো সম্ভব হ্যাভেন দ্বারা সবই সম্ভব। আবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেললো আহি৷ হ্যাভেন তার প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে আবারো বললো,

-‘ উইল ইউ বি মাই কুইন? আই ওয়ান্ট টু ম্যারি ইউ। আই ওয়ান্ট টু ম্যারি ইউ ফর দ্যা সেকেন্ড টাইম। প্লিজ…একসেপ্ট মাই অফার আহি। ‘

বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো আহি। সে কি স্বপ্ন দেখছে নাকি সত্যি বুঝে ওঠতে পারছেনা৷ এও হওয়ার ছিলো তার সাথে? এতো দুঃখ,এতো কষ্ট,যন্ত্রণার পর এতোখানি সুখ লিখা ছিলো তার কপালে? অতি সুখে হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করলো আহির। অস্ফুটে স্বরে হ্যাভেনের নামটি উচ্চারণ করতেই হ্যাভেন আবারো বললো,

-‘ আজ যদি তুমি আমায় একসেপ্ট করো আগামীকালই শ্বশুর মশাইয়ের বাড়িতে গাড়ি পাঠাবো। তাদের অনুমতি নিয়েই আগামীকাল তোমার আমার গায়ে হলুদ, তারপর বিয়ে। এবার কি গ্রহণ করবেন ম্যাম? ‘

দুচোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু নিঃসৃত হতে শুরু করলো আহির। হাত নামিয়ে ফেললো হ্যাভেন৷ মাথা নত করে ক্ষণকাল সময় চুপ থেকে ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ছাড়লো। ফুলের তোরাটি ছাদের মেঝেতে পাশে রেখে দু’হাতে আহির কোমড় জরিয়ে ধরলো। আহির পেটের কাছে মাথা ঠেকিয়ে নিঃশব্দে অশ্রুপাত করে বললো,

-‘ আ’ম সরি আহি। আমি তোমাকে আমার প্রথম ভালোবাসা, প্রথম স্ত্রী করতে পারিনি৷ কিন্তু আমি তোমায় আমার শেষ ভালোবাসা হিসেবে গ্রহণ করেছি। কারো অতিত হওয়াটা গর্বের বিষয় নয় আহি গর্ব তখন করা যায় যখন একটা মানুষের ভবিষ্যৎ শুধু তোমার দ্বারাই নিশ্চত থাকে। তুমি আমার ভবিষ্যৎ, তুমিহীন আমার অস্তিত্ব’কেই স্বীকার করিনা আমি৷ এ পৃথিবীতে সব সম্পর্ক সমান হয় না। সব ভালোবাসার প্রগাঢ়তাও এক হয় না। তোমার আমার সম্পর্কের জটিলতাই সম্পর্কের প্রগাঢ়তা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের প্রথম বিয়েটা সুখকর ছিলো না। আমাদের প্রথম বন্ধনটাও জোরালো ছিলো না৷ এর ফলস্বরূপ হয়তো উপরওয়ালা আমাদের প্রথম সন্তান’কেও আমাদের কাছে পাঠাননি। কিন্তু আমাদের দ্বিতীয় বিয়েটা সুখকর হবে। তোমার আমার এবং দুটো পরিবারের সম্মতি’তে আমরা দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবো। দ্বিতীয় বার ঘর বাঁধবো আমরা। দ্বিতীয় বার আমার সন্তান তোমার গর্ভে আসবে। আমাদের দু’জনের ভালোবাসার ফল হবে সে। আমাদের দু’জনের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে এ পৃথিবীর আলো দেখবে সে। আমার সন্তান, তোমার সন্তান, আমাদের সন্তান আসবে। ‘

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠলো আহি। হ্যাভেন নিজের চোখের অশ্রুকণা গুলো আহির শাড়ি দ্বারা মুছতেই এক ফোটা পানি স্পর্শ করলো আহির কুণ্ডলী’তে। সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে ওঠলো আহি। অস্ফুটে স্বরে বললো,

-‘ হ্যাভেন.. আপনি কাঁদছেন? ‘

স্মিত হাসলো হ্যাভেন জরিয়ে ধরা অবস্থাতেই চোখ তুলে তাকিয়ে ভাঙা আওয়াজে বললো,

-‘ আমার উত্তর এখনো পাইনি আমি। ‘

আহি ফিকরে ওঠলো কান্নামিশ্রিত হাসি দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,

-‘ ইয়েস আই উইল…’

