ঔজ্জ্বল্যের আলোক প্রহর পর্ব-০১

0
1

#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
#সূচনাপর্ব

“তুমি যদি এবর্শন করিয়েছো তাবে তোমাকে কীভাবে ধ্বংস করতে হয় সেটা আমি দেখবো। খবরদার আমার নাতিকে খুন করার চিন্তাভাবনা করেছো তো!”

ফোনের ওপাশ থেকে উত্তেজিত কন্ঠের হুমকি ভেসে এলো।

জ্যোতি চোয়াল শক্ত করে কঠোরভাবে বললো,

“কী করবেন আমাকে? খুন করবেন? তবে তাই করুন পারলে! আপনাদের মতো খুনে পরিবার খুন খারাবি ছাড়া আর কী পারে?”

“জিভ টেনে ছিড়ে ফেলবো বেয়াদব! বাচ্চা হোক, তারপর তোমার যা খুশি করো, তালাক নেও, অন্য বিয়ে করো আমাদের কিচ্ছু যায় আসে না। আমরা আমাদের নাতিকে চাই, ব্যস! আমার খানদানের রক্ত ঝরালে এর পরিণাম খুব খারাপ হবে!”

“আহ্হারে! মুড়ির মোয়া তাই না? নয়মাস গর্ভে ধরবো আমি, প্রসব যন্ত্রণা ভোগ করবো আমি, শরীরের যন্ত্রণা তো আছেই, আর শেষে বাচ্চা হলে কাঠের পুতুলের মতো বাচ্চাটাকে আপনাদের হাতে তুলে দিবো, তাই না?
আমার গর্ভকে কি আপনার ভাড়ায় দেওয়া মনে হচ্ছে? খাটাশ মহিলা!”

জ্যোতি ঠাস করে ফোন কেটে দিলো। রাগে শরীর কাঁপছে তার। পাশেই তার মা রত্মা উৎকন্ঠা নিয়ে বসে আছেন।

“কী? কী বলেছে রে?”

“তারা বাচ্চা চাইছে! বাকিসব যাক জাহান্নামে, তাদের কিচ্ছু যায় আসে না!”

ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বললো জ্যোতি।

পরক্ষণেই আবার বলে,

“নয়মাস আমাকে পেটে ধরতে বলছে তারা, বাচ্চা হলে সাথে সাথে নিয়ে নিবে আমার কোল ফাঁকা করে। তাহলে এই বাচ্চাটা আমি কেনো রাখবো, বলতে পারো? আমার কোল তো সেই শূন্যই থাকবে! আমি না পেলে তাদের কেনো পেতে দিবো? আমি কোনো দাতা হাতেমতাঈ নই!”

কাপতে কাঁপতে কথাকটি বললো সে। রত্মা দ্রুত মেয়েকে বাহুদ্বয় দিয়ে আবদ্ধ করে শান্ত করার চেষ্টা করে।

জ্যোতি এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে,

“আম্মা, আমার সাথে এমন কেনো হলো বলতে পারো? কোন বুঝে আমাকে ওই পরিবারের বউ করে পাঠালে বলো তো? আমি আমার জীবনের বোঝা বইতে পারছি না আর! শেষমেশ যখন মুক্তি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, তখনই আমাকে কয়েদ করার জন্য আমার গর্ভে ওদের বংশধর এলো! আমার সাথেই কেনো এমন হচ্ছে আম্মা?”

রত্মা নিজের কান্না আটকে বললো,

“ধৈর্য ধর মা। সব ঠিক হয়ে যাবে।”

জ্যোতি চোখ মুছে দৃঢ় কন্ঠে বলে,

“আম্মা, এই বাচ্চাটা আমি রাখবো না! ওই খানদানের সাথে আমি সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলতে চাই চিরতরে। কোনো পিছুটান আমি রাখবো না ওদের জন্য! কখনোই না!”

রত্মা হুহু করে কেঁদে ফেলে। তার ভীষণ আদরের জ্যোতি। কত মানতের পর পেয়েছেন তিনি মেয়েটাকে। তাই সন্তানের মর্ম তিনি বুঝেন। কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“মারে, এমন করিস না! ছোট নাজুক প্রাণ! এভাবে শেষ করে দিস না! কতজনে চেয়েও পায় না, আর আল্লাহ তোকে না চাইতেই দিয়েছে। পায়ে ঠেলিস না এই উপহারকে!”

জ্যোতির বুক ধ্বক করে উঠলো। কথাগুলো নিতে পারলো না। হঠাৎই বমি ঠেলে এলো ভিতর থেকে। ছুটে বাথরুমে গিয়ে হড়বড় করে বমি করে ফেললো।

___________°__________

“বেশি বাড় বেড়েছো তাই না? ফোন ধরো না, কত বড় সাহস!”

“আপনি আমার এমন কেউ হোন না যার ফোন ধরতে আমি বাধ্য!”