আহির থেকে উত্তর শুনে আবেশে দৃষ্টিজোড়া বদ্ধ করে কুণ্ডলীতে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো হ্যাভেন। শিউরে ওঠলো আহি হ্যাভেনের আবদ্ধ হাতজোড়া জোর পূর্বক ছাড়িয়ে সরে গেলো কিছুটা। ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেললো হ্যাভেন। মাথা চুলকে ওঠে দাঁড়িয়ে ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে দিয়ে ছাদের কার্ণিশে আহির পাশে অতি নিকটে গিয়ে দাঁড়ালো। এক হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিয়ে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বললো,

-‘ ভালোবাসি তোমায় প্রিয়তমা। ‘

হ্যাভেনের দিকে ঘুরে দু’পায়ের গোড়ালি উঁচু করে দুহাতে হ্যাভেনের গলা জরিয় ধরলো আহি৷ কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

-‘ ভালোবাসি প্রিয়। ‘

রাতের আকাশে চাঁদের পাশে অগণিত তাঁরাদের মেলা বসেছে। সেদিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই এক হাতে আহির কোমড় জড়িয়ে আরেক হাতে আহির চুলগুলো কানের পিছ দিয়ে ঘাড়ে চেপে ধরলো। দৃষ্টি নত রেখে মৃদু স্বরে আহি বললো,

-‘ এবার নিচে চলুন ‘।

আহির দিকে তাকিয়ে কুটিল হাসলো হ্যাভেন বললো,

-‘ অবশ্যই যাবো সুন্দরী… তার আগে তোমার কোমল ওষ্ঠজোড়া আমার ভালোবাসায় সিক্ত করতে চাই। ‘

লজ্জায় যেনো এবার মরণই হয় আহির। হ্যাভেন তার লাজুকতা দেখে যেনো খুব উৎসাহ পেলো আরো দ্বিগুণ লজ্জা দেওয়ার। তাই আচমকাই তার ওষ্ঠ চুমোয় লিপ্ত হয়ে পড়লো।
.
রাত প্রায় এগারোটা বাজতে চললো। সকলেই রাতের খাবার খেয়ে উপরে চলে গেছে। বাকি রয়েছে আহি আর রুবিনা। রুবিনার সঙ্গে একসাথে খাবার সেড়ে। বিয়ের ব্যাপারে টুকটাক কথা বললো আহি। যদিও রুবিনা প্রশ্ন করেছে আহি শুধু উত্তর দিয়েছে। তবে তার ভীষণ লজ্জা করছিলো। বিয়ের এতোদিন পর আবার বিয়ে। ভাবতেই কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে। হ্যাভেন সবটা সামলে নেবে বলেছে। অলরেডি সব ম্যানেজ করাও শেষ তবুও আহির কেমন কেমন লাগছে। আবার মনে মনে ভীষণ ভালো লাগাও কাজ করছে। সকল দুঃস্বপ্ন গুলো যেনো এবার সুস্বপ্নে পরিণত হতে যাচ্ছে।
.
খাওয়া শেষে সব কিছু গুছিয়ে হ্যাভেনের জন্য এক বাটি পায়েস নিয়ে উপরে চলে গেলো আহি। হ্যাভেন মনের সুখে রুমজুরে পায়চারি করছে। আহি রুমে যেতেই দু’বার ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

-‘ এতো লেট কেন হুম? ‘

-‘ মায়ের সঙ্গে জরুরী কথা বললাম। ‘ বলতে বলতেই পায়েসের বাটিটা হ্যাভেন’কে ধরিয়ে দিয়ে বিছানা ঠিক করতে লাগলো আহি। কয়েক চামচ পায়েস মুখে দিয়েই সেন্টার টেবিলে বাটিটা রেখে আহির বাহু ধরে টেনে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে বললো,

-‘জাষ্ট টেন মিনিটস এর মধ্যে জাষ্ট শাড়িটা চেঞ্জ করে আসবে। ‘

-‘ মানে। ‘

-‘ ইয়েস লং ড্রাইভে যাবো। রাতের ঢাকা শহর ঘুরবো আজ দু’জন মিলে। ‘

-‘ পাগল আপনি! আপনি বউ নিয়ে রাত বিরাতে লং ড্রাইভে যাবেন? এও সম্ভব? দেখা যাবে আপনার কোন শুভাকাঙ্ক্ষী শ্যুট করে আপনাকে মেরে দিয়ে আমাকে নিয়ে ভেগে যাবে। ‘

রাগান্বিত হয়ে আহির কাঁধ চেপে ধরলো হ্যাভেন। বললো,

-‘যা বলেছি তাই করো। এ পৃথিবীতে কারো বাপের সাহস নেই যে আমার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি’তে তোমায় স্পর্শ করবে। ভেগে যাওয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার। ‘

-‘ বাপের নেই ছেলের থাকতেও পারে। ‘ বলেই চোখ মারলো আহি।

চোখ দু’টো ছোট করে দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হাতে আহির কোমড় চেপে ধরলো হ্যাভেন। বললো,

-‘ মুডটা আমার ভীষণ ভালো সুন্দরী এভাবে ক্ষেপিয়ো না। ক্যালেংকারী ঘটে যাবে। ‘

এক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে আহি বললো,

-‘ ওকে ওকে, কুল কুল, আমি রেডি হয়ে আসছি। ‘
.
সামনে একটি কার পিছনে একটি কার। মাঝখানে রয়েছে সাদা রঙের প্রাইভেট কার। তার ভিতরে ড্রাইভিং সিটে রয়েছে হ্যাভেন পাশের সিটে রয়েছে আহি। ঘরের বাইরে একান্ত সময় কাটাতে ইচ্ছে করলেও যেনো হয়ে ওঠে না হ্যাভেনের। তবুও আজ আহি’কে নিয়ে বেরোতে ইচ্ছে করলো। তাই সামনে পিছনে সিকিউরিটি রেখেই লং ড্রাইভে বের হলো তারা। বেশ অনেকটা পথ যাওয়ার পর হ্যাভেন বললো,

-‘ আহি… আজকের এই রাতটি আমাদের জন্য খুবই স্পেশাল। এমন একটি স্পেশাল মূহুর্তে তোমার মুগ্ধকর সে কন্ঠে একটি গান শুনতে চাই আমি। ‘

লজ্জায় মাথা মিচু করে ফেললো আহি। বললো,

-‘ আমাকে হয়তো ব্যাগডেটেড ভাবতে পারেন। আমি আধুনিক গান পছন্দও করিনা গাইতেও পারিনা৷ সত্যি বলতে আমার আগ্রহ আসেনা৷ আমি পুরোনো দিনের গানই শুনি এবং মাঝেসাঝে সেগুলাই গাই। আপনার পছন্দ নাও হতে পারে। ‘

ড্রাইভ করার পাশাপাশি আড়চোখে আহির দিকে তাকালো হ্যাভেন বললো,

-‘ আমি অনেক কিছুই ভাববো সো এবার তুমি গাইতে শুরু করো। কেউ নেই এখানে শুধু তুমি আর আমি। আমি আর তুমি। দু’দিন পর আমাদের মাঝে কাউকে আনার জন্য প্রিপারেশন চলবে ইনশাআল্লাহ। আপাতত আমায়ই শোনাও। ফিউচারে সে আর আমায় শুনিও। ‘

হ্যাভেনের দিকে খানিকটা ঘেষে বসলো আহি। হ্যাভেনের কাঁধে মাথা রেখে অনেকটা সময় প্রশান্তির শ্বাস নিলো। তারপর মাথা তুলে হ্যাভেনের গালে টোপ করে চুমু খেলো। অতঃপর গাইতে শুরু করলো,

আমার মনের এই অঙ্গনে
সুখের ফাগুন এলো বুঝি,,
আমার মনের এই অঙ্গনে
সুখের ফাগুন এলো বুঝি,,

এই হঠাৎ পাওয়া দিনগুলো কি
সারাটা দিন খুঁজি
সুখের ফাগুন এল বুঝি,,
আমার মনের এই অঙ্গনে
সুখের ফাগুন এলো বুঝি,,