জ্যোতিই সমান তেজে জবাব দিলো।

শাহরিয়ার দাত কিড়মিড় করে বললো,

“নেহাৎ আমার বাচ্চা তোমার গর্ভে বড় হচ্ছে, তাই তোমার সকল দৌরাত্ম্য হজম করে নিচ্ছি। নয়ত…..”

“নয়তো কী? গায়েব করে দিতেন ক্ষমতা ব্যবহার করে? স্বার্থপর উগ্র দানব কোথাকার!”

“দানবীয় কোনো কিছু তো এখনও দেখলেই না, দোয়া করো যেন কখনো না-ই দেখতে পাও! তোমার সাথে এতো কথার রুচি নেই আমার। আমার বাচ্চার গায়ে যেন একটু আঁচড়ও না লাগে। আমার বাচ্চার গায়ে একটা টোকা পড়লে তোমার খানদান নিশ্চিহ্ন করে দিবো আমি!”

বলেই জ্যোতিকে কিছু বলার অবকাশ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো শাহরিয়ার।

শাহরিয়ার শাহবাজ। প্রতাপশালী শাহবাজ বংশের ছেলে।
মেহেরপুরের সবচেয়ে প্রতাপশালী এই শাহবাজ পরিবার। তাদের প্রতিপত্তি মেহেরপুরে বহু বছর ধরে চলে আসছে। ভীষণ দৌরাত্ম্যময় এবং দাপুটে এক পরিবার। এলাকায় তাদের সমর্থকও দেখার মতো।

জ্যোতির পরিবার মধ্যবিত্ত। জ্যোতি বাবা মায়ের অনেক প্রতীক্ষিত একমাত্র সন্তান। সুন্দরী, মার্জিত এবং আভিজাত্যপূর্ণ এক নারী। গুণেও জুরি মেলা ভার।
এইসব বৈশিষ্ট্যের কারণেই মাধ্যমিক পার না হতেই সমন্ধ আসতো বাড়িতে।
ঠিক তেমনিভাবে শাহবাজ পরিবারের চোখে পড়ে গিয়েছিলো জ্যোতি।

বাবা মা প্রথমে দিতে চাননি এই পরিবারে। কিন্তু বংশের বাকি আত্মীয়দের লাগাতার প্ররোচনায় তারাও রাজি হয়ে গিয়েছিলেন একপর্যায়ে। সবার ভাষ্যমতে এর থেকে ভালো সম্বন্ধ জ্যোতির জন্য আর আসবে না। শাহবাজ পরিবারের একমাত্র বউ হবে সে, রাজ করবে সেখানে।

অথচ বিষয়টা হলো উল্টো। বিয়ের পরপরই শশুর বাড়ির সকলের শীতল ব্যবহারে জ্যোতির দমবন্ধ অবস্থা প্রায়। সম্বন্ধ যখন এসেছিলো তখন জ্যোতি আর তার বাবা মা বেশ চিন্তিত হয়েছিলো এই ভেবে, এত বড় খানদানি পরিবার মধ্যবিত্ত ঘরের জ্যোতির মতো বউ কেনো চায়? আত্মীয় স্বজনদের কথা ছিলো তারা নিশ্চয়ই ঘরোয়া এক মেয়ে চায়, জ্যোতির মতো মেয়ে এই তল্লাটে আর আছে নাকি?
কিন্তু বিয়ের পরে জ্যোতি বুঝতে পারলো তারা কেনো জ্যোতির মতো সাধারণ ঘরের এক মেয়েকে এনেছে বউ করে। যাকে মারলে, কুটলেও সব নীরবে হজম করে যাবে, মুখ উঁচিয়ে এতটুকু প্রতিবাদ করার সাহস পাবে না, বরংচ নিজের হাতের পুতুলের মতো নাচানো যাবে।
হয়েছেও তাই। প্রথম প্রথম জ্যোতি হজম করলেও একটা সময় আর পারলো না। না হোক সে বড়লোকের মেয়ে, কিন্তু আত্মসম্মান তো তার ঠুনকো নয়! প্রতিবাদ করা শুরু করলে বিষয়টা আরো খারাপ হয়। বিয়ের দুতিনদিন পর থেকেই শাহরিয়ার উঁচু গলায় জ্যোতির সাথে কথা বলতো, কেমন যেন ধমক দিয়ে৷ বাড়ির বাকিদের ব্যবহারও ছিলো তাচ্ছিল্যপূর্ণ।
এক মাসের মধ্যেই শাহরিয়ার জ্যোতির গায়ে হাত তুললো। জ্যোতিও ক্ষেপা বাঘিনীর মতো প্রতিবাদ জানালো। তারপরের দিনগুলো জ্যোতি আর মনে করতে চায় না। দুর্বিষহ জীবন ছিলো তার।