সে ছিল আর আমি ছিলাম
আর ছিল লাজ
সে ছিল আর আমি ছিলাম
আর ছিল লাজ
সেই স্ব-লাজের কৃষ্ণচূড়ায়
খোঁপায় দিলাম আজ
আমার স্বপ্ন পাখি চোখের পাতায়
বসল সোজাসুজি
সুখের ফাগুন এলো বুঝি
আমার মনের এই অঙ্গনে
সুখের ফাগুন এলো বুঝি
মন ভাবে আর আমি ভাবি
আর ভাবে প্রান
মন ভাবে আর আমি ভাবি
আর ভাবে প্রান
সেই ভাবনায় মুখের কথায়
যায় যে হয়ে গান
আজ সেই গানেরই
মালায় আমি অভিসারে সাজি
সুখের ফাগুন এলো বুঝি
আমার মনের এই অঙ্গনে
সুখের ফাগুন এলো বুঝি
সে আছে আর আমি আছি
আর আছে সাধ
সে আছে আর আমি আছি
আর আছে সাধ
সেই সাধ আমার পূর্নিমারই
দিনে দেখা চাঁদ
আমায় গরবিনী বল যদি
মানতে এখন রাজি
সুখের ফাগুন এলো বুঝি
আমার মনের এই অঙ্গনে
সুখের ফাগুন এলো বুঝি
এই হঠাৎ পাওয়া দিনগুলো কি
সারাটা দিন খুঁজি
সুখের ফাগুন এল বুঝি
আমার মনের এই অঙ্গনে
সুখের ফাগুন এলো বুঝি
আমার মনের এই অঙ্গনে
সুখের ফাগুন এলো বুঝি

সমাপ্ত❤
প্রিয় পাঠকবর্গ আপনাদের সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ এবং ভালোবাসা রইলো। প্রায় চারমাস হয়ে এলো আপনারা ওহে প্রিয়র সঙ্গে রয়েছেন আমার পাশে রয়েছেন যার জন্য আপনাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। আশা করি ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখে ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন। আমি শুধরে নেবো। গল্প লিখাটা আমার পেশা নয়। শখের বসে লিখি।
আমি জানি আপনারা আমার লেখায় অপরিপক্কতা খুঁজে পেয়েছেন। যার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখীত আমি। ওহে প্রিয় লিখে আমি সকলের ভালোবাসা এবং প্রশংসার পাশাপাশি অনেকের তিক্ত বুলিও শুনেছি৷ কখনো এমন হয়েছে খুব জঘন্য ভাবে অপমান করা হয়েছে। তবুও প্রত্যেককে আমি সম্মান জানাই৷ আর সকলেরই এই কথাটি জেনে রাখা উচিত এই উপন্যাসটি কাল্পনিক । যদি বাস্তবভিত্তিক হতো অবশ্যই আমি সকলকে এ বিষয়ে অবগত করতাম। কোন এক সময় পাঠকরা রিকোয়েস্ট করেছিলো। আমার লেখায় একটি হিরোকে তারা সাইকো রূপে দেখতে চায়৷ তাদের রিকোয়েস্ট মাথায় রেখেই হ্যাভেনকে লিখেছি৷ মূলত আহি বা হ্যাভেনকে নিয়ে লিখার আগ্রহ ছিলোনা। আমি সবা এবং নির্মল নিয়েই লিখবো বলে ঠিক করেছিলাম। তারপর ভাবলাম এটাতে হয়তো পাঠকরা শুধু দুঃখই পাবে। তাই দুঃখের পর যেনো তারা একটুখানি হাসতে পারে সেজন্যই হ্যাভেন, আহির আগমন। তো প্রিয়রা… গল্প বিষয়ে মনের অন্তস্থল থেকে অনুভূতি জানাতে ভুলবেন না৷

#আমি কিন্তু পারতাম সেকেন্ড টাইম বিয়ের উল্লেখ করে বেবি নিয়ে কিছু লিখে সমাপ্তি দিতে। বড়োজোর ৫০০ওয়ার্ড বেশী লিখতে হতো। কিন্তু সব গল্পের সমাপ্তি এক ধাচের হতে হবে এমন তো কথা নেই। উপন্যাসের অন্তিম পর্বে উল্লেখ রয়েছে, হ্যাভেনও বলেছে নেক্সট কি হবে বা কি করবে। বাকিটা পাঠকরাই কল্পনা করে নিক। উপন্যাস পড়ে পাঠক তৃপ্তি বা অতৃপ্তি পাক দু’টোই কিন্তু সার্থকতা। এই যেমন অনেকের মনে কৌতুহল জাগছে তারপর কি হলো? সেকেন্ড টাইম ওদের সুখময় জীবনটি কেমন হবে? সেকেন্ড টাইম আহির প্র্যাগ্নেস্নির খবর পেলে হ্যাভেন কতোটা উচ্ছ্বসিত হবে? এ প্রশ্ন গুলো যদি পাঠকদের মনে আসে তবেই আমি সার্থক। ওহে প্রিয় উপন্যাস’টি সার্থক।
যাইহোক,সবাইকে ধন্যবাদ।