শাহবাজ পরিবারে জ্যোতি বধূ হয়ে গিয়েছিলো পাঁচমাস পূর্বে। এর বেশি সে ধৈর্য রাখতে পারেনি। মনে মনে যখন সিন্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলো খুল্লা তালাক নিবে তখনই জ্যোতির শাশুড়ী ফারিয়া তার শারীরিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে সন্দেহ করে বসেন জ্যোতিকে, তারপর এক প্রকার জোর করে ডাক্তার দেখিয়ে আসেন।
যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই হলো। জ্যোতি দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা।
প্রেগ্ন্যাসির শুরুটায় বুঝতে পারেনি জ্যোতি। এমনিতেই তার মাসিক অনিয়মিত ছিলো। অন্যান্য লক্ষণও খুব একটা স্পষ্ট ছিলো না।
খবরটা বজ্রাঘাতের মতোই জ্যোতির উপর আঘাত হানলো। কিন্তু ততক্ষণে খবর চাউর হয়ে গিয়েছে পুরো খানদানে। খুশির জোয়ারে তখন সবাই মাতোয়ারা। যেখানে জ্যোতি মুক্তি নিতে বদ্ধপরিকর, সেখানে নতুন বন্দীত্বের বেড়ি তার পায়ে আটকে গেলো শক্তপোক্তভাবে।
এমনটা তো জ্যোতি চায়নি! দুশ্চিন্তায় নতুন মাতৃত্বের অনুভূতিটুকু অনুভব করার অবকাশটুকু সে পেলো না! নিজের বাবার বাসায় কয়েকদিনের জন্য যাবার নাম করে নিজের অল্পকিছু জিনিসপত্র নিয়ে একেবারে চলে এসেছে। এরমধ্যে মৌলভী সাহেবের কাছে জেনেছে বাচ্চা না হওয়া পর্যন্ত তালাক নেওয়া যাবে না। দুঃখ চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করেছে তার।
এরপরই রাগের বশে ফোন করে শাহরিয়ারকে জানিয়ে দিয়েছে নিজের সিদ্ধান্ত। তখন থেকে একপ্রকার হুমকি ধামকি চলছে। জ্যোতিও সমান তেজে জবাব দিয়েছে বাচ্চা সে রাখবে না। এরপর শাশুড়ীও ফোন করে যত প্রকার হুমকি দেওয়া যায় দিয়েছেন।

__________°__________

“ড্রাইভার পাঠিয়ে দিয়েছি, ওকে কোনো হম্বিতম্বি না করে চুপচাপ চলে আসতে বলো। ওর নাটক দেখার সময় আমাদের নেই।”

রাগতস্বরে কথাগুলো বললেন ফারিয়া।
রত্না দুশ্চিন্তায় জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললেন,

“আপা, ও ছোট মানুষ। ও নাহয় অবুঝ। আপনারা তো বুঝের, নাকি? ওর কথা এতো আমলে নেওয়ার কিছু আছে?”

“না না রত্মা, তোমার মেয়ে অনেক বুঝদার। এজন্যই শশুর বাড়ির কারো পরোয়া করে না। কী ভেবে বউ করে এনেছি, আর কী হচ্ছে! নেহাৎ বংশের উত্তরাধিকারী ওর গর্ভে, নয়তো আমিই কবে ওর আর শাহরিয়ারের তালাক করিয়ে দিতাম।”

রত্মা আমতা আমতা করে বললেন,

“আপা, অন্তঃসত্ত্বা ও। এই সময় মেয়েদের মায়ের কাছেই থাকতে হয়, মায়েদের যত্ন নিতে হয়—”

“কী বলতে চাইছো? আমাদের এখানে যত্ন নেওয়া হবে না ওর? আর কী দিয়ে যত্ন নিবে তোমরা? কী আছে তোমাদের? সেই সামর্থ্য আছে তোমাদের?”

রত্নার মুখে কেউ যেন অপমানের কালি মেখে দিলো। চোখের কোণে পানি জমলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,

“আপা, আমার মেয়েকে যত্ন নেওয়ার সামর্থ্য তার বাবার আছে!”

“সে নেও তোমার মেয়ের যত্ন। মানা করেছি? কিন্তু আমার নাতির যত্ন নেওয়ার সামর্থ্য আছে তোমাদের? আমার নাতির কথাও তো চিন্তা করতে হবে, নাকি?”

“আপনার নাতি, আমারও নাতি আপা। আমার মেয়ের সন্তান, তার অংশ। কী করে ভাবলেন জ্যোতির যত্ন নিলেও তার গর্ভের সন্তানের যত্ন নিবো না? ওকে আমার কাছে রাখছি আপা। ড্রাইভারকে ফোন করে ফিরে যেতে বলুন!”

বলেই তর্ক করার সুযোগ না দিয়ে রত্না ফোন কেটে দিলেন।

রত্মার অন্তরে অশনি সংকেতের প্রবল ঝড় বইছে মেয়েটার কথা চিন্তা করে। কী হবে তার জ্যোতির? এই ঝড় তো তছনছ করে দিবে সবটা!

বেখেয়ালে তার চোখ পড়ে দরজায়। স্নায়ু স্থির হয়ে যায় তার মূহুর্তেই। জ্যোতি দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে ছলছল চোখে……..

#চলবে…….